`মিশন পসিবল'- বন্যা নিয়ে একটা লিখেছিলাম। আসলে মিশন পসিবলের স্বপ্ন দেখে আমার মত এমন একজন নপুংসক- যার স্বপ্ন দেখা ব্যতীত আর কিছুই করার নাই!
আজকাল নিজের জাগতিক যন্ত্রণার সংগে যোগ হয় অনাকাংখিত যন্ত্রণা। মস্তিষ্কে সব কেমন জট পাকিয়ে যায়- কে জানে, জট পাকাতে পাকাতেই কী মানুষ উম্মাদ হয়ে যায়! আফসোস, মস্তিষ্কের কিছু স্মৃতি টান মেরে ফেলে দেয়া যেত যদি! হয় না এমন, না!
এই সরকারের কাজ অনেকখানি গোছানো কিন্তু মিশন পসিবলের স্বপ্ন কই! সিডরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কই!
এবার নাগরিক, আধা-নাগরিক লোকজনের মাঝে কষ্টের ছাপটা বেশি। অনুমান করি, বিভিন্ন মিডিয়ার লোকজনের অবদান আছে এতে- নিরলস পরিশ্রম করে বিভিন্ন রিপোর্ট করেছেন এরা। গভীর কৃতজ্ঞতা আমাদের।
হায় সিডর, একটা ঝড়। দেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা ঝড় লন্ডভন্ড করে দিল সব। এ দেশের অভাগা মানুষরা বন্যার পর যখন মাত্র উঠে দাড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই। পত্রিকা পড়তে এখন ইচ্ছা করে না। আজকাল বাড়তি চাপ নিতে পারি না- বড় ভংকুর হয়ে গেছি।
কী পড়ব?
পরিবারের সবাই মরে গেছে, একজন বেচে আছে। কার কাছে এই প্রশ্ন করব সে কেন বেচে আছে?
যে মা মিছামিছি ডেগ বসিয়ে রেখেছেন নিবানো চুলায়- তার সন্তানকে প্রবোধ দেয়ার জন্য, রান্না হচ্ছে, খাবার মিলবে। এই মিথ্যাচারের জন্য এই মাকে কোন আইনে বিচার করা হবে, কোন আইনে?
যে শিশুটির জানাজা পড়ছে অল্প কজন লেংটিপড়া মানুষ। লেংটি পড়ে জানাজা পড়ার ধর্মীয় নিয়ম আছে কী? এই নিয়মের ব্যত্যয় করায়, এই মানুষদের ধর্মীয় অনুশাসন ভংগ করার জন্য সহীহ হাদিস-জয়ীফ হাদিসের কেতাবটা খোলা হবে না বুঝি?
৫টা বিস্কুট ত্রাণ নেয়ার জন্য উঠেছে শত কাতর হাত- এই নিবোর্ধ আচরণের জন্য কী এদের কোন শাস্তি হবে না?
প্রথম আলোকে দেখছি ত্রাণভর্তি জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়তে। কার মাথা থেকে এই আইডিয়া বেরিয়েছে জানি না কিন্তু আমি ওই আইডিয়াবাজ মানুষটাকে স্যালুট করি! এক্ষণ এটার বড় প্রয়োজন।
ত্রাণ আসছে, ত্রাণ আসবে- জীবন্মৃত মানুষদের এতে কী কাজ!
আমাদের কারাবন্দী রাজনীতিবিদরা ছটফট করছেন, কেন তাদের ত্রাণ বিতরণ করতে দেয়া হচ্ছে না। কারামুক্ত থাকতে দেখেছি এরা নিজেরাই নিজেদের সামলাতে পারেন না- সামলাতে চারপাশে লোক না হলে চলে না। এরা নাকি দেবেন ত্রাণ- বছরের সেরা রসিকতা বটে!
