পূর্বের লেখায় বলেছিলাম, গত ৪ দিন ধরে একটা মানুষকে নিয়ে কস্তাকস্তি করছি। এই-ই মানুষটাকে নিয়ে। এঁকে আমি ৪ দিন আগে পেয়েছিলাম, স্টেশনের শীতল মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন। যদিও তখন সকাল ১০টা কিন্তু রোদের দেখা নেই, তীব্র বাতাস। আমার নিজের গায়ে ভারী-ভারী কাপড়! মানুষটার মুখ থুবড়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকার ভঙ্গি দেখে আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম মানুষটা আর বেঁচে নেই।
আগেও লিখেছিলাম, আমার ভেতরের শিশু এবং পশুটার লড়াই হরদম লেগেই থাকে- কখন কে জেতে এটা আগাম বলা মুশকিল। আমি আমার ভেতরের পশুটার গায়ের গন্ধ বিলক্ষণ টের পাই- এর ভঙ্গি আমার চেনা। ভেতরের পশুটার জোর লড়াই: সরে যা, সরে যা, ঝামেলা। ভেতরের শিশুটা কী কেরামতি করে আমি জানি না কিন্তু এই মানুষটার মতই আমার ভেতরের পশুটাও তখন মুখ থুবড়ে পড়ে।
যাই হোক, আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে এই মানুষটা জানান দেন, আমি মরি নাই-আমি মরি নাই! অতি বয়স্ক এই মানুষটা অসাধারণ প্রাণশক্তি দেখে আমি হতভম্ব!
এরপর মানুষটাকে বাঁচাবার জন্য যা করা প্রয়োজন ছিল...এর বিশদ আলোচনা এখানে জরুরি না। সেই রাতে আমি যখন আমার নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে আসি- আমার মাথার নিরাপদ ছাদ, ঘরের উষ্ণতা আমাকে বড়ো অপরাধি করে দেয়। নিজের অক্ষমতা আমাকে বড়ো যন্ত্রণা দিচ্ছিল। আমি অজান্তেই বিড়বিড় করি, আমার মস্তিষ্কের যে অংশটা এই সমস্ত দৃশ্য দেখে আহত হয় মস্তিষ্কের সেই অংশটা কেন বিকল হয়ে যায় না?
তখন ভেতরের পশুটা হি হি করে হেসে বলে: ব্যাটা, পরের দিন গিয়ে দেখবি মানুষটা মরে পড়ে আছে। ভাবিস না, মরে গিয়ে তোকে বাঁচিয়ে দেবে।
পরের দিন। মানুষটার নড়াচড়ার শক্তি তখনও হয়নি কিন্তু তাঁর বেঁচে থাকার লড়াই আমাকে অবাক করে। মানুষটাকে তরল খাবার ইচ্ছা করেই দেয়া হচ্ছিল কারণ তাঁর বাথরুম সমস্যা। তাঁর নিজে নিজে বাথরুম করার ক্ষমতা ছিল না। সেদিন মানুষটার হাসি এখনও আমার চোখে ভাসে- কী এক অপার্থিব!
