"শহীদ সাহেব দ্রুত দাঁড়ি কামাতে গিয়ে গাল অনেকটা কেটে ফেলেছেন। দরদর করে রক্ত বেরুচ্ছে। টিস্যু চেপে রক্ত মোছার চেষ্টা করছেন। তিনি চাচ্ছিলেন কাউকে না জানিয়ে চুপিসারে বাসা থেকে বেরুতে কিন্তু গোল বাধল জুতো খুঁজে পাচ্ছেন না। জুতো ছাড়া অফিসে গেলে বসের আজেবাজে কথা শুনতে হবে।
সুমিকে ঘুম থেকে উঠালেন। সুমির ঘুমে চোখ ফোলা। চোখ বড় বড় করে বলল, ‘বাবা, কী আশ্চর্য, তুমি অফিসে যাচ্ছ!’
‘যেতে হবে রে মা, চাকুরীর ব্যাপার।’
‘বাবা-বাবা, এই হরতালে তুমি যাবে কিভাবে! প্লিজ বাবা, যেও না, দোহাই তোমার।’
‘মা-রে, দু-দিন যাইনি। আজও না গেলে চাকরি থাকবে না!’
‘যেও না বাবা প্লিজ। তুমি গেলে আমি দুঃশ্চিন্তায় মরে যাব।’
শহীদ সাহেব সুমীর মাথায় হাত রাখলেন। ‘কিছু হবে না মা, সন্ধ্যায় দেখবি তোর এই বুড়ো বাপ ঠিক ঠিক ফিরে আসবে।’
‘বাবা-!’
‘ মা নিষেধ করিস না, লক্ষী বেটি না আমার।’
সুমি ছলছল চোখে বাবার জুতো খুঁজতে লাগল। বাবাটা কেমন, জুতোতে কালি নেই। আশ্চর্য, মানুষটা নিজের সম্বন্ধে এত উদাসীন কেন! সুমি জুতো খুঁজে চেঁচিয়ে বলল, ‘বাবা, পাঁচ মিনিট, টিফিন দিয়ে দিচ্ছি।’
‘না রে বেটি, দেরি হয়ে যাবে।’
‘পাঁচ মিনিট বাবা, পাঁচ মিনিট। মাথা খাও আমার, বাবা যেও না।’
সুমীর কাছ থেকে শহীদ সাহেব বিদায় নিয়ে পা চালিয়ে হাঁটছেন। হরতালের কারণে রিকশা ছাড়া কিছুই চলছে না। কী দাম- দশ টাকার ভাড়া ত্রিশ টাকা চাচ্ছে! কিছুদূর হেটে হাঁপ ধরে গেছে। না পেরে একটা রিকশা নিলেন। সামনে জটলা দেখে রিকশাওয়ালা চেষ্টা করেছিল রিকশা ঘুরিয়ে নিতে। হইহই করে একঝাক তরুন রিকশা ঘিরে ফেলল।
‘এই শালার রিকশা ভেঙ্গে ফেল।’
রিকশাওয়ালা ভীত গলায় বলল, ‘ভাইজান, এইবার হরতালে রিকশা চলতাছে বইলাই তো বাইর হইছি।’
একজন হাত নেড়ে বলল, ‘ভাগ, শালা, খালি রিকশা নিয়া যা।'
এইবার শহীদ সাহেবকে নিয়ে পড়ল। ‘আঙ্কল, আস্সালামু আলাইকুম। কোথায় যাচ্ছেন এই সাত সকালে।’
শহীদ সাহেবের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘অফিস যাচ্ছি।’
‘আঙ্কল, সর্বনাশের কথা বললেন দেখি। হরতালে অফিস, কী সর্বনাশ!’
