বাবা রাজাকার,
মেয়ে মুক্তিযোদ্ধা! যেমন-তেমন না, দুর্ধর্ষ এক মুক্তিযোদ্ধা! যার কল্যণে মুক্ত
হয়েছিল মুকুন্দপুর নামের বিশাল এক এলাকা। নিহত হয়েছিল অসংখ্য পাকিস্তানী সৈন্য। তাঁর
নাম সায়েরা বেগম। তাঁর সম্বন্ধে প্রকাশ্যে বলেছেন তৎকালীন ৩ নং সাব-সেক্টরের
কমান্ডার, মেজর জেনারেল সায়ীদ আহমেদ (অব.)। লিখিত আকারেও তিনি সায়েরা বেগম
সম্বন্ধে বলেন:
“...সায়েরা
বেগমের বিস্তারিত এবং নির্ভুল তথ্যের উপর ভিক্তি করে মুকুন্দপুরে ১৮ ও ১৯ নভেম্বর ‘৭১-এ
পাকিস্তানি বাহিনীর উপর তীব্র আক্রমণ চালিয়ে অনেক পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা এবং ২৯
জনকে বন্দী করে মুকুন্দপুর শক্রমুক্ত করি। পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজের জীবন
বাজী রেখে সায়েরা বেগম মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন।...।“
এই অসামান্য মানুষটার
খোঁজ পেলাম কেমন করে? দুলাল ঘোষ সেদিন আমাকে বললেন, ‘এই
ভদ্রমহিলার খোঁজ পেয়েছি, যাবেন’? আরে, এ বলে কী- পাগল নাকি, যাবো না
মানে! আমি একমুহূর্ত না-ভেবে বলি, ‘চলেন, এখনই
যাই’।
দুলাল ঘোষ নামের এই মানুষটার আছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সুতীব্র আবেগ কিন্তু এই
মানুষটাকে ছাই দিয়ে না-ধরলে ফসকে যাবে। চেপে বসি
তাঁর ‘পঙ্খিরাজ’
যার চালু নাম মটর-সাইকেলের পেছনে।
তখন পড়ন্ত বিকেল। ২০ কিলোমিটার রাস্তা।
উত্তেজনায় আমার খেয়াল ছিল না গায়ে আমার পাতলা শার্ট। সময় গড়ায়। মটর-সাইকেলের তীব্র
গতির সঙ্গে শীতল বাতাস আমাকে অনেকখানি কাবু করে ফেলে।
দুলাল ঘোষ বিজবিজ করে কীসব বলছিলেন আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম না কারণ আমার মাথায়
তখন ঘুরপাক খাচ্ছে ফেরার সময় তো প্রায় রাত হয়ে যাবে। তখন ঠান্ডা আরও
বাড়বে। আমার আবার ঠান্ডায় বিরাট সমস্যা- শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়।
পৌঁছার পর এই সমস্ত জাগতিক সমস্যা আর
মাথায় থাকে না। মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনি এই অসমসাহসী
সায়েরা বেগম নামের মানুষটার কথা। ১৯৭১ সালে
সায়েরা বেগমের বয়স ১৬ বছর। তাঁর রাজাকার বাবার কাছে যখন পাকিস্তানী সৈন্যরা আসত
তখন তিনি আড়ালে থেকে সমস্ত কথা শুনতেন। গল্পচ্ছলে বাবার কাছ থেকে জেনে নিতেন,
পাকিস্তানী সৈন্যরা সংখ্যায় কতজন, তাদের কাছে কি কি অস্ত্র আছে,
তাদের গতিবিধি...। পরে তাঁর এই সমস্ত তথ্যগুলোর উপর ভিক্তি করে
তৎকালীন ৩ নং সাব-সেক্টরের কমান্ডার, মেজর জেনারেল সায়ীদ আহমেদ
(অব.) ১৯ নভেম্বর মুক্ত করেন মুকুন্দপুর। তাঁর তথ্যের উপর ভিক্তি করে এই অঞ্চল
মুক্ত করতে খরচ হয়েছিল মাত্র ২৯টা বুলেট!
