আজকের প্রথম আলোয় [১] (২৪ আগস্ট, ২০১০) খবরটা পড়ে কেবল মাথায় যেটা ঘুরপাক খাচ্ছে, আমাদের দেশে প্রাণ কত শস্তা! এরচেয়ে শস্তা সম্ভবত আর কিছু নাই, এক বোতল পানির দামও নিদেনপক্ষে ১০ টাকা। প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানাই, এই নিউজটা ছাপাবার জন্য, পাশাপাশি আমার এই ক্ষোভও আছে, এই খবরটাই আরও গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন ছিল। প্রকারান্তরে একটা অন্যায়ও করা হয়েছে, যে ডাক্তারের বক্তব্য ছাপা হয়েছে এটা একটা বিকলাঙ্গ তথ্য!
কসম লেখালেখির, আমার মনে হচ্ছে হাঁটুর নীচে জোর নাই। এই খবরটা আমার চোখ এড়িয়ে গেলেই ভাল হতো, কেন চোখে পড়ল! এটা পড়ার পর থেকে আমার ভুবনটা এলোমেলো হয়ে আছে। কোন একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার সুতীব্র ইচ্ছা। হাতের নাগালে কাউকে না-পেলে আমি নিজে আছি কী করতে! স্বয়ংক্রিয় চাবুক পাওয়া যায় না বাজারে? যেটার কাছে গিয়ে নিজের পিঠ পেতে দিলেই শপাং শপাং; ব্যস, দুর্দম রাগ অনেকটা কমে এলো। এমন একটা জিনিস সহজলভ্য হলে মন্দ হতো না...।
সাভার উপজেলা হাসপাতালে 'খবিরন' নামের এক ছিন্নমূল অন্তঃসত্ত্বা নারী প্রসব ব্যথা নিয়ে গেলে ওখানকার ডাক্তার তাঁকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিদায় করে দেন। খবিরন ওই সময় তীব্র ব্যথায় বারবার ডাক্তারকে অনুরোধ করেও কোন লাভ হয়নি।
গত রোববার রাতে খবিরন অসহ্য প্রসবযন্ত্রণা সহ্য করতে না-পেরে ফুটওভারব্রীজ থেকে লাফিয়ে পড়েন। তাঁর সঙ্গে মৃত্যু হয় তাঁর অদেখা সন্তানেরও [২]।
কত্তো সহজ!
আবার কী অবলীলায়ই না ওই সাভার হাসপাতালের ডাক্তার নিখিল কুমার সাহা এটা বলে পার পেয়ে যান, "...এই নারীর পেটের বাচ্চার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তাই তাকে ঢাকা মেডিকাল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়"।
গুড-গুড! অতি উত্তম।
তা আমাদের সাংবাদিক মহোদয় এটুকু জিগেস করেই ক্ষান্ত দিলেন কেন? তিনি কেন জানতে চাইলেন না, কখন, কেমন করে খবিরনকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে? ঢাকা মেডিকালে এই বিষয়ে খোঁজ নিলেন না কেন? নাকি তিনি এই তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, অফিস ছাপায়নি?
আমরা সবাই যার যার গা বাঁচাচ্ছি। আরে, এটা তো আমার সমস্যা না, খবিরন নামের এই মহিলা তো আমাদের কেউ না। হিস্ট্রি রিপিট। আমাদের সঙ্গে এমনটা ঘটলে তখন আমরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠব, আমরা কি এই অপেক্ষায় আছি? ভাল-ভাল, এই মনস্কামনা পূর্ণ হোক।
এখানে অবশ্য আমার কিছু জানার ছিল। আমি জানতে চাই, খবিরনকে কিসে করে ঢাকা মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছিল, হেলিকপ্টারে, নাকি অ্যামবুলেন্সে করে? হেলিকপ্টারে করে করা হয়ে থাকলে আমি জানতে চাই, কাদের হেলিকপ্টারে করে? সেনাবাহিনীর, নাকি ভিভিআইপিদের যেটায় বহন করা হয়, সেটায়?