দুদিনের মাথায় এই মানুষটার গায়ের কম্বল উধাও! এটা আমাকে অবাক করে না কারণ স্টেশনের মত খোলা জায়গায় এটা বিচিত্র কিছু না। এটা কোনো এক নেশাখোরের কান্ড কারণ সুস্থ কেউ এই মানুষটার গা থেকে কম্বল নিয়ে যাবে এটা আমি বিশ্বাস করি না।
এই লড়াকু মানুষটা ৪দিন ধরে লড়ে যাচ্চিলেন- ক্রমশ সুস্থও হয়ে উঠছিলেন। যতটুকু জানা গেল তিনি থাকেন ঢাকার গাজীপুরে। কিন্তু গাজীপুরের ঠিক কোথায় তাঁর জড়ানো কথায় বোঝা সম্ভব হলো না। মানুষটা ফেরার জন্য অস্থির হয়ে ছিলেন। বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে ঢাকার ট্রেনে উঠায়া দেন, বাড়িতে চিন্তা করব’।
আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনার এখনও যে অবস্থা- ঠিকমত বসতেই তো পারেন না, আপনি তো একা-একা যেতে পারবেন না। আরেকটু সুস্থ হোন আপনার সঙ্গে কোনো লোক দিয়ে আপনাকে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হবে।
যথারীতি আজ সকালে গিয়ে মানুষটাকে আর পাওয়া গেল না। নেই তো নেই, তাঁর সম্বন্ধে কোনো তথ্যও পাওয়া যাচ্ছিল না। এই মানুষটার সঙ্গে আশেপাশে যারা ঘুমাতেন এদের অধিকাংশকেই এখন দিনের বেলায় পাওয়া সম্ভব না। এদের পেতে পেতে সেই সন্ধ্যা। সন্ধ্যায় এদেরই একজনের কাছে জানা গেল রাতের ট্রেনে এই মানুষটাকে তুলে দেয়া হয়েছে।
স্টেশনে থাকে এমন একজন মহিলা এই কাজটা করেছে। একজন মহিলার পক্ষে একা-একা এই কাজটা করা সম্ভব না, নিশ্চয়ই কোনো-না-কোনো পুরুষ মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছে। এবার সেই লোকটাকে খোঁজার পালা। তন্নতন্ন করেও একে পাওয়া গেল না কারণ এ এখানে স্থায়ি কেউ না। পেলে আমি একে পায়ের জুতা খুলে পেটাতাম এতে অন্য কারো সন্দেহ থাকলেও অন্তত আমার নিজের নেই।
অবশ্য ওই মহিলাকে পাওয়া গেল। অদম্য ক্রোধ পাক খেয়ে উঠে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই কাজটা কেন করলা- যেখানে তুমি দেখেছো এই মানুষটার দাঁড়াবার পর্যন্ত শক্তি নেই? তুমি একটা খুনি, তুমি ওই মানুষটাকে খুন করেছো’। এরপর তার সঙ্গে আমার কথাবার্তা... যা ছাপার অযোগ্য তা আমি এখানে লিখতে চাই না।
ফিরে আসার সময় আমার নিজেকে স্রেফ একজন পরাজিত মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। জাস্ট একটা ‘পাইপমানুষ’- যে পাইপের একপাশে খাবার অন্য পাশে...। চর্বিতচর্বণ- তবুও বলি, শ্লা, আমি গত চার বছর ধরে একটা ওল্ডহোম করার স্বপ্ন দেখে দেখে পার করলাম। আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, একটা ওল্ডহোম চালাতে প্রতি মাসে যে টাকা লাগে অন্তত দুই বছরের টাকার যোগাড় না-হলে এতে হাত দেব না।
কিন্তু এই মানুষটা আমার ভাবনা এলোমেলো করে দিয়ে গেছেন। ওল্ডহোমের আমি গুষ্টি কিলাই। ওল্ডহোম, ‘ছাতাহোম’ বুঝি না। স্বল্প পরিসরে হলেও একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব যেখানে কিছুটা কাল হলেও অন্তত একজন মানুষকেও যেন নিরাপদ একটা ছাদ দেয়া যায়। আর খাবারের ব্যবস্থা? এই বিষয়ে আমার অল্প কথা, কে কাকে খাওয়াতে পারে?
কেমন করে সম্ভব হবে আমি জানি না কেবল জানি, এটা আমাকে করতেই হবে। বাস্তবতা যে ভিন্ন এটা আমি বেশ বুঝি। আমার দায়িত্বে থাকা একজন মানুষের মৃত্যু হলে রাষ্ট্রযন্ত্র যদি আমাকে খুনি বানিয়ে দেয়, এটা অভূতপূর্ব কিছু না।
রাষ্ট্রযন্ত্র কী না পারে! দেশের জন্য জীবন বাজি রাখা একজন মানুষ, যাকে ৭০০ দিন ধরে বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তিনি আমাকে বলছিলেন, ‘ভাই, আমার জন্য কেবল একটাই দোয়া করবেন, যেন আমার মৃত্যু এ দেশে না হয়’!