তাঁকে রাষ্ট্র আর্থিক কোনো আর্থিক
সুবিধা দেয়া দূরের কথা স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়নি! অথচ তার পক্ষে তৎকালীন ৩ নং
সাব-সেক্টরের কমান্ডার, অনেক মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য মানুষ লিখিত আকারে সনদ
দিয়েছেন। সায়েরা বেগম পাঁচ বছর ধরে সেই সমস্ত কাগজ নিয়ে এদিক-ওদিক
লাটিমের মত পাক খেয়েছেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এই কারণেই ঢাকায়
গিয়েছেন অনেকবার। একা-একা তো যেতে পারেন না সঙ্গে তাঁর স্বামীকেও যেতে হয়। তাঁর
স্বামী আবার ডায়াবেটিসের রোগি এবং অনেকগুলো অপারেশন হওয়ার কারণে প্রায় পঙ্গু। তাই
সঙ্গে অন্যদেরকেও নিতে হতো। হোটেলে থাকা-খাওয়া এবং
বিভিন্ন কারণে খরচ হয়েছে হাজার-হাজার টাকা। কিন্তু ফলাফল শূন্য!
লাভের লাভ যা হয়েছে তা হলো কপালে জুটেছে
তাচ্ছিল্য! ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের লোকজন মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথাগুলো পর্যন্ত
শোনেনি! শ্লেষভরা কন্ঠে বলেছে, আপনার মত এমন অনেক মহিলাই তো তথ্য
দিয়েছে, তাতে কী হয়েছে!
এই সমস্ত কারণে সায়েরা বেগমের স্বামী
ক্ষুব্ধ, তিতিবিরক্ত। আমি এই ভদ্রলোকের ক্ষোভের বিষয়টা খানিকটা বুঝতে পারি। তিনি
যদি বাড়ির গেটে এই নোটিশ ঝুলিয়ে দিতেন, ‘... এবং
সাংবাদিক প্রবেশ নিষেধ’, তাহলে আমি অন্তত বিন্দুমাত্র অবাক
হতাম না।
আমি দুলাল ঘোষকে আড়াল করে মানুষটার
সামনে দাঁড়াই- তাঁকে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁর বুকটা হালকা হতে দেই।
ফাঁকে-ফাঁকে আমার আস্তিনে লুকিয়ে থাকা অস্ত্রগুলো একের-পর-এক ছুড়ে দেই। বলি, ‘চাচা,
আপনি কী জানেন, আমরা এই প্রজন্ম কোনো মুক্তিযোদ্ধার সামনে বসি না। আপনি কী
বললে বিশ্বাস করবেন যে একজন ডাক্তার ট্রেনে যাওয়ার সময় সিট
ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান কারণ তখন ট্রেনটা যে জায়গা অতিক্রম করে সেটা একজন বীরশ্রেষ্ঠ
মোস্তফা কামালের’?
মানুষটার মুখের রেখাগুলো ক্রমশ নরোম হয়ে
আসে। চলে আসার সময় সায়েরা বেগম ঠিকই লক্ষ করেন আমার গায়ের পাতলা শার্ট।
তিনি যখন বলেন, ‘বাবা,
ঠান্ডা লাগব তো, একটা শাল নিয়া যান; পরে ফেরত পাঠায়া দিয়েন’।
তখন আমার চোখ ভরে আসে। তখনও আমি জানতাম না আবারও আসতে পারব কিনা? কারণ আমার দু-পা
ব্যতীত অন্য কোনো বাহন নাই তার উপর আমার কুখ্যাত স্মৃতিশক্তি। পরে দুলাল ঘোষকে
পাওয়া না-গেলে তখন উপায়? জায়গাটাও
তো চিনতে পারব না! আমি মিথ্যা বলি, ‘না, গরম কাপড়
আছে। মটর-সাইকেলে রেখে এসেছি’।
ফেরার পথে কেমন করে এই দীর্ঘ পথ পার হয়ে
এসেছিলাম সেটার আলোচনা জরুরি না।
...