হেলিকপ্টার না-হয়ে অ্যামবুলেন্স হলে নিশ্চয়ই এটা হাসপাতালের? তাহলে অবশ্যই এই রেকর্ড থাকার কথা কখন, কটায় খবিরনকে ঢাকা মেডিকাল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
আর যদি এটা প্রমাণিত না-হয় তাহলে খবিরনকে যে ডাক্তার দেখেছিলেন বা যিনি দায়ি তাকে কেন দুইজন মানুষ খুনের জন্য শাস্তি দেয়া হবে না? প্রচলিত আইনে দুইজন মানুষকে খুন করলে যে শাস্তি হয় এই শাস্তি কেন এই ডাক্তারকে দেয়া যাবে না।
এটা আমরা বেশ জানি, খবিরনের কাছে যদি বিস্তর টাকা-পয়সা থাকত তাহলে তাঁকে এটা অসহ্য প্রসববেদনায় আত্মহত্যা করতে হতো না। এই ডাক্তারই খবিরনকে নিয়ে দৌড়-ঝাঁপ শুরু করে দিতেন। কারণ অন্তঃসত্ত্বা কাউকে কোন ক্লিনিকে পাঠালেই ডাক্তার সাহেবের পকেটে শুধুশুধুই অন্তত পাঁচ হাজার টাকা চলে আসে।
আমি পূর্বেও বলেছি, এই দেশে সরকারী চাকুরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপরাধ করে থাকেন আমাদের দেশের ডাক্তার। পুলিশ এদের কাছে কোন ছার! পুলিশ অপরাধ করে পেটের জন্যে।
অথচ এই দেশের অধিকাংশ ডাক্তার বেতন, সুযোগ-সুবিধার পরও প্রাইভেট প্র্যাকটিসের পরও হেন কোন অন্যায় নাই যেটা করেন না। ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে গোপন আঁতাত- ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে নগদ টাকার বাইরেও এমন কোন জিনিস নাই এরা পান না, অন্তর্বাস ব্যতীত, নাকি এটাও আজকাল ওষুধ কোম্পানিগুলো দেয়া শুরু করেছে! যে ক্লিনিকে অযথা হাজার-হাজার টাকার টেস্ট পাঠান, টেস্টের টাকার অন্তত ফিফটি পার্সেন্টের বিনিময়ে। যে মার স্বাভাবিক বাচ্চা হওয়ার কথা তাঁর পেট কাটার জন্য ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেন টাকার বিনিময়ে। কয়টার কথা বলব?
খবিরন যে শহরে আত্মহত্যা করেছেন সেই শহরে ক-লক্ষ মানুষ বসবাস করেন আমি জানি না। কেবল জানি ওই শহরের লোকজন মানবতার বড় বড় কথা বলেন, নিয়ম করে নামায-রোজা-হজ পালন করেন; সেই শহরেই যখন খবিরন আত্মহত্যা করেন, হাত-পা ছড়িয়ে মধ্য-রাস্তায় পড়ে থাকেন, তাঁর পেট ফেটে অদেখা বাবুটাও মরে পড়ে থাকে তখন সেই শহরের সমস্ত মানুষ নগ্ন হয়ে পড়েন।
খবিরন যে একটা মা এটা কারও মাথায় আসল না? এই গ্রহের সব মার আদল যে এক, সে 'মাছ-মা' [৩] হোক আর খবিরন, পার্থক্য কী! খবিরন নিশ্চয়ই এই শহরের এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পাগলের মত ছুটাছুটি করেছেন, একে-ওকে ধরেছেন, বাবুটাকে-নিজেকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কেন পারলেন না?
