আহমেদ ছফাকে আমার মনে হয়, চলমান একটা জ্ঞানের ভান্ডার। তাঁর পরিচয় নির্দিষ্ট গন্ডিতে নিয়ে আসা বাতুলতা মাত্র। এই মানুষটাকে বাংলাদেশের এবং কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা যমের মতো ভয় করতেন। তিনি কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলতেন না! শেখ মুজিবর রহমানের বিশাল অফার তিনি অবলীলায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি মানুষটা ছিলেন ভারী অহংকারী। কিন্তু ছফা নোবেল পুরষ্কার পেলেন না কেন- এ ক্ষোভ কার কাছে বলি?
এর চেয়ে অনেক কম অহংকারী মানুষকে আমি বিভিন্ন লেখায় তুলাধোনা করেছি। এ কারণে অনেকেই আমার প্রতি রুষ্ট হন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, আমার মতো অখ্যাত কলমচীর এই অধিকার নাই। আমি স্বীকার করি, আমার যোগ্যতা নাই- কিন্ত আমি ‘ধুনকর’ এর ভূমিকা থেকে পিছপা হইনি।
কিন্ত, ছফার বেলায় তাঁর অহংকার ছাপিয়ে আমার চোখ জলে ছাপাছাপি হয়ে যায়। এই ঘটনাটা যখন আমি পড়ি, আমার চোখের পানি আটকাতে পারিনি। গলা ছেড়ে আমার বলতে ইচ্ছা করছিল, আহমেদ ছফা, আপনি কেন মরে গেলেন? এ ভাবে দুম করে মরে যাওয়াটা কি কাজের একটা কাজ হলো! তাঁর অজস্র কান্ড থেকে একটা তুলে দিচ্ছি:
(উপাত্তটা নেয়া হয়েছে: আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী/ মোহাম্মদ আমীন।)
“স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মায়ের সাথে বাবর রোডের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে উঠেছিলেন। বাংলাদেশ সরকার শহীদ পরিবারের সম্মানার্থে হুমায়ূন আহমেদের মায়ের নামে ওই পরিত্যক্ত বাড়িটি বরাদ্দ করেছিলেন। কিন্ত অল্প কয়েক দিন পর গভীর রাতে রী বাহিনীর একটি সশস্ত্র দল হুমায়ূন পরিবারকে বাড়ি থেকে বের করে দরোজায় তালা লাগিয়ে দেয়। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার, কোথায় যাবেন তাঁরা?
সকাল হল, কেউ নেই, কেউ আসার কোনো আশা নেই। চর্তুদিকে গিজগিজ করছে রক্ষী বাহিনী। কার বুকে এত পাটা যে এগিয়ে আসবে। আহমদ ছফা এসে হাজির। ছফার হাতে একটি টিন, কেরোসিনে ভর্তি, কাঁধে মোটা চাদর। এ নিয়ে আমীন এবং ছফার কথোপথন:
মোহাম্মদ আমীন: আপনি কি হুমায়ূনের কাছে একাই গিয়েছিলেন?
আহমদ ছফা: হাঁ, একাই। তবে হাতে একটা কন্টেনার ছিল, তাতে পাঁচ লিটার কেরোসিন, কিনেছিলাম।
আমীন: কেরোসিন কেন?
ছফা: জ্বলব এবং জ্বালাবো বলে।
আমীন: কাকে?
ছফা: নিজেকে এবং গণভবনকে। আমি হুমায়ূনকে বললাম, হুমায়ূন আমার সাথে রিক্সায় উঠুন, আমরা গণভবন যাব। একটি রিনাউন শহীদ পরিবারকে বাড়ি হতে উচ্ছেদ করে জ্ঞানীর কলমের চেয়েও পবিত্র রক্তকে অবমাননা করা হয়েছে। অপমান করা হয়েছে স্বাধীনতা ও জাতির আত্মদানের গৌরবমন্ডিত ঐশ্বর্যকে। আমি কেরোসিনঢেলে আত্মহুতি দেবার সংকল্পে উম্মাদ হয়ে উঠেছিলাম সে দিন।
আমীন: কেন?
