'ইশ্বরের বিশেষ সন্তানদের ইশকুল' [১] নিয়ে পূর্বে যে পোস্টটা করেছিলাম ওখানে আমার একটা খেদ ছিল নার্গিসের ছবি উঠানো হয়নি বলে। আজ এই সুযোগটা চলে আসে।
বাচ্চাদের স্কুল ড্রেস বানানো হবে, কাপড় সেলাইয়ের মাস্টারকে সাথে নিয়ে গেছি। আজ গিয়ে দেখি বাচ্চা আরেকজন বেড়েছে, সর্বসাকল্যে গিয়ে দাঁড়াল ২৪ জন।
উল্লেখ করেছিলাম, এখানকার সমস্ত বাচ্চাদের বাবা-মা অন্ধ কিন্তু বাচ্চাগুলো স্বাভাবিক, দেখতে পায়।
কেবল নার্গিসই ব্যতিক্রম, ও দেখতে পায় না। কিন্তু ওর শেখার আগ্রহের শেষ নাই!
এমনিতে এখানকার বাচ্চাগুলো আমাকে বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে। আজও এরা আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। মাথা গুণে একটা চকলেট বেশি রেখে নেয়ার জন্য বলেছিলাম, ঠিক ঠিক একটা রয়ে যায়।
গতবার বলে আসা গল্পটা চমৎকার করে বলতে পারে।
স্কুল চালু হয়েছে ৪/৫ দিন হবে, এখন পর্যন্ত এরা মাত্র ৪টা বর্ণমালা শিখেছে। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, উল্টাপাল্টা যে কোন বর্ণমালা জিজ্ঞেস করলে অধিকাংশ বাচ্চাই সঠিক উত্তরটা দিতে পেরেছে। সালমা নামের টিচার, ক্লাশ এইট পড়ুয়া পিচ্চি মেয়েটার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। যেটা দেড় মাসেও হরিজন পল্লীর বাচ্চাদের মাস্টার মশাই শেখাতে পারেননি!
আজ সঙ্গে রঙ-পেন্সিল নিয়ে গিয়েছিলাম। এদের সবাইকে কাগজ দিয়ে বললাম, যে যা পারো আকোঁ। এরা জীবনের এই প্রথম রঙ পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকবে।
নার্গিসকেও আমি অবশ্যই দিতাম কিন্তু ও আগ বাড়িয়ে হইচই শুরু করে। এখানকার দু-এক জন বাচ্চা ফট করে বলে বসে, হে চোখে দেখে না, হে কি আঁকব।
আজ এই প্রথম এখানকার এই বাচ্চাদের ধমক দেই। টিচারকে বলে দেই, নার্গিসের প্রতি যেন আলাদা করে খেয়াল করে। এবং আজকের পর এখানকার কোন বাচ্চা যেন এই ধরনের কথা না বলে যে, ও তো এটা পারবে না কারণ ও চোখে দেখে না।
কিন্তু নার্গিস যখন বলে, আমি কি আকুম? আমার মনটা অহেতুক খারাপ হয়ে যায়, জীবনে কত অকাজের জিনিস শিখলাম কিন্তু এই বাচ্চাটাকে শেখাবার মত কোন শিক্ষা কেন শিখলাম না! আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। এই বাচ্চাটাকে আমি কি আঁকতে বলব? অন্ধকার? এ তো কিছুই দেখেনি, এর ভুবনে অন্ধকার ব্যতীত কোন কিছু দেখার স্মৃতি নাই- চারপাশে জ্যোৎস্নায় থই থই তবুও নিতল অন্ধকার। আমি একে কি আঁকতে বলব? এদিকে মেয়েটা যে বড়ো আশা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি নিরুপায় হয়ে বলি, নার্গিস, তুমি ফুল আঁকো। শোনো, এই দেখো, আমি তোমার হাত ধরছি, এই ভাবে গোল গোল করে আঁকবে তাহলে ফুল হবে। নার্গিস আঁকতে থাকে।
আমার ভাল লাগছিল না, কষ্ট হচ্ছিল। আমি দুর্বলচিত্তের মানুষ, শেষে এখানে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আমি বেরিয়ে আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করি। কী কান্ড, চারপাশটা এতো চমৎকার এটা এর আগে খেয়াল করিনি। জায়গাটা কী শান্ত- মনে হয় দিনভর এখানে কাটিয়ে দেয়া যেতে পারে! ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পেয়ারা গাছ, এদের একেকজনের ভাগে নাকি ২২টা করে পেয়ারা গাছ পড়েছে। পাশেই লাল মাটির উঁচু রাস্তা, দশ কদম গেলেই নাকি ভারতের সীমান্ত! আরেক দিন গেলে এই রাস্তা ধরে হাঁটব, বিএসএফ না আবার দুম করে গুলি করে বসে।
বলতে গেলে টিলার মাঝখানে স্কুলটা।
সবার আঁকা হলে আমি অবাক হই, যারা কখনও রঙ-পেন্সিল ছুঁয়ে দেখেনি এরা যা এঁকেছে আমার মত সাধারণ একজন মানুষকে মুগ্ধ করার জন্য যথেষ্ঠ। সবার আঁকা কাগজে যার যার নাম লিখে স্কুলের টিনের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়ার জন্য টিচারকে বলে আসি। পরবর্তীতে এরা স্কুলে ঢুকলেই যার যার শিল্পকর্মগুলো দেখবে।
কেবল নার্গিসের ছবিটা আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। মেয়েটাকে ইচ্ছা করে আমি সবুজ রঙ দিয়েছিলাম। এই গ্রহে কতো বিচিত্র ঘটনা ঘটে, আরেকটা ঘটলে আসমান একহাত নীচে নেমে আসবে এই দিব্যি কে দিয়েছে? এটা আশা করতে কে আমাকে আটকাচ্ছে, একদিন এই মেয়েটাও সবুজ দেখবে...।
সহায়ক লিংক:
১. ঈশ্বরের বিশেষ সন্তানদের ইশকুল: http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post_24.html
২. হরিজন পল্লীর ইশকুল: http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post_9016.html
2 comments:
আমি জানি না সবুজ যে আকিজুকি দেখা যাচছে ঐ টাই প্রিয় নার্গিসের ছবি তা নাকি। যদি ঐ টাই হ্য় তাহলে আমি বলব যে এই টা এক টা খুবই ভাল ছবি হইছে যদিও আমি ছবির আগা মাথা কিছুই বুঝি না। কিন্তু আমার কাছে ভাল লাগছে।
হ্যাঁ, এটা নার্গিসের ছবি।
ছবি কেমন হয়েছে এতে কি আসে যায়, আমি তো নার্গিসের চোখ দিয়ে দেখি, সবুজ, কী গাঢ় সবুজ, সবুজে থইথই করছে চারদিক...@nixon
Post a Comment