আমার এই বন্ধুর সঙ্গে পরিচয়পর্ব খানিকটা নাটকীয়! সালটা সম্ভবত ১৯৯৮। আমি কোনো এক কাজে বাসার বাইরে। একজন হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বললেন, 'আপনার বাসার দিকে আর্মির গাড়ি গেছে'।
তখন আমি সম্ভবত কারও সঙ্গে কথা বলছিলাম, বিশেষ গা করলাম না। একটু পর আবারও একজন, 'তাড়াতাড়ি বাসায় যান, আর্মি আপনাকে খুঁজতাছে'। আমি বাসার দিকে যেতে যেতে ভাবছিলাম: খোদা, এ আবার কোন মুসিবত!
তবে এ সত্য, তখন খুব একটা চিন্তিত ছিলাম না কারণ পুলিশ হলে ভয়ের কারণ ছিল। কারণ আমাদের দেশের পুলিশ মানেই বিপদ, মহাবিপদ! বাসার কাছে এসে দেখি আর্মির একটা গাড়ি দাঁড়ানো, গাড়িটার মাথায় লাইট-ফাইট 'আক্কাড়-পাক্কাড়' অনেক কিছু লাগানো। তখনও জানতাম না এটা 'মিলিটারি পুলিশের গাড়ি'। বাসার কাছে দাঁড়ানো একজন সৈনিক খুব ভদ্র ভাষায় বলল, 'আপনি কি অমুক'?
আমি বললাম, 'হ্যাঁ'।
সে আবারও বলল, 'আমাদের স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন'।
আমি বললাম, 'ঠিক আছে। আপনার স্যারকে আমার বাসায় আসতে বলেন'।
আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, 'স্যার' নামের অসম্ভব ছটফটে যে ছেলেটি বাসায় আসলো সে তখন সম্ভবত সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট বা লেফট্যানেন্ট টাইপের কিছু একটা।
ঘটনা অন্য কিছু না। এখানে একটা হেলিপ্যাড হওয়ার কথা। ওই কারণে এই মানুষটি এসেছে সরেজমিনে দেখার জন্য। আমার সঙ্গে কি? লেখালেখি সংক্রান্ত! এ পত্র-পত্রিকায় কোথাও নাম দেখে এই ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছে! মানুষটার সঙ্গে বন্ধুত্বের সেই শুরু। মানুষটা অনেকবারই আমাকে হতবাক করেছে, মনটাকে আর্দ্র করেছে।
এমনিতে মানুষটার সঙ্গে আমার দেখা হতো কালেভদ্রে। এদের কাজটাই অসম্ভব ব্যস্ততার, তখন আমিও ব্যস্ত। তার উপর এর ছুটিছাটা হাতেগোনা। একবার এ দুদিনের ছুটিতে সিলেট থেকে ঢাকায় বাড়িতে যাচ্ছিল। তখন 'উপবন এক্সপ্রেস' আমাদের এখানে থামত। দুম করে রাত আড়াইটায় এখানকার স্টেশনে নেমে পড়ল। সারাটা রাত কোনো-এক অখ্যাত 'চিত -কাইত' হোটেলে প্রায় বসেই কাটিয়েছিল। সকাল-সকাল আমার বাসায় এসে হাজির। দু-বগলে মালেশিয়ার ঢাউস বিস্কিটের প্যাকেট।
আমার পরিচিত লোকজনেরা বিলক্ষণ জানেন আমি একজন বিস্কিটমানব- বিস্কিট খেয়ে দিন পার করে দেয়া আমার কাছে ডালভাত। ওই দুইদিন আমার এখানে কাটিয়ে আবার সিলেটে ফিরে গেল। এই অযাচিত পাগলামি-আবেগের কথা ভুলি কেমন করে? এমন অসহ্য ভালোবাসা সহ্য হয় না।
ইউএন মিশনে কঙ্গো থেকে ফেরার সময় আমার জন্য নিয়ে এসেছিল চমৎকার এই জিনিসটা, দূর্লভ কাঠে এই অসাধারণেএকটা কাজ। আমি অবশ্য এটা নিয়ে খানিকটা ভজকট করে ফেলেছিলাম। কারণ এর মাথাটা আলাদা ছিল, খুলে লাগাতে হয়। নির্বোধ আমি, উল্টো লাগিয়ে রেখেছিলাম। আকৃতিটা হয়ে গিয়েছিল অর্থহীন! নিজের এই বোকামি নিয়ে নিজেই বিস্তর হেসেছিলাম।
পরে ইউকে-তে এর কোনো এক ট্রেনিং ছিল। ফেরার সময় নিয়ে এলো এটা। টেনিসের ইতিহাস। আমি বললাম, টেনিসের ইতিহাস দিয়ে আমি কি করব, বাপ! টেনিস আমি খেলেছি না আমার বাপ! এটা বললাম অবশ্যই মনে মনে। একজন প্রিয় মানুষের মুখের উপর বুঝি মনের এমন গোপন কথাটা বলা যায়!
