Search

Friday, May 1, 2009

আমার আনন্দ-বেদনার অপকিচ্ছা: ২

কুমিল্লা ল কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। রাতে ক্লাস করতে হত। কিন্তু এক বছর ঝুলে থেকে আইন পড়া বাদ দিলাম। তিনটা কারণে। এক, আইন পড়তে আমার ভাল লাগছিল না। দুই, রাতের ট্রেনে আসা-যাওয়া করতে হত। আর তিন নম্বরটা? যেটা প্রধান কারণ ছিল সেটা হচ্ছে আমার  হাই-স্কুলের সাবেক শিক্ষক ফজলে আলী স্যার, তিনি!
আল্লা মালুম, কে স্যারের মাথায় এই কু-বুদ্ধি ঢুকিয়েছিল যে তিনিও আমার সঙ্গে ল-কলেজে ভর্তি হলেন! ইয়া মাবুদ, কোথাও কোণায় একটা সিগারেট ধরিয়েছি বন্ধুদের সঙ্গে, স্যার এগিয়ে এসেছেন। আমার সঙ্গে তাঁর তখন রাজ্যের আলাপ। তখন সিগারেট ফেলা বা লুকাবার সুযোগ না-থাকলে মুঠি চেপে নিবিয়েছি। তালুতে ফোস্কা পড়ে যেত।
আবার বান্ধবীদের সঙ্গে পড়া বুঝে নেয়ার ছল করে 'ইয়ে...' করছি যথারীতি স্যার এগিয়ে আসছেন। ধুর, 'খেতাপুড়ি' আইনের পড়া...। 

মাহবুব ভাই [] নামের একজন আমার কানের পাশে ঘ্যানঘ্যান করে মাথা ধরিয়ে দিতেন। আরে, আপনি এতো পড়েন লেখেন না কেন। শোনো কথা, পড়লেই বুঝি লেখা যায়! তো একবার মানুষটার উপর বিরক্ত হয়ে লেখা শুরু করলাম। সবাই শুরু করে কবিতা বা ছোট-গল্প দিয়ে। আমি বেকুবের মত লিখে ফেললাম আস্ত একটা উপন্যাস! লিখে তো ফেললাম, এখন উপায় কী!

আমি খুঁজে খঁজে কিছু প্রকাশকের নাম-ঠিকানা যোগাড় করলাম। এদের এখানে গিয়ে আমার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে! প্রকাশকদের পাওয়ার উপায় আছে- কেউ গেছে বাজারে হুমায়ূন আহমেদের জন্য মোষের দই আনতে তো কেউ...। আর ঘুরেফিরে একটাই কথা; 'ফেলো কড়ি, মাখো লাউয়ের জুস'! পাগল, বই ছাপাবার জন্য তোদের টাকা দেব কেন রে, বাপু! কী এমন ঠ্যাকা পড়েছে আমার টাকা দিয়ে ছাপাবার? 
এখানেই পরিচয় হলো আহমাদউল্লাহ নামের একজন অসম্ভব হৃদয়বান মানুষের সঙ্গে। যিনি নিজেও একজন সু-লেখক। তিক্ত অভিজ্ঞতার যন্ত্রণায় আমার যখন ইচ্ছা করছিল ২৬ তলা (তখন ঢাকায় এর উপর দালান ছিল না সম্ভবত) থেকে ঝাঁপ দেই, ঠিক সেই মুহুর্তে তিনি মমতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমার লেখাগুলো মনোযোগ নিয়ে পড়ে কিছু সদাশয় মন্তব্য করেছিলেন। আমার ধারণা, এটা তাঁর মজ্জাগত অভ্যাস, এ কাজটা তিনি অন্যদের জন্যও জীবনে বহুবার করেছেন।
আহমাদউল্লাহ নামের মানুষটা- অনেক কটা বছর তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না। এই মানুষটাকে পাগলের মত খুঁজেছি। পাইনি! খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেব এমনটাও ভেবেছিলাম, সত্যি-সত্যি। কেউ কোন খোঁজ দিতে পারেন না। এক বইমেলায় দন্তস্য রওসন বললেন, তিনি নাকি যুগান্তরের ইসলামি পাতা দেখেন। অনেক যন্ত্রণা করে একদিন মানুষটাকে ফোনে পেলাম। মানুষটা আর আগের সেই মানুষ নাই। কেমন শীতল-শীতল একটা বিষয় চলে এসেছে! প্রতি শ্বাসে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। এটা দোষের এমন না কিন্তু তাঁর শীতলতায় আমি জমে গেলাম। কেমন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
একদিন তিনি বললেন, 'চলেন বাংলা একাডেমী যাই, ওখানে রশীদ ভাইকে পাই কিনা দেখি'। রশীদ ভাই মানে সু-সাহিত্যিক রশীদ হায়দার। আমার ধারণা ছিল, আহমাদউল্লা নামির মানুষটার নিজের কোন কাজ হবে-টবে হয়তো বা! কিন্তু তিনি যখন আমাকে মি. রশীদ হায়দারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, 'রশীদ ভাই, এর লেখাটা একটু পড়ে দেখবেন তো'। মারাত্মক, ইয়ে...।
আমি তখন রুলকরা আমার বাইন্ডিং খাতাসহ ওখান থেকে উধাও যেতে পারলে বেঁচে যাই। নিদেনপক্ষে, অন্তত মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারলে রক্ষা হয়!

