সকালে উঠে যে একটু আয়েশ করে চায়ে চুমুক দেব সে যো নেই, সময়ের পাগলা ঘোড়া ঘাড়ের উপর বসে আছে। এখুনি ছুটতে হবে আমাকে হোটেলে, ঝাড়া দুই দিন হয়ে গেছে আমার গোসল করা হয়নি। তাছাড়া জরুরি যেটা, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে আমার খানিকটা শ্বাসকষ্টও হচ্ছিল। শ্বাসকষ্টের ওষুধ-টষুধ সব হোটেলে, গাঁটরি-বোঁচকায়।
আরাফাতেরও অফিসের তাড়া। হক নামের সদাশয় মানুষটা আমাকে হোটেলে ড্রপ করবেন। পরে হোটেল থেকে ডয়চে ভেলের অফিসে আমার যাওয়ার জন্য কেউ একজন আবারও কষ্ট করবেন। আমার ভারী লজ্জা করছিল, আমার মত একজন যাচ্ছেতাই মানুষের জন্য এঁদের কী ঝামেলাটাই না যাচ্ছে! কী করব, এতে আমার হাত কি? কারও শরীরের কোন অংশ থাকে না, আমারও একটা অংশ নাই। আমার ব্রেন নাই। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, তাহলে তোমার লেখাগুলো কে লিখে দেয়? কেন কলম, হালের কী-বোর্ড', আমি কি আর লিখি, ছাই!
অনেকের কাছে এটা বড়ো হাস্যরসের যোগান দেয় কিন্তু আমার প্রাণ যায়। জার্মানি আসার পূর্বে দেশে আমার কিছু কেনাকাটা ছিল। ওখানেও সময়ের স্বল্পতা। আমার এক জুনিয়র বন্ধু জাকির। তার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল না কিন্তু সিনেমার মতই রাস্তায় দেখা হয়ে গিয়েছিল। তখন আমি একটা স্কুটার খুঁজছিলাম, ঢাকার স্কুটার যারা চালান তাঁরা একেকজন লাটসাহেব। জাকিরের সঙ্গে গাড়ি থাকায় অসম্ভব সুবিধে হলো। সে বলল, আলী ভাই, আজিজ মার্কেটে গেলে আপনাকে আমি নিয়ে যাই?
যাই মানে, বলে কী ব্যাটা! আমি তাকে বললাম, আমার কিছু জিনিস কিনতে হবে, তুমি সাথে থাকলে আমার সুবিধা হয়।
বেচারা মুখ শুকিয়ে বলল, আলী ভাই, আমার বউকে অফিস থেকে নিয়ে আসতে হবে। আপনি আমাকে ১ ঘন্টা সময় দেন, এই যাব আর আসব। এরিমধ্যে আপনি যা কেনার কিনে ফেলেন। রাতে কিন্তু আমরা একসাথে ডিনার করব।
আমি মনে মনে ঠান্ডা শ্বাস ফেলি, এই ১ ঘন্টা মানে তো আটটা, আটটায় তো আজিজের সমস্ত দোকান বন্ধ হয়ে যায়। তখন ওখানে আমি গিয়ে কী ঘণ্টাটা করব? আমার লেখালেখির সুবাদে আজিজ মার্কেটে আমাকে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে কিন্তু এখানকার সব আমি গুলিয়ে ফেলি। অতীতে এই নিয়ে অনেক কেলেংকারী হয়েছে [১]।
সে আমাকে এখানে নামিয়ে দেয়ার পর সব কেমন গোলমাল হয়ে যায়। সাড়ে সাতটা বাজে, হাতে সময় মাত্র ত্রিশ মিনিট। এই অল্প সময়ে আমি কি করব, বড়ো অসহায় লাগে নিজেকে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় দোকানদার আমাকে জানান, এই গেট এখন বন্ধ হয়ে গেছে আপনি ওই গেট দিয়ে নীচে যেতে পারবেন। আমি তাকে কাতর অনুরোধ করি, ভাইরে, কোন গেট, কি গেট বুঝতে পারছি না। আমার সঙ্গে একজন কাউকে দেন, সে কেবল আমাকে নীচে নামার রাস্তা দেখিয়ে দেবে। সেই মানুষটার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
যাই হোক, হোটেলে ফিরে খানিকটা আরামের শ্বাস ফেলি। হোটেলটাকে হোটেল-হোটেল মনে হয় না কেমন বাড়ি-বাড়ি ভাব! হোটেলটা কী নীরব! আমার ধারণা ছিল, তেমন কোন গেস্ট নেই। আমার ধারণটা ভুল, গেস্ট উপচে পড়ছে কিন্তু বাড়তি কোন শব্দ নাই। এরা দেখলাম শব্দের বিষয়ে ভারী সচেতন। কেউ গাড়ির হর্ণ বাজাচ্ছে না, বাজালে ধরে নিতে হবে সামনের গাড়িটার চালকের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করল, গালি দিল। পারতপক্ষে যেটা এরা করতে চায় না।