আজ দুলাল ঘোষকে বললাম, দুলাল, চলেন,
আজকের এই ১৬ ডিসেম্বরটা অন্য রকম করে পালন করি। সায়েরা
বেগমকে দেখে আসি। আমরা দুজনেই অনেকটা ‘দিন
আনি দিন খাই’
টাইপের মানুষ তবুও পছন্দ করে সায়েরা বেগম এবং তাঁর স্বামীর জন্য সামান্য উপহার
নিয়ে যাই। বিশেষ কিছু না, একটা শাড়ি, একটা পাঞ্জাবি। এমন না এঁরা খুবই অস্বচ্ছল,
এমন না এঁরা এই কাপড় কিনতে পারবেন না তবুও আমি খানিকটা
অনুমান করেছিলাম এই মানুষগুলো খুশি হবেন, তাঁদের তীব্র বেদনা যৎসামান্য হলেও লাঘব
হবে। কারণ এই সামান্য উপহারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই প্রজন্মের আবেগ।
কিন্তু...কিন্তু...। না, আমি তাঁদের অভিব্যক্তির বর্ণনা দেব না। কারণ সেটা
বড়ো নাটকীয় মনে হবে...।
আমরা আগের বার
এটাও জানতে পারিনি তাঁদের কোনো সন্তান নেই, হয়নি।
যাই হোক, সায়েরা বেগম আমাদের কাছে সবই
বলেছিলেন, অকপটে। কিন্তু অতি জরুরি একটা বিষয় তিনি সযতনে গোপন করেছিলেন। ভাগ্যিস,
আজ তিনি অসতর্ক এক মুহূর্তে ধরা পড়ে গেছেন। সায়েরা বেগমের পেটে টিউমার- টাকার জন্য
তিনি অপারেশন করাতে পারছেন না!
আমি জানি না তাঁর পেটে কোন প্রকৃতির
টিউমার, এটা অপারেশন করতে কেমন টাকাই-বা লাগবে? কেবল জানি- জানিই না কেবল, আমি
বিশ্বাস করি, সায়েরা বেগমের টিউমারের অপারেশন হবে, হবেই, হতেই হবে...।
*সায়েরা
বেগম আমাকে এটাও জানিয়ে ছিলেন, তাঁর দেয়া তথ্যের কারণে এই এলাকায় একজন
মানুষকেও ধরা পড়তে হয়নি বা কোনো নারীকেও সম্ভ্রম হারাতে হয়নি কারণ তিনি এই
সংক্রান্ত তথ্য জানামাত্র মুক্তিবাহিনীর লোকজনকে আগাম জানিয়ে দিতেন।
সায়েরা বেগমের পক্ষে এতো দালিলিক প্রমাণ যার সবগুলো আমি এখানে দিতে পারিনি। আমরা যে সমস্ত কর্মচারি পুষি, যাদের অধিকাংশই পাজারো হাঁকিয়ে বেড়ান তাদের কাঁচা রাস্তার ধুলো উড়িয়ে, সায়েরা বেগমের বাড়িতে গিয়ে এই সমস্যার সমাধান করাটাই সমীচীন ছিল। কিন্তু দেশটা যে বাংলাদেশ...! সায়েরা বেগমের অসংখ্য দালিলিক প্রমাণের কিছু অংশ এখানে দেয়া হলো।
সায়েরা বেগমের পক্ষে এতো দালিলিক প্রমাণ যার সবগুলো আমি এখানে দিতে পারিনি। আমরা যে সমস্ত কর্মচারি পুষি, যাদের অধিকাংশই পাজারো হাঁকিয়ে বেড়ান তাদের কাঁচা রাস্তার ধুলো উড়িয়ে, সায়েরা বেগমের বাড়িতে গিয়ে এই সমস্যার সমাধান করাটাই সমীচীন ছিল। কিন্তু দেশটা যে বাংলাদেশ...! সায়েরা বেগমের অসংখ্য দালিলিক প্রমাণের কিছু অংশ এখানে দেয়া হলো।
**দুলাল ঘোষের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা
1 comment:
ভালো , সরকার মূল্যায়ন করলেই হল ।
Tender And Consulting Opportunities in
Bangladesh
Post a Comment