মি. রশীদ হায়দার তখন ‘উত্তরাধিকার’ নামের সাহিত্য-ত্রৈমাসিকের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। তিনি সহজভঙ্গিতে রুলকরা খাতাটা নিলেন। কথাপ্রসঙ্গে তিনি বললেন, 'জানো, কলম ধরতে লাগে দশ বছর আর কলম কাগজে ছোঁয়াতে লাগে দশ বছর'।
কথাটা ছিল রূপকার্থে, কিন্তু আমার আক্কেল গুড়ুম। আমি বললাম, ইয়া রব, মারিছে (অবশ্যই মনে মনে )!
পরে বিভিন্ন সময় আমি রশীদ হায়দার মানে রশীদ ভাইয়ের কাছে গিয়েছি। ভাই বলার অনুমতি তিনিই দিয়েছিলেন। ব্যস্ত থাকলে বলতেন: খবরদার বসবা না, তোমাকে এক মিনিট সময় দিলাম, যা বলার বলে বিদায় হও।
অবশ্য অবসর থাকলে চুটিয়ে গল্প করতেন। সেই গল্প ঝড়ের গতিতে চলতে থাকত। কার সঙ্গে, কার সঙ্গে আবার, আমার সঙ্গে? শোনে কথা, আমি কী-এক গল্প করার লোক যে রশীদ ভাইয়ের মত লোক আমার সঙ্গে গল্প করার জন্য বসে থাকেন!
 
একদিনের কথা আমি আজীবন ভুলব না। কথা বলছি, এরিমধ্যে তাঁর একটা ফোন এলো। তখন ল্যান্ডফোনের যুগ। তিনি ফোনে বললেন, ‘আখাউড়া থেকে আমার এক লেখক বন্ধু এসেছেন, কথা বলছি, তুমি একটু পরে ফোন করো’।
নিমিষেই আমার গোটা পৃথিবীটা আধার হয়ে এলো। আমি ঝাপসা চোখে এই অসাধারণ মানুষটা, একজন স্বপ্নবাজ, একজন লেখক বানাবার মেশিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। হা ঈশ্বর, আমার মত ছদরউদ্দিন-মদরউদ্দিন টাইপের একজন মানুষ যার তখন পর্যন্ত এক লাইন লেখাও কোথাও ছাপা হয়নি, যার শরীর থেকে ভক করে সরষে তেলের গন্ধ বের হয় তার মতো অগাবগা মানুষ নাকি রশীদ হায়দারের লেখক বন্ধু! আমি আজীবন এটা ভুলব না!

বাংলা একাডেমী থেকে আমার সেই উপন্যাসটা ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সেটা ছাড়িয়ে যায় এইসব লেখক বানাবার মানুষ! এইসব মানুষরা নিজে কি তারচেয়ে বড়ো হচ্ছে এঁরা আমাদের মধ্যে স্বপ্নের বীজ বপন করেন!
রশীদ হায়দারের মত মানুষ এই গ্রহ ছেড়ে কোন গ্রহে গেলেন সে ভিন্ন আলোচনার বিষয় কিন্তু পেছনে ছড়িয়ে যান স্বপ্নগুলো...!

সহায়ক সূত্র:
১. মাহবুব ভাই: https://www.ali-mahmed.com/2007/07/blog-post_06.html 



No comments: