কুশী [১] বেদম কাশছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। এসি না চালালে ভাল হতো কিন্তু জানালা খুলে দিলে ধুলায় ওর আরও কষ্ট হবে।
রহমত খুব আশাবাদী, ‘সার, চিন্তার কিছু নাই। হরতাল হইলেও বাবুর অসুখ বললে কেউ কিছু কইব না। ফিসাবিলিল্লাহ। টাইট হইয়া বইস্যা থাকেন।’
রহমতের আশ্বাস ফারাকে মোটেও প্রভাবিত করেনি। সে বেশ খানিকটা ভীত-সন্ত্রস্ত। শাহেদ ভোর থাকতেই বেরিয়ে পড়েছে। ক্ষীণ আশা, হরতালে যারা পিকেটিং করে এরা এত ভোরে উঠবে না। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ভালভাবেই পার হলো। ভৈরব ঢোকার মুখে আটকে গেল। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে, কালো ধোঁয়া পাক খাচ্ছে। সম্ভবত টায়ারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
রহমত উদগ্রীব হয়ে বলল, ‘সার, হর্ন বাজায়া স্পীড বাড়ায়া দিব?’
শাহেদ আঁতকে উঠল, ‘না-না বলো কি!’
রহমত জটলার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, সার, গাড়ি থামাব।’
‘হু।’
রহমত গাড়ি না-থামালে বিপদে পড়ত। টায়ার-টিউব, ছোট-ছোট গাছের গুড়ি ফেলে রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। খুব কাছে না আসলে বোঝার উপায় নেই।
‘রহমত একদম মাথা গরম করবে না। নরোম হয়ে কথা বলবে।’
রহমত গ্লাস নামিয়ে মাথা বের করলে, জটলা থেকে নেতা টাইপের একজন এগিয়ে এল, ‘বিষয় কি, যান কই?’
রহমতের নম্র গলা, ‘ভাই একটু ঢাকা যামু।’
‘মিঞা, তুমি কি বাংলাদেশ থাহো না?’
‘ভাই, বিপদে পইড়া যাইতাছি।’
‘কিসের আবার বিপদ, রঙে বাইর হইছ।’
রহমত গাড়ির দরোজা খুলে ওই লোককে টেনে একপাশে নিয়ে গেল। অনেকক্ষণ লাগিয়ে গুজুর-গুজুর করল। একসময় হাসি মুখে ফিরে এল, ইগনেশন কি ঘুরিয়ে বলল, ‘সার, রওয়ানা দেই।’
শাহেদের বিস্মিত গলা, ‘রহমত, কি করলে বুঝলাম না!’
‘সার, একশো টাকা দিছি।’
‘কিসের জন্য!’
ওরা বলল সকাল থেকে রাস্তা পাহাড়া দিতাছে। নাস্তাও নাকি করেনি। তো, আমি বললাম ভাই আপনার মনে কষ্ট না নিলে আমি আপনেদেরকে নাস্তা করাই।’
‘তা তুমি নাস্তা করালে!’
