Search

Monday, October 12, 2009

মুক্তিযুদ্ধে: একজন সিরাজুর রহমান

যুদ্ধ নামের কদাকার পশুর মুখোমুখি হলে মানুষ কোন পর্যায়ে নেমে যায় এটা আঁচ করা মুশকিল! মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়টা আজ আমরা, এই প্রজন্মের পক্ষে আঁচ করা প্রায় অসম্ভব। এটা তাঁরাই উপলব্ধি করতে পারবেন যারা সেই সময়টা অতিক্রম করে এসেছেন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটা সত্য ঘটনা। বৃষ্টির মত বোমা পড়ছে। বাবা তার সন্তানকে নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। বাবা তার সন্তানের মাথায় একটা হাত দিয়ে রেখেছেন। এই অবোধ বাবা হাত দিয়ে বোমা থেকে তাঁর
সন্তানকে রক্ষা করতে চাইছিলেন। ঠান্ডা মাথায় বাবার এই আচরণ নিয়ে বেদম হাসাহাসি হবে কিন্তু তখনকার সময়ের জন্য এটাই ছিল রূঢ় বাস্তবতা।

১৯৭১-এর সেই উত্তাল সময়ে কতশত মানুষের প্রিয়মানুষ কে কোথায় ছিটকে পড়েছিল তার হিসাব কে রাখে! প্রিয়মানুষের একটা খবরের জন্য কেউ তার শরীরের একটা অংশ অবলীলায় খোয়াতে রাজি হতেন এ আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি।
আজকের মত তখন তো আর ইমেইল, ফ্যাক্স, ফোনের সুবিধা ছিল না। ওই সময়ে কেউ কেউ ঠিকই অসাধারণ কাজটা করে গেছেন।

যেটা আমি বারবার বলে আসছি, একটা যুদ্ধ বিশাল ব্যাপার। একেকজনের যুদ্ধ করার ভঙ্গি একেকরকম। কেবল স্টেনগান দিয়েই যুদ্ধ হয় না, একটা ফটোগান কতটা শক্তিশালী তা সহজেই অনুমেয়!
বিশেষ-বিশেষ কাউকে নিয়ে হরদম 'নর্তন-কুর্দন' করার মানে হচ্ছে অন্যদের খাটো করা, প্রকারান্তরে নিজেকেই খাটো করা। একটা বামন-বিকলাঙ্গ হয়ে বড় হয়ে উঠা।

“সিরাজুর রহমানের (তৎকালীন বিবিসি, বাংলা বিভাগ) সাক্ষাৎকার:
১৯৭১ সালে বিবিসিতে কিছু সমস্যা ছিল। আমাদেরকে শ্রোতাদের সঠিক এবং সর্বশেষ খবর পরিবেশন করতে হবে। কোন অবস্থাতেই যেন তথ্য বিভ্রাটের আঙ্গুল না ওঠে!
আমরা বাংলা বিভাগে যারা ছিলাম, সংখ্যায় অত্যন্ত কম ছিলাম। আমাদের পক্ষে সব কিছু সামলানো কঠিন ছিল।
সৌভাগ্যবশত, তখন আশেপাশে কিছু ছাত্র ছিলেন, তাঁরা উচ্চ শিক্ষার জন্য এ দেশে এসেছিলেন। তাঁরা আমাদেরকে যথাসাধ্য সাহায্য করতেন!

আমার মনে আছে, আমার সহকর্র্মী শ্যামল লোধ, কমল বোসসহ অনেক দিন সকাল ৯টা থেকে অফিসে এসে আবার রাত ২টা, কখনো ৩টায় বাসায় ফিরতাম!

এরমধ্যে আবেগের ব্যাপারটাই প্রধান ছিল। দেশ থেকে অবিরাম খবর আসছে। দেশের জন-সাধারণের দুঃখ দুর্দশা, ভোগান্তি, মৃত্যু আমাদেরকে তাড়িত করতো!

সবচেয়ে জরুরী যে ব্যাপারটা ছিল, আমাদের হাজার হাজার বাঙ্গালী যারা পাকিস্তানে আটকা পড়ে ছিলেন, দেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার কোন উপায় ছিল না তাঁদের! আবার দেশের ওরাও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। দু’ তরফ থেকেই তারা আমাদের স্মরণাপন্ন হচ্ছিলেন।
প্রথমত, আমরা বাংলাদেশ থেকে পাওয়া কিছু চিঠি
পাকিস্তানে আটকা পড়া আত্মীয় স্বজন এবং পাকিস্তানে আটকা পড়াদের চিঠি বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। কয়েক হাজার চিঠি-পত্র এভাবে এদিক থেকে ওদিকে পাঠানো হয়েছিল।

আমাদের পর্যাপ্ত লোকবল ছিল না এগুলো দেখাশোনা করার জন্য। শেষে আমরা ‘সেতু বন্ধন, সাগর পাড়ের বাণী’ অনুষ্ঠানে তাঁদের খবরাখবর চিঠি পাঠের মাধ্যমে দেয়া শুরু করলাম।
অজস্র চিঠি পেতাম আমরা। সেই সময় আমাদের শ্রোতারা কী যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতেন এই অনুষ্ঠানের জন্য এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি!

আরও মনে পড়ে, ১৬ ডিসেম্বর, যখন অমরা টের পেলাম
পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করবে তখন আমরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলাম।
আমার মনে আছে, যখন আমরা সেই অনুষ্ঠানটি প্রচার করি, ঠিক সেই সময়ে ইয়াহিয়া খান
পাকিস্তানে বেতার ভাষণ দিচ্ছিলেন।
আমি কানে ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনছিলাম আর মুখে আমাদের শ্রোতাদের বাংলায় খবরটা দিয়ে যাচ্ছিলাম, ইয়াহিয়া খান কি বলছেন একই সঙ্গে! অর্থাৎ ইয়াহিয়া যে সময় ইংরাজীতে ভাষণ দিচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের শ্রোতারা
বাংলায় পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পনের খবরও শুনতে পাচ্ছিলেন ।
সেই মুহূর্তের কথা আমার মনে পড়ে, কান্না চেপে রাখতে পারছিলাম না তখন। অথচ বেতার সাংবাদিকের জন্য আবেগের প্রকাশ অযোগ্যতার পরিচয় কিন্তু তবুও সে দিন কান্না চেপে রাখতে পারিনি!

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৫ খন্ড

No comments: