একটি বাংলা ওয়েব-সাইটে দীর্ঘদিন লেখালেখির সুবাদে একটা অন-লাইন সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল আমার মতো অগাবগা মানুষের। সাক্ষাৎকারটির আয়োজন করেছিলেন, কৌশিক আহমেদ। মানুষটার কাছে আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এবং যারা প্রশ্ন করে আমার আলো-অন্ধকার বের করে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের প্রতিও আমার গভীর কৃতজ্ঞতা।
অন লাইনে আমাকে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তরগুলো আমি চেষ্টা করতাম সততার সঙ্গে দেয়ার জন্য এবং এটা করতে গিয়ে অবলীলায় উঠে আসত আমার অন্ধকার দিক, নির্বোধ আচরণ।
প্রশ্ন: আপনি নিজেকে প্রায় অশিক্ষিত কেন বলেন?
উত্তর: আমি প্রায় অশিক্ষিত কেন বলেছি? আমার একাডেমিক শিক্ষার যে বহর এটা সর্দি মুছে ফেলে দেয়ার জিনিস- এমন একটা ডিগ্রি আজকাল একজন কেরানীরও থাকে! এস.এস.সি করেছি সায়েন্স নিয়ে, স্বপ্ন ছিল বিরাট বিজ্ঞানি হব। সায়েন্সে নিয়মিত ক্লাশ করতে হয় বলে এইচ.এস.সি-তে নিলাম কমার্স। ওয়াল্লা, কমার্সেও দেখি নিয়মিত ক্লাশ করতে হয়! কমার্স থেকে এইচ.এস.সি করে গ্রাজুয়েশন করলাম আর্টস থেকে। আমি প্রশ্নের উত্তর তেমন করে শিখতাম না। মূল বিষয় পড়ে হাবিজাবি যা মনে আসত তাই পরীক্ষার খাতায় লিখে দিতাম। আমার আসলে গতবাঁধা একটা বইয়ের নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন পড়ে একটা চলনসই ডিগ্রির প্রয়োজন ছিল- ব্যস, আর কিচ্ছু না! কিন্তু আজকাল এমন একটা সনদ থাকা না-থাকা সমান! আইন নিয়ে কিছুদিন ঝুলে রইলাম। ঝুলাঝুলিই সার, ভাল লাগল না।
প্রশ্ন: কি ধরনের বই পড়তে পছন্দ করেন?
উত্তর: পড়ার কোন আগামাথা নাই। আর সবচেয়ে বাজে অভ্যাস হচ্ছে, একসঙ্গে অনেকগুলো বই পড়া। অভ্যাস হয়ে গেছে। উদাহরণ দেই, এখন পড়ছি, মিলান কুন্ডেরার 'দ্য জোকস'। প্রথমে ভালই লাগছিল এখন আর ভাল লাগছে না। রুশোর 'কনফেশন'। জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলো' আগে পড়েছিলাম বিচ্ছিন্নভাবে, আবারও পড়ছি। আকুতাগাওয়ার গল্প, 'রাসোমন' গল্পটার এতো নাম, অথচ আমার একদম ভালো লাগেনি। কিন্ত এর পরের একটা গল্প অসাধারণ। নামটা মনে নাই! ওহ ভালো কথা, আরেকটা হচ্ছে, 'সোলেমানী তাবিজ'। কি ভাবে একজনকে বশ করা যায় এইসব। হা হা হা। না-না, কাউকে বশ করার জন্য না। অনেক সময় এইসব লেখার খুব কাজে লাগে!
আমার বুদ্ধিশুদ্ধির একটা মজার ঘটনা বলি, আপনার মতই একজন কোন এক বিচিত্র কারণে আমার লেখালেখির প্রতি অযাচিত মমতা দেখান। তো, হঠাৎ একদিন বললেন, আচ্ছা, আপনি শেষের কবিতা পড়েছেন, কেমন লেগেছে আপনার কাছে?
আমি খানিকটা অন্যমনস্ক ছিলাম সম্ভবত, বললাম, ভাইরে, আমি তো কবিতা খুব কম পড়ি। তিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। সম্ভবত মনে মনে ভাবছিলেন, কেন, এই গর্দভের লেখা পড়ি! হা হা হা!
পরক্ষণেই আমার মনে পড়লো অমিত-লাবন্যর কথা। যে বইটা আমি কয়েকবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও শেষ করতে পারিনি, জানি না কেন আমার ভালো লাগেনি! রবি দাদার লোকজনরা আমাকে পেলে পিটিয়েই মেরে ফেলবেন। অথচ রবি দাদার ছোট গল্প আমার কাছে মনে হয় একেকটা মাস্টারপীস! আমার মনে হয়, ছোট গল্পে দাদা এমন কোন বিষয় নেই বাদ রেখেছেন। বারবার পড়তে ইচ্ছা করে।
আমার সমস্যাটা কি জানেন, একজন পছন্দের লেখক, তা তিনি যতো নামকরাই হোন না কেন। তাঁর সব লেখা ভাল লাগতেই হবে বা তিনি যা লিখেছেন সব পাতে দেয়ার মতো, এতে আমার আপত্তি প্রবল আপত্তি আছে!
