লেখালেখির জগতে আমার দেখা অল্প ক’জন অসাধারণ মানুষদের একজন, কাজী আনোয়ার হোসেন। মাসুক নানার(!) সৃষ্টা এ দেশে বইয়ের জগতে বিপ্লব নিয়ে আসা একজন মানুষ!
শেখ আবদুল হাকিমের উপর আমি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। সেই যে বললেন ঢাকা আসলে যোগাযোগ করবেন, অনেক যন্ত্রণা করে একবার ঢাকা গেলাম। গিয়ে শুনলাম, উনি প্রত্যেকদিন অফিসে আসেন না। বারটা ঠিক মনে নাই, সম্ভবত এ রকম ছিল, তিনি শনি এবং মঙ্গলবারে অফিসে বসেন।
আমার খুব অস্থির লাগছিল, মেজাজ খারাপ হচ্ছিল! হায়, আবর্জনা লেখকের মেজাজ, পক্ষীর বিষ্টা! কেন রে বাবা, কোন বারে বসেন, এটা আমাকে আগে বললে আপনি কি ক্রমশ বড়োমাপের মানুষ থেকে ছোটমাপের মানুষের দিকে ধাবিত হতেন?
আমার মতো আবর্জনা লেখকের এইসব রাগ মানায় না, কিন্তু আমরা কি সব সময় মস্তিষ্ক দিয়ে বিচার করি, বিশেষ করে আমার মতো দুর্বল মানুষ! প্রস্থান করার পর আর ওমুখো হইনি! পরে আর এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
কি জানি কেন এটা করেছিলাম, এই স্ক্রিপ্টটাই (কনক পুরুষ) বাই পোস্টে কাজী আনোয়ার হোসেনকে পাঠিয়েছিলাম। ক’দিন পর তিনি আমাকে একটা চিঠি লিখলেন, চিঠিতে তিনি কিছু সদাশয় মন্তব্য করেছিলেন। আমার ধারণা, এমন মন্তব্য তিনি অহরহই করে থাকেন। কিন্তু তখন আমার মনে হয়েছিল, মৃত্যুর পরও এঁরা অমর হয়ে থাকবেন, এ কারণে, এঁরা লেখক বানাবার মেশিন। এঁরা আমাদেরকে স্বপ্ন দেখান, আলোর ভূবনের!
চিঠিতে আরো লেখা ছিল, ঢাকা আসলে দেখা করবেন। আপনার মতো...একজন লেখকের সঙ্গে দেখা হলে সুখি হবো।
হা ঈশ্বর, এও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে, আমার মতো তিন টাকা দামের একজন কলমবাজের জন্যে তিনি কাজকাম ফেলে দেখা করার জন্যে মুখিয়ে আছেন... ওই যে বললাম, এঁরা স্বপ্ন দেখান!
ফোন করলে তিনি বললেন, আপনি কি বিকালে আসতে পারেন, সকালে তো খুব ঝামেলা থাকে, বেশীক্ষণ কথা বলতে পারবো না?
আমি মনে মনে বলি, এটা একটা কথা হলো, বিকাল কেন, রাত বারোটা হলে আমার অসুবিধা কি!
আমি আগেভাগেই পৌঁছে গেলাম, যদি দেরী হয়ে যায়।
অফিসের চৌবাচ্চায় কি-সব মাছ; ধুর ব্যাটা মাছ, তোদের সার্কাস দেখে কে! অফিসে এন্ট্রির ঝামেলা শেষ হলে আমাকে বলা হলো তিনি এখন মেডিটেশন করছেন, নির্দিষ্ট সময়ে দেখা করবেন।
এই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করা খুব জটিল। একজন বডিগার্ডের মতো মানুষ আমাকে তাঁর রুমে এগিয়ে দিয়ে আসলেন। একপাশের পুরোটা দেয়াল জুড়ে বিশাল এক্যুরিয়াম, নাম না জানা সব মাছ, ভদ্রলোকের দেখি মাছের ভারী শখ!
