যাতায়তে সমস্যা তবুও ঈশ্বরের বিশেষ সন্তানদের স্কুলে সুযোগ পেলেই আমি চলে যাই। এটার প্রতি আমার আলাদা বাড়তি টান আছে কারণটা পূর্বেও বলেছিলাম, এখানকার বাচ্চারা অল্প সময়ে আমাকে যথেষ্ঠ বিভ্রান্ত করছে। দাবা একটা কঠিন খেলা, আমি নিজেও ভাল পারি না। স্কুলের বাচ্চাদের জন্য ফুটবল, লুডু, লাফাবার দড়ির সঙ্গে একটা দাবা কিনে দেয়া হয়েছিল, দাবাটা এখানকার দু-চারজন ভালই রপ্ত করে ফেলেছে, হাতি-ঘোড়া-মন্ত্রী-রাজা নিয়ে মারামারি করে।
এখানকার বয়স্ক মানুষদের আমি এড়িয়ে চলি, ঘটনাটা খানিকটা অন্য রকম। এখানকার লোকজনের একটা অদেখা স্বপ্ন আছে; সেটা হচ্ছে, একটা মসজিদ। এখানে আশেপাশে কোন মসজিদ নেই, চোখে দেখতে না-পাওয়ার কারণে দূরের মসজিদে যাওয়াটা এঁদের জন্য বড়ো কঠিন।
বেশ ক-বার একটা মসজিদের ব্যবস্থা করে দেয়ার কথা আমাকে বলার পর আমি চেষ্টাকৃত খানিকটা কঠিন করে বলেছিলাম, আমার পক্ষে এটা সম্ভব না।
এমন না মসজিদ করার বিষয়ে আমার কোন অনীহা আছে। আমি নিজে কতটুকু ধর্মীয় আচার পালন করি, কি করি না এই নিয়ে কারও সঙ্গে আলাপ করতে আগ্রহ বোধ করি না। কিন্তু কারও ধর্ম-বিশ্বাসের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অটুট। তাঁদের বিশ্বাস কোনটা ঠিক-বেঠিক এই নিয়েও আমার মাথা ঘামাবার প্রয়োজনও দেখি না।
একটা মসজিদ ভেঙ্গে ফেললে আমি যে কাতরতা অনুভব করি তেমনই আদিমানুষদের কোন প্রার্থনাস্থল ভেঙ্গে ফেললেও [১]।
এই গ্রহে এটা একটা জঘণ্য অপরাধ, প্রার্থনা করার সময় কাউকে মেরে ফেলা। কারণ তখন সেই মানুষটা মনে-প্রাণে-শরীরে সমর্পিত অবস্থায় থাকেন, তাঁর মধ্যে একটা পিপড়াকেও প্রতিরোধ করার ক্ষমতা থাকে না। তখন কাউকে মেরে ফেলার মত কাপুরুষতা আর নাই! যে পাকিস্তানী আর্মি প্রার্থরনারত [২] দানবীর নতুনচন্দ্রকে মেরে ফেলেছিল আমি যেমন ওই পাকিস্তানি আর্মিদের শাস্তি মৃত্যু চাইব তেমনি যে দানব পাকিস্তানি মসজিদে বোমা মেরে শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে, তাকেও। এবং আমি সেই দানবদেরও তাচ্ছিল্য করব যারা এই অন্যায়ে উল্লসিত হয় [৩]।
বিশ্বাস। কারও বিশ্বাসটাকে আমি প্রচন্ড গুরুত্ব দেই কারণ আমি মনে করি, বিশ্বাস বিষয়টার শক্তি অসাধারণ, দানবীয়। আমি কোন একটা লেখায় লিখেছিলাম, প্লাসিবো এবং নসিবোর কথা [৪]। প্লাসিবোটা আসে তীব্র বিশ্বাস থেকে, অদেখা স্রষ্টার কাছে একজন যখন তাঁর শরীর-মন-ভাবনা শিথিল করে বারবার একটাই জিনিস চাইছে তখন ওই মানুষটার সমগ্র সত্ত্বা প্রস্তুত হচ্ছে জিনিসটা পাওয়ার জন্য। হতে পারে এটা জটিল কোন রোগ। ফলশ্রুতিতে উপশম না-হওয়ার কোন কারণ দেখি না।
কোন রোগির যদি ডাক্তারের উপর আস্থা না-থাকে বা সেই রোগি যদি হাল ছেড়ে দেন, এই গ্রহের সমস্ত ডাক্তার গুলে খাইয়ে দিলেও তিনি সেরে উঠবেন এমনটা আমি মনে করি না। আমি এও মনে করি, আমাদের মত দেশগুলোতে অস্ত্রপচার অসফল হওয়ার হার বেশি হওয়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে ডাক্তাররা রোগির সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন না, রোগি জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগ পর্যন্ত একটার বেশি দুটা কথা জানতে চাইলেই ডাক্তার বাবু ধমকে থামিয়ে দেন, 'আপনে কি ডাক্তার'?
আরে শ্লা, আমরা ডাক্তার হলে তোকে জিজ্ঞেস করতাম কেন? আমরাই তো তোর ঠ্যাং কাটতাম।
বিশ্বাসের খারাপ দিকও আছে। বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে একটা মানুষকে অনায়াসে তৈরি করা যায় একটা 'হিউম্যান বম্ব'-এ। এর একটা উদাহরণ হতে পারে তামিল, এলটিটিই-এর ৭৫ জন নারী যোদ্ধা গ্রেনেড বিস্ফোরন ঘটিয়ে একেক করে নিজেদের উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কী ভয়াবহ, কী দানবীয় এই বিশ্বাসের ক্ষমতা!
