উপবন ট্রেনটা সিলেট স্টেশন থেকে ছেড়েছিল কাঁটায় কাঁটায় দশটায়। ভোর পাঁচটার দিকে ঢাকা পৌঁছার কথা। ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিল। আখাউড়া জংশন পৌঁছতেই ভোর ছ’টা বেজে গেল। ওদের টিকেট শোভন চেয়ার কোচের কিন্তু বগিগুলো প্রায় ফাঁকা। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্টেশনে লোকজন নেমে গেছে। আখাউড়া এসে সেই যে ট্রেন দাঁড়াল আর নড়াচড়া নেই।
সাকিব শূণ্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। লুবাবা ইচ্ছার বিরুদ্ধে সাকিবকে পাঠিয়েছিল স্টেশনে খোঁজ নিয়ে আসতে। সাকিব ফিরে এসেছিল শুকনো মুখে, চোখে ভীত দৃষ্টি।
লুবাবা ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল, জিজ্ঞেস করলে ট্রেন ছাড়ছে না কেন, হরতাল তো শুরু হয়ে গেছে।
হুঁ।
আঃ সাকিব, কি হয়েছে বলো!
টঙ্গির কাছে রেললাইন উপড়ে ফেলেছে, ট্রেন আর যাবে না।
ক্কি, কি বলছ এসব!
হুঁ।
ট্রেন টঙ্গি পর্যন্তও যাবে না?
না। ওরা বলছে দু-স্টেশনের মাঝখানে আটকা পড়লে নিরাপত্তার সমস্যা হবে।
লুবাবার মত শক্ত মেয়েও ভেঙে পড়ল। হায় হায় এখন কি হবে? ট্রেনের গার্ড এসে বলল, সার, আপনাদের তো নেমে যেতে হবে।
সাকিব অবাক হল: কেন নামব কেন?
ট্রেনের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে তালা মারতে হবে। এভাবে খোলা রাখলে ট্রেনটার তো লোকাল ট্রেন থেকেও খারাপ অবস্থা হবে। সিট-ফিট সব খুলে নিয়ে যাবে।
সাবিক চেঁচিয়ে উঠেছিল: পেয়েছেন কি আপনারা, মগের মুল্লুক, সময়মত ট্রেন পৌঁছাতে পারেন না আর এখন বলছেন নেমে যেতে হবে। হোয়াই, কি করবেন, জোর করে নামিয়ে দেবেন? নামান তো দেখি, ইয়েস-ইয়েস। টাচ মি, টাচ মি নাউ। গায়ে হাত দিয়ে দেখুন, দিন না, দিন না গায়ে হাত।
লুবাবা জোর করে সাকিবকে বসিয়ে দিল। নরোম গলায় বলল: গার্ড সাহেব, প্লিজ ওর আচরণে কিছু মনে করবেন না, ওর মার খুব অসুখ। খবর পেয়ে আমরা ঢাকা যাচ্ছিলাম। প্লিজ, গার্ড সাহেব, প্লিজ, আপনিই দয়া করে বলুন আমরা এখন কি করব?
গার্ড সাহেব আর্দ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। অল্পক্ষণ ভেবে বললেন: আমার ক্ষমতায় থাকলে আপনাদেরকে ঢাকায় পৌঁছে দিলাম কিন্তু আমি নিরুপায়, সে উপায় নেই। আপনাদের কোথায় যে থাকার ব্যবস্থা করি? আমি তো থাকব রানিং রুমে। পুরুষ হলে সমস্যা ছিল না আপনাকে নিয়েই সমস্যা।
লুবাবা বলল: এখানে ভাল হোটেল আছে না?
গার্ড সাহেব একজনকে হোটেলের খোঁজে পাঠালেন। সে ফিরে এলে জানা গেল আজেবাজে ধরনের যে দু-একটা হোটেল আছে ওগুলোতেও জায়গা নেই। গার্ড সাহেব প্রচুর ছুটাছুটি করেও কোনো ব্যবস্থা করতে পারলেন না। দেখে লুবাবার মায়াই হচ্ছিল। শেষ পর্যায়ে গার্ড সাহেব করুণ গলায় বললেন: আফসোস, আপনাদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না।
লুবাবা ইতস্তত করে বলল: ভাই, আমরা এই রেলের কামরায় থাকলে আপনার কি খুব সমস্যা হবে?