জিন্সের প্যান্টপরা সপ্রতিভ এই মানুষটার যে দিকটা আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছিল, অখ্যাত কুখ্যাত পরের কথা কিন্তু একজন মানুষের সঙ্গে অন্য একজন মানুষের যেমনটা আচরণ হওয়া উচিৎ, তাঁর আচরণে এর একরত্তি কমতি নেই!
এমন একজন লেখক, যার লেখা পড়ে কতো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। কতো দুঃসময়ই না পার করেছি অথচ তিনি আমার মতো আবর্জনা লেখকের সঙ্গে এমন আচরণ করছিলেন যেন উল্টো আমি তাঁকে সাক্ষাত দিয়ে কৃতার্থ করছি! আহারে, লেখা ছাপা না হলেই বা কী আসে যায়!
সবই ঠিক ছিল কিন্তু ফেরার সময় গুলিয়ে ফেললাম কারণ তখন বডিগার্ডের মত কেউ ছিল না। কাজীদার অন্য রুমে ঢুকে পড়ে ওঁদের বিব্রত হওয়ার চেয়ে নিজে বিব্রত হয়েছিলাম বেশী। কী লজ্জা-কী লজ্জা!
* কাজীদা, একজন লেখক বানাবার মেশিন: http://www.ali-mahmed.com/2009/10/blog-post_13.html
7 comments:
'কনক পুরুষ' আউট অভ স্টক, বইটা আবার প্রজাপতি থেকে রিপ্রিন্ট করা যায় না? জানি ওঁদের প্রতি আপনার ক্ষোভ আছে, কিন্তু আপনি কি জানেন কাজীদা কতোবার সেবার বইয়ের আলোচনা বিভাগে পাঠকের চিঠির জবাবে আপনার লেখার ভূয়সি প্রশংসা করেছেন? 'কনক পুরুষ' কাজীদার পছন্দের উপন্যাসগুলোর একটি। সেবা বা প্রজাপতি এখন একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান, শেখ আব্দল হাকিম কিংবা কমর্চারিদের দুর্ব্যবহারের জন্য নিশ্চয়ই কাজীদাকে দায়ী করা যায় না। 'কনক পুরুষ' রিপ্রিন্ট হওয়া অন্তত আমার জন্য জরুরি,কারণ, উপন্যাসের একটি কপি যে ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ডইয়ারে পড়ুয়া অস্থির এক তরুণীকে দিতে হবে, 'কনক পুরুষ'এর জন্মের সময় যে-ছিলো নিতান্তই শিশু আর এখন চাটাগাঁ শহরে বসে মুঠোফোনে আমার জীবনটাকে ভাজাভাজা করে।
এ পোস্টেও বলেছি এবং এখনও বিনয়ের সঙ্গে বলি, আমার দেখা অসাধারণ মানুষদের একজন কাজিদা।
কিন্তু, একটা কিন্তু রয়ে যায়। তাঁর কিছু পলিসি আমার অপছন্দ। এক সময় তিনি অন্য যোগ্য লেখকদের চেয়ে নিজের পরিবারের লেখকদেরকে বেশি প্রাধান্য দেয়া শুরু করেন। আমার ধারণা, তাঁর এই ভাবনা ভুল ছিল। এবং ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে, সেবা বা প্রজাপতির আগের সেই দবদবা নাই। এখানকার অনেক দুর্ধর্ষ লেখকই (যাদের অনেক লেখা পড়ে আমি নিজেও মুগ্ধ হয়েছি- এই মুগ্ধতার রেশ কখনও কেটেছে, কখনও কাটে নি) এখন আর এই প্রকাশনীর সঙ্গে নাই।
আপনি জানতে চেয়েছেন, বইটা আবার প্রজাপতি থেকে রিপ্রিন্ট করা যায় না?