রহমত একগাল হাসল।
ভৈরব পার হয়ে আবার দাঁড়াতে হলো, কিছু ছেলে চা-র দোকানের টুল-টেবিল জোড়া দিয়ে রাস্তার মাঝখানে বসে গল্প-গুজব করছে। গাড়ি দাঁড় করাবার পরও ছেলেগুলো নির্বিকার। ভাবখানা এমন, রাস্তা এখানেই শেষ।
রহমত বিনম্র গলায় বলল, ‘ভাই, আমরা একটু ঢাকা যাব।’
একটা ছেলে উদাসীন হয়ে বলল, ‘যান, হেঁটে যান। একটু কষ্ট করেন।’
অন্য ছেলেরা হইহই করে উঠল। রহমত ফিসফিস করে ছেলেটিকে কি যেন বলল। ফিরে এসে শাহেদকে বলল, ‘দুশোর কমে মানল না, সার।’
শাহেদ অন্যমনস্ক, ‘ঠিক আছে। এখন যেতে পারবে তো।’
যে ছেলেটি কথা বলছিল, ওই ছেলেটি গাড়ির কাছে এগিয়ে এল। শাহেদের বুক কেঁপে উঠল। তরুন রাগী যুবক, এদের বোঝা বড় দায়। যুবকটি ভব্যতার সীমা লঙ্ঘন না করে জানালায় নক করল। শাহেদ পাওয়ার উইন্ডো জানালার কাঁচ নামিয়ে মুখ বাড়াল।
‘ভাইজান, ঢাকা পর্যন্ত তো যেতে পারবেন না। ’
শাহেদ দুঃখিত গলায় বলায়, ‘বুঝলেন, আমার বাচ্চাটার না খুব অসুখ, না গিয়ে আমার কোন উপায় নেই।’
যুবকটি এবার ভাল করে কুশীর দিকে তাকাল। কুশী জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। সমস্তটা মুখ আগুনের মত গনগনে লাল। যুবকটি সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘জিস...ক্রাইস্ট!’
এবার মায়াভরা গলায় বলল, ‘প্রার্থনা করি আপনি বাবুটাকে নিয়ে ভালয় ভালয় দ্রুত ঢাকা পৌঁছান। এই জনি, শুয়োরের বাচ্চা, টাকা ফেরত দে।’
শাহেদরা জোরাজুরি করেও টাকা গছাতে পারল না।
টঙ্গীর কাছে এসে শাহেদ বিমূঢ়। লোকে গিজগিজ করছে। একচুল ফাঁক নেই। অদূরে কিছু পুলিশও টহল দিচ্ছে।
রহমত গ্লাস নামিয়ে নেতা গোছের একজনকে বলল, ‘ভাইজান, আমরা একটু ঢাকা যামু।’
‘কুত্তার ছাও, নাইম্যা কথা ক।’
রহমতের দরোজা খুলে নামতে খানিকটা দেরী হওয়ায় লোকটা ওর গালে চড় কষিয়ে বলল, ‘এইবার ক, কি হইছে।’
রহমত ভয়ের চোটে তোতলাতে শুরু করল, ‘সার-সারের বাচ্চারে ডাক্তার দেখাইব। ’
‘তোর সার কি লাটসাব, গাড়ি থিক্যা নামতে ক।’
রহমত গাড়ির কাছে এসে বলল, ‘সার, একটু নামেন, ঝামেলা করতাছে।’
শাহেদ নেমে এসে নিচুস্বরে বলল, ‘ভাই কি হয়েছে?’
‘কিসু হয় নাই, হইব। আপনের মেয়েছেলেরে নামতে কন।’
শাহেদকে কিছু বলতে হলো না, ফারা আঁচ করতে পেরেছে। কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। কুশীকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে দ্রুত নেমে এল।
শাহেদ কেবল তাকিয়েই রইল। একজন মোটা লাঠি দিয়ে উইন্ড শীল্ড-এ আঘাত করল। কাঁচ ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে। কুশী কাঁচ ভাঙ্গার প্রচন্ড শব্দে জেগে উঠে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। ওর দ্রুত শ্বাস পড়ছে। মুখ হাঁ করে রেখেছে। শাহেদ পুলিশদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘প্লিজ, আপনারা কিছু একটা করেন, প্লিজ।’
পুলিশদের মধ্যে থেকে একজন রাগী গলায় বলল, ‘হরতালের মধ্যে গাড়ি বের করেন আবার প্লিজ প্লিজ করেন।’
‘আমার বাচ্চাটা অসুস্থ। ঢাকা নিয়ে যাচ্ছি চিকিৎসার জন্য, বাবা হিসাবে....।’
শাহেদ আর বলতে পারল না। ওর গলা ভেঙ্গে গেছে, চোখের পানি লুকাবার জন্য অন্যদিকে মুখ ফেরাল। কুশীর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। গণতন্ত্রের শিশুর চোখের দৃষ্টি কী তীব্র! শাহেদ দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল।
...
