লম্বা একটা সময় ধরে আমার অনলাইনে লেখালেখি করা হচ্ছে না! আমার ধারণা ছিল এটা কেউ লক্ষ করবেন না কিন্তু কেউ-কেউ ভারী উদ্বিগ্ন হয়েছেন। আলাদা করে জানতেও চেয়েছেন, আমি কি অসুস্থ নাকি কোনো সমস্যায় পড়েছি। ওই সব মানুষদের প্রতি কেবল গভীর কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করি না এটাও জানার প্রবল আগ্রহ, আপনাদের মনে এতো মায়া কেন গো!
আমি আসলে একটি পাক্ষিক পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। নড়বড়ে একটা নৌকা নিয়ে সাগর পাড়ি দেয়ার মত- তা, কেন এই বোকামীটা করতে গেলাম? বোকামীর গল্পটা বলি। সেটা বছর দেড়েক আগের কথা...।
ডা. গুলজার হোসেনের সঙ্গে আমার পরিচয় সম্ভবত বছর দুয়েক হবে। আমি যে স্কুলগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলাম, সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা- যেখানে মেথরপট্টির বাচ্চারা, অন্ধ বাবা-মাদের সন্তান এবং রেলস্টেশনের পানি বিক্রেতা বাচ্চারা ওই স্কুলগুলোয় পড়ত, সেখানে একটা বিষয় নিয়ে খুব বিপদে, মন খারাপ করে থাকতাম। সেটা হচ্ছে, এদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে। কারণ এই বাচ্চাদের একটু দেখে দেবেন- হাসপাতালের কোনো ডাক্তারদেরকে হাতেপায়ে ধরেও রাজি করাতে পারিনি। কারো এফসিপিএস পরীক্ষা তো কেউ হাজার টাকা চেয়ে বসেন!
তো, এই ডা. গুলজার এই স্কুল তিনটার সমস্ত বাচ্চাদেরকে কেবল যে বিনে পয়সায় দেখে দিতেন এমনই না, বিনে পয়সায় ওষুধেরও ব্যবস্থা করে দিতেন। কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি তখন আমার মাথা থেকে ভারী একটা বোঝাও নেমে গিয়েছিল।
পরে তিনি এখান থেকে বদলি হয়ে গেলেন কিন্তু এখানকার সঙ্গে যোগটা রয়ে গেল। শুক্রবার, সপ্তাহে একদিন এখানে আসাটা নিয়মিত রাখলেন। দুপুর বেলা আমরা একসঙ্গে ভাত খাই। গান শুনি, হাবিজাবি কাজ করি। ফাঁকে ফাঁকে আমি চাঁদাবাজিও করি। স্কুলের শিক্ষকের বেতন বা ঘর ভাড়া দিতে না-পারলে নির্লজ্জের মত বলি, মাস্টারের বেতন দিতে হইব, টাকা দেন...।
যাই হোক, কী এক কথার প্রসঙ্গে একদিন তিনি বললেন, 'চলেন, একটা পত্রিকা বের করি'। আমিও বললাম, 'চলেন...'।
সেই শুরু! এরপর আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন দুজন দুঁদে সাংবাদিক, বিশ্বজিৎ পাল বাবু এবং সমীর চক্রবর্তী। আমরা ইচ্ছা করলে পত্রিকাটি সাপ্তাহিকের জন্য আবেদন করতে পারতাম কিন্তু আমরা চাইনি চিপসের ঠোঙার মত পত্রিকাটি হোক, তাই পাক্ষিকই সই।
ওয়াল্লা, একটা পত্রিকা বের করার জন্য দেখি হাজার-হাজার নিয়মকানুন। একটা শেষ করলে অন্যটা এসে হাজির হয়। তিনটা নাম পাঠাবার নিয়ম। কম পছন্দের তিন নাম্বার নামটাই পত্রিকার নামের অনুমতি পাওয়া গেল সরকারের কাছ থেকে, 'খবরের খোঁজে'।
দিন যায়, মাস যায়, বছরও...কিন্তু পত্রিকা প্রকাশ করার অনুমতিপর্ব আর পাওয়া যায় না! নমুনা দেখে আমার বিরক্তির একশেষ। মেজাজ খারাপ হয়। আমি রগড় করে পত্রিকাটার নাম বদলে দিতাম, 'কবরের খোঁজে'। সহযোদ্ধা বাবু এবং সমীরকে প্রায়শ বলতাম, একটা জায়গা দেখো, যেখানে এপিটাফে লেখা থাকবে, এখানে শুয়ে আছে, কবরের খোঁজে। এরা দুজন আমার রসিকতাটা শুনে মুখ লম্বা করত। এরা আমার সম্বন্ধে মনে মনে দু-চারটা মন্দ কথা যে বলেনি এর নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি না।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত অনুমতি পাওয়া গেল- পত্রিকাটি আলোর মুখ দেখল। কিন্তু একটা পত্রিকা বের করা যে কী অসাধ্য এক কাজ এটা যদি আগে জানতাম! ফুটো নৌকা নিয়ে...সখি, আগে জানলে...!