প্রশ্ন: বেশীর ভাগ সময় কোথায় কাটান?
উত্তর: আমার নিজস্ব ছোট্ট একটা রুম আছে। হেনতেন সবই এটায় থাকে। এমনকি স্টাফ করা ব্যাঙও পাওয়া যাবে। তো, আমার গানশোনা, মুভি দেখা, বই পড়া প্রায় সবকিছুই এখানে। এমনিতে আমার বই পড়া হয় তিনবেলা খাওয়ার সময়। বদ অভ্যাস, এ নিয়ে বাসার সবাই প্রচন্ড ক্ষুব্ধ থাকে। অনেক দিন দেখা গেছে টেবিলে তরকারীর একটা পদ রয়ে গেছে অথচ আমার খাওয়া শেষ! হা হা হা!
প্রশ্ন: আপনার কনকপুরুষের পর আর বই এখান থেকে ছাপা হয়নি?
উত্তর: আসলে প্রজাপতি প্রকাশনের যে উপন্যাসটার কথা বলছেন এটায় আমার কোন কৃতিত্ব নাই। এদের মার্কেটিং অসাধারণ। বই চলে এদের মার্কেটিং এবং এদের প্রকাশনার নামে। ইদানিং এদের আর আগের মতো সেই দবদবা নাই কারণ, এরা অন্য লেখককে অবমূল্যায়ন করা শুরু করেছেন। আত্মীয় স্বজনরাই লিখছেন! পরে ওখানে আর লেখা হয় নাই।
কিছু কারণ ছিল, একবার এদের অফিসে গেলাম। আমাকে অফিস সহকারী বললেন, কাজী স্যার ব্যস্ত, ১০-১৫ মিনিট অপেক্ষা করেন। আমি বসে আছি তো বসেই আছি। অফিসের সবাই গল্পগুজব করছে। নিজেকে একটা ফার্নিচার ফার্নিচার মনে হচ্ছিল, লাইক আ বেগার! পরে কাজীদাকে কঠিন একটা চিঠি দিয়েছিলাম। ওই অফিস সহকারী চিঠি লিখে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, তার নাকি আমার কথা মনে ছিল না! কিন্তু আর যাওয়া হয়নি।
আমার রয়েলটির কিছু টাকা এখনো এদের কাছে পাই। অনেকবার অনুরোধ করেছি, আমার টাকাটা ডাকে পাঠিয়ে দিতে কিন্তু এদের এক গোঁ, স্বয়ং এসে নিয়ে যেতে হবে। আমিও রাগ করে বলে দিয়েছিলাম, যান, টাকাটা আপনাদেরকে দান করে দিলাম!
প্রশ্ন: আপনার নিজেকে কি ধরনের মানুষ মনে হয়…?
উত্তর: সত্যি বলি, আমার নিজেকে একজন পোকামানব মনে হয়!
প্রশ্ন: আপনার কোন কষ্টের স্মৃতি…?
উত্তর: অনেক। শুধু একটা শেয়ার করি। ঢাকা মিডফোর্ড হাসপাতালে আমার বাবা রাত ২টার পর মারা যান। আমার বয়স তখন ১৬। ওদিন কোন এক কারণে আমি ছাড়া তাঁর কাছে কেউ ছিল না। তাঁর যখন শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। পৃথিবীতে এতো বাতাস কিন্তু এক ফোঁটা বাতাসের জন্য মানুষটা কী আকুতি! আমি পাগলের মতো ডাক্তার, নার্সের জন্য ছুটাছুটি করছি। এ অভাগা দেশে যা হয় আর কি, কাউকে পাচ্ছিলাম না। একবার মনে হলো ছাদে গিয়ে লাফ দেই। আই ডোন্ট নো হোয়াই, এখন প্রায়শ আমার মনে হয়, কেন সে দিন লাফ দিলাম না? হয়তো আমি একজন ভীতু মানুষ বলে! আমি বাবার হাত ধরে আছি।
বাবা বারবার বলছিলেন, খোকা, বড়ো কষ্ট, আমাকে একটু অক্সিজেন দিতে বল! ইশ-শ, বললেই হলো! ১৬ বছরের এক কিশোরের কাছে এটা না চেয়ে তুমি অন্য কিছু চাইতে! আমার মুঠোর ভেতর ক্রমশ তাঁর হাত শীতল হয়ে আসে।
এক সময় ডাক্তার আমাকে নিশ্চিত করেন, এই মানুষটা আমার বাবা না, একটা লাশ! শুরু হয় প্রিয়মানুষের একটা লাশ নিয়ে ভোরের প্রতিক্ষা!
কিন্তু ভোর তো আর হয় না! আসলে ভোর হয়, ভোরকে কেউ আটকাতে পারে না কিন্ত কেউ কেউ হাল ছেড়ে দেয়…।
No comments:
Post a Comment