আমরা জানি, অদেখা বাবুদের আত্মিক যোগ থাকে কেবল মার সঙ্গেই- কেবল আমরা এটা জানি না, বাবুটা কি কোন প্রকারে মাকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করেছিল? নাকি সেও হাল ছেড়ে দিয়েছিল, একগাদা থুথু ফেলে উল্টো আরও মাকে প্ররোচিত করছিল। থুথু! অনেকে চেঁচিয়ে উঠবেন, ভুল-ভুল! অ, আচ্ছা, অদেখা সন্তানরা থুথু ফেলতে পারে না, না? তাই হবে!
আমি কেবল ভাবি, সেই শহরের দালান-কোঠাগুলো এখনও দাঁড়িয়ে থাকে কেমন করে? কেন এখানে রোদ, কেন বৃষ্টি?
নপুংসক আমরা, আমরা আর কিছু না পারলে খবিরনের বিরুদ্ধে একটা মামলা ঠুকে দিতে পারি। কারণ আত্মহত্যা প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা কলমের মাধ্যমে অনলবর্ষন করতে পারেন, কলামলেখক লিখতে পারেন দেড় হাত লম্বা কলাম, 'কী নিষ্ঠুর মা' এই শিরোনামে:
"খবিরন ভয়ংকর একটা অন্যায় করিয়াছে। সে নিজেকে মারিয়া ফেলিয়াছে। কেবল তাহাই নহে, এই পাষন্ডী মা তাহার গর্ভের সন্তানকেও মারিয়া ফেলিয়াছে। আমরা ভাবিয়া ভাবিয়া কূল পাইতেছি না, একজন মা হইয়া কেমন করিয়া তাহার গর্ভের সন্তানকে হত্যা করিতে পারে? ইহা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বটে। আমরা সরকারের কাছে জোর দাবী করিতেছি, এই পাপিষ্ঠাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হউক।"
অভাগা খবিরন- ইহকাল গেল, পরকালও!
সহায়ক লিংক:
১. প্রথম আলো: http://www.eprothomalo.com/?opt=view&page=4&date=2010-08-24
২. মা এবং তার অদেখা সন্তান: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_10.html
৩. মাছ-মা: http://www.ali-mahmed.com/2009/06/blog-post_6002.html
এরশাদ-খালেদা জিয়ার সময় যেভাবে লেখা গেছে, ক্যারিকেচার, কার্টুন আঁকা গেছে আওয়ামী শাসনামলে সেটা ছিল স্রেফ একটা স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন! একদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (!) শহিদুল আলমকে নগ্ন পায়ে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল। কোথায় নিয়ে গেল সেটা আবার অনেক পরে জানা গেল। কোর্টে আবার 'মাই লর্ড' বিচারক পুলিশকে জিজ্ঞেস করছেন, পুলিশ আসামীর (শহিদুল আলমের) ফোনের পাসওয়ার্ড নিয়েছে কিনা, সেদিনই লেখালেখির কফিনে পেরেক ঠোকা হয়ে গেল...!
Tuesday, August 24, 2010
ডাক্তার নামের খুনিটার বিচার হবে না?
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
7 comments:
Vai Amar pokhoo theke dacter shaheb r gale duta jutar bari ki mera astee paren... Deshe thaklee ami nijai matram...
আমি আপনার আবেগ-যন্ত্রণাটা বুঝতে পারছি। আসলে এটা কোন সমাধান না।
আসলে আমরা সবাই গা বাঁচিয়ে চলছি। এটা যে বুমেরাং হয়ে আমাদের কাছেই ফিরে আসবে এটা মাথায় নাই। আপনার এই মন্তব্যের কারণে আমি মূল পোস্টে খানিকটা রদবদল করেছি:
"তা আমাদের সাংবাদিক মহোদয় এটুকু জিগেস করেই ক্ষান্ত দিলেন কেন? তিনি কেন জানতে চাইলেন না, কখন, কেমন করে খবিরনকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে? ঢাকা মেডিকালে এই বিষয়ে খোঁজ নিলেন না কেন? নাকি তিনি এই তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, অফিস ছাপায়নি?
