ফ্রিডম বইটিতে আমি প্রচুর উপাত্ত, লেখা নিয়েছি, মুক্তিযুদ্ধের উপর কিছু অসাধারণ গ্রন্থ থেকে। ওগুলোর মাঝ থেকে, এটা আমার অসম্ভব পছন্দের একটি লেখা। এ লেখাটি আমাকে ভাবায়, আমি যে একটা জানোয়ার এটা বারংবার মনে করিয়ে দেয়! কী অবলীলায় আমরা ভুলে যাই এই বালিকাটির আত্মত্যাগের কথা। কেমন করে বিস্মৃত হই অসমসাহসী ১০ বছরের বালকযোদ্ধা লালুর কথা!
তোতা পাখির মতো ক্রমাগত আউড়ে যাই গুটিকয়েক মানুষের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা।
বিশেষ একটা মাসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাতর হই, মুখে ফেনা তুলে ফেলি। মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে হৃদপিন্ড, অনবরত ধুকধুক করে চলতেই থাকবে। যে দিন আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পুরাপুরি বিস্মৃত হবো, সেই দিন আমরা পরিণত হবো একটা লাশে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা বই লেখা ছিল আমার স্বপ্ন। প্রচলিতভাবে আমি লেখতে চাইনি। আমি চেয়েছি এই প্রজন্মের চোখ দিয়ে দেখতে। কোন উঁচুমাপের লোক এটা পড়লেন, না কোন সাহিত্য সম্পাদক এর আলোচনা করলেন, এতে আমার কিছুই যায় আসে না। আমি তীব্র সুখী হই এ প্রজন্মের একজন পড়লে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খানিকটা আবেক্রান্ত হলে।
প্রবাসী আমার এক বন্ধুর অনুরোধে আমি ফ্রিডম থেকে খানিকটা এখানে তুলে দিচ্ছি:
"…বর্বরতার রেকর্ড (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, অষ্টম খন্ড)
মহাদেবের জটা থেকে নয় বাংলা মায়ের নাড়ী থেকে ছিঁড়ে জন্ম নিয়েছিলেন যে সোনার মেয়ে, সে ভাগীরথীকে ওরা জ্যান্ত জীপে বেঁধে শহরের রাস্তায় টেনে টেনে হত্যা করেছে। খান দস্যুরা হয়তো পরখ করতে চেয়েছিল ওরা কতখানি নৃশংস হতে পারে। বলতে হয় ওরা শুধু সফলই হয়নি, বর্বরতার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
অষ্টাদশী ভাগীরথী ছিল বরিশাল জেলার পিরোজপুর থানার বাঘমারা কদমতলীর এক বিধবা পল্লীবালা। বিয়ের এক বছর পর একটি পুত্র সন্তান কোলে নিয়েই তাকে বরণ করে নিতে হয় সুকঠিন বৈধব্য। স্বামীর বিয়োগ ব্যথা তার তখনও কাটেনি। এরই মধ্যে দেশে নেমে এল ইয়াহিয়ার ঝটিকা বাহিনী। গত মে মাসের এক বিকালে ওরা চড়াও হলো ভাগীরথীদের গ্রামে। হত্যা করলো অনেককে যাকে যেখানে যেভাবে পেলো।
এ নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের মধ্যে ভাগীরথীকে ওরা মারতে পারলোনা। ওর দেহলাবণ্য দস্যুদের মনে যে লালসা জাগিয়েছিল তাতেই হার মানল তাদের রক্ত পিপাসা। ওকে ট্রাকে তুলে নিয়ে এল পিরোজপুরে। তারপর ক্যাম্পে তার উপর চালানো হলো হিংস্র পাশবিক অত্যাচার।
সতী নারী ভাগীরথী। এ পরিস্থিতিতে মৃত্যুকে তিনি একমাত্র পরিত্রাণের উপায় বলে ভাবতে লাগলেন। ভাবতে ভাবতেই এক সময় এল নতুন চিন্তা- হ্যাঁ মৃত্যুই যদি বরণ করতে হয় ওদেরই বা রেহাই দেব কেন? ভাগীরথী কৌশলের আশ্রয় নিল এবার।