সবই বুঝি তবুও যে মন মানে না। সেই পুরনো কথাটাই ঘুরেফিরে আসে, একটাই জীবন আমাদের- কে দেখেছে নেক্সট সামার, কে দেখেছে নেক্সট উইন্টার...।
আগেও লিখেছিলাম, আমার ভেতরের শিশু এবং পশুটার লড়াই হরদম লেগেই থাকে- কখন কে জেতে এটা আগাম বলা মুশকিল। আমি আমার ভেতরের পশুটার গায়ের গন্ধ বিলক্ষণ টের পাই- এর ভঙ্গি আমার চেনা। ভেতরের পশুটার জোর লড়াই: সরে যা, সরে যা, ঝামেলা। ভেতরের শিশুটা কী কেরামতি করে আমি জানি না কিন্তু এই মানুষটার মতই আমার ভেতরের পশুটাও তখন মুখ থুবড়ে পড়ে।
যাই হোক, আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে এই মানুষটা জানান দেন, আমি মরি নাই-আমি মরি নাই! অতি বয়স্ক এই মানুষটা অসাধারণ প্রাণশক্তি দেখে আমি হতভম্ব!
এরপর মানুষটাকে বাঁচাবার জন্য যা করা প্রয়োজন ছিল...এর বিশদ আলোচনা এখানে জরুরি না। সেই রাতে আমি যখন আমার নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে আসি- আমার মাথার নিরাপদ ছাদ, ঘরের উষ্ণতা আমাকে বড়ো অপরাধি করে দেয়। নিজের অক্ষমতা আমাকে বড়ো যন্ত্রণা দিচ্ছিল। আমি অজান্তেই বিড়বিড় করি, আমার মস্তিষ্কের যে অংশটা এই সমস্ত দৃশ্য দেখে আহত হয় মস্তিষ্কের সেই অংশটা কেন বিকল হয়ে যায় না?
তখন ভেতরের পশুটা হি হি করে হেসে বলে: ব্যাটা, পরের দিন গিয়ে দেখবি মানুষটা মরে পড়ে আছে। ভাবিস না, মরে গিয়ে তোকে বাঁচিয়ে দেবে।
পরের দিন। মানুষটার নড়াচড়ার শক্তি তখনও হয়নি কিন্তু তাঁর বেঁচে থাকার লড়াই আমাকে অবাক করে। মানুষটাকে তরল খাবার ইচ্ছা করেই দেয়া হচ্ছিল কারণ তাঁর বাথরুম সমস্যা। তাঁর নিজে নিজে বাথরুম করার ক্ষমতা ছিল না। সেদিন মানুষটার হাসি এখনও আমার চোখে ভাসে- কী এক অপার্থিব!
দুদিনের মাথায় এই মানুষটার গায়ের কম্বল উধাও! এটা আমাকে অবাক করে না কারণ স্টেশনের মত খোলা জায়গায় এটা বিচিত্র কিছু না। এটা কোনো এক নেশাখোরের কান্ড কারণ সুস্থ কেউ এই মানুষটার গা থেকে কম্বল নিয়ে যাবে এটা আমি বিশ্বাস করি না।
এই লড়াকু মানুষটা ৪দিন ধরে লড়ে যাচ্চিলেন- ক্রমশ সুস্থও হয়ে উঠছিলেন। যতটুকু জানা গেল তিনি থাকেন ঢাকার গাজীপুরে। কিন্তু গাজীপুরের ঠিক কোথায় তাঁর জড়ানো কথায় বোঝা সম্ভব হলো না। মানুষটা ফেরার জন্য অস্থির হয়ে ছিলেন। বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে ঢাকার ট্রেনে উঠায়া দেন, বাড়িতে চিন্তা করব’।
আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনার এখনও যে অবস্থা- ঠিকমত বসতেই তো পারেন না, আপনি তো একা-একা যেতে পারবেন না। আরেকটু সুস্থ হোন আপনার সঙ্গে কোনো লোক দিয়ে আপনাকে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হবে।