ছফা: যে দেশের সরকার স্বাধীনতায় জীবন বিসর্জনকারী একজন প্যাট্রিয়ট পরিবারকে বাসা হতে গভীর রাতে উচ্ছেদ করে দেয়ার মত জঘন্য ঘটনা ঘটাতে পারে সে দেশে আর যাই থাকুক, আমি নেই। এমন ঘৃণ্য দেশে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল, অনেক। তো, আমি হুমায়ূনকে বললাম, আপনি তাড়াতাড়ি রিক্সায় উঠুন।
হুমায়ূন বললেন, কোথায় যাব?
আমি বললাম (ছফা): গনভবনে যাব। নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেব। একটি শহীদ পরিবারের প্রতি যে অপমান করা হয়েছে- তার প্রতিবাদে এ কাজটা করব। আত্মহুতি।
হুমায়ূন: কি বলছেন ছফা ভাই?
ছফা: কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না। উঠে আসুন। সঙ্গে ভারী চাদরও নিয়ে এসেছি। আপনি আমার গায়ে ভালোমত চাদরটা জড়িয়ে দেবেন। যেন আগুনটা ঠিকমত লাগে।
আহমদ ছফার গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহুতি দেয়ার সংবাদ দাবানলের মত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই আস্তে আস্তে জড়ো হতে লাগলেন। বন্ধুরা ছফাকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্ত ছফা অনঢ়, তিনি আত্মহুতি দেবেনই। অন্য কেউ হলে ভাবা যেত আত্মহুতি নয়, কেবল হুমকি, কথার কথা। কিন্ত সবাই জানে ছফা অন্য রকম, সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছেন প্রতিকার না পাওয়া পর্যন্ত একচুলও এদিক সেদিক করবেন না, যাই হোক কিংবা যাই ঘটুক।
কবি সিন্দাকার আবু জাফর ব্যস্ত হয়ে ছফার কাছে এলেন। জোর গলায় বললেন, আমি ব্যবস্থা করছি। কথা দিচ্ছি, এই শহীদ পরিবারের জন্য থাকার একটা ব্যবস্থা করব। তুমি কেরোসিন টিন আমার বাসায় দিয়ে এসো।
ছফা বললেন, হুমায়ূন পরিবারকে আবার সস্থানে তুলে না দেয়া পর্যন্ত আমি আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাবো না এবং আপনার হাতে সময় মাত্র ১ ঘন্টা।
পরিশেষ: ছফার জবানীতে শুনুন:
মুজিব সরকার হুমায়ূন আহমেদের পরিবারকে পুনরায় উচ্ছেদকৃত বাসায় তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল। অন্তত আমি এই একটি ব্যপারে শেখ মুজিবের প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে মরে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।
এর চেয়ে অনেক কম অহংকারী মানুষকে আমি বিভিন্ন লেখায় তুলাধোনা করেছি। এ কারণে অনেকেই আমার প্রতি রুষ্ট হন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, আমার মতো অখ্যাত কলমচীর এই অধিকার নাই। আমি স্বীকার করি, আমার যোগ্যতা নাই- কিন্ত আমি ‘ধুনকর’ এর ভূমিকা থেকে পিছপা হইনি।
কিন্ত, ছফার বেলায় তাঁর অহংকার ছাপিয়ে আমার চোখ জলে ছাপাছাপি হয়ে যায়। এই ঘটনাটা যখন আমি পড়ি, আমার চোখের পানি আটকাতে পারিনি। গলা ছেড়ে আমার বলতে ইচ্ছা করছিল, আহমেদ ছফা, আপনি কেন মরে গেলেন? এ ভাবে দুম করে মরে যাওয়াটা কি কাজের একটা কাজ হলো! তাঁর অজস্র কান্ড থেকে একটা তুলে দিচ্ছি:
(উপাত্তটা নেয়া হয়েছে: আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী/ মোহাম্মদ আমীন।)
“স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মায়ের সাথে বাবর রোডের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে উঠেছিলেন। বাংলাদেশ সরকার শহীদ পরিবারের সম্মানার্থে হুমায়ূন আহমেদের মায়ের নামে ওই পরিত্যক্ত বাড়িটি বরাদ্দ করেছিলেন। কিন্ত অল্প কয়েক দিন পর গভীর রাতে রী বাহিনীর একটি সশস্ত্র দল হুমায়ূন পরিবারকে বাড়ি থেকে বের করে দরোজায় তালা লাগিয়ে দেয়। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার, কোথায় যাবেন তাঁরা?
