ঢাকা যাওয়া হলো সম্ভব বছর দুয়েক পর। না-গিয়ে উপায় ছিল না কারণ আমার এক সুহৃদের ঝুঁকিপূর্ণ এক অপারেশন। এই মানুষটা সেই অল্প মানুষদের একজন, এই গ্রহে যে অতি অল্প মানুষ বিচিত্র কারণে আমাকে পছন্দ করেন ইনি তাদের একজন। এই মানুষটার কাছে আমি বিভিন্ন প্রকারে ঋণী। আজ তাঁর এই দুঃসময়ে আমার খানিকটা আয়ু দিতে পারার ব্যবস্থা থাকলে মন্দ হতো না।
কপালের ফের, এমন এক মুহূর্তে ঢাকা গেলাম যখন ‘অবরোধ’ এবং ‘বিশ্ব ইজতেমা’ চলছে। অবরোধ বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই- গণতন্ত্রের জন্য এটার প্রয়োজন ছিল, আছে, থাকবে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত।
এমন অস্বাভাবিক অবস্থা দূরের কথা স্বাভাবিক অবস্থাতেই আমি ঢাকামুখো হতে চাই না যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ আমাকে স্টেশন থেকে নিয়ে যাবে। কারণটা আগেও বলেছি, শত-শত বার ঢাকা গেলেও আমি লোকেশন মনে রাখতে পারি না। পাঠকের মনিটর কাঁপানো হাসির ঝুঁকি নিয়েও বলি, আমি স্রেফ হারিয়ে যাই। অনেকের কাছে এটায় বিস্তর হাসির উপাদান থাকলেও আমার জন্য যে কী পরিমাণ যন্ত্রণা এটা কেবল আমি জানি।
পূর্বে বিভিন্ন প্রকারে চেষ্টা করতাম মনে রাখার জন্য, লাভ হয়নি। এখন সে চেষ্টা বাদ দিয়েছি নিজেকে এই সান্ত্বনা দিয়ে, সবার কী আর ব্রেন থাকে রে, পাগলা।
এর সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে আরেক দুর্দশা, আমার চশমা সংক্রান্ত জটিলতা। যে চক্ষু বিশেষজ্ঞ বহু বছর ধরে আমার চোখ দেখছেন সম্প্রতি দু-দুবার তার কাছে যাওয়ার পরও তার একই রা, আপনার চশমায় কোনও চেঞ্জ আনার প্রয়োজন নাই। এর সঙ্গে এটাও যোগ করেছিলেন, আপনার চোখে কোনও অসুখ নাই।
আমার চোখ যে তথ্য পাঠাচ্ছে মস্তিষ্ক খানিকটা বিভ্রান্ত হচ্ছে। যার ফল হাতে হাতে পেয়েছি ধানমন্ডি থেকে বেরুবার সময় গাড়ির নীচে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। এই গ্রহের কোথা থেকে আমার জন্য ব্লেসিং ছিল কে জানে!
রোসো, চোখের ডাক্তার, এইবার তোমাকে চোখ দেখাতে গেলে গদাম করে এক ঘুসি মেরে তোমার এক চোখ গেলে দেব।
তো, ওখানে সবাই রোগি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত এমতাবস্থায় তো আর কাউকে এমন অন্যায্য কথা বলা চলে না। অবশ্য দয়াবান এরা, আমার ব্রেন নাই এই সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল বলেই গন্তব্য স্থান খুঁজে পাওয়ার জন্য শব্দের একটা ম্যাপ এঁকে দিয়েছেন। শব্দের এই ম্যাপ থেকে বিখ্যাত স্টার কাবাব হাউজ থেকে শুরু করে ঢাউস বিলবোর্ড কিছুই বাদ রইল না। আমি কঠিন মুখ করে স্কুটারওয়ালাকে তোতাপাখির মত শব্দের ম্যাপটা গড়গড় করে বলে গেলাম। আলাদা গাম্ভীর্য এনে রাশভারী গলায় এটাও জানাতে ভুল করলাম না, ‘চিনছ তো, তুমি ঠিক ওই জায়গায় আমাকে নামায়া দিবা’।
এর প্রয়োজন আছে নইলে এই ব্যাটা আমাকে ‘মগা’ পেয়ে কোনও একটা কূট-কৌশল করে সব সাফ করে দেবে। যাই হোক, স্কুটারওয়ালা ঠিক-ঠিক পৌঁছে দিল। একবার কেবল জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই রাস্তা দিয়ে যামু না ওই রাস্তা দিয়া’? আমার কঠিন উত্তর, ‘যেদিক দিয়া জ্যাম কম সেই দিক দিয়া যাও’।
ব্যাটা ফাজিল, গাবতলির আগে মহাখালি নাকি মহাখালির আগে গাবতলি এই ছাতাফাতাই কী আর আমার মনে থাকে যে আমি এই রাস্তা-সেই রাস্তার বিবরণ বলে দেব!
