"বুক্কা শ্বাস বন্ধ করে বাবার গল্প শুনছে। হাতি-ঘোড়া, ভূত-প্রেতের গল্প না। সত্যি গল্প। বাবার শৈশব-কৈশোরের গল্প। কী রোমাঞ্চকর সব গল্প!
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বেটারে, আহা, কী সব দিন ছিল।
বুক্কা বলল, বাবা, ছোটবেলায় তুমি কি কি করতে? খুব দুষ্ট ছিলে বুঝি?
বাবা লাজুক গলায় বললেন, হুঁ, একবার মৌমাছির চাকে ঢিল দিলাম। দিল কামড়। মুখ ফুলে ঢোল। বাবা ছাতা দিয়ে দিলেন এক বাড়ি। জীবনে সেই প্রথম বাবার হাতে মার খেলাম। কেন জানি বাবার মেজাজ সেদিন খুব খারাপ ছিল।
বুক্কা বলল, মৌমাছির চাক কি বাবা?
বাবা বললেন, এই যে মধু; অ, তুই চিনবি কি করে! তুই তো ব্রেডের সঙ্গে খাস জ্যাম-জেলী। ফুল থেকে মৌমাছি মধু নিয়ে তার বাসায় জমায়। আগুনের ধোঁয়া দিলে মৌমাছিরা বাসা ছেড়ে চলে যায়। তখন ওদের বাসা ভেঙ্গে মধু সংগ্রহ করা হয়।
বুক্কা অবাক হয়ে বলল, বাবা আগুনে মৌমাছিরা মারা যায় না?
বাবা বিব্রত গলায় বললেন, তাতো মরবেই। তবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মৌমাছি চাষ করলে অবশ্য মৌমাছিরা মরে না।
বুক্কা চোখ গোল গোল করে বলল, বাবা মৌমাছির বাসা কি রকম দেখতে, এ্যাকুরিয়ামের মতো?
বাবা হাসলেন, ধুর পাগল। দাড়া তোকে সিডি এনে দেব। খুঁজে দেখি পাই কিনা, কম্পিউটারে দেখতে পারবি।
বুক্কা ঠোঁট উল্টে বলল, সে তো আমিই পারি। জিসানের কাছে কত্তো সিডি।
বাবা অবাক হলেন, জিসান কে?
বুক্কা হড়বড় করে বলল, আমার বন্ধু। বাবা, তুমি ওকে চেন না, আশ্চর্য! ওর বাবা একজন মন্ত্রী!
বুক্কার বাবা গভীর শ্বাস ফেললেন, তোর বন্ধু-বান্ধব, সচিব-মন্ত্রীর ছেলে। অথচ আমার শৈশব-কৈশোরের বন্ধু ছিল কেউ ধোপার ছেলে, কেউ বা মুচির ছেলে।
বুক্কা আর্তনাদ করে উঠল, হোয়াট দ্য হেল য়্যু আ টকিং এবাউট . . .!
বাবা তীব্র গলায় বললেন, শাটআপ বুক্কা । এসব কি অভদ্র কথা!
বুক্কা মাথা নীচু করে বলল, সরি বাবা
বাবা বললেন, তো, যা বলছিলাম, আমার শৈশব-কৈশোর এদের কাছে ঋণী। আজ আমি যা কিছু, এর পেছনে এদের অনেক অবদান আছে। এটাই বাস্তব, আমি ওখান থেকেই উঠে এসেছি। আহা কী সব দিন! এদের সঙ্গে কতো ডাংগুলি খেলেছি।
বুক্কার বিস্মিত গলা, ডাংগুলি কি বাবা?
বাবা ঝলমলে মুখে বললেন, খুব মজার একটা খেলা। এক লাল হলে আস্ত একটা গুদাম কেনা যেত। এড়ি, দুড়ি, তেলকা, চুড়ি, চম্পা, ডেগ, সুতেগ . . . এভাবে গুণে গুণে এক লাল হত। মুচির ছেলে গাদুরার কাছে আমি নিয়মিত হারতাম। সে গুদাম-টুদাম, নদী সব কিনে ফেলত। আমি ফতুর হয়ে যেতাম। পরে অসংখ্য কিল নিতে হতো।’
কিল কি বাবা?
বাবা হাসলেন, ইসরে বেটা বলিস না, পিঠে দুমদুম করে মার!
বুক্কা এবার সত্যি সত্যি আগ্রহী হলো, বাবা এই খেলার কি সিডি পাওয়া যাবে?
বাবা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, মনে হয় না। আজকাল তোরা কী সব খেলা খেলিস- ব্যাকগ্যামন, পেসেন্স, গল্ফ, বিলিয়ার্ড, তাও কম্পিউটারে!
বুক্কা বলল, আর কি খেলা ছিল তোমাদের সময়, বাবা?
