কিন্তু হাইকোর্ট এও বলছেন, 'এই আদেশ দেয়ার ক্ষমতা ওই জজের নাই'। পরে ওই ওই জজ সাহেব স্বীকার করেছেন, এই রায় দেয়ার এখতিয়ার তার নাই, এটা তার জানা ছিল না। (প্রথম আলো: ০১.০৭.০৮)
ছোট্ট সমস্যা দেখা দিয়েছে, ফাঁসির দন্ড পাওয়া আসামী হাহাকার করা একটা প্রশ্ন করেছেন, সাড়ে চার বছর ফাসিঁর প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেছি, কে ফিরিয়ে দেবে আমার এই সাড়ে চার বছর?
পাগল! ফিরিয়ে দেয়ার কথা আসছে কোত্থেকে এখানে? জজ সাহেব যেখানে বলছেন এটা উনার জানা ছিল না এরপর এই প্রশ্ন করা বাতুলতা মাত্র!
বাস্তবতা হচ্ছে, এই ৩ জনের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল যে মানুষটাকে এসিডে চুবিয়ে মারা জন্য ওই মানুষটার ফরেনসিক রিপোর্টে বলা হয়, মৃতের শরীরে এক ফোঁটা এসিডের চিহ্নও ছিল না। অন্য রিপোর্টে জানা যায়, মানুষটাকে জনতা পিটিয়ে মেরেছিল এক মহিলাকে বিবস্ত্র করার জন্য। কোর্টেও এই রিপোর্টগুলোও দেয়া হয়েছিল, জজ সাহেবের এখতিয়ার নাই এটাও বলা হয়েছিল, তারপরও এই ফাসিঁর আদেশ। এবং এই মামলায় রাজনৈতিক চাপ ছিল বলে জানা যায়।
কী আর করা, জজ বলে কথা! জজ সাহেবদের নিয়ে কথা বলে এমন সাহস কার?
হুমায়ূন আহমেদ এক লেখায় জজদের নিয়ে লিখে কঠিন বিপদে পড়েছিলেন।
‘দরজার এপাশে’ উপন্যাসে একটা সংলাপ ছিল এমন, ‘…আগে জাজ সাহেবরা টাকা খেতেন না। এখন খায়। অনেক জাজ দেখেছি কাতলা মাছের মত হা করে থাকে’।
ব্যস, তুমুল প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। এ নিয়ে ক’জন বিচারপতি হুমায়ূন আহমেদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করেন হাইকোর্টে। ৪৮ জন বিচারপতি একাট্টা হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন এই লেখকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমার খুব অবাক লেগেছিল আমাদের তাবড়-তাবড় লেখকরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলমের কালি খরচ করতে তকলিফ করেননি। কেবল আসাদুজ্জামান নূর এই লেখকের পক্ষে কলম তুলে নিয়েছিলেন অথচ তিনি কলমবাজি করেন না।
হুমায়ূন আহমেদকে বলা হয়েছিল ক্ষমা চাইলে বিষয়টা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু তিনি অনড়, তিনি ক্ষমা চাইবেন না। তাঁর মতে, তিনি কোন অন্যায় করেননি।
হুমায়ূন আহমেদের এই সাহস আমাকে মুগ্ধ করেছিল। কেবল হ্যাটস অফ বলে তেলিবেলি আমি ক্ষান্ত হলে বেঁচে যেতাম কিন্তু আমার ৩ টাকা দামের কলম বড় যন্ত্রণা করছিল, শ্লা কলম!
যে পত্রিকায় টানা দেড় বছর লিখছিলাম ওই পত্রিকায় এই প্রসঙ্গে যে লেখাটা দিয়েছিলাম, ছাপা হয়নি। লেখাটা পাতে দেয়ার মত না এটা বললে সমস্যা ছিল না কিন্তু আমাকে বলা হয়েছিল বিষয়টা সংবেদনশীল তাই ঘাঁটাঘাঁটি না করাই উত্তম।
আচ্ছা, সংবেদনশীলের মানে কী? গু টাইপের কিছু , যে এটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা যাবে না?
পরে ‘একালের প্রলাপ’ বইয়ে ছাগলা দাড়ি- হুমায়ূন আহমেদ নামে ছাপা হলো। ভাগ্যিস, প্রকাশক লেখাটা নিয়ে আপত্তি উঠাননি। দুগগা-দুগগা!