ফি বছর আমরা এমনসব দৃশ্য আমরা দেখেই যাব। কলমের কালি খরচ করার তো এখন রীতি নাই, হালের কী বোর্ড টেপাটেপি করে আমার মত সস্তা কলমবাজ ছাতাফাতা একটা লেখা লেখার চেষ্টা করা। তারপর যথারীতি ভুলে যাওয়া, আগামী একটা বিপযর্য়ের জন্য অপেক্ষা...।
*এই লেখাটার বক্তব্য বোঝার জন্য মিশন পসিবল লেখাটিতে চোখ বুলানো আবশ্যক।
এরশাদ-খালেদা জিয়ার সময় যেভাবে লেখা গেছে, ক্যারিকেচার, কার্টুন আঁকা গেছে আওয়ামী শাসনামলে সেটা ছিল স্রেফ একটা স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন! একদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (!) শহিদুল আলমকে নগ্ন পায়ে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল। কোথায় নিয়ে গেল সেটা আবার অনেক পরে জানা গেল। কোর্টে আবার 'মাই লর্ড' বিচারক পুলিশকে জিজ্ঞেস করছেন, পুলিশ আসামীর (শহিদুল আলমের) ফোনের পাসওয়ার্ড নিয়েছে কিনা, সেদিনই লেখালেখির কফিনে পেরেক ঠোকা হয়ে গেল...!
Friday, November 23, 2007
মিশন পসিবল বলে কোন শব্দ নেই...
বিভাগ
স্বপ্নভংগ
Wednesday, November 21, 2007
সঞ্জীব চৌধুরী, একজন লেখক বানাবার মেশিন!
সঞ্জীব চৌধুরীকে কেউ বলেন গায়ক, কেউ বলেন লেখক, কেউ বা বলেন পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক- আমি বলি, লেখক বানাবার মেশিন!
এঁরা নিজেরা কতটা লেখালেখি করেন, লেখার মান কেমন এসব কুতর্কে আমি যাবো না। অল্প কথায় বলব, আমাদের দেশে এমন লেখক বানাবার মেশিনের বড়ো প্রয়োজন। আফসোস, এদেশে লেখক বানাবার মেশিনের বড্ডো আকাল!
আপনাদের অনেকের হয়তো মনে আছে, এ দেশে টানা ২২ দিন পরিবহন ধর্মঘট ছিল। সব ধরনের মুভমেন্ট বন্ধ! কল্পনা করুন, এক দুই দিন না, ২২ দিন! মধ্যে শুধু একদিন ২৬ শে মার্চ ধর্মঘটের আওতার বাইরে ছিল। রপ্তানীযোগ্য চিংড়ি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল, গার্মেন্টেসের মেশিনে এক ইঞ্চি সুতা খরচ হয়নি, একের পর এক রপ্তানীর অর্ডার বাতিল। গোটা দেশ অচল। কেউ টুঁ-শব্দও করছেন না, গণতন্ত্রের জন্য এর নাকি প্রয়োজন আছে। হায় গণতন্ত্র, হায়!
এ দেশের সেরা সন্তানরা হাঁ করে আকাশের দিকে চেয়ে ছিলেন, যেন বৃষ্টির মতো সমাধান ঝরে পড়বে! আর আমার মতো নপুংসকের তো করার কিছু ছিল না। তিন টাকা দামের কলমবাজ, এই-ই তো লোটাকম্বল!
`পরিবহন ধর্মঘট' নামে একটা লেখা লিখে 'ভোরের কাগজ'-এ পাঠিয়েছিলাম। তখন প্রথম আলোর জন্ম হয়নি। সম্পাদক মতিউর রহমান। ভোরের কাগজে কি বিচিত্র কারণে এই লেখাটা ছাপা হয়েছিল জানি না। অনুমান করি, এর পেছনে নিশ্চিত সঞ্জীব চৌধুরীর হাত ছিল, নইলে মুক্তচিন্তার দৈনিক আমার মতো অগাবগার লেখা ছাপাবে কেন!
