এই সমালোচনাটা করেছেন রাসেল পারভেজ (তাঁর স্ক্রীণ-নেমটা এখানে শেয়ার করার প্রয়োজন বোধ করছি না)। একটা ওয়েব সাইটে খোদেজা নিয়ে সমালোচনা লিখেছিলেন। এর উত্তর লিখব লিখব করে আর লেখা হয়নি। একটা লেখা লিখে ফেলাটা যতটা সহজ কিন্তু এর কোন একটা অংশের ব্যাখ্যা করা, বা সমালোচনার পিঠে আলোচনা করা; আমার জন্য এরচেয়ে কঠিন কিছু নেই! তদুপরি সবিরাম চেষ্টাটা থাকেই!
ওই সাইটে রাসেল পারভেজ হামেশাই 'ডেঞ্জার জোনে' থাকেন। কখন তার সমস্ত লেখালেখিসহ গোটা ব্লগ উধাও হয়ে যায় এই ভাবনায় সমালোচনাটার অংশবিশেষ এখানে দিয়ে দিলাম।
গোটা ব্লগ উধাও করে দেয়া- ওখানে নাকি এটার চল আছে! যে-দেশের যে চল! এইজন্য ব্লগারদের মিটিং-মিছিল পর্যন্ত করতে হয়! এই ভাবনাটা আমার কাছে কেবল অমানবিকই মনে হয় না, অসুস্থ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ। অন্যদের কথা জানি না কিন্তু আমার কাছে আমার লেখা সন্তানসম। আমার সন্তানকে আমি স্পর্শ করতে পারব না এমন কোন আইনকে আমি মানি না, স্বীকার করি না।)
রাসেল পারভেজ তাঁর সমালোচনায় লিখেছেন:
আমরা সাহিত্যের অপমৃত্যু দেখি এ রকম আত্মঘাতি প্রবনতায়। খোদেজা উপন্যাসটির পেছনের পাতায় খোদেজা উপন্যাসের যেই কাঠামোর তথ্য বিদ্যমান ভেতরে প্রবেশ করে সেই কাঠামো খুঁজে পাওয়া যায় না। লেখকের অসাবধানতা কিংবা অযোগ্যতা কিংবা প্রকাশকের কূণ্ঠা কোনটাকে দায়ী করবো ভেবে পাই না আমি।
সামান্য কথায় ঘটনাটা বলতে গেলে লেখকের সবিনয় নিবেদন থেকে তুলে দিতে হয় এ উপন্যাস লেখার পশ্চাত কথনটুকু। খোদেজা নামের এক শিশু ধর্ষিত হয় বাংলাদেশের কোনো এক গ্রামে, তার প্রতি এই নির্মমতার কোনো দ্বিতীয় উদাহরন নেই। সম্প্রতি মগবাজারে ২জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের ধর্ষন করবার পরে হত্যা করা হয়েছে তবে তাদের ধর্ষণ এতটা নির্বিকার নির্মম ধর্ষণ না। তাকে হত্যা করে ঘাতকেরা তার জানাজায় অংশ নেয়। এই মর্মবেদনা লিখে রাখবার কারণেই এই উপন্যাস লিখবার তাড়না তৈরি হয় লেখকের ভেতরে।
উপন্যাসটি একটা পরিনতিতে পৌছালেও আমার কাছে অসম্পূর্ণ এবং ফাঁকিবাজির কাজ মনে হয়। প্রথমত উপন্যাসে ঢুকতে না পারার অক্ষমতা। মূলত এমন সব চরিত্র নিয়ে নাড়াচাড়া হচ্ছে এখানে যাদের সাথে খোদেজার সংশ্লিষ্ঠতা সামান্য, এবং এই চরিত্রগুলো কখনই খোদেজার সাথে সম্পর্কিত হয় না কিংবা তাদের সাথে সংযুক্ত হতে পারে না উপন্যাসের ব্যপ্তিতে।
মূলত গত বছর অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে, প্রতিটা ঘটনাই কোনো না কোনো ভাবে অমানবিক, লেখক এই ঘটনাগুলোকে পূঁজি করে একতা মায়াময় আবহ তৈরি করতে চেষ্টা করেছেন, তবে যেহেতু ঘটনাগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন তাই জুড়ে দেওয়ার নিপূন সূচীশৈলীর অভাবটা প্রকট।
(আমার বক্তব্য, ফিকশনের জন্ম রিপোটিং-এর গর্ভে। একটু অন্য রকম বললে, পৃথিবীর সব কলাই প্রকৃতির নকল। একেকজন একেক রকম নকলবাজি করে এই যা! চোখে দেখা, পড়ে শোনা ঘটনা নিয়ে লিখতে বাধা কী!)