পরে জাপানে গিয়েছিল একটা স্কলারশিপ নিয়ে। ঠিক তখনই জাপানে ভয়াবহ সুনামি হলো। প্রাণ হাতে নিয়ে ফিরে এসেছিল। তবুও ফিরে এসে কী যে আফসোস আমার জন্য কিছু আনতে পারল না বলে!
আমি যেবার ডয়চে ভেলের আমন্ত্রণে জার্মানি গেলাম তখন কিছু জটিলতার কারণে যাওয়ার আগে ঢাকায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। কিছু কেনাকাটাসহ জরুরি কিছু কাজ রয়ে গিয়েছিল অথচ আমার হাতে তখন সময় খুব অল্প। আমার পরিচিত লোকজনেরা বিলক্ষণ জানেন ব্রেন নামের জিনিসটা আমার নাই! কয়েক-শো বার ঢাকায় এসেছি কিন্তু ঢাকার রাস্তাঘাট মনে না-থাকার বিষয়ে আমার কুখ্যাতির শেষ নাই। সঙ্গে কেউ না-থাকলে কী অসহায় যে লাগে! তো, মনখারাপ করে একটা স্কুটার খুঁজছিলাম। শ্লা, ঢাকার স্কুটারওয়ালারা একেকজন লাটসাহেব!
তখনই..., ঠিক তখনই, ঠিক সেই সময়টাতেই মধ্য রাস্তায় এই মানুষটার সঙ্গে দেখা, অবিকল সিনেমার মত। সিনেমায় এমনটা হরহামেশা হয় বটে তবে বাস্তবে না [১]। একে না-জানিয়ে আমি দেশের বাইরে যাচ্ছি শুনে এ অবিকল শিশুর মত গাল ফুলিয়ে বলেছিল, 'আপনি না-বলে আমাকে না-জানিয়ে ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছিলেন বুঝি, না? আজ আপনাকে ডিনার না করিয়ে ছাড়ছি না'।
আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, 'ডিনার, সময় নাই যে, আমার যে কিছু কাজ রয়ে গেছে। এদিকে স্কুটার পাচ্ছি না'।
ও হাতে কিল মেরে বলল, 'আলী ভাই, সাথে গাড়ি আছে। চলেন কোথায়-কোথায় যাবেন। এরপর কিন্তু ডিনার'।
তখন আমার হাতে চাঁদ পাওয়ার মত অবস্থা। কারণ দাউদ হায়দার [৩] এবং অন্যদের জন্য কিছু জিনিসপত্র কিনতে হবে আজিজ মার্কেট থেকে। যাক বাবা, বাঁচা গেল!
আহারে, সেই ডিনারটা আমার জন্য মনে রাখার মত ছিল কারণ স্টেক এবং নান, অসাধারণ ছিল- পরিবেশটাও ছিমছাম! পরে ওখানে আবারও যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল কিন্তু আজও যাওয়া হয়ে উঠল না। অনেক কারণের একটা, ঢাকার কোনো লোকেশন খুঁজে বের করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। পরিচিত লোকজনেরা এও জানেন আসলে আমার স্মৃতিশক্তি বলে কোনো কিছু নেই! আসলে আমার তো ব্রেনই নাই তাও আবার স্মৃতি, হাহ...!
মানুষের কতশত স্বপ্ন থাকে- আমার স্বপ্নগুলো বড় সীমিত। আমি স্বপ্ন দেখি, এই মানুষটার সঙ্গে ওইখানে আবারও আরাম করে খাচ্ছি, হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছি।
আগেই বলেছি আমাদের দেখা-সাক্ষাত হত খুবই কম। কিন্তু আমার কোনো বিপদে এ কেমন করে যেন ঠিক ঠিক হাজির হয়ে যেত- এটা কাকতালীয় হলে কাকতালীয়, 'ফাততলীয় হলে ফাকতলীয়'। আমার সঙ্গে শেষ দেখা হাসপাতালে। আমার মাকে নিয়ে ঢাকা গেছি। কাউকে জানাইনি। কিন্তু ঠিক ওদিনই এর ফোন।
দেখো দিকি কান্ড, অপারেশন হবে, ওদিকে আবার আমার মার রক্তের প্রয়োজন। আমার বন্ধু সাদিক অবশ্য রক্ত দিল কিন্তু আরেকজন দাতাকে হাতের নাগালে রাখতে হবে। এই মানুষটা সবগুলো দাঁত বের করে বলল, 'চিন্তা নাই, আমারও রক্তের গ্রুপ একই'।
আহারে, রক্তের ঋণ শোধ হয় কেমন করে কে জানে!
