
আজ বেছে বেছে সব মন খারাপ হওয়ার ব্যাপারগুলো ঘটছে। হাতের নাগালে পড়ার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। লোপা কষ্টের শ্বাস ফেলল। ও নিজে বাংলায় মাস্টার্স করেছে, কী শখই না ছিল বই পড়ার। অথচ কী একটা মানুষের পাল্লায় পড়েছে, রাব্বি হচ্ছে একেবারে উল্টোটা!
আজিব একটা মানুষ, ভুলেও যদি একটা বই পড়ে দেখত। লোপা তো প্রথম প্রথম বুঝে উঠতেই পারত না একজন মানুষ কেমন করে বই না পড়ে থাকতে পারে! দু-এক বার জোর করে পড়াবার চেষ্টাও করেছে কিন্তু ৫ মিনিটের মাথায় মানুষটা ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকতে শুরু করেছে। অথচ ওর অফিস সংক্রান্ত মার্কেটিং-এর ঢাউস বইগুলো পড়তে তার কোন সমস্যা নাই। কেবল পড়েই ক্ষান্ত দেয় এমন না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়বে, লাইন বাই লাইন মার্কার দিয়ে আন্ডার-লাইন করবে, প্রয়োজনীয় নোট নেবে। কখনও খটকা লাগলে ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে প্রয়োজনীয় উপাত্ত খুঁজে বের করবে, ওই ঢাউস বইগুলোর মার্জিনে মন্তব্য করবে। এখানেই শেষ না, মার্জিনের মন্তব্যগুলো তার ল্যাপটপে নিয়মিত আপডেট দেবে। ক্ষণে ক্ষণে, জনে জনে ফোন করবে। সে এক দক্ষযজ্ঞ!
লোপা যে বইটা খুলে বসেছে এটায় পড়ায় মন নেই, কেন যেন এগুচ্ছে না। খুঁজে ওর নিজের ডায়েরিটা বের করল। এক সময় চুটিয়ে লিখত। সুমন এবং ওর মধ্যে একটা অলিখিত প্রতিযোগীতা চলত। সুমন অবশ্য ঝুলাঝুলি করত, আপুনি, পত্রিকা অফিসে লেখাটা পাঠিয়ে দেই। লোপা সলাজে আপত্তি করত, ধুর, আমাদের লেখা পত্রিকাওয়ালাদের ছাপাতে বয়েই গেছে। ইশ, সুমনবাবু কী এক লেখক হয়েছেন! একপাতা লিখতে দশটা বানান ভুল করে তার লেখা ছাপাবে পত্রিকা, হি হি হি।
সুমন চোখ লাল করে তাকাত। রাগে চিড়বিড় করে বলত, তুই যা লিখিস এগুলো দিয়ে বাচ্চার ইয়েও কেউ পরিষ্কার করবে না।
লোপা ফি-রোজ নিয়ম করে নিজের কোন লেখা না-লিখলেও লিখে যেত। অন্যদের মত নিজের কথাবার্তা না। যা-সব পড়ত তাই লিখত। কোন লাইন, প্যারা, কবিতা ভাল লেগে গেলে টুকে রাখত। এভাবে ওর কত ডায়েরি যে ভরে গেল! কারও বড় কোন লেখা লিখে রাখতে সমস্যা মনে হলে পাতাটা কেটে রেখে দিত। দেখা যেত ওদের বাসার পত্রিকা, ম্যাগাজিনের অনেক পাতা কাটা।
মা খুব রাগ করতেন কারণ তিনি কাগজগুলো সের দরে বেচে দিতেন। দোকানদারের কাছ থেকে কঠিন অভিযোগ আসত, খালাম্মা, আপনাগো কাগজ লয়া বড়ো দিগদারি, পাতায় পাতায় ঢুলা! ঘটনাটা কি কইনছেন, এইটা তো ইন্দুর কাটে না, বেলেইড দিয়া কাটা। বাইচ্চারে সামলান নাইলে একদিন হাত-হুত কাইটা দরবার লাগাইব।
মার সেকি রাগ। রাগের তোড়ে লোপার পিঠে গুম গুম করে কিল। ইশ, মা কী জোরেই না মারতেন! আবার চোখে জল নিয়ে মন খারাপ করে বলতেন, লোপানি, ব্যথা পাইছস?