উহুঁ, আমি যে দানশীল ব্যক্তি•••হা হা হা।
প্রসঙ্গ যখন আসলই, তো কাহিনীটা বলি।
অবশ্য এইসব অন্ধকার দিক নিয়ে লেখকরা আলোচনা করতে আগ্রহী হন না। যেহেতু আমি নিজেকে লেখকই বলি না, তাই আমার এতো লাজ নাই।
কনক পুরুষের রয়েলটির টাকার একটা অংশ পাওনা ছিলাম।
আমি এঁদেরকে অনেক অনুরোধ করেছি, কাতর হয়ে বলেছি, টাকাটা মানি অর্ডার বা ডাকে পাঠিয়ে দিতে। এঁদের এক গোঁ, ঢাকা এসে সশরীরে নিয়ে যেতে হবে। আমি যেন চোর-চোট্টা! হায়রে আইন, হায়রে গাইন!
হাহ, আর আমি যেন মিনিস্টার আর কি, যে বিনে পয়সায় ইচ্ছা হলেই ঢাকা চলে যেতে পারি!
তো, পরে আমি তিতিবিরক্ত হয়ে ফোনে বলেছিলাম, যান, টাকা দিতে হবে না, টাকাটা আপনাদেরকে দান দিয়ে দিলাম।
আসলে আমাদের দেশে লেখকদের চে অভাগা আর কেউ নাই। ভাবখানা এমন, এরা অন্য গ্রহ থেকে আসবেন, লেখালেখি করে দেশ উদ্ধার করবেন।
এদের টাকা-পয়সার কোন সমস্যা থাকে না- থাকতে নাই।
ভাল কথা, আমার কাছে সবেমাত্র একটাই কপি আছে। আপনি চাইলে ফটোকপি করে দিতে পারি।
সেকেন্ডইয়ারে পড়ুয়া অস্থির এক তরুণীকে...আমার পক্ষ থেকে দেবেন অশেষ শুভেচ্ছা।
আরেকটা কথা, অনির্বাণ-এ মন্তব্য করতে চেয়েছিলাম। রেজিস্ট্রেশন হয়নি- কি সমস্যা জানি না।
তো, মন্তব্যটা এখানেই দিয়ে দিচ্ছিঃ
বুকের ভেতর অন্য রকম কষ্ট...
ভাইরে, কবিতা ভাল বুঝি না।
আমার কিছু কিছু কবিতা অজ্ঞাত লিখে লেখায় ঢুকিয়ে দেই। কারও মন্দ লাগলে উদাস হয়ে বলি, কি জানি কার কবিতা। আর কোন বিচিত্র কারণে কারও ভাল লাগলে সলাজে বলি, ওহ, এইটা লিখেছিলুম বটি আমি। হা হা হা।
মানিঅর্ডার বা ডাকে পাঠানো টাকা 'গাপ' হয়ে যায় বলেই হয়তো তাঁরা হাতেহাতে দিতে চান। আর পরিবারতন্ত্রের কথা কী বলবো?ওটাতো আমাদের কমন রোগ।যাই হোক, 'জাগৃতি' থেকে রিপ্রিন্ট করা যায় কিনা দেখুন। আর ফটোকপি পাঠানোর প্রয়োজন নেই, ধন্যবাদ;পুরনো কপিটা এখনো অক্ষত অবস্থায় আমাদের বাড়ির লাইব্রেরিতে আছে।
একবার সেবায় গিয়ে আচমকা কাজীদা'র সাথে দেখা হয়ে যায় ফেরার সময়...সে-ই প্রথম। আমি সালাম দেয়ার জন্যে হাত তোলার আগেই উনি আমাকে সালাম দিয়ে বসলেন। লজ্জায় মরি, আর কী!
কাজীদা, আমার দেখা অসাধারণ একজন মানুষ! লেখক বানাবার আস্ত এক মেশিন! @Duke John
Post a Comment