এই লেখাটা যখন লিখি তখন হরতাল ডাকতেন শেখ হাসিনা। তখন হরতালের নামে একটা মানুষকে উলঙ্গ [৩] করে ফেললেও সমস্যা ছিল না।
শেখ হাসিনার লোকজনরা এখন বলছেন, হরতাল একটি অকেজো ও মরচে পড়া অস্ত্র! অথচ এরাই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর [৪] হরতাল করে গেছেন। গণতন্ত্রের নামে!
নেতার ছবি পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন হয় না কেবল কুশী নামের গণতন্ত্রের শিশুটির চোখের চাহনি। সেই তীব্র দৃষ্টির দিকে চোখ রাখার ক্ষমতা এদের কোথায়?
এখন গণতন্ত্রের এই অস্ত্রটা নিয়ে এসেছেন খালেদা জিয়া। তিনি আগামী মাসের ২৭ জুন সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছেন। আহারে, এঁদের দেশের জন্য কী মায়া! গণতন্ত্রের চারাটা নইলে শুকিয়ে যাচ্ছে যে।
আচ্ছা, আপনারা হরতাল না করে অনশন করেন না কেন? দেশেরও উপকার হলো, শরীরেরও।
বাহ, আপনি আপনার একটা মুখের কথায় গোটা দেশটাকে একটা কারাগার বানিয়ে ফেলবেন। আমাদের গায়ে গা ঘিনঘিনে শুঁয়োপোকাটা [২] ছেড়ে দেবেন। কী মজা, না?
আমাদের দেশের দুর্ধর্ষ জাজরা কত তুচ্ছ বিষয়ে সুয়োমোটো রুল জারি করেন, পারেন না কেবল হরতার নিয়ে কোন রুল জারি করতে।
আমাদের দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বগলে সংবিধানের বই চেপে, সংবিধান গেল রে বলে বুক চাপড়ে মাতম করেন।
আমাদের দেশের হিউম্যান রাইটসের লোকজনরা কাঁদতে কাঁদতে আন্ডার গার্মেন্টস ভিজিয়ে ফেলেন, কতো তুচ্ছ বিষয়ে দুম করে মামলা ঠুকে দেন; পারেন না কেবল হরতাল নিয়ে একটা মামলা করতে।
আমাদের দেশে জাফর ইকবালের মত মানুষরা শিক্ষা বিভাগকে হরতালের আওতামুক্ত চান। মিডিয়ার লোকজন মিডিয়া বিভাগ! গণতন্ত্রের নামের এই লেবেনচুষ মুখে দিয়ে এই দেশের সমস্ত লোক বসে থাকেন। বাহ, কী একেজন সেরা সন্তান! 'পায়ে লাগু'- কদমবুসি করি আপনাদের।
আপনি সবাইকে গণতন্ত্রের লেবেনচুষ খাওয়ান, আমি আপনার এই লেবেনচুষ খেতে আগ্রহী না। আপনার হরতালের এই আহ্বান-নির্দেশ আমি মানি না। ২৭ জুন আমি বেরুব, পারলে আপনি ঠেকান। আমি জানি, আপনার বিশাল চেলা-চামুন্ডাদের পক্ষে আমাকে আটকানো, পিটিয়ে মেরে ফেলা ডালভাত। তাতে কী আসে যায়! আমার গলিত শব থেকে জন্ম নেবে অসংখ্য সত্যিকারের যোদ্ধা। যাদের অস্ত্রে থাকবে সূর্যের আলোর ঝলকানি। তাসের ঘরের মত উড়ে যাবেন আপনাদের মত দেশপ্রেমিক(!)
সহায়ক লিংক:
১. কয়েদী, ৩: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_19.html
২. গা ঘিনঘিনে শুঁয়োপোকাটা: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_3036.html
৩. কয়েদী, ২: http://www.ali-mahmed.com/2009/02/blog-post_18.html
৩.কয়েদী, ১: http://www.ali-mahmed.com/2007/06/blog-post_5073.html
No comments:
Post a Comment