আমরা সবাই যার যার গা বাঁচাচ্ছি। আরে, এটা তো আমার সমস্যা না, খবিরন নামের এই মহিলা তো আমাদের কেউ না। হিস্ট্রি রিপিট। আমাদের সঙ্গে এমনটা ঘটলে তখন আমরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠব, আমরা কি এই অপেক্ষায় আছি? ভাল-ভাল, এই মনস্কামনা পূর্ণ হোক।"
এই প্রশ্নটা আমার মনেও জেগেছিল৷ রিপোর্টারকে আরো অনুসন্ধানী হওয়া উচিত ছিল৷ ডাক্তারের মন্তব্যটা পড়ে মনে হয়েছে সাংবাদিক সাংবাদিকতার একেবারেই সাধারণ নিয়মটা মেনেছেন, "যাকে বলে অভিযুক্তের মন্তব্য নেয়া"৷ কিন্তু সেটা যে প্রতিবেদনের জন্য যথেষ্ট নয়, তা মাথায় ঢোকেনি তার৷ উচিত ছিল আপনার লেখা কী জানি হয়তো অন্য কোন কারণও থাকতে পারে৷ বলা মুশকিল৷
এই প্রশ্নটা আমার মনেও জেগেছিল৷ রিপোর্টারকে আরো অনুসন্ধানী হওয়া উচিত ছিল৷ ডাক্তারের মন্তব্যটা পড়ে মনে হয়েছে সাংবাদিক সাংবাদিকতার একেবারেই সাধারণ নিয়মটা মেনেছেন, "যাকে বলে অভিযুক্তের মন্তব্য নেয়া"৷ কিন্তু সেটা যে প্রতিবেদনের জন্য যথেষ্ট নয়, তা মাথায় ঢোকেনি তার৷ আপনার লেখা প্রশ্নগুলো তার মাথাতেও আসা উচিত ছিল৷ খুবই যৌক্তিক জিজ্ঞাসা এগুলো৷
সেই।
রিপোর্টটা হয়ে গেছে বিকলাঙ্গ একটা রিপোর্ট। আমি স্বপ্ন দেখি, কোর্টে এই ডাক্তারকে দুইটা খুনের জন্য দাঁড় করানো হয়েছে।
এবং পাশাপাশি এই পত্রিকার লোকজনকেও সতর্ক করা হয়েছে পরবর্তিতে রিপোর্ট করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করার জন্যে...। @Anonymous
যে-কারণেই হোক, সেদিনের পেপার দেখা হয়নি আমার। খবরটা আমি পেয়েছি সামহোয়্যারইনব্লগের মাধ্যমে, একজনের লেখায়, তাও ভোর চারটার সময়। সেখানে আমি মন্তব্য করেছিলাম, ভোর রাতে কেন যে কাঁদান!
অনেক দিন আগে আমি একটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম 'সুশীল' পত্রিকায়। শিরোনাম ছিল, 'ডাক্তার চাই, কসাই নয়!' এরা লেখাটা ছাপিয়েছিল, কিন্তু কসাই শব্দটি সেন্সর করে। কী আশ্চর্য, কসাইকে কসাই বলা যাবে না!
"কী আশ্চর্য, কসাইকে কসাই বলা যাবে না!"
এখানে আমার আপত্তি আছে।
'ফ্রিডম' বইয়ে আমি যা লিখেছিলাম তা এখানে শেয়ার করি। আলীম নামের একটা চরিত্রের কথা এখানে তুলে দেই:
আমার মতে, ডাক্তাররা হচ্ছে কসাইদেরও অধম। ক্ষমা চাচ্ছি, উদাহরণটা ঠিক হলো না, কসাইগিরি একটা সৎ পেশা। প্রচলিত উদাহরণ দিয়ে এঁদেরকে (কসাই) অপমান করা হয়, এঁদের প্রতি অবিচার করা হয়। @সুব্রত
Post a Comment