উপন্যাসের মূল ঘটনা ৩টি। বাংলাদেশ বিমানের কেবিন ক্রুদের জন্য অমানবিক একটা অলিখিত নিয়ম আছে, গর্ভবতী হলেই তাদের বরখাস্ত করা হবে, এই নিয়ে তারা একটা মামলা করেছিলেন, সেটায় রায় হয়েছে, সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়া এবং এর অমানবিকতা একটা প্রসঙ্গ, দ্বিতীয় প্রসঙ্গ হচ্ছে শিশু মাদকাসক্তি এবং মূলত যা এই উপন্যাস লিখবার তাড়না সেই খোদেজা উপাখ্যান।
লেখক নিজে তাদের সাথে কোনো সংযুক্ততা বোধ করেন না। তারা নেহায়েত খবরের কাগজের করুণ রিপোর্ট হয়ে থাকে, রক্তমাংসের শরীর নিয়ে সামনে উপস্থিত হতে পারে না। মূলত তারা নিজের চরিত্রের কয়েকটা আঁচর হিসেবে থেকে যায়। কয়েকটা রেখা দিয়ে একটা মানুষের মুখ চিহ্নিত করা যায়, তবে সে মুখে আদল আর অনুভূতি ফোটাতে অনেক রঙ খরচ করতে হয়। এখানে লেখক শুধুমাত্র কয়েকটা আঁচর দিয়ে নিজের দায়িত্ব সমাপ্ত করেছেন।
কেনো এমনটা হলো এটা লেখক ছাড়া অন্য কেউ বলতে পারবে না।
(আমার উত্তর: এই বিষয়ে অনেক কথা বলার ছিল। আমি ওই পথ ধরে হাঁটলাম না। কেবল পোস্টের সঙ্গে এই স্কেচটা দিলাম। এই স্কেচটা আমি দাঁড় করেছি কেবল ৩টা রেখা দিয়ে। এখানে একটা ফিগার দাঁড় করিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। এটা বলার আবশ্যকতা দেখি না: এটা একজন মার স্কেচ। মা-টার গর্ভ হয়েছে। তাঁর সন্তান ছেলে না মেয়ে এইসব নিয়ে বলারও আগ্রহ নাই! আমি পাঠককে অসম্ভব বুদ্ধিমান মনে করি- চলমান একেকটা ক্ষুরধার ব্রেন। সবই বলে দিলে পাঠককে নিবোর্ধ ভাবা হয়। পাঠককে এমনটার ভাবার সাহস আমার নাই।)
লেখার আরও একটা সীমাবদ্ধতা হলো লেখকের উপস্থিতি এবং ভাববিনিময়। এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই যে লেখক নিজে চরিত্র হয়ে তার লেখায় উপস্থিত থাকতে পারবে না, তবে এখানে লেখক প্রথম পুরুষে বর্ণনার ভার নেওয়া কোনো চরিত্র নয়।
ব্যক্তিগত পরিচয় এবং অনেক দিন ধরে তার লেখা পড়বার সুবাদে জানি এখানের অনেকগুলো লেখা এবং মন্তব্য সামহোয়্যারের অতীতের পাতা থেকে তুলে নেওয়া। হয়তো সাময়িক ভাবশূন্যতা কিংবা কিছু একটা দিয়ে পৃষ্টা ভরাতে হবে এমন কোনো ভাবনা থেকেই অসম্পাদিত অবস্থায় সেটা সরাসরি খোদেজা উপন্যাসের অংশভুক্ত হয়েছে।
(ভাল! যে দু-চারজন পাঠক বইটা পড়বেন তাঁদের ওয়েবে আমার সঙ্গে পরিচয় নাই এটা ভেবে খানিকটা আরামের শ্বাস ফেলি।)
চরিত্র বিশ্লেষনঃ নাগরিক চরিত্র নিশি, যে একজন এয়ারহোস্টেস এবং গর্ভবতী তার সাথে লেখকের পরিচয় হয় কোনো এক ব্লগ সাইটে। নিশি এখানে পাঠক, তার নিজের প্রবল আকাঙ্খা সে এই সন্তানের জননী হবে।
তার স্বামী জাবীর মূলত স্বপ্নভুক মানুষ, পরিবারবিচ্ছিন্ন এবং যথাযোগ্য রকমের ভাববিলাসী, পলায়নপ্রবন চরিত্র, তার কোনো আগ্রহ নেই এই সন্তান গ্রহনের। তার নিজস্ব অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার গল্প এখানে জড়িত।
(ওয়েবের লেখালেখির অংশবিশেষ বইয়ে দেয়া যাবে না এমন তো কোন কথা নাই। কেন, এ গ্রহের কোথাও বসে কোন চরিত্র, যে ওয়েবে তার কোন পছন্দের লেখকের লেখা পড়ছে? এমনটা কী হতে পারে না!)
