দুগ্ধপোষ্য শিশু কি অপাপবিদ্ধ? সব শিশু নিশ্চয়ই না? বিশেষ করে যাদের বাবা-মা হতদরিদ্র। এমনই এক শিশু এক টুকরো সাদা কাপড় মুড়ে শুয়ে আছে বিশাল আকাশের নিচে, জানাজার অপেক্ষায়। বেঁচে থাকতে সে দৃষ্টিনন্দন ছিল না মোটেও- উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কুচকুচে কালো গায়ের রঙ, হাড় জিরজিরে, সরু পাটকাঠি পা। বেঁচে ছিল ১৪ দিন!
শিশুটির বাবা কাজের সন্ধানে গেছেন বহুদুর। জানেনও না, চমৎকার না হোক একটি সন্তানের জনক তিনি। তাদের ভালবাসা-বাসির প্রথম সন্তান। জননী মৃত সন্তানকে হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলেন না। তার এক কথা, এর বাবা এক পলকের জন্যে হলেও একে দেখবে। অবুঝ জননী যুক্তি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন না, এ অসম্ভব! সন্তানের বাবাকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসতে যে সময় গড়িয়ে যাবে ততক্ষণ লাশ ফেলে রাখা যাবে না। আর কার এতো দায় পড়েছে, হন্যে হয়ে খুঁজবে!
দয়ালু এক প্রতিবেশী অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে লাশ নিয়ে এসে গভীর উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছে, নামাজ শেষ হলে জানাজা হবে। এক সময় নামাজ শেষ হলে কাতর গলায় বলল, ‘হুজুর, এর এট্টু জানাজা কইর্যা দেন।’
মুখ অসম্ভব অন্ধকার করে ফেললেন ইমাম সাহেব, লোকটাকে দেখে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল। এ ত্যাদড় টাইপের- বেনামাজী, ধর্মকর্মে বিশেষ মন নেই। মানী লোকের মান দিতে জানে না। একদিন ডেকে এনে ধমক দিয়ে বলেছিলেন: কি জলিল মিয়া, মসজিদে দেহি না, নামাজ পড়ো না- বিষয়ডা কি?
বেয়াদবটা ঘাড় শক্ত করে বলেছিল: মুনির কাম করি, টেম(টাইম) পাই না।
চড় দিয়ে উল্টে ফেললে আরাম পেতেন। সামলে নিয়ে বলেছিলেন: দোজখে গেলে সময় পাবি?
হেইডা আফনে কেমনে কন, আমি দুজখে যামু! এই মসজিদের সেক্রেটারি মতিন সাব কি বেহেস্তে যাইব, হে তো এক নম্বর সুদখোর।
মসজিদের সেক্রেটারি মতিন সাহেব লোক হিসেবে এতটা খারাপ না। কুস্তিগিরের শরীর, একেবারে ঘাড়গর্দানে। বিশাল বেঢপ ভুঁড়ি চোখে না পড়ে উপায় নেই। মসজিদে নিয়মিত সামনের কাতারে দাঁড়ান। সুদ খান, এটা এখন কে না খায়? অবশ্য দরিদ্র মহিলারা এঁর সংসপর্শে এসে বিচিত্র অসুখ বাধিয়ে বসে। মতিন সাহেবের মত ভুঁড়ি গজায়- সুখের বিষয় অসুখটা এক সময় সেরে যায়।
ইমাম সাহেব এবার বললেন, ‘কার জানাজা?’
জলিল মিয়া বলল, ‘জ্বে, এই দুধের বাচ্চাডার।’
মতিন সাহেব এবার এগিয়ে এসে বললেন, ‘অই, তোর বাচ্চা নিহি।’
‘জ্বে-না, আমাগো পরতিবেশীর। এই ধরেন গিয়া দুই ঘর পর, ’বলল জলিল মিয়া, হড়বড় করে।
আগ বাড়িয়ে মসজিদের সেক্রেটারি মতিন সাহেব রাগ-রাগ গলায় বললেন, ‘তা হের বাপ কই? ফাজিলের দল সব, বাপ না আইস্যা লতায়-পাতার সমপর্ক আসছে।’
‘জ্বে, হের বাপরে পামু কই! হে তো তিন মাস বাড়ি ছাড়া। মজুর খাটতে গেছে। আহারে, জানেও না, পুলা হইয়া মইরাও গেছে।
‘মরবই তো, এমুন কাণ্ড জ্ঞান যে বাপের হের পুলা কি লাফাইবো!’
