বইমেলায় অটোগ্রাফ দেয়ার ভয়ে স্টলে বসি না, এটা শুনে লেখালেখি ভুবনের মানুষদের কী হাসাহাসি! থু-থু, নিজের লেখা নিজেই পড়ে, হুহ, আবার কী একটা বা... হইছে!
অটোগ্রাফ জিনিসটার প্রতি আমার এলার্জি আছে, অন্য কারণে। তবুও আমার যে দু-চারজন পাঠক আছেন, তাঁরা যখন দুম করে অটোগ্রাফ চেয়ে বসেন, তখন আমার মাথায় সব কেমন জট পাকিয়ে যায়! কি লিখব ভেবে পাই না।
দূর-দূর, দু-কলম লেখার চেষ্টা করলেই বুঝি লেখক হওয়া যায়! আগেও লিখেছিলাম: আমি নিজেকে বলি লেখার রাজমিস্ত্রি। একজন রাজমিস্ত্রি যেমন একের পর এক ইট সাজিয়ে একটা কাঠামো গড়ে তোলেন; তেমনি আমিও একের পর এক শব্দের ইট বসিয়ে একটা কাঠামো দাঁড় করাবার চেষ্টা করি। ওই নিষ্প্রাণ কাঠামো নামের বাড়িটার সবগুলো আলো জ্বলে উঠে যখন কোন পাঠক লেখাটা পড়েন, প্রকারান্তরে ছুঁয়ে দেন।
তো, বললেই বুঝি অটোগ্রাফে কিছু লিখে দেয়া যায়! নিরুপায় আমি, পালাতে না-পারলে লজ্জায় লাল-নীল হয়ে হাবিজাবি কিছু একটা লিখে দেই।
একবার একজনকে কিছুই লিখে দিলাম না। উপরে কেবল একটা গোঁফ নীচে একটা চশমা। এই মানুষটার ছিল পেল্লাই গোঁফ আর আমার চশমা। তবে এও সত্য, যিনি একবার আমার অটোগ্রাফ নিয়েছেন তিনি দ্বিতীয়বার ভুলেও অটোগ্রাফের নাম নেননি। তিনিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন, আমিও।
কী আর করা, কপালের ফের!
আসলে সত্যি সত্যি লেখক যারা, তাঁরা ওড়নার মত গলায় একটা চাদর ঝুলিয়ে অটোগ্রাফে করকমলেষু, শ্রদ্ধাস্পদেষু টাইপের কঠিন কঠিন কিছু বাতচিত লেখেন। গালে হাত দিয়ে ফটো খিঁচান, ভাবুক যে। এঁরা আকাশ পানে তাকিয়ে হাঁটাহাঁটি করেন- আকাশলোকের বাসিন্দা যে!
যাই হোক, এবারের বইমেলায় সহ-ব্লগার একজন, আমাকে পাকড়াও করলেন অটোগ্রাফ দেয়ার জন্য। আমি বললাম, অটোগ্রাফ যে দেব, ২ টাকা দেন, ক্যাশ। তিনি ভাবলেন, আমি রসিকতা করছি, সম্ভবত ২ টাকা নেব না। আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে ২ টাকা পকেটস্থ করলাম। আমি নিশ্চিত, বেচারা ভাবছিলেন, আরে, এমন লালচি মানুষ তো আর দেখি নাই!
হা হা হা, হলামই না-হয় লালচওয়ালা! আমাদের জীবনে গল্প করার মতো গল্পের বড় অভাব, তাঁর জন্য থাকুক না একটা গল্প। কে জানে, এই মানুষটা একদা তার নাতি-পুতির কাছে তিতিবিরক্ত ভাব নিয়ে গল্প করবেন: জানিস রে বেটা, 'মিথ্যা মিথ্যি' এক লেখক এক লাইন লেইখা ২ টাকা নিয়া নিল, চিন্তা কর! কী ডাকাতি!
আমি শুভ নামে প্রায় ১ বছর একটা ওয়েবসাইটে বেশ কিছু লেখা লিখেছিলাম, যার চালু নাম ব্লগিং। ওইসব ছাতাফাতা নিয়ে 'শুভ-র ব্লগিং' নামের একটা বই বের হয়েছিল। প্রথমে প্রকাশকের ঘোর আপত্তি ছিল। তিনি চাচ্ছিলেন, প্রেমের উপন্যাস। বই বের হওয়ার পর দেখি মানুষটা হড়বড় করে ফোনে একগাদা কথা বলেই যাচ্ছেন, আরে শোনেন, একটা না বিরাট ঘটনা হয়ে গেল।
আমি ভয়ে ভয়ে জানতে চাই, কি ঘটনা?