যথারীতি আজ সকালে গিয়ে মানুষটাকে আর পাওয়া গেল না। নেই তো নেই, তাঁর সম্বন্ধে কোনো তথ্যও পাওয়া যাচ্ছিল না। এই মানুষটার সঙ্গে আশেপাশে যারা ঘুমাতেন এদের অধিকাংশকেই এখন দিনের বেলায় পাওয়া সম্ভব না। এদের পেতে পেতে সেই সন্ধ্যা। সন্ধ্যায় এদেরই একজনের কাছে জানা গেল রাতের ট্রেনে এই মানুষটাকে তুলে দেয়া হয়েছে।
স্টেশনে থাকে এমন একজন মহিলা এই কাজটা করেছে। একজন মহিলার পক্ষে একা-একা এই কাজটা করা সম্ভব না, নিশ্চয়ই কোনো-না-কোনো পুরুষ মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছে। এবার সেই লোকটাকে খোঁজার পালা। তন্নতন্ন করেও একে পাওয়া গেল না কারণ এ এখানে স্থায়ি কেউ না। পেলে আমি একে পায়ের জুতা খুলে পেটাতাম এতে অন্য কারো সন্দেহ থাকলেও অন্তত আমার নিজের নেই।
অবশ্য ওই মহিলাকে পাওয়া গেল। অদম্য ক্রোধ পাক খেয়ে উঠে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই কাজটা কেন করলা- যেখানে তুমি দেখেছো এই মানুষটার দাঁড়াবার পর্যন্ত শক্তি নেই? তুমি একটা খুনি, তুমি ওই মানুষটাকে খুন করেছো’। এরপর তার সঙ্গে আমার কথাবার্তা... যা ছাপার অযোগ্য তা আমি এখানে লিখতে চাই না।
ফিরে আসার সময় আমার নিজেকে স্রেফ একজন পরাজিত মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। জাস্ট একটা ‘পাইপমানুষ’- যে পাইপের একপাশে খাবার অন্য পাশে...। চর্বিতচর্বণ- তবুও বলি, শ্লা, আমি গত চার বছর ধরে একটা ওল্ডহোম করার স্বপ্ন দেখে দেখে পার করলাম। আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, একটা ওল্ডহোম চালাতে প্রতি মাসে যে টাকা লাগে অন্তত দুই বছরের টাকার যোগাড় না-হলে এতে হাত দেব না।
কিন্তু এই মানুষটা আমার ভাবনা এলোমেলো করে দিয়ে গেছেন। ওল্ডহোমের আমি গুষ্টি কিলাই। ওল্ডহোম, ‘ছাতাহোম’ বুঝি না। স্বল্প পরিসরে হলেও একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব যেখানে কিছুটা কাল হলেও অন্তত একজন মানুষকেও যেন নিরাপদ একটা ছাদ দেয়া যায়। আর খাবারের ব্যবস্থা? এই বিষয়ে আমার অল্প কথা, কে কাকে খাওয়াতে পারে?
কেমন করে সম্ভব হবে আমি জানি না কেবল জানি, এটা আমাকে করতেই হবে। বাস্তবতা যে ভিন্ন এটা আমি বেশ বুঝি। আমার দায়িত্বে থাকা একজন মানুষের মৃত্যু হলে রাষ্ট্রযন্ত্র যদি আমাকে খুনি বানিয়ে দেয়, এটা অভূতপূর্ব কিছু না।
রাষ্ট্রযন্ত্র কী না পারে! দেশের জন্য জীবন বাজি রাখা একজন মানুষ, যাকে ৭০০ দিন ধরে বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তিনি আমাকে বলছিলেন, ‘ভাই, আমার জন্য কেবল একটাই দোয়া করবেন, যেন আমার মৃত্যু এ দেশে না হয়’!
সবই বুঝি তবুও যে মন মানে না। সেই পুরনো কথাটাই ঘুরেফিরে আসে, একটাই জীবন আমাদের- কে দেখেছে নেক্সট সামার, কে দেখেছে নেক্সট উইন্টার...।
No comments:
Post a Comment