... ... ... এই অংশটুকু পরে যোগ করা:
আজ ৩১ জানুয়ারি, আমি যখন এই লেখাটা লিখছি, এরই মধ্যে দিনটা পার হয়ে গেছে। এই মানুষটার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর, এমন কোনো বছর যায়নি যে বছর আমার জন্মদিনে মানুষটা আমাকে শুভেচ্ছা জানায়নি। এবারই তার ব্যতিক্রম হলো! আমি কখনও একে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছি বলে মনে পড়ে না কিন্তু এ ঠিক-ঠিক আমারটা মনে রেখেছে। আসলে আমার ছাতার জন্মদিন বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে সেটা আজ বড় পানসে!
এই মানুষটাকেই মেজর থাকাকালীন সেনাবাহিনী থেকে অকালীন অবসর দেয়া হয়েছিল। আজ জানলাম এই মানুষটাকেই সাম্প্রতিক সরকার উৎখাতের ঘটনায় আটক করা হয়েছে। আমি এই মানুষটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, এ দেশের কোনো ক্ষতি করার কথা ভাবতেও পারে এটা অন্তত আমার বিশ্বাস না। অন্যায় প্রসঙ্গে ওই মানুষটা ছিল আপোষহীন- নিজের বাপকেও ছাড় দিতে নারাজ। যে মানুষটা বিচিত্র কারণে আমাকে পছন্দ করত সেই মানুষটাই একবার স্পষ্ট করে, কাটা-কাটা গলায় আমাকে বলেছিল, 'আলী ভাই, আপনি কোনো দু-নম্বুরির সঙ্গে নাই তো'?
তখন এক বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে আমার ঝামেলা যাচ্ছিল। এরা অহেতুক আমাকে অপদস্ত করার চেষ্টা করছিল। মোদ্দা কথা, ও আমাকে সহায়তা করবে যদি আমি সঠিক পথে থাকি, নইলে না। যাই হোক...।
যে মানুষটা জঙ্গিদের দাবড়ে ধরেছে সেই মানুষটাই আজ জঙ্গির সঙ্গে জড়িত এটা আমাতে শুনতে হচ্ছে, হা ঈশ্বর!
এই দেশ তার সেরা সন্তানদের ধরে রাখতে পারে না এ তো নতুন কিছু না। আহা, আজ সবাই এই ছেলেটার হাত সবাই ছেড়ে দিলেও আমি কেমন করে অস্বীকার করব এ আমার বন্ধু না!
আজ এই দেশের ১৬ কোটি মানুষ এই ছেলেটার হাত ছেড়ে দিলেও আমি কেমন করে এর হাত ছেড়ে দেব, এমন শক্তি আমার কই! এই কারণে কেউ আমাকে জঙ্গি বানিয়ে দিলেও আমার কিচ্ছু যায় আসে না! মাই ফুট!
তবে আমি অপত্যস্নেহে অন্ধ একজন মানুষ নই- আমার সন্তানের বেলায়ও একই কথা। কেউ অন্যায় করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে এতে আমার কোনো বক্তব্য নাই। কিন্তু আমি এও বিশ্বাস করি, এই মানুষটা কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না।
এও বিশ্বাস করি, অহেতুক কেউ এর ক্ষতি করতে পারবে না কারণ অসংখ্য মানুষের ব্লেসিং তাড়া করছে এই মানুষটাকে। আমার ব্লেসিংও। কেউ কী আজ এটা বিশ্বাস করবে, তত্বাবধায়ক সরকারের সময় এই মানুষটা যখন ঢাকার টাস্কফোর্স কমান্ডার তখন কোটি-কোটি টাকার অন্যায্য সুযোগ নিতে পারত ওই মানুষটা অনায়াসে সেই লোভকে জয় করতে পেরেছিল। তার কারণে তখন সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছিল শত কোটি টাকা। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? টোল প্লাজার শত-শত কোটি টাকার টোল ফাঁকির কথা কি আপনাদের মনে আছে?