যাক সে প্রসঙ্গ। পরে এরা বয়স্কদেরকে আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিলেন। এখন বয়স্কদের মুখের উপর ফট করে কঠিন কথা বলা যায় না, তাই আমি এঁদের এড়িয়ে চলতাম। আমি পা টিপে টিপে গেলেও কেমন করে যেন এঁরা টের পেয়ে যেতেন, 'কে যায়-কে যায়'। বাধ্য হয়েই বলতে হতো, আমি। ব্যস, শুরু হয়ে যেত সেই মসজিদের কথা। কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়!
হপ্তাখানেক আগে ওখানে আমাকে বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছিল। ওঁদের ওখানে থাকেন রমজান নামের একজন মানুষ। চোখে দেখতে না-পাওয়া এই মানুষটার প্রতি আমার আলাদা টান আছে, এঁর কারণেই আমি এঁদের খোঁজ পাই এবং অবশেষে স্কুল করা হয় [৬]।
রমজান পায়ে কুড়ালের কোপে আহত, এই ডাক্তারকে [৫] দেখাবার কথা বলে এসেছিলাম কিন্তু রমজান আসেননি।
আজ গিয়ে দেখি এঁর পায়ের অবস্থা ভয়াবহ। আমি ডাক্তার না কিন্তু চোখ বুজে বলে দেয়া যায় এর সঠিক চিকিৎসা না হলে পা-টা কেটে ফেলতে হবে। অথচ মানুষটা হাতুড়ে ডাক্তার দেখিয়ে এরিমধ্যে হাজারখানেক টাকা খরচ করে ফেলেছেন। মেজাজ খারাপ হয় কিন্তু এঁদের উপর রাগ করা বৃথা। এক প্রকার চ্যাংদোলা করে নিয়ে আসতে হয়েছিল এঁকে।
সেদিন বাঁচা গেল না! সবাই মিলে আমাকে কোণঠাসা করে ফেললেন। এঁরা বারবার বলতে থাকেন, মসজিদ এখন আমরা চাই না, আপনি খালি বলেন, হবে। আমি নির্বোধের মত বলি, আচ্ছা হবে। ইয়ে, কত লাগে মসজিদের জন্য একটা ঘর করতে?
এঁরা হিসাব দেন, টিন-বাঁশ দিয়ে দশ ফুট বাই বিশ ফুট একটা ঘর করতে আনুমানিক বিশ হাজার টাকা লাগবে। আমি বলি, আচ্ছা কাজ শুরু করেন কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে সেটা হচ্ছে, আপনারা এখানে নামাজ পড়েন, কোরান পড়েন, জিকির করেন কোন সমস্যা নেই কেবল এক ঘন্টার জন্য বাচ্চারা এখানে পড়বে।
এরা একটা ধাক্কার মত খান। মসজিদ হচ্ছে আল্লার ঘর এখানে বাচ্চারা পড়বে কেমন করে? আমি বলি, দেখেন আগে কিন্তু মসজিদ কেবল নামাজ পড়ার জন্যই ব্যবহৃত হত না, শিক্ষা দেয়ার জন্যও। বোঝাবার পর এঁদের আর আপত্তি থাকে না।
আমার আনন্দিত হওয়ার কথা কিন্তু মনখারাপ করা শ্বাস ফেলি, আমার কাছে এখন এই বাড়তি খরচ করার মত টাকা নেই। যারা আমাকে আর্থিক সহায়তা করেন তাঁদের কোন মুখে বলব? কিন্তু তাঁদের কেমন করে বোঝাব, ব্যাটলফিল্ডে থাকা আর নিরাপদ দুরত্বে থাকার মধ্যে অনেক ফারাক। এঁদের সঙ্গে কাজ করতে হয় আমাকে, এঁদের চোখে চোখ রাখতে হয় আমাকে, আপনাদের না।
পরে ভাবছিলাম, আচ্ছা, আহাম্মকের মত এটা কেন বলতে গেলাম, আমি কি আহাম্মক? নাকি এঁদের অদেখা স্বপ্ন এঁরা আমার মধ্যে সঞ্চারিত করতে সফল হয়েছিলেন? হতে পারে। কে বলেছে, যারা চোখে দেখেন না তাঁরা স্বপ্ন দেখতে পারবেন না, কে মাথার দিব্যি দিয়েছে তাঁদের স্বপ্নটা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারবেন না? আমার মত দুর্বল মানুষকে কাবু করা যাবে না...!
*ঈশ্বরের বিশেষ সন্তানদের ইশকুল: http://www.ali-mahmed.com/2010/08/blog-post_05.html
সহায়ক লিংক:
১. আদিমানুষ: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_23.html
২. দানবীর নতুনচন্দ্র: http://www.ali-mahmed.com/2007/06/blog-post_4432.html
৩. দেশপ্রেমিক: http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post_30.html
৪. প্লাসিবো, নসিবো: http://www.ali-mahmed.com/2009/12/blog-post_20.html
৫. ডাক্তার: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_06.html
৬. রমজান মিয়া: http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post_3014.html
No comments:
Post a Comment