অবশ্য অনেকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেন। প্রবাসে থাকেন এমন একজন পত্রিকা বের হওয়ার পূর্বেই এক হাজার কপি কিনে ফেললেন! ঘটনা কী! না, বিষয় অন্য কিছু না- তিনি চান, স্কুলের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে একটা করে পত্রিকা বিনে পয়সায় সৌজন্য কপি হিসাবে দেয়া হোক। যেন এদের মধ্যে পড়ার অভ্যাসটা গড়ে উঠে।
তো, শেষমেশ পাক্ষিক এই পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা, দ্বিতীয় সংখ্যাও ছাপা হয়ে গেল, তৃতীয় সংখ্যার কাজ চলছে। স্বল্প জায়গায় অনেক কিছুই দেয়ার চেষ্টা ছিল। এলাকার সংবাদের পাশাপাশি হাবিজাবি, কৌতুক, ধাঁধাঁ কিছুই বাদ গেল না। কী সর্বনাশ, এখন দেখি রাস্তাঘাটে বাচ্চাদের বাপও আমাকে ধাঁধাঁ জিজ্ঞেস করেন, 'বলেন তো, কোন সাগরের উপর দিয়ে ট্রেন চলে'? মহা মুসিবত দেখি!
আমরা ঠিক করলাম, প্রত্যেক সংখ্যায় একজন করে নায়কের লেখা ছাপব। সিনেমার নায়ক না, আসল নায়ক। যেমন প্রথম সংখ্যায় নায়ক ছিলেন একজন রিকশাচালক, লিটন মিয়া। কেন তিনি নায়ক? কারণ তিনি যাত্রীর ফেলে যাওয়া ৫০ হাজার টাকা পাওয়ার পর অনেক খুঁজে ঠিক সেই মানুষটিকেই ফেরত দিয়েছিলেন। এই ঘটনাটা কোনো জাতীয় পত্রিকা ছাপায়নি। কেন? সম্ভবত এটা তাদের কাছে কোনো গুরুত্ব রাখে না। কারণ এরচেয়ে অনেক জরুরি সংবাদ যেমন কোন নেতা কোন রঙের শাড়ি পরেছেন, কার শাড়ির পাড়টা কোন রঙের এটা ছাপিয়ে জায়গা কোথায়, বাওয়া!
লিটন মিয়া নামের এই রিকশাচালকের কথা অন্য কোনো দিন লিখব...।
* খবরের খোঁজে: http://khoborer-khoje.blogspot.com
আমি আসলে একটি পাক্ষিক পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। নড়বড়ে একটা নৌকা নিয়ে সাগর পাড়ি দেয়ার মত- তা, কেন এই বোকামীটা করতে গেলাম? বোকামীর গল্পটা বলি। সেটা বছর দেড়েক আগের কথা...।
ডা. গুলজার হোসেনের সঙ্গে আমার পরিচয় সম্ভবত বছর দুয়েক হবে। আমি যে স্কুলগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলাম, সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা- যেখানে মেথরপট্টির বাচ্চারা, অন্ধ বাবা-মাদের সন্তান এবং রেলস্টেশনের পানি বিক্রেতা বাচ্চারা ওই স্কুলগুলোয় পড়ত, সেখানে একটা বিষয় নিয়ে খুব বিপদে, মন খারাপ করে থাকতাম। সেটা হচ্ছে, এদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে। কারণ এই বাচ্চাদের একটু দেখে দেবেন- হাসপাতালের কোনো ডাক্তারদেরকে হাতেপায়ে ধরেও রাজি করাতে পারিনি। কারো এফসিপিএস পরীক্ষা তো কেউ হাজার টাকা চেয়ে বসেন!