হোটেলের বাইরে বসার জায়গাটাও দেখলাম চমৎকার গুছিয়ে রেখেছে।
আমি আয়েশ করে বসে সিগারেট ধরাই। এখানে বসে সিগারেট খেতে কোন মানা নেই। বসে বসে চারপাশ দেখি। হঠাৎ নজর পড়ে আমার নিজের হাতের উপর। হায়-হায়, একি অবস্থা! আমি মানুষটা কালো কিন্তু এমন ঝিক কালো তো না! ঝিক কালো না বলে আলকাতরা বললে আমার জন্য বোঝাতে সুবিধে হয় কিন্তু তাই বলে আলকাতরা, ছ্যা।
চামড়া কেমন কুঁকড়ে আছে, রঙ হয়েছে আবলুশ কাঠের মত (আবলুশ কাঠ জিনিসটা আমি কখনও দেখিনি কিন্তু লেখার সময় কুচকুচে কালো বোঝাতে হলে এটা লেখার চল আছে)।
সমস্যটা খানিকটা বুঝতে চেষ্টা করি, সম্ভবত আবহাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে।
একটা পাখি এসে বসে। অবাক হই, যাক, এই দেশে তাহলে এখনও পাখি-টাখি আছে! দেশটা তাহলে পুরোপুরি যান্ত্রিক হয়ে উঠেনি! এই দেশে পাখি যখন আছে তখন মানুষগুলোর মনও নিশ্চয়ই পাথরসদৃশ হয়নি।
পাখিটা আমার সঙ্গে ফাজলামি শুরু করে, আমি এর ছবি উঠাবার জন্য চেষ্টা করলেই এ অন্যদিকে গিয়ে বসে।
আমি মনে মনে বলি, রসো, তুমি জার্মানির পাখি, ভাবছো তোমার বুদ্ধি বঙাল দেশের মানুষের চেয়ে বেশি?
লুকোচুরি খেলার সমাপ্তি ঘটে, পাখিটা ছবিতে আটকা পড়ে, আটকা পড়ি আমিও, দরোজার কাঁচে!
আমার মধ্যে গা-ছাড়া ভাব। তাড়া নেই। কারণ আরাফাত বলেছে, আমাকে নিয়ে যাবে। আর আমি মনে মনে বলি, আরাফাত আজ কাজের চাপে আটকা পড়ুক। অন্তত ট্রেন মিস করুক, বাস মিস করুক তবুও যেন এখুনি হোটেলে এসে না পৌঁছে। অন্য কারও কি দায় পড়েছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার। আমি খানিকটা আলস্যে গা ভাসিয়ে দেই।
কপালের ফের, আরাফাত কাজের চাপে ঠিকই আটকা পড়েছে কিন্তু ব্যবস্থা একটা ঠিকই করেছে। মায়াবতী এসে হাজির, এই সব জটিলতায় ওর আজ ক্লাশ বাদ পড়েছে। মায়াবতী তাড়া দেয়, এখুনি আমাকে ডয়চে ভেলের অফিসে যেতে হবে।
আবারও ছুট। যেতে যেতে. হাঁটতে হাঁটতে আমি বন শহরটাকে দেখি। দেখি এখানকার লোকজনকে। কোথাও কোন অসঙ্গতি চোখে পড়ে না, চোখে পড়লে আরাম পেতাম।
আবারও চরম বিরক্তি আসে, মিডিয়া ফোরামের উপর। এরা কোন বুদ্ধিতে এতো স্বল্প সময়ের জন্য টিকেট দিল? নাকি এদের বীমা কোম্পানির সঙ্গে আঁতাত আছে? আমাকে যে আসার সময় ত্রিশ হাজার ইউরোর বীমা করতে হয়েছিল কি এই জন্যে; আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসাখাতে ব্যয় হবে! :)
এই সব পুরনো স্থাপনা আমাকে খুব টানে। আমি নিজেও থাকি প্রায় ১০০ বছরের পুরনো একটা বাড়িতে। বাড়িটা বুড়া হয়ে গেছে, অনেক যন্ত্রণা দেয় কিন্তু আমি আমৃত্যু এই বুড়ার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছা প্রকাশ করি। আমার কেবল মনে হয়, এই বুড়ার দিকে যে রাস্তাটা গেছে এটা স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা [২]। তীব্র ইচ্ছা, এই বুড়ার কোলে মরতে চাই।