সোহাগ, নিশি জাবীরের পরিবারের শ্রম সহায়ক শিশু, সে খোদেজার ভাই।
এইটুকু স্মৃতিময় যোগাযোগ ছাড়া আর কোথাও উপন্যাসে এই ৩ জনের সাথে খোদেজা কিংবা লেখকের যোগাযোগ নেই।
(ওই ৩ রেখার স্কেচটার কথাই আবার বলব।)
খোদেজা এবং তার বাবা, উপন্যাসের মূল চরিত্র না হয়েও পুলিশ অফিসার জুনাব আলী এবং ওবায়েদ যারা ঘটনার সমাপ্তি ঘটান মেলোড্রামাটিক উপায়ে, তারাই মূলত সবচেয়ে বেশী লেখকের অনুকম্পা পেয়েছেন।
(ওবায়েদ সাহেব, হুঁ। আসলে এটা চরিত্র না, একটা স্বপ্নের নাম।)
নিশি চরিত্রটির নিজস্ব দ্বিধা এবং যাতনা , জাবীরের পলায়নপ্রবনতা, সোহাগের ছিটকে পড়া এবং সাময়িক উদ্ধার অমীমাংসিত, খোদেজাও তেমনভাবে প্রাণ পায় না, যতটা ওবায়েদের প্রতিক্রিয়ায় পায়। এবং ওবায়েদ স্বর্গচ্যুত এক দেবতার মতো হঠাত এসে উদয় হয় খোদেজার গ্রামে, এক দিনে সে সামাজিক দায়বদ্ধতা চুকিয়ে বিদায় নেয়।
এই চরিত্র লেখকের ন্যায় দেওয়ার প্রবল আন্তরিকতায় সৃষ্ট। লেখকের এই প্রাণপন প্রচেষ্টার কারণে শেষ পর্যন্ত এই ওবায়েদের উপরেই একটা শ্রদ্ধাবোধ জন্মায়। তবে পাঠক ভীষণভাবে প্রতারিত হয়। অন্তত লেখক শিশু নির্যাতন এবং এই অমানবিকতার প্রতি যে সীমাহীন ঘৃণা নির্মাণের একটা পটভূমি পেয়েছিলেন, এই নির্যাতিতকে ন্যায় দিতে গিয়ে তিনি এই সুযোগটা হেলাফেলায় নষ্ট করলেন, এবং সম্ভবত তার নিজস্ব কষ্টবোধ লাঘব হলেও সামাজিক সচেতনতা এবং প্রতিবাদী মনন তৈরির পথ রুদ্ধ হয়ে গেলো।
উপন্যাসটির পরিশিষ্টে এই দায়মোচনের চেষ্টা ছিলো লেখকের তবে আমার মনে হয় লেখকের নির্মোহ অমানবিক রুঢ়তা থাকলে এটা চমৎকার একটা উপন্যাস হতে পারতো। মানবিকতার চিত্রায়ন যেভাবে এসেছিলো তাতে এটার গন্তব্য ছিলো অনেক দূর, তবে এই যাত্রা কেনো ব্যর্থ হলো, কেনো চমৎকার একটা হতে পারতো উপন্যাসের অপমৃত্যু ঘটলো, এটার উত্তর কার কাছে?
(আমার উত্তর নাই। এই ছড়িটা পাঠকের হাতে)। পাঠক দুয়েক ঘা মারলে সহ্য করা ব্যতীত উপায় কী!)
আমাদের ফর্মা ধরে উপন্যাস লিখবার প্রকাশকীয় চাপ কিংবা আমাদের লেখকের অতিরিক্ত করূণা এবং ন্যয় প্রত্যাশী মনন, কিংবা লেখার সাবলীলতা স্বত্ত্বেও যদি বলি লেখকের নিজস্ব ব্যর্থতা। লেখক নিজেও অলিখিত চাপে ভুগছেন তবে?
(এখানে আমি নিরুত্তর। এও সত্য বটে, অখ্যাত লেখকের কাছে প্রকাশক হচ্ছেন দ্বিতীয় ঈশ্বর!)
...............
পরিশেষে অন্য প্রসঙ্গ,
পৃথিবীর সেরা শেফ অসম্ভব যত্ন নিয়ে রান্না করলেন। সমালোচক খেয়ে, তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললেন, লবন আরেকটু বেশি হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত আর কী!
হা হা হা।
খোদেজা: ৩
No comments:
Post a Comment