তখনও আমি মানুষটাকে চিনি না।
ক-দিন বাদে কোন এক কাজে ওই পত্রিকা অফিসে গিয়েছিলাম, সম্ভবত কারও খোঁজে! কোত্থেকে এসেছি শুনে আড্ডা ছেড়ে ঝাকড়া চুলের, টিংটিং, হাসিমুখের যে মানুষটা এগিয়ে এলেন তিনিই সঞ্জীব চৌধুরী। সঞ্জীব দা।
তিনি এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললেন, 'আচ্ছা, আপনিই কি ওই লেখাটা পাঠিয়েছিলেন? আরে বসেন-বসেন। বেশ আড্ডা দেয়া যাবে'।
আমি মনে মনে বললাম, বাহ বেশ তো, আমি দেখি বেশ আড্ডাবাজ টাইপের লোক! আমার মত একজন লোক যার সঙ্গে নিজের মানুষরাই অল্পক্ষণেই বিরক্ত হয়ে উঠে অথচ এই মানুষটা আমার সঙ্গে আড্ডা দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন।
মানুষটা চা-সিগারেট আনালেন। আমি চুকচুক করে চা খাই, আয়েস করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ি। অ্যাসট্রে নাই। সিগারেটের ছাই কোথায় ফেলব বললে তিনি হা হা করে হেসে বললেন, গোটা ফ্লোরটাই অ্যাসট্রে। ফেলে দেন যেখানে খুশি।
তিনি বললেন, 'এ ধরনের লেখা আরো লিখেন, আমি ছাপাবো'।
আমি বিনীতভাবে বলেছিলাম, 'আসলে আমি তো ঠিক এ ধরনের লেখা লিখি না, আমি অপন্যাস লেখার অপচেষ্টা করি'।
তিনি টেবিলে আঙ্গুল ঠুকে বললেন, 'আপনি আপনার মতো করে যে প্রসঙ্গ নিয়ে ভালো লাগে লেখেন, সমস্যা নাই'।
আমার এই স্বাধীনতাটা ভাল লাগল। পরে কখনই তিনি বিষয় নির্দিষ্ট করে দিতেন না এবং লেখা কাটাছেঁড়া করতেন না। কদাচিৎ কোন প্রসঙ্গ গুরুতর সমস্যা মনে হলে অমায়িক ভঙ্গিতে বলতেন, আচ্ছা এই জায়গাটায় কি এভাবে করা যায়? মানুষটার এইসব সহৃদয়তার কথা আমি ভুলব না।
পরেও যখন বিভিন্ন সময় গিয়েছি, কখনো শত ব্যস্ততায়ও আমি তাঁকে বিরক্ত হতে দেখিনি, সদা হাস্যময়। এই লেখা দেখছেন, এই গুনগুন করে গান গাইছেন, এই টেবিলে তবলা ঠুকছেন।
আমাকে যেটা আকৃষ্ট করত, তাঁর মধ্যে ভান জিনিসটার বড়ো অভাব; সহজিয়া একটা ভাব! অনেক সময় তুমুল আড্ডা ছেড়ে উঠে এসেছেন আমাকে সময় দেয়ার জন্য, অফিসের আঁতেল টাইপের অন্যদের কপালের ভাঁজ উপেক্ষা করে। আমি সলাজে বিব্রত হতাম।
আসলে ঢাকার নাগরিক মানুষদের আমার মত মফঃস্বলের মানুষদের প্রতি দারুণ অবজ্ঞা, সম্ভবত ভক করে আমার শরীর থেকে সরষে তেলের গন্ধ লাগত! এদের দোষ দেই না, এঁরা কী মননশীল মানুষ একেকজন, কপাকপ সাহিত্য চিবিয়ে খান! হাঁটেন পা ফাঁক করে।
`একালের রুপকথা' নামে ওখানে প্রায় টানা দেড় বছর লিখলাম। উপভোগ্য একটা সময়- বিচিত্রসব বিষয় নিয়ে লেখা ফি হপ্তায়। একবার সঞ্জীব চৌধুরী নামের মানুষটা লজ্জায় নুয়ে পড়েছিলেন।
হয়েছিল এমন, এই দেড় বছরে সব লেখাই ছাপা হলো কেবল একটা লেখা আটকে দেয়া হলো। 'শিশু কাঠগড়ায় দাড়াও' নামের একটি লেখা। লেখাটার মূল উপজীব্য ছিল, ১৪ দিন বয়সী এক শিশুর, যার জানাজা পড়া নিয়ে সমস্যা হয়েছিল, তার বাবা নামাজ পড়েন না এই অজুহাতে।
ঘটনাটা আমার নিজের চোখে দেখা। এটা নিয়েই লেখাটা লিখেছিলাম। সব লেখা ছাপা হলো কেবল হলো না এটা!
সঞ্জীব চৌধুরী নামের মানুষটা অসম্ভব বিব্রত হয়ে বলেছিলেন, 'আপনার লেখাটা ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে বলে লেখাটা ছাপানো যাচ্ছে না। সম্পাদকের আপত্তি আছে'।
আমি রাগ গোপন করে বলেছিলাম, 'এটা কি আপনিও বিশ্বাস করেন'?
তিনি কাতর হয়ে বললেন, 'না-না। অমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি মতি ভাইকে বোঝাতে, লাভ হয়নি। কিন্তু তাতে কী আসে যায়! আপনি সম্পাদকের সংগে দেখা করে কথা বলেন।
মতি ভাই নামের সম্পাদক মানুষটার সংগে দেখা করা বা কথা বলার আমার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। আমি এ দেশের এমন কোন 'কলমচী-কলমবাজ' না যে পাঠকরা হাঁ করে বসে থাকেন আমার লেখা পড়ার জন্য। এই সর্বনাশ থেকে বাঁচার জন্য সম্পাদকের সংগে দহরম-মহরম থাকাটা আবশ্যক! আমি সঞ্জীবদাকে কঠিন কিছু কথা বলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম, তাহলে ইনকিলাব পত্রিকা কী দোষ করল! কিন্তু সঞ্জীবদার বিমর্ষ মুখ দেখে কথাগুলো বলা হলো না। আমি মানুষটাকে বইয়ের খোলা পাতার মতো পড়তে পারছিলাম। চাকরির শেকলে বাঁধা একজন প্রবলপুরুষ!
এরিমধ্যে এই পত্রিকার ইন-হাউজে কি কি যেন ভজকট হল, কেউ-কেউ কি-কি যেন কলকাঠিতে ঘুটা দিচ্ছিলেন। সঞ্জীব চৌধুরী আর ওই পাতার দায়িত্বে নাই। পরে এই পত্রিকা তাঁকে ছাড়তে হয়েছিল। সত্যটা হচ্ছে কিছু চালবাজ মানুষ চাল করে এই পত্রিকা থেকে তাঁকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। সেইসব চালবাজ মানুষরাই আজ বেশ্যার মত নগ্ন ভঙ্গিতে, নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপন নিজেরাই দেন, প্রথম মুদ্রণ শ্যাষ দ্বিতীয় মুদ্রণ চলিতেছে লিখে দেন।
আমারও আর ওখানে লিখতে ইচ্ছা করল না, চালবাজদের সংগে তাল মেলাতে পারছিলাম না। এক চোট্টা-চালবাজ তো এই পত্রিকাতেই আমার একটা লেখার থিম অন্য নামে আমার অনুমতি ছাড়াই ছাপিয়ে দিলেন । আজ ওই চালবাজের নাম বললে অনেকে রে-রে করে তেড়ে আসবেন। ওই অন্ধকার দিক নিয়ে এখন আর বলতে ইচ্ছা করছে না।
`পরিবহন ধর্মঘট' নামে একটা লেখা লিখে 'ভোরের কাগজ'-এ পাঠিয়েছিলাম। তখন প্রথম আলোর জন্ম হয়নি। সম্পাদক মতিউর রহমান। ভোরের কাগজে কি বিচিত্র কারণে এই লেখাটা ছাপা হয়েছিল জানি না। অনুমান করি, এর পেছনে নিশ্চিত সঞ্জীব চৌধুরীর হাত ছিল, নইলে মুক্তচিন্তার দৈনিক আমার মতো অগাবগার লেখা ছাপাবে কেন!
তখনও আমি মানুষটাকে চিনি না।
ক-দিন বাদে কোন এক কাজে ওই পত্রিকা অফিসে গিয়েছিলাম, সম্ভবত কারও খোঁজে! কোত্থেকে এসেছি শুনে আড্ডা ছেড়ে ঝাকড়া চুলের, টিংটিং, হাসিমুখের যে মানুষটা এগিয়ে এলেন তিনিই সঞ্জীব চৌধুরী। সঞ্জীব দা।
তিনি এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললেন, 'আচ্ছা, আপনিই কি ওই লেখাটা পাঠিয়েছিলেন? আরে বসেন-বসেন। বেশ আড্ডা দেয়া যাবে'।
আমি মনে মনে বললাম, বাহ বেশ তো, আমি দেখি বেশ আড্ডাবাজ টাইপের লোক! আমার মত একজন লোক যার সঙ্গে নিজের মানুষরাই অল্পক্ষণেই বিরক্ত হয়ে উঠে অথচ এই মানুষটা আমার সঙ্গে আড্ডা দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন।
মানুষটা চা-সিগারেট আনালেন। আমি চুকচুক করে চা খাই, আয়েস করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ি। অ্যাসট্রে নাই। সিগারেটের ছাই কোথায় ফেলব বললে তিনি হা হা করে হেসে বললেন, গোটা ফ্লোরটাই অ্যাসট্রে। ফেলে দেন যেখানে খুশি।
তিনি বললেন, 'এ ধরনের লেখা আরো লিখেন, আমি ছাপাবো'।
আমি বিনীতভাবে বলেছিলাম, 'আসলে আমি তো ঠিক এ ধরনের লেখা লিখি না, আমি অপন্যাস লেখার অপচেষ্টা করি'।
তিনি টেবিলে আঙ্গুল ঠুকে বললেন, 'আপনি আপনার মতো করে যে প্রসঙ্গ নিয়ে ভালো লাগে লেখেন, সমস্যা নাই'।
আমার এই স্বাধীনতাটা ভাল লাগল। পরে কখনই তিনি বিষয় নির্দিষ্ট করে দিতেন না এবং লেখা কাটাছেঁড়া করতেন না। কদাচিৎ কোন প্রসঙ্গ গুরুতর সমস্যা মনে হলে অমায়িক ভঙ্গিতে বলতেন, আচ্ছা এই জায়গাটায় কি এভাবে করা যায়? মানুষটার এইসব সহৃদয়তার কথা আমি ভুলব না।
পরেও যখন বিভিন্ন সময় গিয়েছি, কখনো শত ব্যস্ততায়ও আমি তাঁকে বিরক্ত হতে দেখিনি, সদা হাস্যময়। এই লেখা দেখছেন, এই গুনগুন করে গান গাইছেন, এই টেবিলে তবলা ঠুকছেন।
আমাকে যেটা আকৃষ্ট করত, তাঁর মধ্যে ভান জিনিসটার বড়ো অভাব; সহজিয়া একটা ভাব! অনেক সময় তুমুল আড্ডা ছেড়ে উঠে এসেছেন আমাকে সময় দেয়ার জন্য, অফিসের আঁতেল টাইপের অন্যদের কপালের ভাঁজ উপেক্ষা করে। আমি সলাজে বিব্রত হতাম।
আসলে ঢাকার নাগরিক মানুষদের আমার মত মফঃস্বলের মানুষদের প্রতি দারুণ অবজ্ঞা, সম্ভবত ভক করে আমার শরীর থেকে সরষে তেলের গন্ধ লাগত! এদের দোষ দেই না, এঁরা কী মননশীল মানুষ একেকজন, কপাকপ সাহিত্য চিবিয়ে খান! হাঁটেন পা ফাঁক করে।
`একালের রুপকথা' নামে ওখানে প্রায় টানা দেড় বছর লিখলাম। উপভোগ্য একটা সময়- বিচিত্রসব বিষয় নিয়ে লেখা ফি হপ্তায়। একবার সঞ্জীব চৌধুরী নামের মানুষটা লজ্জায় নুয়ে পড়েছিলেন।
হয়েছিল এমন, এই দেড় বছরে সব লেখাই ছাপা হলো কেবল একটা লেখা আটকে দেয়া হলো। 'শিশু কাঠগড়ায় দাড়াও' নামের একটি লেখা। লেখাটার মূল উপজীব্য ছিল, ১৪ দিন বয়সী এক শিশুর, যার জানাজা পড়া নিয়ে সমস্যা হয়েছিল, তার বাবা নামাজ পড়েন না এই অজুহাতে।
ঘটনাটা আমার নিজের চোখে দেখা। এটা নিয়েই লেখাটা লিখেছিলাম। সব লেখা ছাপা হলো কেবল হলো না এটা!