শহীদ সাহেব দুরুদুরু বুকে ভাবছিলেন; ছেলেগুলো শিক্ষিত। সম্ভবত ভার্সিটিতে পড়ে। এরা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বললে বুঝবে। কতই বা বয়স এদের, সুমির বয়সের হবে।
‘বাবারা, অফিসে না গেলে আমার চাকরি থাকবে না।’
‘আহারে। চাকরি না থাকলে ব্যবসা করবেন। বুড়া মানুষ- সাহস তো কম না রিকশায় ঠ্যাং তুলে অফিসে যান। হাতে ওটা কি টিফিন বক্স? দেখি দেখি, এই খোল তো- ওয়াও, পরোটা ডিম।’ নিমিষে ভাগাভাগি করে এরা পশুর মতো চিবুতে লাগল।
একজন ঢেকুর তুলে বলল, ‘আঙ্কল, সার্টটা খুলেন।’
শহীদ সাহেব বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন। এইবার সত্যি সত্যি ভয় পেলেন। এখন এদেরকে খানিকটা বুঝতে পারছেন- এরা তাকে নিয়ে একটা মজার খেলা খেলতে চাচ্ছে। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘বাবারা, আমাকে যেতে দাও। বাসায় চলে যাব।’
‘না-না আঙ্কল, আপনাকে অফিসে যেতে হবে যে কিন্তু আঙ্কল আপনার তো অফিসের পোষাক তো ঠিক নাই। খুলেন-খুলেন, সার্টটা খুলেন ফেলেন।’
শহীদ সাহেব দেরি করছেন দেখে একজন ফড়ফড় করে পকেট ছিঁড়ে ফেলল। যেন কাঠের স্তুপে আগুন ধরাবার বাকি ছিল। কাপড় ছেঁড়ার শব্দে সবার মধ্যে একটা মাদকতা সৃষ্টি হলো। একসময় শহীদ সাহেবের গায়ে একটা সুতোও রইল না।
তিনি কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। বোধ শক্তি সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে।
ঝকঝকে দিন- গাঢ় নীল আকাশ- চারপাশের অতি ব্যস্ত মানবসন্তান- ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ, সব কেমন দূরে সরে যাচ্ছে। তিনি দু-হাত ছড়িয়ে অবিকল ভিক্ষুকের গলায় বলছেন: আল্লার ওয়াস্তে আমারে একটা কাপড় দেন।"
*ছবিঋণ: ডেইলি স্টার। (আমি ডেইলি স্টারেই দেখেছিলাম কিন্তু তখন সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব হয়নি। অনেক খুজেঁও পাচ্ছিলাম না- পরে এই সূত্রে একটা নিউজপ্রিন্ট পত্রিকা ছাপিয়েছিল। পুরনো ওই কাগজের অবস্থা তখন যা-তা।)
**লেখাঋণ: 'কয়েদী' (২০০৫) বইটির এই অংশটুকু লেখার উত্স এই ছবিটি। এই ছবিটা অনেকদিন আমাকে তাড়া করত। এই ছবিতে পশুমানব নামের এমন একজন মানুষ আছেন যিনি পরবর্তীতে বিটিভি'র একজন দুঁদে উপস্থাপক হয়ে লম্বা লম্বা বাতচিত করতেন। ভাগ্যিস, এই মানুষটার মত শিক্ষিত হতে পারিনি। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি!
***কয়েদী: ১
****কয়েদী বইটির সমালোচনা করেছিলেন আনোয়ার সাদাত শিমুল। ভাল ভাল কথা লিখেছেন বলেই না, তিনি লেখাটার মূল সুরটা চমৎকার করে ধরতে পেরেছিলেন বলে এটা আমার পছন্দের লেখা।