হি হি হি। আহা, কীসব দিন! কীসব ভাল লাগা কবিতা! জীবনানন্দ দাশের কবিতাটা পড়ে মনটা আরও খারাপ হলো:
“একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষূর বিছানার কিনারে।”
আবার কি ফিরে আসব না পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষূর বিছানার কিনারে।”
রত্মেশ্বর হাজরার এটাও কেমন মন উদাস করে দেয়:
“মৃত্যু ও মৃতের অধিকার নিয়ে সে
একবার সভাও ডেকেছিল ময়দানে
যদিও সেই সভায় সে নিজে ছাড়া উপস্থিত ছিল
বাতাস
বিকেল বেলার রোদ
মাঠের নির্জনতা
আর বিস্ময়।”
একবার সভাও ডেকেছিল ময়দানে
যদিও সেই সভায় সে নিজে ছাড়া উপস্থিত ছিল
বাতাস
বিকেল বেলার রোদ
মাঠের নির্জনতা
আর বিস্ময়।”
রনজিৎ দাসের এই কবিতাটা কী অদ্ভুত:
“শুঁয়োপোকাটির সঙ্গে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছি, ঠিক তারই মত
স্থূল ও মন্থর, ও পাখিদের খাদ্য হয়ে, আত্মবিষসহ
যদি তার মতো কোন অবিশ্বাস্য রূপান্তর পেয়ে যাই শুধু এই লোভে।”
স্থূল ও মন্থর, ও পাখিদের খাদ্য হয়ে, আত্মবিষসহ
যদি তার মতো কোন অবিশ্বাস্য রূপান্তর পেয়ে যাই শুধু এই লোভে।”
লোপা পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছে। ক্রমশ মনটা ভালো হয়ে আসছে। দুম করে নিজের অজান্তেই অনেক ক-টা বছর পেছনে চলে গেছে। কত হাবিজাবি প্রসঙ্গই না লিখে রেখেছে! হি হি হি।
লিখে রেখেছে, কী কী করলে একজনকে মহাপাতক বলা যায়? মহাপাতক:
এক, ব্রহ্মহত্যা
দুই, ব্রহ্মস্বাপহরণ
তিন, সুরাপান
চার, গুরুপত্মীহরণ
পাঁচ, মহাপাতকী সংসর্গ
আচ্ছা, ব্রহ্মহত্যা মানে কি? ব্রাক্ষণকে হত্যা করা? ব্রহ্মস্বাপহরণ, এইটারই বা অর্থ কী! সুরাপান বোঝা গেল, মদ্যপান। কিন্তু গুরুপত্মীহরণ, গুরুর পত্মীকে নিয়ে পলায়ন। সর্বনাশ, আগে কী কেউ গুরুর পত্মীকে নিয়ে ভেগে যেত নাকি? ছি-ছি, এ তো বিরাট অন্যায়! কেউ এমনটা ভাবে কেমন করে? শিক্ষকের স্ত্রীর সঙ্গে...ভাবতেই ওর গা গুলাচ্ছে।
মহাপাতকী সংসর্গ, মহাপাতকীর কাছ থেকে দূরে থাকা- উহুঁ, হবে কাছে থাকা? আচ্ছা, মহাপাতকীর সংজ্ঞা কী? এটার অর্থ এখন কোথায় পাওয়া যাবে? দূর ছাই!
রাব্বিকে ফোন করে জিজ্ঞেস করবে? মনে হয় না ও বলতে পারবে। তারচে বড় কথা, বিরক্ত হবে, চরম বিরক্ত। অফিসে ফোন করা ও একদম পছন্দ করে না। ব্যস্ত থাকলে না ধরলেই হয় তাই বলে অফিসে ফোন করা যাবে না কেন? অফিস কী ওর মাথা কিনে নিয়েছে! একজন চাকরি করলেই অফিস আওয়ারে কয়েক মিনিটের জন্যও তার নিজস্ব সময় থাকবে না? এর মানে কী! লোপা ঠিক করল ও ফোন করবেই, রাব্বি বিরক্ত হলে হবে। দেখা যাক।
অনেকবার রিঙ হওয়ার পর রাব্বি ধরল। কোন এক বিচিত্র কারণে ওর মনটা আজ তরল।
রাব্বির উৎফুল্ল গলা, হ্যালো হানি।
কি বললা?
যা শুনলা।
ফাজলামি করছ নাকি?
দূর-দূর! ফাজলামি করব কেন! কেউ কী বউয়ের সাথে ফাজলামি করে। ফাজলামো করতে হয় অন্য মেয়েদের সাথে।
লোপা বিরক্ত গলায় বলল, শস্তা রসিকতা করবে না। শুনতে ভালো লাগছে না। বস্তি-বস্তি লাগছে।
সত্য কথা বললে দোষ, এটা কি ঠিক?