এখানকার পর্ব শেষ হলে আমার হাতে বিস্তর সময়। ফেরার ট্রেন রাত বারোটায়। আরেকজন সুহৃদের সঙ্গে দেখা করার কথা। কাজের ওই মানুষটা ফেরার সময় আমাকে নিয়ে যাবেন এমনটাই আশা করে বসে ছিলাম। কিন্তু ‘কাজের মানুষ’ এই মানুষটার সেই সুযোগ আর হয় না। তিনি আমাকে মহাখালি ডিওএইচএস-এর একটা ঠিকানায় তাঁর অফিসে চলে আসতে বললে আমি পড়লাম বিপাকে।
হাসপাতাল থেকেই একজন ফিরবেন উত্তরায়। তাকে পটিয়ে-পাটিয়ে রাজি করালাম আমাকে মহাখালির গন্তব্যে নামিয়ে দিতে। এখানে নেমে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম কারণ এখন আর চিন্তার কিছু নেই। আমার দায়-দায়িত্ব এখন এই ভদ্রলোকটার উপর বর্তাবে। তাঁর ওখানে রাতের খাওয়ার পর তিনি আমাকে অন্যান্য বারের মতই স্টেশনে পৌঁছে দেবেন। বারোটার পূর্বে ঠিক-ঠিক আমাকে এয়ারপোর্ট স্টেশনে রেখে যাওয়ার সময় পইপই করে এটাও বলে গেলেন, ‘ট্রেন লেট হলে আমাকে একটা একটা ফোন দিয়েন আমি এসে নিয়ে যাবো। পরদিন যাবেন’।
অলক্ষ্যে আমি হাসি গোপন করলাম। ট্রেন আর কতক্ষণ লেট হবে? পাগল, আমার বুড়ো বাড়িটা, আমার পরিচিত বিছানাটা, আমার লাগানো গাছগুলো যে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। স্টেশনে এসে পড়েছি এখন আর আমাকে পায় কে! কপাল, ট্রেন তিন-চার ঘন্টা লেট। স্টেশনে কেবল মাথা আর মাথা- লোকে গিজগিজ করছে। হঠাৎ করে শীতও পড়েছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে তীব্র বাতাস। শীত তেমন ছিল না বলে আমি যথেষ্ঠ গরম কাপড় আনিনি। পাতলা একটা জ্যাকেট যেটা থাকা না-থাকা সমান। শীতে আমি হি হি করে কাঁপছি। এয়ারপোর্ট স্টেশনে বসার জায়গা দূরের কথা দাঁড়াবার জায়গাও নেই। দাঁড়াতে হচ্ছে গিয়ে প্রায় খোলা একটা জায়গায়। তীব্র শীত আমাকে কাবু করে ফেলছে। এই তিন-চার ঘন্টা সময়ে কি করব?
সঙ্গে করে আনা মার্সেল মোরিং-এর ‘দ্য ড্রিম রুম’ বইটা পড়ার চেষ্টা করছি। পড়ব কী, ছাই- শীতে কাঁপছি আমি, সঙ্গে বইয়ের অক্ষরগুলোও!