তো, এই ডা. গুলজার এই স্কুল তিনটার সমস্ত বাচ্চাদেরকে কেবল যে বিনে পয়সায় দেখে দিতেন এমনই না, বিনে পয়সায় ওষুধেরও ব্যবস্থা করে দিতেন। কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি তখন আমার মাথা থেকে ভারী একটা বোঝাও নেমে গিয়েছিল।
পরে তিনি এখান থেকে বদলি হয়ে গেলেন কিন্তু এখানকার সঙ্গে যোগটা রয়ে গেল। শুক্রবার, সপ্তাহে একদিন এখানে আসাটা নিয়মিত রাখলেন। দুপুর বেলা আমরা একসঙ্গে ভাত খাই। গান শুনি, হাবিজাবি কাজ করি। ফাঁকে ফাঁকে আমি চাঁদাবাজিও করি। স্কুলের শিক্ষকের বেতন বা ঘর ভাড়া দিতে না-পারলে নির্লজ্জের মত বলি, মাস্টারের বেতন দিতে হইব, টাকা দেন...।
যাই হোক, কী এক কথার প্রসঙ্গে একদিন তিনি বললেন, 'চলেন, একটা পত্রিকা বের করি'। আমিও বললাম, 'চলেন...'।
সেই শুরু! এরপর আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন দুজন দুঁদে সাংবাদিক, বিশ্বজিৎ পাল বাবু এবং সমীর চক্রবর্তী। আমরা ইচ্ছা করলে পত্রিকাটি সাপ্তাহিকের জন্য আবেদন করতে পারতাম কিন্তু আমরা চাইনি চিপসের ঠোঙার মত পত্রিকাটি হোক, তাই পাক্ষিকই সই।
ওয়াল্লা, একটা পত্রিকা বের করার জন্য দেখি হাজার-হাজার নিয়মকানুন। একটা শেষ করলে অন্যটা এসে হাজির হয়। তিনটা নাম পাঠাবার নিয়ম। কম পছন্দের তিন নাম্বার নামটাই পত্রিকার নামের অনুমতি পাওয়া গেল সরকারের কাছ থেকে, 'খবরের খোঁজে'।
দিন যায়, মাস যায়, বছরও...কিন্তু পত্রিকা প্রকাশ করার অনুমতিপর্ব আর পাওয়া যায় না! নমুনা দেখে আমার বিরক্তির একশেষ। মেজাজ খারাপ হয়। আমি রগড় করে পত্রিকাটার নাম বদলে দিতাম, 'কবরের খোঁজে'। সহযোদ্ধা বাবু এবং সমীরকে প্রায়শ বলতাম, একটা জায়গা দেখো, যেখানে এপিটাফে লেখা থাকবে, এখানে শুয়ে আছে, কবরের খোঁজে। এরা দুজন আমার রসিকতাটা শুনে মুখ লম্বা করত। এরা আমার সম্বন্ধে মনে মনে দু-চারটা মন্দ কথা যে বলেনি এর নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি না।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত অনুমতি পাওয়া গেল- পত্রিকাটি আলোর মুখ দেখল। কিন্তু একটা পত্রিকা বের করা যে কী অসাধ্য এক কাজ এটা যদি আগে জানতাম! ফুটো নৌকা নিয়ে...সখি, আগে জানলে...!
অবশ্য অনেকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেন। প্রবাসে থাকেন এমন একজন পত্রিকা বের হওয়ার পূর্বেই এক হাজার কপি কিনে ফেললেন! ঘটনা কী! না, বিষয় অন্য কিছু না- তিনি চান, স্কুলের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে একটা করে পত্রিকা বিনে পয়সায় সৌজন্য কপি হিসাবে দেয়া হোক। যেন এদের মধ্যে পড়ার অভ্যাসটা গড়ে উঠে।
তো, শেষমেশ পাক্ষিক এই পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা, দ্বিতীয় সংখ্যাও ছাপা হয়ে গেল, তৃতীয় সংখ্যার কাজ চলছে। স্বল্প জায়গায় অনেক কিছুই দেয়ার চেষ্টা ছিল। এলাকার সংবাদের পাশাপাশি হাবিজাবি, কৌতুক, ধাঁধাঁ কিছুই বাদ গেল না। কী সর্বনাশ, এখন দেখি রাস্তাঘাটে বাচ্চাদের বাপও আমাকে ধাঁধাঁ জিজ্ঞেস করেন, 'বলেন তো, কোন সাগরের উপর দিয়ে ট্রেন চলে'? মহা মুসিবত দেখি!
আমরা ঠিক করলাম, প্রত্যেক সংখ্যায় একজন করে নায়কের লেখা ছাপব। সিনেমার নায়ক না, আসল নায়ক। যেমন প্রথম সংখ্যায় নায়ক ছিলেন একজন রিকশাচালক, লিটন মিয়া। কেন তিনি নায়ক? কারণ তিনি যাত্রীর ফেলে যাওয়া ৫০ হাজার টাকা পাওয়ার পর অনেক খুঁজে ঠিক সেই মানুষটিকেই ফেরত দিয়েছিলেন। এই ঘটনাটা কোনো জাতীয় পত্রিকা ছাপায়নি। কেন? সম্ভবত এটা তাদের কাছে কোনো গুরুত্ব রাখে না। কারণ এরচেয়ে অনেক জরুরি সংবাদ যেমন কোন নেতা কোন রঙের শাড়ি পরেছেন, কার শাড়ির পাড়টা কোন রঙের এটা ছাপিয়ে জায়গা কোথায়, বাওয়া!
লিটন মিয়া নামের এই রিকশাচালকের কথা অন্য কোনো দিন লিখব...।
* খবরের খোঁজে: http://khoborer-khoje.blogspot.com
No comments:
Post a Comment