আমাদের নিজেদের কত স্থাপনা অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। পানাম নগরীতে [৩] গিয়ে আমার কান্না পেয়েছিল, হাতে ধরে আমরা আমাদের শেকড়গুলোকে কেমন করে নষ্ট করছি।
নাচঘরে আমি দেখেছিলাম গরু চড়তে। এই কষ্ট কাকে বলি, কোথায় রাখি। ময়নামতির হাজার বছর পূর্বের ইট দিয়ে দেখেছি গরুর খুঁটা বসাতে!
যাও অল্প স্থাপনাগুলো আছে সেইসব দেখার অনুমতি আমাদের মত সাধারণ মানুষদের নাই, এ এক অসভ্যতারই নামান্তর [৪]।
ব্রিটিশদের করা রেলওয়ের এই সব চমৎকার বাংলোগুলো [৫] সহসাই ভেঙে ফেলা হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
মায়াবতী আমাকে ডয়চে ভেলের অফিসে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেন। এখানে মডারেশন নিয়ে জানা এবং আমার একটা রেডিও সাক্ষাৎকার [৬] ছিল। এই সাক্ষাৎকার নিয়ে আমি খুব একটা আরাম বোধ করছিলাম না। কারণ কমিউনিটি ব্লগে আমি দীর্ঘ সময় লেখালেখি করি না। কারণ বিবিধ। দলাদলি বিষয়টা আমার ভারী অপছন্দের। যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পর্যন্ত [৭] দলবাজি করেন সেখানে আমার মত দলহীন একজন মানুষ এবং একটা কলাগাছের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। তাছাড়া কমিউনিটি ব্লগে একজনের অন্যজনের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা বোধ না থাকা। নো মডারেশনের নামে যা খুশি তা বলার স্বাধীনতা। কিন্তু এটা আমরা মনে রাখার চেষ্টা করি না, কলম হচ্ছে ছুঁরির মত। এখন ছুঁরিটা কার হাতে এটাও মূখ্য বিষয়। বানরের হাতে ছুঁরি থাকলে যা হওয়ার তাই হয়!
যাই হোক, যারা কমিউনিটি ব্লগে ব্লগিং করেন তাঁরা মডারেশন বিষয়ে আরও ভালো বলতে পারবেন। এবং কমিউনিটি ব্লগে যেটা আমরা মনে রাখার চেষ্টা করি না সেটা হচ্ছে ভলতেয়ারের চমৎকার সেই কথাটা:
"আমি তোমার সঙ্গে একমত না কিন্তু তোমার মত প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু লড়ব"।
*বৈদেশ পর্ব, এগারো: http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post_03.html
সহায়ক লিংক:
১. হায় ঢাকা: http://www.ali-mahmed.com/2009/08/blog-post_9358.html
২. বুড়া বাড়িটা: http://www.ali-mahmed.com/2009/11/blog-post_24.html
৩. পানাম নগর: http://www.ali-mahmed.com/2010/01/blog-post_10.html
৪. অসভ্যতারই নামান্তর: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_04.html
৫. 'গরিবারোগ': http://www.ali-mahmed.com/2009/02/blog-post_14.html
৬. মডারেশন নিয়ে রেডিও সাক্ষাৎকার: http://ht.ly/22gl0
৭. স্যাররা, দলবাজি বন্ধ করেন: http://www.ali-mahmed.com/2009/12/blog-post_19.html
আরাফাতেরও অফিসের তাড়া। হক নামের সদাশয় মানুষটা আমাকে হোটেলে ড্রপ করবেন। পরে হোটেল থেকে ডয়চে ভেলের অফিসে আমার যাওয়ার জন্য কেউ একজন আবারও কষ্ট করবেন। আমার ভারী লজ্জা করছিল, আমার মত একজন যাচ্ছেতাই মানুষের জন্য এঁদের কী ঝামেলাটাই না যাচ্ছে! কী করব, এতে আমার হাত কি? কারও শরীরের কোন অংশ থাকে না, আমারও একটা অংশ নাই। আমার ব্রেন নাই। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, তাহলে তোমার লেখাগুলো কে লিখে দেয়? কেন কলম, হালের কী-বোর্ড', আমি কি আর লিখি, ছাই!