জলিল মিয়া হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে গিয়ে সামলে নিল, সময়টা ভাল না। ভাঙা গলায় বলল, ‘আল্লারওয়াস্তে দুধের বাচ্চাডার জানাজা দেন।’
মতিন সাহেব ঘৃণায় একগাদা থুথু ফেলে বললেন, ‘তুই কইলেই হইব? হুকুম দেস! খোঁজখবর নিতে হইব না, বাচ্চার বাপ নামাজ পড়ে? আহাম্মুক, বাপ বেনামাজী হইলে জানাজা হইবো কেমনে!’
জলিল মিয়া সব গুলিয়ে ফেলল। জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, ‘ইডা আফনে কি কন! বাচ্চা তো ফেরেশতা, বাপের নামাজের লগে হের কি 'সমপর্ক'!’
মতিন সাহেব অসহ্য রাগে লাফিয়ে ওঠলেন, ‘ধর্ম শিখতে হইব তোর কাছে, তোর মত কাফেরের কাছে!’
এ মসজিদের ইমাম সাহেব মতিন সাহেবের সঙ্গে সায় দিলেন, তার অর্জিত জ্ঞান দিয়ে। মোয়াজ্জেন, চল্লিশ-পঞ্চাশজন মুসুল্লী কেউ টুঁ শব্দ করল না।
অনেক দেরিতে হলেও শিশুটির জানাজা হয়। সৌভাগ্য তার, পচনশীল দেহ বাড়তি এ সুবিধাটুকু নিয়ে জন্মেছিল। শিশুটি পাপ করার সময়ও নিশ্চয়ই পেয়েছিল, বারো লক্ষ ন হাজার ছশো সেকেণ্ড- চৌদ্দ দিন, কম সময় তো না!
*লেখাটি নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। ভোরের কাগজে কোন লেখা আটকালো না, এটা আটকে গেল। বিভাগীয় সম্পাদক সঞ্জীব দা অন্য দিকে তাকিয়ে বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, সম্পাদক সাহেব বলেছেন এটা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে। আপনি কি একটু সম্পাদক সাহেব, মতি ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে দেখবেন।
আমার মাথায় ঢুকছিল না এটা কেমন করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে! পত্রিকাটা তো ইনকিলাব টাইপের না যে এরা ধর্ম নামের সমস্ত অস্ত্র বাগিয়ে বসে আছেন! আমি সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ বোধ করলাম না। আমি তো এই পত্রিকার চাকুরে না, ফ্রিল্যান্স কলমচি। লেখাটা ওখানে আর ছাপা হয়নি। পরবর্তিতে ওখানে লেখার আগ্রহ কমে এলো।
তাছাড়া ঘটনাটা আমার নিজের চোখে দেখা। এটা নিয়ে লিখতে পারব না কেন? এটা তো আমার অধিকার।
হায় অধিকার! এই দেশে অধিকার ফলাতে গেলে হাজার-লাখ পাঠকের বদলে কপালে জুটবে দু-চারজন পাঠক! রত্মেশ্বর হাজরা-র কবিতা ধার করে বলতে হয়:
"মৃত্যু ও মৃতের অধিকার নিয়ে সে
একবার সভাও ডেকেছিল ময়দানে
যদিও সেই সভায় সে নিজে ছাড়া উপস্থিত ছিল
বাতাস
বিকেল বেলার রোদ
মাঠের নির্জনতা
আর বিস্ময়-"
No comments:
Post a Comment