গার্ড সাহেব গর্জে উঠলেন: হলে হবে, কি আর হবে ঘোড়ার ডিম, বেশি-বেশি চাকরি চলে যাবে। আপনারা এক কাজ করেন, এই কামরায় না থেকে প্রথম শ্রেণীর স্লিপিং কোচে চলে যান। আরামে থাকবেন এবং ওই কামরা এটার চেয়ে সেফ। ট্রেনের দরজা জানালা আমি বন্ধ করিয়ে দিচ্ছি।
এবার সাকিবের দিকে ফিরে বললেন: একটা চাবি আপনাকে দিয়ে যাব ডাইনিং কার দিয়ে আপনি খুলে ঢুকতে এবং বেরুতে পারবেন। অন্য দিক থেকে বের হলে লোকজন কৌতুহলী হবে। এমনিতে কোনো সমস্যা নেই তবুও সতর্ক থাকা উচিত। শক্ত হন, সাহস হারাবেন না। কোন-না-কোন একটা রাস্তা বেরুবে। সুযোগ করে আমি আপনাদের খোঁজ-খবর নেব। অন্য কোনও ব্যবস্থা হলে সঙ্গে সঙ্গে খবর দেব। রাফার চিবুক নেড়ে খুব আদর করে বললেন: খুকি, এখন গোটা বাড়িটা তোমার। যাও, তোমাকে দিয়ে দিলাম, হা হা হা।
দু-দিন ধরে এই রেলের বগিটাই ওদের থাকার জায়গা। মাঝে-মাঝে সাকিবের দমবন্ধ হয়ে আসে, মনে হয় শ্বাস নিতে পারছে না। আজ সকালেও যখন সিগারেট খাচ্ছিল, তখন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। সিগারেটের ছাইগুলো বাম হাতের তালুতে জমাচ্ছিল। কেউ হঠাৎ করে দেখলে ভাববে হয়তো মেঝে অপরিস্কার হবে এ কারণে মেঝেতে ফেলছে না।
আসল ঘটনা হচ্ছে, পেস্ট নেই, দাঁত মাজা যাচ্ছে না। ছাই দিয়ে দাঁত ঘসালে অনেকখানি পরিস্কার হয়। লুবাবাকে অনেক বলে-কয়েও সিগারেটের ছাই দিয়ে দাঁত মাজতে রাজি করানো যায়নি। ওর নাকি বমি আসে। আজ ডাইনিং কারের লোকজন কাউকে টাকা দিয়ে বলতে হবে, একটা পেস্ট কিনে নিয়ে আসার জন্য।
সাকিব দাঁত ঘসাচ্ছে, দরদর করে ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ে ছাই পানিতে মাখামাখি। রায়হান পরিষ্কার করে কিছু বলল না, মা কি গুরুতর অসুস্থ, নাকি...? মাকে কি শেষ দেখাটা দেখা যাবে না। অ আল্লা-অ আল্লা, এই শাস্তিটা আমাকে দিও না, আল্লা।
গার্ড সাহেব তার সাধ্যাতীত করার চেষ্টা করেছেন। ডাইনিং কারের লোকজনরা নিজেদের জন্য রান্না করবে। ওদের জন্যও তিনবেলা রান্নার ব্যবস্থা করতে বলেছেন। ডাইনিং কারের লোকদের খাবারের দাম দেয়া যাচ্ছে না। গার্ড সাহেব নাকি পইপই করে নিষেধ করে গেছেন, খাবারের দাম ওঁর নামে লেখা হবে।
পরদিন গার্ডসাহেব খোঁজ নিতে এসেছিলেন, সাকিব টাকার প্রসঙ্গ উঠাতেই গার্ড সাহেব হা হা করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন: আরে ভাই, সময় হোক দেখবেন জোঁকের মত লেগে টাকা আদায় করব।
আজ সকালেও এই প্রসঙ্গ নিয়ে সাকিব জোরাজুরি করলে গার্ড সাহেব মন খারাপ করা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেনন, আজ এখানে আমার বাসা থাকলে, তখনও কি আপনারা আমার বাসা থেকে যাওয়ার সময়ও খাবারের দামটা দিয়ে যেতেন।
এরপর সাকিব একটা টুঁ-শব্দও করেনি। হাত বাড়িয়ে এই ভাল-মানুষটাকে হাত ধরে ছলছল চোখে কেবল বলেছিল: জানেন আমার মা না মারা যাচ্ছে। আমি মার কুসন্তান তো তাই মা চাচ্ছে না তাঁকে শেষ দেখাটা দেখি।
*রেল-বাড়ি, ১:http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_7540.html
আমি কোথাও লিখেছিলাম, "ফিকশনের জন্ম রিপোর্টিং-এর গর্ভে"।
সালটা আমার মনে নেই। তখন পরিবহণ ধর্মঘটের নামে সম্ভবত টানা ২২ দিন হরতাল চলছিল। ছোট্ট একটা রেল-স্টেশনে একটা পরিবার আটকা পড়েছিলেন, বাচ্চাসহ। এঁরা ২দিন রেলের একটা কামরায় আটকে ছিলেন। আমি যখন এটা শুনি, তখন আর এঁদের গিয়ে পাইনি। কেউ তেমন ভালো খোঁজ-খবর দিতে পারল না, এরা কেমন করে, কোথায় গেলেন। আমাদের এতো সময় কোথায়। বড়ো কষ্ট হচ্ছিল তখন- গোটা এলাকায় হাজার-হাজার মানুষ কিন্তু আমার নিজেকেই কেন যেন নগ্ন মনে হচ্ছিল
আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, ওই পরিবারটির অনুভূতির কথা জানা- কেবল চোখ বন্ধ করে খানিকটা ভাবার চেষ্টা করা।
২৭ জুন হরতাল ডাকা হয়েছে। আমি আরেকটা "রেল-বাড়ি" দেখতে চাই না। আগের পোস্টে বিস্তারিত বলেছি, চর্বিতচর্বণ আর করি না। গণতন্ত্রের লেবেনচুষ: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_22.html
এক কথায় বলি, আপনাদের হরতাল আমি মানি না। আমাকে কয়েদী বানাবার অধিকার আপনাদেরকে দেই না।
No comments:
Post a Comment