অনেকের কাছে এটা বড়ো হাস্যরসের যোগান দেয় কিন্তু আমার প্রাণ যায়। জার্মানি আসার পূর্বে দেশে আমার কিছু কেনাকাটা ছিল। ওখানেও সময়ের স্বল্পতা। আমার এক জুনিয়র বন্ধু জাকির। তার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল না কিন্তু সিনেমার মতই রাস্তায় দেখা হয়ে গিয়েছিল। তখন আমি একটা স্কুটার খুঁজছিলাম, ঢাকার স্কুটার যারা চালান তাঁরা একেকজন লাটসাহেব। জাকিরের সঙ্গে গাড়ি থাকায় অসম্ভব সুবিধে হলো। সে বলল, আলী ভাই, আজিজ মার্কেটে গেলে আপনাকে আমি নিয়ে যাই?
যাই মানে, বলে কী ব্যাটা! আমি তাকে বললাম, আমার কিছু জিনিস কিনতে হবে, তুমি সাথে থাকলে আমার সুবিধা হয়।
বেচারা মুখ শুকিয়ে বলল, আলী ভাই, আমার বউকে অফিস থেকে নিয়ে আসতে হবে। আপনি আমাকে ১ ঘন্টা সময় দেন, এই যাব আর আসব। এরিমধ্যে আপনি যা কেনার কিনে ফেলেন। রাতে কিন্তু আমরা একসাথে ডিনার করব।
আমি মনে মনে ঠান্ডা শ্বাস ফেলি, এই ১ ঘন্টা মানে তো আটটা, আটটায় তো আজিজের সমস্ত দোকান বন্ধ হয়ে যায়। তখন ওখানে আমি গিয়ে কী ঘণ্টাটা করব? আমার লেখালেখির সুবাদে আজিজ মার্কেটে আমাকে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে কিন্তু এখানকার সব আমি গুলিয়ে ফেলি। অতীতে এই নিয়ে অনেক কেলেংকারী হয়েছে [১]।
সে আমাকে এখানে নামিয়ে দেয়ার পর সব কেমন গোলমাল হয়ে যায়। সাড়ে সাতটা বাজে, হাতে সময় মাত্র ত্রিশ মিনিট। এই অল্প সময়ে আমি কি করব, বড়ো অসহায় লাগে নিজেকে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় দোকানদার আমাকে জানান, এই গেট এখন বন্ধ হয়ে গেছে আপনি ওই গেট দিয়ে নীচে যেতে পারবেন। আমি তাকে কাতর অনুরোধ করি, ভাইরে, কোন গেট, কি গেট বুঝতে পারছি না। আমার সঙ্গে একজন কাউকে দেন, সে কেবল আমাকে নীচে নামার রাস্তা দেখিয়ে দেবে। সেই মানুষটার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
যাই হোক, হোটেলে ফিরে খানিকটা আরামের শ্বাস ফেলি। হোটেলটাকে হোটেল-হোটেল মনে হয় না কেমন বাড়ি-বাড়ি ভাব! হোটেলটা কী নীরব! আমার ধারণা ছিল, তেমন কোন গেস্ট নেই। আমার ধারণটা ভুল, গেস্ট উপচে পড়ছে কিন্তু বাড়তি কোন শব্দ নাই। এরা দেখলাম শব্দের বিষয়ে ভারী সচেতন। কেউ গাড়ির হর্ণ বাজাচ্ছে না, বাজালে ধরে নিতে হবে সামনের গাড়িটার চালকের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করল, গালি দিল। পারতপক্ষে যেটা এরা করতে চায় না।
হোটেলের বাইরে বসার জায়গাটাও দেখলাম চমৎকার গুছিয়ে রেখেছে।
আমি আয়েশ করে বসে সিগারেট ধরাই। এখানে বসে সিগারেট খেতে কোন মানা নেই। বসে বসে চারপাশ দেখি। হঠাৎ নজর পড়ে আমার নিজের হাতের উপর। হায়-হায়, একি অবস্থা! আমি মানুষটা কালো কিন্তু এমন ঝিক কালো তো না! ঝিক কালো না বলে আলকাতরা বললে আমার জন্য বোঝাতে সুবিধে হয় কিন্তু তাই বলে আলকাতরা, ছ্যা।