হ্যা, ঠিক।
আচ্ছা যাও, বলব না। এখন বলো কেন ফোন করেছ। একটু পরে একটা মিটিং আছে।
আচ্ছা, তোমরা কী সারা দিন মিটিং-এর উপরই থাকো। কাজ করো কখন?
আরে, এ বলে কী! কাজ আবার কী! মিটিংই তো কাজ। আমাদের এখানে একটা কথা চালু আছে। কোন কাজ না থাকলে চলো একটা মিটিং ডাকি। আর আমাদের অফিসে একটা মাদারি-বস আছে, বুঝলে। এ কয়বার হাগা করবে এটার জন্যও মিটিং ডেকে বসে থাকে। মিটিং ডেকে সোজা বাথরুমে ঢুকে পড়ে। এ মনে হয় দক্ষিণহস্ত ব্যবহারে পারদর্শী।
মানে?
দক্ষিণহস্ত-। থাক, এটা তোমাকে বলা যাবে না।
কেন বলা যাবে না।
এটা একটা কুৎসিত কথা।
তোমার কুৎসিত কথা বলার প্রয়োজন কী!
ইয়ে, মানে-।
লোপার বিরক্তি বাড়ছে, তোমার মুখে বস্তি-মার্কা কথা শুনতে ভাল লাগে না।
রাব্বি বলল, আচ্ছা বেশ, বলো ফোন করেছো কেন?
তুমি মহাপাতকী কাকে বলে জানো?
আজিব, তুমি মহাপাতকী কাকে বলে এটা জানার জন্য ফোন করেছো?
হুঁ।
না, মহাপাতকী জানি না তবে মহাপাতকের খোঁজ দিতে পারি।
লোপা আগ্রহী গলায় বলল, কেমন?
আমাদের অফিসের সৈয়দ হচ্ছে একজন আপাদমস্তক মহাপাতক। আরে, ওই মাদারিটা আর কী, আমার বস!
আবারও ফাজলামো করছ।
আরে না, সত্যি। এ যদি মহাপাতক না হয় আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে গু সাফ করব। টাটকা গু।
রাব্বি, তোমার সাথে কথা বলাই ভুল।
বিশ্বাস করো, আমি বাড়িয়ে বলছি না। অফিসের পিয়নকে দিয়ে সিগারেট আনিয়ে পয়সা দেয় না। শুয়োরটার নাকি মনে থাকে না। কুত্তাটা একদিন করল কি-
রাব্বি, তোমাকে না বলেছি আমার সঙ্গে কুৎসিত কথা বলবে না, বলিনি?
আচ্ছা যাও, বলব না। আচ্ছা শোনো ওই কুত্তাটা একদিন করেছে কি-।
রাব্বি, খবরদার আর একটা ফাজিল কথা বলবে না।
আচ্ছা যাও, বলব না।
আমি কয়েকটা বইয়ের নাম বলে দেই, তুমি কি আসার সময় নিয়ে আসতে পারবে?
পাগল, আমি কোথায়-কোথায় গিয়ে বই খুঁজব। আমাদের অফিসে ঢাউস-ঢাউস প্রচুর বই আছে। চাইলে এগুলো নিয়ে আসতে পারি।
লোপা খানিকটা আগ্রহী হয়ে বলল, কি বই?
এই মার্কেট রিসার্চের উপর বিখ্যাত লেখকদের বই। দাঁড়াও তোমাকে লেখকের নামটা বলি-।
লোপা ফোন রেখে দিল। রাগে ওর শরীর চিড়বিড় করছে। রাব্বির এইসব আচরণ ওর অসহ্য লাগে। মানুষটার মধ্যে সামান্যতম ঔচিত্য বোধ নেই!
লোপা রেখে দেয়া বইটা আবার পড়া শুরু করল, পাতাটা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়নি। এতক্ষণ চুলের কাটাটা খুঁজে পাচ্ছিল না এখন বইয়ের মাঝে পেল। জমাটি গল্প কিন্তু কেন যেন পড়া এগুচ্ছে না। ওর মনটা বিক্ষিপ্ত এটা একটা কারণ হতে পারে, আবার এ-ও হতে পারে লেখায় ওকে ধরে রাখার ক্ষমতাটা লেখকের নাই।
*জীবনটাই যখন নিলামে: ১
No comments:
Post a Comment