ওই লেখাটা সংক্ষেপিত করে এখানে দিচ্ছি:
" ছাগলা দাড়ি- হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ুন আহমেদ লিখেছেন আজকালকার জজ সাহেবরা টাকা খান। তিনি তো আর এটা বলেননি ওই বিচারালয়ের অমুক মাননীয় জজ সাহেব টাকা খান। আমাদের এ নাট্যমঞ্চে বিচারক এক অন্যরকম স্রষ্টা- তাঁর কলমের খোঁচায় অন্ধকার হঠে উঠে আসে আলো। কিন্তু বিচারক তো আর ঐশ্বরীক কিছু না- তিনি প্রথমে মানুষ এরপর বিচারক। সমাজে থেকে কেউ সমাজ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন না। পার্থক্যটা হলো অনুপাতের। বিচারকরা দুর্নীতি করছেন এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। সমপ্রতি প্রকাশিত হয়েছে, দুর্নীতির দায়ে তিনজন বিচারক সাময়িকভাবে বরখাস্ত। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের এক আদেশবলে এসব অভিযুক্ত জজদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন মহিলা বিচারকও আছেন।হুমায়ুন আহমেদের পূর্বে অসংখ্য লেখক বিচারকদের নিয়ে লিখেছেন।
রবিঠাকুর ‘বিচারক’ গল্পে লিখেছেন:
"জজ মোহিত মহন দত্ত স্ট্যাট্যুটরি সিভিলিয়ান। তাঁহার কঠিন বিচারে ক্ষীরোদার ফাঁসির হুকুম হইল। হতভাগিনীর অবস্থা বিবেচনা করিয়া উকিলগন তাহাকে বাঁচাইবার জন্য বিস্তর চেষ্টা করিলেন কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইলেন না। জজ তাহাকে তিলমাত্র দয়ার পাত্রী বলিয়া মনে করিতে পারিলেন না। না পারিবার কারণ আছে। একদিকে তিনি হিন্দু মহিলাগনকে দেবী আখ্যা দিয়া থাকেন। অপরদিকে স্ত্রীজাতির প্রতি তাঁহার আন্তরিক অবিশ্বাস । …মোহিত যখন কালেজে পড়িতেন তখন বেশভূষায় বিশেষ মনোযোগ ছিল, মদ্যমাংসে অরুচি ছিল না এবং আনুষাঙ্গিক আরও দু একটা উপসর্গ ছিল"।
‘বিচারক’ গল্পের মূলভাব হলো এরকম যে ক্ষীরোদা আজবাদে কাল ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলবে সে চব্বিশ বছর পূর্বে বিধবা বালিকা ‘হেম’ ছিল। ‘বিনোদচন্দ্র’ ছদ্দনামে এক যুবকের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে বালিকা ‘হেম’ এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল, ‘ বিনোদচন্দ্র’ যথানিয়মে একসময় বালিকার হাত ছেড়ে দেয়। বিশাল, নির্দয় পৃথিবীতে এই নি:সঙ্গ বালিকা কালে-কালে হল পতিতা ‘ক্ষীরোদা’। দুঃখ-কষ্ট, অভিমান, ক্ষুধায় একসময় গতযৌবনা ক্ষীরোদা তার শিশু সন্তানসহ কূপের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিশুটি মারা যায়- ক্ষীরোদা প্রাণে বেঁচে গেলেও আইনের হাত থেকে বাঁচতে পারে না। শুরু হয় তার বিচার। যে জজ মোহিত মহন দত্ত এ পতিতাকে ফাঁসীর আদেশ দেন তিনিই ‘বিনোদচন্দ্র’ ছদ্দনামের সেই যুবক।
চালর্স ডিকেন্স ‘অলিভার টুইস্ট’-এ বিচারক সম্বন্ধে লিখেছেন, "মাননীয় বিচারক মি. ফ্যাঙ অত্যন্ত কৃশকায়- গরম মেজাজের লোক। ইনি অশক্ত শরীরে যতোটুকু সহ্য হয় এরচে’ বেশি মদ্যপান করেন। ফল যা হবার তাই হয়- সর্বদা মেজাজ টং হয়ে থাকে। তাছাড়া কদিন পূর্বে একটি দৈনিক পত্রিকায় তার লেখা মামলার এক রায়-এর কঠোর সমালোচনা বেরিয়েছে। পত্রিকাটি লিখেছে, এ পর্যন্ত তিনশোবার বিচারক ফ্যাঙের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করা হয়েছে…"।
‘দরজার ওপাশে’ একটি চরিত্র ফুফা, মাতাল অবস্থায় বলেন, "ওটা ছিল অভিনয়। আমি তোমাদের আসাদুজ্জামান নূরের চেয়ে ... ওই ছাগলা দাড়িকে ... হা-হা- হা"।
‘দরজার ওপাশে’ উপন্যাসে লেখক হুমায়ুন আহমেদ প্রস্তাবনায় লিখেছেন: যদিও আমি খুব গুরুত্বের সঙ্গে লেখাটি লিখেছি তবু বিনীত অনুরোধ করছি কেউ যেন গুরুত্বের সঙ্গে লেখাটি গ্রহণ না করেন।
প্রস্তাবনা অংশে বিনীত অনুরোধ করলেই লেখাটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে না এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই।
মদমত্ত অবস্থায় এলোমেলো কথাবার্তা, আচরণ করা হবে এটাই মদের গুণ। কিন্তু এই মাতাল ফুফা হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্টি। একজন লেখকের কী অপরিসীম ক্ষমতা- বদলে দিতে পারেন গোটা একটা সমাজ ব্যবস্থা, সচেতন করে তুলতে পারেন একটি জনগোষ্টীকে! যে কোনো বিষয়ে লেখার অধিকার তার রয়েছে।
কিন্তু সীমাবদ্ধ ক্ষমতা নিয়ে একজন স্রষ্টা হতে পারেন না। লেখকের সীমাবদ্ধতা, দায়বদ্ধতা, পাঠক, সমাজ, নিজের কাছে- নিজের সৃষ্ট কাঠগড়ায় দাঁড়ানো থেকে লেখক বাঁচতে পারেন না। একজন স্রষ্টা তার সৃষ্টির জন্যে অবশ্যই দায়ী- বিশেষ করে যে সৃষ্টির নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা নেই। সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী বলেই একজন লেখক একটি মাতাল চরিত্র সৃষ্টি করে কারো নাম উল্লেখ করে অপমান সূচক সংলাপ বলাতে পারেন না। এ কুত্সিত রসিকতার অর্থ হলো সীমাহীন ক্ষমতার অপচয়, লেখালেখির বদলে কলম দিয়ে কান চুলকানো!
No comments:
Post a Comment