চামড়া কেমন কুঁকড়ে আছে, রঙ হয়েছে আবলুশ কাঠের মত (আবলুশ কাঠ জিনিসটা আমি কখনও দেখিনি কিন্তু লেখার সময় কুচকুচে কালো বোঝাতে হলে এটা লেখার চল আছে)।
সমস্যটা খানিকটা বুঝতে চেষ্টা করি, সম্ভবত আবহাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে।
একটা পাখি এসে বসে। অবাক হই, যাক, এই দেশে তাহলে এখনও পাখি-টাখি আছে! দেশটা তাহলে পুরোপুরি যান্ত্রিক হয়ে উঠেনি! এই দেশে পাখি যখন আছে তখন মানুষগুলোর মনও নিশ্চয়ই পাথরসদৃশ হয়নি।
পাখিটা আমার সঙ্গে ফাজলামি শুরু করে, আমি এর ছবি উঠাবার জন্য চেষ্টা করলেই এ অন্যদিকে গিয়ে বসে।
আমি মনে মনে বলি, রসো, তুমি জার্মানির পাখি, ভাবছো তোমার বুদ্ধি বঙাল দেশের মানুষের চেয়ে বেশি?
লুকোচুরি খেলার সমাপ্তি ঘটে, পাখিটা ছবিতে আটকা পড়ে, আটকা পড়ি আমিও, দরোজার কাঁচে!
আমার মধ্যে গা-ছাড়া ভাব। তাড়া নেই। কারণ আরাফাত বলেছে, আমাকে নিয়ে যাবে। আর আমি মনে মনে বলি, আরাফাত আজ কাজের চাপে আটকা পড়ুক। অন্তত ট্রেন মিস করুক, বাস মিস করুক তবুও যেন এখুনি হোটেলে এসে না পৌঁছে। অন্য কারও কি দায় পড়েছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার। আমি খানিকটা আলস্যে গা ভাসিয়ে দেই।
কপালের ফের, আরাফাত কাজের চাপে ঠিকই আটকা পড়েছে কিন্তু ব্যবস্থা একটা ঠিকই করেছে। মায়াবতী এসে হাজির, এই সব জটিলতায় ওর আজ ক্লাশ বাদ পড়েছে। মায়াবতী তাড়া দেয়, এখুনি আমাকে ডয়চে ভেলের অফিসে যেতে হবে।
আবারও ছুট। যেতে যেতে. হাঁটতে হাঁটতে আমি বন শহরটাকে দেখি। দেখি এখানকার লোকজনকে। কোথাও কোন অসঙ্গতি চোখে পড়ে না, চোখে পড়লে আরাম পেতাম।
আবারও চরম বিরক্তি আসে, মিডিয়া ফোরামের উপর। এরা কোন বুদ্ধিতে এতো স্বল্প সময়ের জন্য টিকেট দিল? নাকি এদের বীমা কোম্পানির সঙ্গে আঁতাত আছে? আমাকে যে আসার সময় ত্রিশ হাজার ইউরোর বীমা করতে হয়েছিল কি এই জন্যে; আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসাখাতে ব্যয় হবে! :)
এই সব পুরনো স্থাপনা আমাকে খুব টানে। আমি নিজেও থাকি প্রায় ১০০ বছরের পুরনো একটা বাড়িতে। বাড়িটা বুড়া হয়ে গেছে, অনেক যন্ত্রণা দেয় কিন্তু আমি আমৃত্যু এই বুড়ার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছা প্রকাশ করি। আমার কেবল মনে হয়, এই বুড়ার দিকে যে রাস্তাটা গেছে এটা স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা [২]। তীব্র ইচ্ছা, এই বুড়ার কোলে মরতে চাই।
আমাদের নিজেদের কত স্থাপনা অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। পানাম নগরীতে [৩] গিয়ে আমার কান্না পেয়েছিল, হাতে ধরে আমরা আমাদের শেকড়গুলোকে কেমন করে নষ্ট করছি।
নাচঘরে আমি দেখেছিলাম গরু চড়তে। এই কষ্ট কাকে বলি, কোথায় রাখি। ময়নামতির হাজার বছর পূর্বের ইট দিয়ে দেখেছি গরুর খুঁটা বসাতে!
