'কালের কন্ঠ' নামের একটি দৈনিক ১০ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করেছে। এই দেশের সেরা সন্তানরা ঝাঁপিয়ে পড়ে পত্রিকাটিকে আর্শিবাদ করেছেন, 'আয়ুষ্মান ভবঃ'। এতে সমস্যা নাই, আর্শিবাদ খারাপ জিনিস না।
স্বল্প পরিসরে সবার কথা বলা তো সম্ভব না, কয়েক জনের কেবল লেখার শিরোনামই উল্লেখ করি:
হুমায়ূন আহমেদ:
"বৈরি স্বর।" (হুমায়ূন আহমেদ বৈরি স্বরে ইনিয়ে বিনিয়ে তাঁর বেদনার কথা বলেছেন, তিনি শোকে মুহ্যমান। কাঁদতে কাঁদতে শ্যাষ কিন্তু তিনি রাজাকারের পত্রিকা ইনকিলাব, পূর্ণিমায় লেখতে বড়ই আনন্দ বোধ করেন। ভালো টাকা পেলে তিনি গোলাম আজমের পত্রিকাতেও লিখবেন, আই বেট! তাঁর এই লেখাটা পড়ে আমার এক চোখে পানি এক চোখে জল চলে এসেছিল। সেই 'পানিজল' গড়িয়ে কী-বোর্ডে গেলে তো সর্বনাশ!)
মুহাম্মদ ইউনূস:
"সংবাদপত্র, তুমি কার? ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদিন আমরা ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে যত সময় কাটাই , তার চেয়ে বেশি পরিমাণ উচ্চমানের সময় কাটাই দৈনিক সংবাদপত্রের সঙ্গে।" (তিনি সংবাদপত্র তুমি কার? এটা না বলে সুদ, মহা-সুদ, তুমি কার? এটা বললে ভালো হতো। মুহাম্মদ ইউনূসের এই কথায় ভয়ংকর এক সত্য উঠে এসেছে। ছাপার অক্ষর ওরফে সংবাদপত্র যে কী শক্তিশালি তা আঁচ করা যায়। এমন মারণাস্ত্র দুষ্টের হাতে থাকা আর বানরের হাতে ক্ষুর থাকার মধ্যে কোন ফারাক নাই। কী ভয়াবহ!)
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান:
"স্বপ্নের বাংলাদেশ'। আমাদের স্বপ্নভঙ্গের জন্য রাজনীতিকসহ অন্যদের সঙ্গে দায়ী আমাদের প্রশাসনের বুদ্ধিধর আমলারা।" (স্যার, আপনার কাছে আমার জিজ্ঞাসা, আমাদের স্বপ্নভঙ্গের জন্য কেবল কি এরাই দায়ী? একজন অভিযুক্ত খুনি, ভূমিদস্যু, তস্কর কি দায়ী না?এদের পক্ষে লিখে আপনি দায়ী না?)
মুহমম্দ জাফর ইকবাল:
"প্রথম বছর। এখন ১৫ আগস্টের অন্যান্য হত্যাকান্ড আর জেলহত্যার বিচার শেষ করতে পারলেই এই কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি টানা যায়।" (হে স্বপ্নবাজ, আপনি কেন বোঝেন না আপনাকে লক্ষ-লক্ষ তরুণ অন্ধের মতো অনুকরণ করে! আপনিও যখন যেখানে খুশি লেখেন তখন আমাদের আর দাঁড়াবার জায়গা থাকে না। আমাদের দেশের স্বপ্নবাজের যে বড়ো অভাব। জেলহত্যা অসম্ভব ভয়ংকর একটি ঘটনা এতে কোন দ্বিমত নাই কিন্তু আপনি কি সাব্বির [যার রক্ত লেগে আছে আহমেদ আকবর সোবহানের হাতে, এই হত্যার বিচার চান না?)
আকবর আলি খান:
"গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত। প্রায় প্রতিটি দেশেই গগনস্পর্শী দুর্নীতি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গ্রাস করেছে।" (ভাল! স্যার, দুর্নীতি কি নীতি হয়ে যায় পত্রিকা বের করলে?)