আমার ব্রেন নাই এটা সত্য কিন্তু খুলির ভেতর দুয়েক ফোঁটা সমান যে মগজ আটকে আছে তারই ফল হবে সম্ভবত। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। আরে, কমলাপুর স্টেশনে চলে গেলেই তো হয়। ওখানে ভিড় কম থাকবে খানিকটা উষ্ণতাও হয়তো পাওয়া যাবে। যাওয়াটা কঠিন কিছু না ঢাকামুখো যে কোনও ট্রেনে উঠে পড়লেই হয়। দিনাজপুর থেকে আসা ঢাকাগামী একটা ট্রেনে উঠে পড়লাম, বাছাধনের কমলাপুর স্টেশনে না-গিয়ে উপায় নেই...।
সহায়ক সূত্র:
পরের পর্ব, 'পা-কাটা শিশু এবং মিডিয়ার ভোগান্তি-ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়: ২! ': http://www.ali-mahmed.com/2015/01/blog-post_13.html
কপালের ফের, এমন এক মুহূর্তে ঢাকা গেলাম যখন ‘অবরোধ’ এবং ‘বিশ্ব ইজতেমা’ চলছে। অবরোধ বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই- গণতন্ত্রের জন্য এটার প্রয়োজন ছিল, আছে, থাকবে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত।
এমন অস্বাভাবিক অবস্থা দূরের কথা স্বাভাবিক অবস্থাতেই আমি ঢাকামুখো হতে চাই না যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ আমাকে স্টেশন থেকে নিয়ে যাবে। কারণটা আগেও বলেছি, শত-শত বার ঢাকা গেলেও আমি লোকেশন মনে রাখতে পারি না। পাঠকের মনিটর কাঁপানো হাসির ঝুঁকি নিয়েও বলি, আমি স্রেফ হারিয়ে যাই। অনেকের কাছে এটায় বিস্তর হাসির উপাদান থাকলেও আমার জন্য যে কী পরিমাণ যন্ত্রণা এটা কেবল আমি জানি।
পূর্বে বিভিন্ন প্রকারে চেষ্টা করতাম মনে রাখার জন্য, লাভ হয়নি। এখন সে চেষ্টা বাদ দিয়েছি নিজেকে এই সান্ত্বনা দিয়ে, সবার কী আর ব্রেন থাকে রে, পাগলা।
এর সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে আরেক দুর্দশা, আমার চশমা সংক্রান্ত জটিলতা। যে চক্ষু বিশেষজ্ঞ বহু বছর ধরে আমার চোখ দেখছেন সম্প্রতি দু-দুবার তার কাছে যাওয়ার পরও তার একই রা, আপনার চশমায় কোনও চেঞ্জ আনার প্রয়োজন নাই। এর সঙ্গে এটাও যোগ করেছিলেন, আপনার চোখে কোনও অসুখ নাই।
আমার চোখ যে তথ্য পাঠাচ্ছে মস্তিষ্ক খানিকটা বিভ্রান্ত হচ্ছে। যার ফল হাতে হাতে পেয়েছি ধানমন্ডি থেকে বেরুবার সময় গাড়ির নীচে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। এই গ্রহের কোথা থেকে আমার জন্য ব্লেসিং ছিল কে জানে!
রোসো, চোখের ডাক্তার, এইবার তোমাকে চোখ দেখাতে গেলে গদাম করে এক ঘুসি মেরে তোমার এক চোখ গেলে দেব।
তো, ওখানে সবাই রোগি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত এমতাবস্থায় তো আর কাউকে এমন অন্যায্য কথা বলা চলে না। অবশ্য দয়াবান এরা, আমার ব্রেন নাই এই সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল বলেই গন্তব্য স্থান খুঁজে পাওয়ার জন্য শব্দের একটা ম্যাপ এঁকে দিয়েছেন। শব্দের এই ম্যাপ থেকে বিখ্যাত স্টার কাবাব হাউজ থেকে শুরু করে ঢাউস বিলবোর্ড কিছুই বাদ রইল না। আমি কঠিন মুখ করে স্কুটারওয়ালাকে তোতাপাখির মত শব্দের ম্যাপটা গড়গড় করে বলে গেলাম। আলাদা গাম্ভীর্য এনে রাশভারী গলায় এটাও জানাতে ভুল করলাম না, ‘চিনছ তো, তুমি ঠিক ওই জায়গায় আমাকে নামায়া দিবা’।
এর প্রয়োজন আছে নইলে এই ব্যাটা আমাকে ‘মগা’ পেয়ে কোনও একটা কূট-কৌশল করে সব সাফ করে দেবে। যাই হোক, স্কুটারওয়ালা ঠিক-ঠিক পৌঁছে দিল। একবার কেবল জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই রাস্তা দিয়ে যামু না ওই রাস্তা দিয়া’? আমার কঠিন উত্তর, ‘যেদিক দিয়া জ্যাম কম সেই দিক দিয়া যাও’।
ব্যাটা ফাজিল, গাবতলির আগে মহাখালি নাকি মহাখালির আগে গাবতলি এই ছাতাফাতাই কী আর আমার মনে থাকে যে আমি এই রাস্তা-সেই রাস্তার বিবরণ বলে দেব!