তিনি বিমলানন্দে বলে চলেন, এই দেশে বাংলা ব্লগিং-এর উপর এটাই হচ্ছে প্রথম বই।
আমি বললাম, আচ্ছা।
আমার উচ্ছ্বসিত হওয়ার কোন কারণ ছিল না। কারণ বইমেলা শেষ হলে এই মানুষটাই মুখ কালো করে বলবেন, মেলায় যে একটা মাত্রই বই বিক্রি হলো এটা কি আপনি নিজেই কাউকে দিয়ে খরিদ করিয়া ছিলেন।
ওই ওয়েবসাইটের বিখ্যাত প্রাপ্তির পু, সারিয়া তাসনিম, সহ-ব্লগারের একটা মন্তব্য ছিল এমন: "শুভ, একটা কথা দিতে হবে। আজ এখুনি। আপনি ঢাকায় আসবেন, আমরা মেলায় যাবো এবং 'শুভর ব্লগিং' নামের একটা বই আমি আপনাকে উপহার দিবো। এর আগে খবরদার বইয়ে হাত দিবেন না"।
কী সর্বনাশ! এ দেখি মার্শাল ল আইন!
আমি আমার কথা রেখেছিলাম। তিনি 'শুভর ব্লগিং' বইটা কিনে দিলেন। আমি বললাম, এটায় একটা অটোগ্রাফ দেন। তিনি অটোগ্রাফ দিলেন কিন্তু মজা হচ্ছে, অটোগ্রাফটা ছিল বইয়ের উল্টা দিকে। তিনি চাচ্ছিলেন, ঠিক করে দিতে। আহা, তাহলে যে মজাটাই নষ্ট হয়ে যায়, কি দরকার থাকুক না এমনই।
প্রাপ্তির জন্য আমি আমার একটা প্রেমের উপন্যাস দিলাম, 'তিতলি তুমিও '। লিখে দিলাম: "প্রাপ্তি, প্রবল আশা, একদিন তুমি এই বইটা পড়বে"। সারিয়া তাসনিম আমার লেখার উদ্দেশ্যটা সম্ভবত ধরতে পারেননি। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম তাঁর ভাবনা, এই মানুষটা বেকুব নাকি, এইটা দিল কি মনে কইরা, এইটা কী বাচ্চার বই!
পুরনো যারা তাদের জানা আছে, প্রাপ্তি দুরারোগ্য রোগে ভুগছিল। অন্তত এই প্রেমের উপন্যাসটা পড়ার জন্য এবং তার ভালবাসা-বাসি মানুষের সঙ্গে হাত ধরে ঘুরে বেড়াবার জন্য, প্রকারান্তরে তার আয়ু প্রার্থনা করলাম; মন থেকে।
...
আমার মনে আছে, আমার বইয়ের প্রকাশকের কাছ থেকেও আমি একটা অটোগ্রাফ চেয়ে তাঁকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছিলাম। বিষয়টা এমন। একজন পাঠক একটা বই ফেরত নিয়ে এলেন, ভেতরের ম্যাটার হচ্ছে আমার একটা উপন্যাস 'তিতলি তুমিও'-এর কিন্ত প্রচ্ছদ আমারই অন্য একটা উপন্যাস 'নিষিদ্ধ জ্যোৎস্না'র।
আমি গম্ভীর মুখ করে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে বললাম, এই বইটায় একটা অটোগ্রাফ দেন।
তিনি ভাল করেই জানেন, আমার মাথায় খানিকটা সমস্যা আছে। মনে মনে নিশ্চয়ই ভাবছিলেন, আজ তো আমবস্যা পূর্ণিমা না, ঘটনা কী, কোন কারণে পাগলটা আজ খেপেছে!
তিনি মুখ শুকিয়ে বললেন, বিষয় কী, কি হয়েছে?
আমি বইটা দেখালে তিনি বললেন, উপস, বড়ো ভুল হয়ে গেছে। বাইন্ডিং ব্যাটা...।
আমি গম্ভীর, বেটা-মেটা বুঝি না। ছাড়াছাড়ি নাই, অটোগ্রাফ। বইটা আমি হাতছাড়া করছি না। রেখে দেব।
তিনি হাসি গোপন করে বললেন, আমি লিখতে চাই, ম্যান ইজ মর্টাল!
আমি বললাম, যা খুশি লেখেন, মর্টাল লেখেন, মর্টার লেখেন।
তিনি আটকে রাখা শ্বাস ছেড়ে খসখস করে লিখে দিলেন, ম্যান ইজ মর্টাল!
ওই বইটা যেমন আজও আছে আমার কাছে, সারিয়া তাসনিমের বইটাও যত্মে থাকবে এবং ২ টাকার নোটটাও।
2 comments:
মাঝে মাঝে অনেক ছোট ও বিষয়বস্তু ছাড়া লেখাও সুন্দর হয়, এই লেখাটি তারই একটি জলন্ত প্রমান।
অটোগ্রাফ নিয়ে এত সুন্দর অভিজ্ঞতা/বর্ণনা আগে কখনো পড়িনি।
ধন্যবাদ আপনাকে। অন্য রকম, ছুয়েঁ যাওয়া মন্তব্যর জন্য। লেখা ভাল লেগেছে জেনে আমারও ভাল লাগছে।
Post a Comment