অথচ এই মানুষটা একবার দরিদ্র একটা মানুষের কাজ করে দিয়েছিল সেই মানুষটা তার গাছের কয়েকটা কাঁচা আম নিয়ে এসেছিল। একজনের গাছের সামান্য কয়েকটা কাঁচা আম ভেট পেয়ে কী ঝলমলই না করে উঠেছিল এর মুখ [৩]!
তদন্ত চলছে। আমি নিশ্চিত, এই মানুষটার প্রতি সুবিচার করা হবে। অতীতে এই মানুষটার দেশের প্রতি দায়বোধ, দেশের প্রতি অসাধারণ কর্তব্য হিসাবের মধ্যে রাখা হবে। আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষের উপর আস্থা রাখতে চাই।
এই দেশের দেশপ্রেমিকের তালিকা করার দায়িত্ব আমাকে কেউ দিলে আমি এই মানুষটার নামও রাখব। দেশের প্রতি মমতার কথা যদি বলা হয়, যদি, যদি সেখানে আমাদের দুজনের মধ্যে কাউকে বেছে নিতে বলা হলে আমি নিজেকে একপাশে সরিয়ে চোখ বন্ধ করে এই মানুষটিকেই বেছে নেব। এ আমার বিশ্বাস, নিশ্চিত বিশ্বাস।
এই দেশ তার এই সেরা সন্তানকে ফেলে দেবে এ আমি বিশ্বাস করি না...। আমি আশায় বুক বাঁধি। সত্যের তরবারি দিয়ে সমস্ত অপবাদ একপাশে সরিয়ে আবারও মেজর জাকির নামের এই মানুষটা আমার সামনে এসে দাঁড়াবে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, ঠিক আগের মত করে। আমি অপেক্ষায় আছি...।
আই বেট, এই মানুষটার সঙ্গে জাস্টিস, জাস্টিসই হবে। নইলে, নইলে এ যে এক ভয়াবহ বিপর্যয় যেখানে সভ্যতা থমকে দাঁড়ায়! রাষ্ট্র যার আরেক নাম পিতা, সে যদি এমন-এক ভয়াবহ অন্যায় করে তাহলে পাক খেয়ে উবে যায় তার সমস্ত অর্জন। আহ, এই মানুষটার সন্তান, তারা অন্যদের চোখে চোখ রাখবে কেমন করে? আজীবন তারা কাঁধে বয়ে বেড়াবে এই গ্রহের সবচেয়ে কঠিন ওজন। তার নিষ্পাপ বাবার মিথ্যা পাপের ভার। সত্যটা হচ্ছে, উল্টো রাষ্ট্র চোখ রাখবে কেমন করে এই মানুষটার সন্তানদের চোখে? তখন নিরুপায় নগ্ন রাষ্ট্র হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াবে এক চিলতে কাপড়...!* এন্ড অব দ্য ডে:
মেজর জাকির নামের এই মানুষটাকে ১১ দিন গুম করে রাখা হয়েছিল। তাঁর পরিবার জানতই না এই মানুষটা আদৌ কোথায় আছেন! এরপর বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছিল প্রায় ৭৫০ দিন [৫]! তারপর জেল- সে আরেক প্রহসন। ২ বছর কাশেমপুর কারাগারে বিনা অপরাধে জেলখাটা।এই রাষ্ট্রের অপার সৌভাগ্য যে এখনও এখানে রোদ উঠে, বৃষ্টি হয়, গাছের গা থেকে ছিটকে বের হয় সবুজ আলো, পাখিরা কিচিরমিচির করে!কেবল, কেবল রাষ্ট্র নামের নগ্ন পিতার এই ক্ষমতাটুকু নেই মেজর জাকির নামের এই মানুষটার সন্তানদের চোখে চোখ রাখার...!
সহায়ক সূত্র:
১. বৈদেশপর্ব...: http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post_8079.html ২. হাসপাতাল...: http://www.ali-mahmed.com/2011/12/blog-post_05.html
৩ দাউদ হায়দার: https://www.ali-mahmed.com/2009/02/blog-post_21.html
৪. এই মুত্যু উপত্যকায় দাঁড়াবার জায়গা কোথায়!: http://www.ali-mahmed.com/2009/11/blog-post_08.html
৪. এই মুত্যু উপত্যকায় দাঁড়াবার জায়গা কোথায়!: http://www.ali-mahmed.com/2009/11/blog-post_08.html
No comments:
Post a Comment