এখন আর অবাধ্য মেয়ে নয় দস্তরমত খানদের খুশী করতে শুরু করল, ওদের আস্থা অর্জনের আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগলো। বেশীদিন লাগলোনা, অল্প কদিনেই নারী লোলুপ ইয়াহিয়া বাহিনী ওর প্রতি দারুণ আকর্ষণ অনুভব করল। আর এই সুযোগে ভাগীরথী ওদের কাছে থেকে জেনে নিতে শুরু করল পাক বাহিনীর সব গোপন তথ্য। এক পর্যায়ে বিশ্বাস ভাজন ভাগীরথীকে ওরা নিজের ঘরেও যেতে দিল। আর কোন বাঁধা নেই। ভাগীরথী এখন নিয়মিত সামরিক ক্যাম্পে যায় আবার ফিরে আসে নিজ গ্রামে।
এরই মধ্যে চতুরা ভাগীরথী তাঁর মূল লক্ষ্য অর্জনের পথেও এগিয়ে গেল অনেকখানি। গোপনে মুক্তি বাহিনীর সাথে গড়ে তুলল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এরপরই এল আসল সুযোগ। জুন মাসের একদিন ভাগীরথী খান সেনাদের নিমন্ত্রণ করলো তাঁর নিজ গ্রামে।
এদিকে মুক্তি বাহিনীকেও তৈরী রাখা হলো যথারীতি। ৪৫ জন খান সেনা হাসতে হাসতে বাগমার কদমতলা নিমন্ত্রণ খেতে এসেছিল কিন্তু তার মধ্যে ৪/৫ জন ক্যাম্পে ফিরতে পেরেছে বুলেটের ক্ষত নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে। বাকিরা ভাগীরথীর গ্রামেই শিয়াল কুকুরের খোরাক হয়েছে।
এরপর আর ভাগীরথী ওদের ক্যাম্পে যায়নি। ওরাও বুঝেছে, এটা তারই কীর্তি। পাক আর্মিরা তাই হুকুম দিল জীবিত অথবা মৃত ভাগীরথীকে যে ধরিয়ে দিতে পারবে তাকে নগত এক হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। কিন্ত ভাগীরথী তখনও জানতো না ওর জন্য আরও দুঃসহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। একদিন রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লো ভাগীরথী। তাকে নিয়ে এল পিরোজপুর সামরিক ক্যাম্পে।
খান সেনারা এবার ভাগীরথীর উপর তাদের হিংস্রতার পরীক্ষার আয়োজন করলো। এক হাটবারে তাকে শহরের রাস্তায় এনে দাঁড় করানো হলো জনবহুল চৌমাথায়। সেখানে প্রকাশ্যে তার অঙ্গাবরণ খুলে ফেলল কয়েকজন খান সেনা। তারপর দু’গাছি দড়ি ওর দু’পায়ে বেঁধে একটি জীপে বেঁধে জ্যান্ত শহরের রাস্তায় টেনে বেড়াল ওরা মহাউৎসবে। ঘন্টাখানেক রাজপথ পরিক্রমার পর আবার যখন ফিরে এল সেই চৌমাথায় তখনও ওর দেহে প্রাণের স্পন্দন রয়েছে। এবার তারা দুটি পা দুটি জীপের সাথে বেঁধে নিল এবং জীপ দুটিকে চালিয়ে দিল বিপরীত দিকে। ভাগীরথী দুভাগ হয়ে গেল।
সেই দু-ভাগে দু-জীপে আবার শহর পরিক্রমা শেষ করে জল্লাদ খানরা আবার ফিরে এল সেই চৌমাথায় এবং এখানেই ফেলে রেখে গেল ওর বিকৃত মাংসগুলো। একদিন দু’দিন করে সে মাংসগুলো ঐ রাস্তার মাটির সাথেই একাকার হয়ে গেল এক সময়। বাংলামায়ের ভাগীরথী এমনি ভাবে আবার মিশে গেল বাংলার ধুলিকণার সাথে…।"
*ভাষারীতি অবিকল রাখা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment