ক্রসফায়ার (link) এ দেশের এক মহা মহা আবিষ্কার। গ্রিজ-জেল মাথায় মেখে একজন মন্ত্রীবাহাদুর এটা চালু করেছিলেন! এ জন্যে নোবেল না পেলেও 'বোবেল' পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ক্রসফায়ার জটিল এক আবিষ্কার! অনেক আঁক কষতে হয়, জটিলসব সূত্র, অংকের ফল মেলাতে হয়। বাংলার ফল খেতে খেতে, অংকের ফল মিলিয়ে, ইংরাজিতে ফল হয়ে জনমের তরে মাটিতে শুয়ে যেতে হয়।
প্রথমে আমি ধারণা করেছিলাম এটা মৌলিক আবিষ্কার না। কিন্তু স্টেফেন হকিং-এর 'আ ব্রিফ হিস্ট্রি অভ টাইম' বা আইনস্টাইনের বই-টই খুঁজেও না পেয়ে স্বস্থির নিশ্বাস ফেললাম, যাক এটা তাহলে বঙ্গালদের(! ) আবিষ্কার!
ক্রসফায়ার খুব জটিল একটা বিষয়! ধরুন, আপনি আইনের লোক। আপনার কাছে আছে শটগান। একজন আউট-ল, তার কাছে আছে ওয়েলথার পিপিকে।
ধরুন (আমি বিজ্ঞানী না যে আপনাদেরকে চুলচেরা তথ্য দিতে পারব। তাই আমি ধরুন বলব আর আপনারা ধরতে থাকবেন, দয়া করে আবার হাতের মুঠোয় গুলি ধরতে যাবেন না যেন)।
তো ধরুন, আপনার শটগানের গুলির গতি সেকেন্ডে ১০০ মাইল, আইটল’র ওয়েলথারের গতি ১১৫ মাইল।
বজ্রনির্ঘোষ ঘোষণা হল, ওপেন ফায়ার। ওয়ান, টু, থ্রি...টেন...ফিফটি...নাউ ফাইনাল ফায়ার। আপনি গুলি করলেন (আপনি আ মীন আইনের লোকই প্রথমে গুলি চালাবেন। এটা ক্রিকেট খেলা না, এখানে টসের কোন সুযোগ নাই। লেডিজ ফার্স্ট এর মত আইনের লোকও ফার্স্ট)।
আউটলও গুলি করল। ১০০ মাইল এবং ১১৫ মাইলের মধ্যে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ।
আউটলও গুলি করল। ১০০ মাইল এবং ১১৫ মাইলের মধ্যে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ।
যদিও আপনারা সবাই জানেন, আপনি যদি ১০০ মাইল স্পিডের কোন গাড়িতে ভ্রমণ করেন এবং আপনার জানালার বাইরে দিয়ে যদি ঠিক একটা ১০০ মাইল স্পিডের গুলি যায়, সত্যি সত্যি আপনি হাতের মুঠোয় গুলিটা ধরতে পারবেন। হে হে হে, উত্তাপে হাত পুড়ে গেলে অবশ্য অন্য কথা!
রসো, এক্ষণ কিন্তু গুলিতে কেউ হাত দেবেন না, কেউ না, যমও!
তো, আমরা ফিরে যাই সেই কুরুক্ষেত্রে, না-না, ক্রসফায়ারক্ষেত্রে। যেহেতু ১১৫ মাইল গতির আউটল’র গুলিটা ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করছে তাকে তো না হেরে উপায় নেই।
আপনাকে মনে রাখতে হবে ১০০ মাইল হচ্ছে নায়ক, ১১৫ মাইল হচ্ছে খলনায়ক-ভিলেন। হিন্দি-বাংলা সিনেমায় কি কখনো দেখেছেন ভিলেন বেঁচে আছে নায়ক মরে গেছে? পাগল, এই ছবি একদিন পরই হল থেকে নেমে যাবে!
তো, একটা গাড়ি যেমন অন্য গাড়িকে ওভারটেক করে তেমনি দু-পক্ষের গুলি আগুপিছু করে খুব সূক্ষ একটা পয়েন্টে স্থির হবে। উভয়পক্ষই ওই পয়েন্টটা নোটবুকে টুকে রাখবেন।
যাকে আপনি মারার জন্যে গোপন ইচ্ছা পোষণ করেন, তিনি কিন্তু এতক্ষণ ধরে ফ্রিজ হয়ে থাকবেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবেন, লাইক আ ল্যাম্পপোস্ট। অতঃপর নোটবুক খুলে ওই পয়েন্টটার সূক্ষাতিসূক্ষ হিসাবটা বুঝবে,ন তারপর হেলেদুলে হাঁটা ধরবেন।
ঠিক ওই সূক্ষ যে পয়েন্টটাতে ১০০ এবং ১১৫ মাইল গতির দুইটা বুলেট একত্রিত হয়েছে, আ মীন ক্রস করেছে এবং বিদ্ধ করার জন্য ঝুলে আছে, ওখানে গিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবেন।
ব্যস।
এরপর আর কী? ইন্নালিল্লাহ, রাম নাম সাত্য হ্যায়, যীশু তার আত্মাকে শান্তি দিন।
কি এক বিচিত্র কারণে, কে জানে, সক্রেটিস যেভাবে স্ব-ইচ্ছায় হেমলক পান করেছিলেন এইসব আউটলরাও সূক্ষ ওই পয়েন্টে বুক পেতে দিচ্ছে! এ এক রহস্য! আমি সম্ভবত ঠিক বুঝাতে পারলাম না, আসলে খুবই জটিল একটা বিষয় তো! হকিং ছাড়া আসলে হবে না। দেখি হকিং সাহেবকে মেইল করে...।
ক্রসফায়ার আমাদের দেশে এতো জনপ্রিয় হওয়ার কারণ অনেক। দু একটা বলি, কিছু সন্ত্রাসী এতো ভয়ংকর, এদের টিকিটিও কেউ স্পর্শ করতে পারে না। কোন কারণে ধরা গেলেও অল্প কয়েকদিনের ভেতরই জামিন নিয়ে সে আবার সাক্ষী বা বাদীকে খুন করে। এই দানবদের থামানো মুশকিল।
এ জন্য আইনে কি কি পরিবর্তন আনা প্রয়োজন এটা আমার আলোচ্য বিষয় না- এর জন্য বড় বড় বিশেষজ্ঞরা রয়ে গেছেন। তবে প্রলম্বিত বিচার, এটাই সবেচেয়ে বড়ো সমস্যা!
জাস্টিস ডিলে...আমি ওই বহুল ব্যবহৃত শব্দটা না বলে, চীনা একটা প্রবাদ বলি: একটি বেড়ালের জন্যে আপনি মামলা করবেন। নির্ঘাত একটা গাভী হারাবেন কিন্তু তারপরও আপনি ওই বেড়ালটা পাবেন কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নাই।
বহুল আলোচিত একটা মামলার কথা বলতে চাই। শাজনীন হত্যা মামলা। শাজনীনের বাবা হচ্ছেন প্রথম আলোর মালিক এবং এ দেশের একজন বিগশট, মি. লতিফুর রহমান। স্কলাসটিকা স্কুলের নবম শ্রেনীর ছাত্রী শাজনীনকে ১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল রাতে হত্যা করা হয়। ২০০৭ সাল পর্যন্ত (তখন পর্যন্ত তাই জানতাম), এই মামলা চলছে। কেন চলছে এসব জটিলতায় আমি যেতে চাচ্ছি না। প্রায় ৯ বছর এ মামলা চলছে।
লতিফুর রহমানের মতো বিগশটের যদি এই হয় অবস্থা, আমাদের মতো ছাপোষাদের আল্লা-ভগবান-গড-গুরু নানক ছাড়া গতি কী! এঁরা আবার ঘুমাতে বড়ো পছন্দ করেন!
২৪.০৪.০৬-এ প্রথম আলোয় একজন লিখেছেন, 'দয়া করে এ খুনটাকে ক্রসফায়ার বলবেন না'। ঘটনাটা এ রকম, শুনুন ওই পত্র লেখকের মুখে: "খুলনায় পুলিশের ক্রসফায়ারে মুকুল নামের একজন চরমপন্থী নিহত হন। এই পত্র লেখক মুকুলের নিকট আত্মীয়।
তার বক্তব্য: ২২ বছর আগে কিশোর মুকুল কুড়িয়ে পাওয়া এক বোমা নিয়ে খেলতে গিয়ে তার দুই হাত বোমায় ওড়ে যায়। ২২ বছর ধরে দুই হাতবিহীন প্রতিবন্ধী মুকুল অসহায় নিরপেক্ষভাবে জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করেছে! এটা সবাই জানে, আর জানেন মহান প্রভু আল্লাহ, যিনি সবই জানেন।
...নিরপেক্ষ তদন্ত করলে সব বেরিয়ে পড়বে। পুলিশ মুকুলকে দীর্ঘ আটদিন আটকে রেখে না খেতে দিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে, গ্রেপ্তার না দেখিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল, তার পাপহীন জীবনটা ভিক্ষা চাইতে গিয়ে অনেক সরকারী নেতার কাছে গিয়েছি, নতজানু হয়ে ভিক্ষা চেয়েছি। হাত না থাকার কারণে তাকে সন্ত্রাসী করেছে, আরও কতশত প্রশ্ন। কী হাস্যকর, কী বিস্ময়কর!"
*'শুভ'র ব্লগিং' বই থেকে।