সঞ্জীব চৌধুরী নামের মানুষটা অসম্ভব বিব্রত হয়ে বলেছিলেন, 'আপনার লেখাটা ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে বলে লেখাটা ছাপানো যাচ্ছে না। সম্পাদকের আপত্তি আছে'।
আমি রাগ গোপন করে বলেছিলাম, 'এটা কি আপনিও বিশ্বাস করেন'?
তিনি কাতর হয়ে বললেন, 'না-না। অমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি মতি ভাইকে বোঝাতে, লাভ হয়নি। কিন্তু তাতে কী আসে যায়! আপনি সম্পাদকের সংগে দেখা করে কথা বলেন।
মতি ভাই নামের সম্পাদক মানুষটার সংগে দেখা করা বা কথা বলার আমার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। আমি এ দেশের এমন কোন 'কলমচী-কলমবাজ' না যে পাঠকরা হাঁ করে বসে থাকেন আমার লেখা পড়ার জন্য। এই সর্বনাশ থেকে বাঁচার জন্য সম্পাদকের সংগে দহরম-মহরম থাকাটা আবশ্যক! আমি সঞ্জীবদাকে কঠিন কিছু কথা বলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম, তাহলে ইনকিলাব পত্রিকা কী দোষ করল! কিন্তু সঞ্জীবদার বিমর্ষ মুখ দেখে কথাগুলো বলা হলো না। আমি মানুষটাকে বইয়ের খোলা পাতার মতো পড়তে পারছিলাম। চাকরির শেকলে বাঁধা একজন প্রবলপুরুষ!
এরিমধ্যে এই পত্রিকার ইন-হাউজে কি কি যেন ভজকট হল, কেউ-কেউ কি-কি যেন কলকাঠিতে ঘুটা দিচ্ছিলেন। সঞ্জীব চৌধুরী আর ওই পাতার দায়িত্বে নাই। পরে এই পত্রিকা তাঁকে ছাড়তে হয়েছিল। সত্যটা হচ্ছে কিছু চালবাজ মানুষ চাল করে এই পত্রিকা থেকে তাঁকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। সেইসব চালবাজ মানুষরাই আজ বেশ্যার মত নগ্ন ভঙ্গিতে, নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপন নিজেরাই দেন, প্রথম মুদ্রণ শ্যাষ দ্বিতীয় মুদ্রণ চলিতেছে লিখে দেন।
আমারও আর ওখানে লিখতে ইচ্ছা করল না, চালবাজদের সংগে তাল মেলাতে পারছিলাম না। এক চোট্টা-চালবাজ তো এই পত্রিকাতেই আমার একটা লেখার থিম অন্য নামে আমার অনুমতি ছাড়াই ছাপিয়ে দিলেন । আজ ওই চালবাজের নাম বললে অনেকে রে-রে করে তেড়ে আসবেন। ওই অন্ধকার দিক নিয়ে এখন আর বলতে ইচ্ছা করছে না।
বারবার যেটা বলতে ইচ্ছা করছে, সঞ্জীব চৌধুরী, এদেশে আপনার মত লেখক বানাবার মেশিনের বড্ডো আকাল! কাজটা আপনি ঠিক করলেন না! এভাবে চলে যাওয়া কোন কাজের কাজ না!
সহায়ক সূত্র:
১. পরিবহন ধর্মঘট: http://www.ali-mahmed.com/2010/09/blog-post_02.html
বিভাগ
কষ্ট
Subscribe to:
Posts (Atom)