হাসান আজিজুল হক:
"বারবার ফেরত পাঠানো স্বপ্ন। চক্ষুষ্মান মাত্রেই মানুষ দেখতে পাচ্ছে উজ্জ্বল দুপুরের সূর্য নিষ্প্রভ।" (রাইট স্যার। আপনার মতো লেখকরাই আমাদের স্বপ্ন দেখান, দুঃস্বপ্নও দেখান।)
আল মাহমুদ:
"আমাদের স্বপ্নের স্বদেশ।" (আল মাহমুদকে নিয়ে আমার বলার বিশেষ কিছু নাই)আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক:
'তথ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। জাপান...সেখানে বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ১৫ কপি পত্রিকাও কেন সঞ্চালিত হয় না- তা বোঝার জন্য রকেটবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন হয় না।" (আচ্ছা, এই আ আ ম স এটার অর্থ জানার জন্য কি রকেটবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন হয়? না-হলে আমার জানার খুব ইচ্ছা এই আ আ ম স এটার অর্থ কি?)
আবদুল গাফফার চৌধুরী:
"বৈরী স্বকাল এবং দ্রোহী সংবাদপত্র।" (তিনি আবেদ খানকে তুমি-তুমি বলে বিস্তর উপদেশ দিয়েছেন। বিস্তারিত লিখতে চাচ্ছি না, ইতিমধ্যে মনিটর তেলতেলে হয়ে গেছে।)
এই দেশের আরও অনেকে আছেন। ক-জনের আর নাম বলব? আরও আছেন ওপার বাংলার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, অভিজিৎ সেন সহ অনেকে। আহা, আমাদের ছফা নাই, নইলে দাদাদের উপর ক্ষেপে যেতেন।
বৈদেশি সাহেবরাও পিছিয়ে নেই। নোয়াম চমস্কি, নাদিন গর্ডিমার সহ অনেকে। নাদিন গর্দিমারের সঙ্গে রুবানা হকের ছবিও ছাপা হয়েছে আমাদের বিশ্বাসের ভিত জোরালো করার জন্য। এর আদৌ প্রয়োজন ছিল না।
দাদারা এবং বৈদেশি ভাইয়ারা আমার এই লেখার মূল উপজীব্য না- এরা এই দেশের কী ঘোড়ার ডিমটা জানে! আমাদের দেশের সেরা সন্তানদের নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখি আমাদের সেরা স-ন্তা-ন! আহারে, এঁরা, খোকারা কি জানেন না 'কালের কণ্ঠ' কার পত্রিকা!
আমার জানার খুব ইচ্ছা, গোলাম আজম সাহেব যদি 'মুড়ির ঘন্ট ' নামে কোন পত্রিকা বের করেন, সেই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে আবেদ খানের মত কাউকে (ধরুন, আপনাকেই বানিয়ে দেয়া হলো) বসিয়ে দেন তাহলে কি আমার দেশের এই সেরা সন্তানরা হুবহু এমন লেখাই লিখবেন? নাকি লেখার সুর অনেকখানি পাল্টে যাবে? নাকি এরা মুড়ির ঘন্টে লেখা দেবেন না? কেন-কেন, কেন লেখা দেবেন না কেন? লেখা না দিলে ব্যক্তিগত ভাবে আমি ভারী দুঃখিত হবো। এ অন্যায়! কেন রে বাপু, কেন এমন অনাচার?
আহমেদ আকবর সোবহান যেমন এ দেশের নাগরিক, গোলাম আজমও। কি বললেন, এটা কী সত্য না? সত্য, আচ্ছা, গোলাম আজম কি বড়ো ধরনের অন্যায়ের জন্য অভিযুক্ত না? সো, হোয়াই য়্যু আস্ক মী সাচ দিস কোশ্চেন? অভিযুক্ত তো আহমেদ আকবর সোবহান, তিনিও তো ভুমিদস্যুতা, কর ফাঁকি মায় সাব্বিরের খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত- তার খুনি সন্তানকে বাঁচাবার জন্য বিস্তর অন্যায্য কলকাঠি নেড়েছেন!