"আমরা যখন কয়েদী এ গ্রহের সবচেয়ে বড় কারাগারের খবর পেয়েছিলাম আগেই। কিন্তু এবার যখন 'কয়েদী' পড়া শুরু করলাম তখন ক্রমান্বয়ে তিন পাশে গজিয়ে উঠে অক্ষমতার দেয়াল আর অন্যপাশে বাধা দেয় কষ্ট ও ক্ষোভের কপাট। গৌরবময় ইতিহাসের সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ যখন হরতাল নামক দানবের হিংস্র ছোবলের শিকার তখন নিষ্ঠুরভাবে দেশটির ১৪ কোটি মানুষ বন্দী হয় অদ্ভুত এক কারাগারে। এ কারাগারের পাঁচটি সেলের গল্প উঠে এসেছে আমাদের ব্লগার শুভ'র 'কয়েদী' উপন্যাসে। প্রথম সেলে আমরা দেখি - গার্মেন্টস মালিক জামিল আহমেদ এবং তার জাপানীজ বায়ার রিউনোসুকে আকুতাগাওয়ার গল্প। টানা অসহযোগ আন্দোলনের ফাঁদে ফ্যাক্টরী বন্ধ, শ্রমিকদের জীবন অনিশ্চিত। বৈরী পরিস্থিতিতে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশ ছাড়ে আকুতাগাওয়া। জামিল আহমেদ হারায় প্রসপেক্টিভ বিজনেস ডিল। তবে আকুতাগাওয়ার রেখে যাওয়া চিঠি ছুঁড়ে দেয় অনেকগুলো প্রশ্ন। দেশপ্রেমের অসহায় বোধ প্রকট হয়ে উঠে।
দ্বিতীয় সেলে রয়েছে মরণাপন্ন মায়ের মুখ শেষবারের মতো না দেখার যন্ত্রণায় সন্তানের করূণ কান্না। অসুস্থ মা'কে ঢাকা দেখতে যাওয়ার পথে সাকিবের ট্রেন আঁটকা পড়ে আখাউড়া জংশনে। বৌ-বাচ্চা নিয়ে সাতদিন বন্দী থাকে রেলের কামরায়। কয়েদী জীবনের উপায়হীন হাহাকার তখন কেবলই শুন্যে প্রকম্পিত হয়।
তবুও কয়েদী জীবন উপভোগ করে কেউ কেউ। তৃতীয় সেলে আমরা দেখি, হরতালের অখন্ড অবসরে একজন লেখক আনমনে লিখে যাচ্ছেন। দেশের ক্ষতি তাকে ভাবাচ্ছে না। 'পাঠক খাওয়ানো' রাজনৈতিক উপন্যাস লিখতে ব্যস্ত তিনি। ...এ অংশে 'কয়েদী'-র পাঠক খানিকটা খেই হারাতে পারে। তবে একটু ধৈর্য্য নিয়ে পরের সেলে তাকাতেই চোখে পড়বে - হরতাল দানবের আরেকটি কুৎসিত আঁচড়; অফিসগামী শহীদ সাহেবকে বিবস্ত্র করছে সন্তান-বয়েসী পিকেটাররা। মিরর অব দ্য সোসাইটির অভিজ্ঞ রাঁধুনির ক্যামেরা তখন ক্লিক ক্লিক ছবি তুলে যায়। এটুকু পড়ে পাঠক বিবেক কুঁকড়ে যায় অক্ষমতার যাতনায়। অনেকগুলো তীর এসে মূল্যবোধের ঘরে হানা দেয়।
উপন্যাসের শেষ অংশে আমরা দেখি - অসুস্থ দশ মাসের শিশুকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে যাচ্ছে শাহেদ-ফারা দম্পতি। তিন ঘন্টার রাস্তায় মোড়ে মোড়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকে হরতাল দানব। দানবের মেদ জমা শরীরের ফাঁক-ফোকর পেরিয়ে খানিকটা এগুলেও গন্তব্যে পৌঁছা যায় না। ...পিকেটাররা উৎসব করে ভাঙছে শাহেদের গাড়ী!
'কয়েদী' পড়ে প্রথমে মনে হতে পারে ঘটনাগুলো সম্পর্কহীন-বিক্ষিপ্ত। অমনটিই স্বাভাবিক। কয়েদখানার সেলগুলোয় পাশাপাশি থেকেও কোন যোগসূত্র স্থাপিত হয় না, অথচ খুব কাছাকাছি অবস্থান সবার। ঠিক তেমনি জামিল আহমেদ, সাকিব, লেখক, শহীদ সাহেব কিংবা শাহেদ - এরা আমাদেরই আশেপাশের মানুষ। হয়তো তাদের পাশের সেলে বাস করছি আমি-আপনি এবং আমরা। হরতাল প্রেক্ষিতে আমাদের এক একটি নিজস্ব গল্প পূরণ করে দেয় 'কয়েদী' কাহিনীর শুন্যতাগুলো!
'কয়েদী' সম্ভবত: বাংলাদেশে হরতাল নিয়ে লেখা একমাত্র উপন্যাস। বিবেক নাড়া দেয়া বইটি প্রকাশ করেছে জাগৃতি প্রকাশনী।"
1 comment:
oi shikkhito uposthapoker nam ki?
Post a Comment