সকাল হল, কেউ নেই, কেউ আসার কোনো আশা নেই। চর্তুদিকে গিজগিজ করছে রক্ষী বাহিনী। কার বুকে এত পাটা যে এগিয়ে আসবে। আহমদ ছফা এসে হাজির। ছফার হাতে একটি টিন, কেরোসিনে ভর্তি, কাঁধে মোটা চাদর। এ নিয়ে আমীন এবং ছফার কথোপথন:
মোহাম্মদ আমীন: আপনি কি হুমায়ূনের কাছে একাই গিয়েছিলেন?
আহমদ ছফা: হাঁ, একাই। তবে হাতে একটা কন্টেনার ছিল, তাতে পাঁচ লিটার কেরোসিন, কিনেছিলাম।
আমীন: কেরোসিন কেন?
ছফা: জ্বলব এবং জ্বালাবো বলে।
আমীন: কাকে?
ছফা: নিজেকে এবং গণভবনকে। আমি হুমায়ূনকে বললাম, হুমায়ূন আমার সাথে রিক্সায় উঠুন, আমরা গণভবন যাব। একটি রিনাউন শহীদ পরিবারকে বাড়ি হতে উচ্ছেদ করে জ্ঞানীর কলমের চেয়েও পবিত্র রক্তকে অবমাননা করা হয়েছে। অপমান করা হয়েছে স্বাধীনতা ও জাতির আত্মদানের গৌরবমন্ডিত ঐশ্বর্যকে। আমি কেরোসিনঢেলে আত্মহুতি দেবার সংকল্পে উম্মাদ হয়ে উঠেছিলাম সে দিন।
আমীন: কেন?
ছফা: যে দেশের সরকার স্বাধীনতায় জীবন বিসর্জনকারী একজন প্যাট্রিয়ট পরিবারকে বাসা হতে গভীর রাতে উচ্ছেদ করে দেয়ার মত জঘন্য ঘটনা ঘটাতে পারে সে দেশে আর যাই থাকুক, আমি নেই। এমন ঘৃণ্য দেশে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল, অনেক। তো, আমি হুমায়ূনকে বললাম, আপনি তাড়াতাড়ি রিক্সায় উঠুন।
হুমায়ূন বললেন, কোথায় যাব?
আমি বললাম (ছফা): গনভবনে যাব। নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেব। একটি শহীদ পরিবারের প্রতি যে অপমান করা হয়েছে- তার প্রতিবাদে এ কাজটা করব। আত্মহুতি।
হুমায়ূন: কি বলছেন ছফা ভাই?
ছফা: কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না। উঠে আসুন। সঙ্গে ভারী চাদরও নিয়ে এসেছি। আপনি আমার গায়ে ভালোমত চাদরটা জড়িয়ে দেবেন। যেন আগুনটা ঠিকমত লাগে।
আহমদ ছফার গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহুতি দেয়ার সংবাদ দাবানলের মত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই আস্তে আস্তে জড়ো হতে লাগলেন। বন্ধুরা ছফাকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্ত ছফা অনঢ়, তিনি আত্মহুতি দেবেনই। অন্য কেউ হলে ভাবা যেত আত্মহুতি নয়, কেবল হুমকি, কথার কথা। কিন্ত সবাই জানে ছফা অন্য রকম, সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছেন প্রতিকার না পাওয়া পর্যন্ত একচুলও এদিক সেদিক করবেন না, যাই হোক কিংবা যাই ঘটুক।
কবি সিন্দাকার আবু জাফর ব্যস্ত হয়ে ছফার কাছে এলেন। জোর গলায় বললেন, আমি ব্যবস্থা করছি। কথা দিচ্ছি, এই শহীদ পরিবারের জন্য থাকার একটা ব্যবস্থা করব। তুমি কেরোসিন টিন আমার বাসায় দিয়ে এসো।
ছফা বললেন, হুমায়ূন পরিবারকে আবার সস্থানে তুলে না দেয়া পর্যন্ত আমি আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাবো না এবং আপনার হাতে সময় মাত্র ১ ঘন্টা।
পরিশেষ: ছফার জবানীতে শুনুন:
মুজিব সরকার হুমায়ূন আহমেদের পরিবারকে পুনরায় উচ্ছেদকৃত বাসায় তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল। অন্তত আমি এই একটি ব্যপারে শেখ মুজিবের প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে মরে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।
No comments:
Post a Comment