প্রকারান্তরে এ-ও অন্যায়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এদের দু-জনের কেউই নিজ হাতে খুন করেছেন এমন চাক্ষুষ প্রমাণ নাই কিন্তু আমি কি গোল্ডা মায়ারের বিখ্যাত সেই কথাটা মনে করিয়ে দেব,
"কাউকে নিজ হাতে হত্যা করা এবং হত্যার করার সিদ্ধান্ত দেয়ার মধ্যে কোন ফারাক নাই"।
নাকি এখন এটাও মনে করিয়ে দেয়ার আবশ্যকতা আছে, খুন করা এবং সজ্ঞানে খুন ধামাচাপা দেয়া দুই-ই জঘণ্য অপরাধ।
কে ৭১ সালে অন্যায় করেছে, কে ২০০৬, ২০১৬, ২০২৬ সালে তাতে কী, তাতে কি অন্যায়ের হেরফের হয়? কার অপরাধ কতো বড়ো সেটা তো এখানে আলোচ্য বিষয় না। আমি তো বিচারক না, কার গলায় ফাঁসির দড়ি ঝুলবে নাকি ফুলের মালা সেটার বিচারের ভার তো আমার উপর না। এটা আইনের এখতিয়ার। আমি সমস্ত অপরাধিকে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো দেখতে চাই। কার ১ বছরের জেল হবে, কার ১০০ বছরের সেটা পরের কথা- ৩৭ বছর গেল নাকি ৩৭০ বছর তাতে কী!
আমি খুনিকে স্রেফ খুনি বলব, মুনি না- রাজাকারকে রাজাকার বলব, ছড়াকার না। ভূমিদস্যুকে ভূমিদস্যু, সাব্বিরের খুনিকে খুনি, দ্যাটস অল। কোন-কোন বিখ্যাত মানুষ তাদের কোলে বসিয়ে চুমু খেলেন নাকি আয়ুষ্মান ভবঃ বলে আর্শিবাদ করে-করে পশ্চাদদেশ দোলালেন, তাতে আমার কী!
পাখি উড়ে যায় ফেলে যায় পালক- পানি চলে যায়, রেখে যায় দাগ। বাঁচার জন্য কোথাও না কোথাও একটা গাছ থাকতেই হবে তেমনি অন্ধকারেরও একটা দাগ থাকবেই। নিতল অন্ধকার থেকে উঠে আসা 'কালের কন্ঠ'ও তার ছাপ রেখে যাবে এর জন্য রকেটবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আগামীতেও এই সমস্ত মিডিয়া এই পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রত্যক্ষ খুন, পরোক্ষ খুনের ধামাচাপা দেওয়ার বেলায় বেশ কাজে লাগবে। জুম্মা জুম্মা সাত দিনও হয়নি, নমুনা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে...!
আফসোস, আমরা একবারও ভাবি না যে আমরা 'পাইপমানুষ' না। ‘পাইপমানুষ’! যে মানুষ নামের পাইপের এক পাশে থাকে যার চালু নাম খাবার- অন্য পাশে আবর্জনা!
খাবার...ভদ্রতা করে বললাম নইলে খাবার না ছাই! ভাগ্যিস, মস্তিষ্ক খাবার নামে যে সমস্ত খাদ্যবস্তু চেনে বলে রক্ষা নইলে সর্বনাশ হয়ে যেত। কারণ মানব-বর্জ্যকেও খাবার রূপে চিনত। তখন গোটা গ্রহ বর্জ্যময়!
তো, জন্তুর মত কেবল খাওয়া আর বাথরুম করার জন্য এই গ্রহে আমাদের সু-আগমণ না। কে বড় লেখক, কে বড় সাংবাদিক, কে বড় ব্যবসায়ি তারচেয়ে জরুরি হচ্ছে কে একজন ভাল মানুষ। এবং একজন ভাল মানুষ 'পাইপমানুষ' না-বলেই তার পরের প্রজন্মের জন্য তার জ্ঞানটা রেখে যায়। এভাবেই একজনের হাত ধরে-ধরে সভ্যতা এগিয়ে যায়। মানুষ ক্রমশ অমর হতে থাকে...।
No comments:
Post a Comment