এখানকার পর্ব শেষ হলে আমার হাতে বিস্তর সময়। ফেরার ট্রেন রাত বারোটায়। আরেকজন সুহৃদের সঙ্গে দেখা করার কথা। কাজের ওই মানুষটা ফেরার সময় আমাকে নিয়ে যাবেন এমনটাই আশা করে বসে ছিলাম। কিন্তু ‘কাজের মানুষ’ এই মানুষটার সেই সুযোগ আর হয় না। তিনি আমাকে মহাখালি ডিওএইচএস-এর একটা ঠিকানায় তাঁর অফিসে চলে আসতে বললে আমি পড়লাম বিপাকে।
হাসপাতাল থেকেই একজন ফিরবেন উত্তরায়। তাকে পটিয়ে-পাটিয়ে রাজি করালাম আমাকে মহাখালির গন্তব্যে নামিয়ে দিতে। এখানে নেমে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম কারণ এখন আর চিন্তার কিছু নেই। আমার দায়-দায়িত্ব এখন এই ভদ্রলোকটার উপর বর্তাবে। তাঁর ওখানে রাতের খাওয়ার পর তিনি আমাকে অন্যান্য বারের মতই স্টেশনে পৌঁছে দেবেন। বারোটার পূর্বে ঠিক-ঠিক আমাকে এয়ারপোর্ট স্টেশনে রেখে যাওয়ার সময় পইপই করে এটাও বলে গেলেন, ‘ট্রেন লেট হলে আমাকে একটা একটা ফোন দিয়েন আমি এসে নিয়ে যাবো। পরদিন যাবেন’।
অলক্ষ্যে আমি হাসি গোপন করলাম। ট্রেন আর কতক্ষণ লেট হবে? পাগল, আমার বুড়ো বাড়িটা, আমার পরিচিত বিছানাটা, আমার লাগানো গাছগুলো যে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। স্টেশনে এসে পড়েছি এখন আর আমাকে পায় কে! কপাল, ট্রেন তিন-চার ঘন্টা লেট। স্টেশনে কেবল মাথা আর মাথা- লোকে গিজগিজ করছে। হঠাৎ করে শীতও পড়েছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে তীব্র বাতাস। শীত তেমন ছিল না বলে আমি যথেষ্ঠ গরম কাপড় আনিনি। পাতলা একটা জ্যাকেট যেটা থাকা না-থাকা সমান। শীতে আমি হি হি করে কাঁপছি। এয়ারপোর্ট স্টেশনে বসার জায়গা দূরের কথা দাঁড়াবার জায়গাও নেই। দাঁড়াতে হচ্ছে গিয়ে প্রায় খোলা একটা জায়গায়। তীব্র শীত আমাকে কাবু করে ফেলছে। এই তিন-চার ঘন্টা সময়ে কি করব?
সঙ্গে করে আনা মার্সেল মোরিং-এর ‘দ্য ড্রিম রুম’ বইটা পড়ার চেষ্টা করছি। পড়ব কী, ছাই- শীতে কাঁপছি আমি, সঙ্গে বইয়ের অক্ষরগুলোও!
আমার ব্রেন নাই এটা সত্য কিন্তু খুলির ভেতর দুয়েক ফোঁটা সমান যে মগজ আটকে আছে তারই ফল হবে সম্ভবত। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। আরে, কমলাপুর স্টেশনে চলে গেলেই তো হয়। ওখানে ভিড় কম থাকবে খানিকটা উষ্ণতাও হয়তো পাওয়া যাবে। যাওয়াটা কঠিন কিছু না ঢাকামুখো যে কোনও ট্রেনে উঠে পড়লেই হয়। দিনাজপুর থেকে আসা ঢাকাগামী একটা ট্রেনে উঠে পড়লাম, বাছাধনের কমলাপুর স্টেশনে না-গিয়ে উপায় নেই...।
সহায়ক সূত্র:
পরের পর্ব, 'পা-কাটা শিশু এবং মিডিয়ার ভোগান্তি-ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়: ২! ': http://www.ali-mahmed.com/2015/01/blog-post_13.html
No comments:
Post a Comment