যাও অল্প স্থাপনাগুলো আছে সেইসব দেখার অনুমতি আমাদের মত সাধারণ মানুষদের নাই, এ এক অসভ্যতারই নামান্তর [৪]।
ব্রিটিশদের করা রেলওয়ের এই সব চমৎকার বাংলোগুলো [৫] সহসাই ভেঙে ফেলা হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
মায়াবতী আমাকে ডয়চে ভেলের অফিসে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেন। এখানে মডারেশন নিয়ে জানা এবং আমার একটা রেডিও সাক্ষাৎকার [৬] ছিল। এই সাক্ষাৎকার নিয়ে আমি খুব একটা আরাম বোধ করছিলাম না। কারণ কমিউনিটি ব্লগে আমি দীর্ঘ সময় লেখালেখি করি না। কারণ বিবিধ। দলাদলি বিষয়টা আমার ভারী অপছন্দের। যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পর্যন্ত [৭] দলবাজি করেন সেখানে আমার মত দলহীন একজন মানুষ এবং একটা কলাগাছের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। তাছাড়া কমিউনিটি ব্লগে একজনের অন্যজনের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা বোধ না থাকা। নো মডারেশনের নামে যা খুশি তা বলার স্বাধীনতা। কিন্তু এটা আমরা মনে রাখার চেষ্টা করি না, কলম হচ্ছে ছুঁরির মত। এখন ছুঁরিটা কার হাতে এটাও মূখ্য বিষয়। বানরের হাতে ছুঁরি থাকলে যা হওয়ার তাই হয়!
যাই হোক, যারা কমিউনিটি ব্লগে ব্লগিং করেন তাঁরা মডারেশন বিষয়ে আরও ভালো বলতে পারবেন। এবং কমিউনিটি ব্লগে যেটা আমরা মনে রাখার চেষ্টা করি না সেটা হচ্ছে ভলতেয়ারের চমৎকার সেই কথাটা:
"আমি তোমার সঙ্গে একমত না কিন্তু তোমার মত প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু লড়ব"।
*বৈদেশ পর্ব, এগারো: http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post_03.html
সহায়ক লিংক:
১. হায় ঢাকা: http://www.ali-mahmed.com/2009/08/blog-post_9358.html
২. বুড়া বাড়িটা: http://www.ali-mahmed.com/2009/11/blog-post_24.html
৩. পানাম নগর: http://www.ali-mahmed.com/2010/01/blog-post_10.html
৪. অসভ্যতারই নামান্তর: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_04.html
৫. 'গরিবারোগ': http://www.ali-mahmed.com/2009/02/blog-post_14.html
৬. মডারেশন নিয়ে রেডিও সাক্ষাৎকার: http://ht.ly/22gl0
৭. স্যাররা, দলবাজি বন্ধ করেন: http://www.ali-mahmed.com/2009/12/blog-post_19.html
4 comments:
ভাই, "মায়াবতী" ব্যাপারটা ঝেড়ে কাসুন তো...!!!
ইনি হচ্ছেন আরাফাতুল ইসলামের বউ।
ইনার চমৎকার একটা নামও আছে কিন্তু মানুষের জন্য এই মেয়েটার মনে মায়া প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত, তাই আমি নাম এঁর দিয়েছি মায়াবতী।
বৈদেশ পর্ব: নয়, এটা সম্ভবত আপনি পড়েননি। ওখানে বিস্তারিত বলা আছে:
http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post_01.html
@Shaqlain Shayon
কয়েকদিন আসা হয় নাই। আগের পর্বগুলো মিস হয়েছে আমার। ভাল্লাগছে...
:) শুকরিয়া। @মুকুল
Post a Comment