বাবা বললেন, কতো ধরনের খেলা- দাড়িয়াবান্ধা, এক্কা-দোক্কা। গুলতি দিয়ে একবার বিরাট একটা পাখি মেরেছিলাম।
বুক্কা থেমে থেমে বলল, কী নিষ্ঠুর ছিলে তুমি, বাবা!
বাবা দুঃখিত হলেন, জানিস এখন মনে পড়লে বড় কষ্ট হয়। আমার এক বন্ধুর এয়ারগান ছিল। ওরা শুধুমাত্র একবেলা খাওয়ার জন্য চল্লিশ-পঞ্চাশটা চড়ুই পাখি মারত!
বুক্কা শিউরে উঠলো, কী বিভৎস!
বাবা এক বুক কষ্ট নিয়ে বললেন, বুক্কা, জীবনে একবার আমি খুব বড় একটা অন্যায় করেছিলাম। বন্ধুর এয়ারগান দিয়ে একটা কাক মেরেছিলাম। ওই সময় কষ্ট লাগেনি। হতভম্ব হয়েছিলাম, যখন বন্ধুটি মৃত কাককে ফুটবলের মতো লাথি দিয়েছিল!
বুক্কা আর্তনাদ করে উঠলো, বাবা, তোমার পায়ে পড়ি আর বলো না।
বাবা কথা ঘুরাবার জন্য বললেন, জানিস আমার না একটা রাখাল বন্ধুও ছিল। নামটা মনে নাই। ছোটবেলা থেকে আমি তো খুব বই পড়তাম। ক্লাসের বই না, আমাদের ভাষায় আউট বই। স্কুলের নাম করে বের হতাম, বাসা থেকে একটু দুরে ওই রাখালের গোয়ালঘর ছিল। আমার রাখাল বন্ধু আমাকে ভেতরে রেখে তালা বন্ধ করে গরু চরাতে বেরিয়ে যেত। আমি ধুমসে বই পড়তাম। কোন অনুবাদ, দস্যু বনহুর, দস্যু রাণী, ফাল্গুণি, নিহার রঞ্জন, যা পেতাম তাই।
বুক্কা চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি স্কুল ফাঁকি দিতে, বাবা!
বাবা বিব্রত গলায় বললেন, হুঁ। ওই আর কি, মানে সব সময় যেতাম না আর কি।
বাবা টিচাররা তোমায় কিছু বলত না?
বাবা উত্তর দিলেন না। স্কুল ফাঁকি দেয়ার ব্যাপারটা বুক্কার সঙ্গে আলোচনা করতে ভাল লাগছিল না, কথা ঘুরাবার জন্য বললেন, বুক্কা, তোরা তো আবার বিদেশী লেখা ছাড়া এখন আর পড়িস না। কীসব যেন হ্যারী পটার . . . ।
বুক্কা মন খারাপ করা গলায় বলল, দেশে আমাদের জন্য দেশে কেউ লেখে নাকি?
বাবা বললেন, দেশে তোদের জন্য লেখালেখি করেন না এমন না, অনেকেই আছেন. . .। ছোট বেলায় রাশিয়ান একটা গল্প পড়েছিলাম, জানিস। লেখকের নামটা মনে নাই।
বুক্কা বলল, কি ছিল গল্পটা?
বাবা বললেন, বলি শোন: 'কুয়োতলায় সব মায়েরা জড়ো হয়েছেন। মারা একসঙ্গে হলে যা হয় আর কি? রান্না-বান্না, শাড়ি-গহনা, এইসব নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। সবশেষে প্রসঙ্গ এলো কার সন্তান কতো প্রতিভাবান এই নিয়ে। দূরে সবার সন্তানরা খেলা করছিল।
এক মা তার এক সন্তানকে কাছে ডাকলেন। তার সন্তান চমৎকার ডিগবাজী খেল। সবাই মুগ্ধ। ওই সন্তানের মার মুখ ঝলমলে।
অন্য একজন মার সন্তান চমৎকার গান গাইল। কেউ বা কবিতা আবৃত্তি করল।
কেবল মাত্র একজন মা বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যরা বলল: কিগো তোমার ছেলেকে ডাকলে না। ওই মা চোখ নীচু করে বললেন, আমার খোকার যে কোন গুণ নাই, বলে ভারী বালতিটা উঠিয়ে তিনি গুটিগুটি পায়ে এগুতে লাগলেন। রোগা দুবলা কালো কালো মতো তার সন্তান কোত্থেকে জানি ঝড়ের গতিতে এলো, মার ভারী বালতিটা ছিনিয়ে নিল। সোজা বাড়ীর দিকে হাঁটতে লাগল।'
বাবার চোখে জল। কিন্তু বাবা বুক্কার কাছ থেকে লুকাবার কোন চেষ্টাই করলেন না।
বাবা সামলে নিয়ে বললেন, মজার আরেকটা খেলা ছিল- রস, কস, সিঙ্গা, বুলবুল, মালেক, মুসতাক। জানিস, ঘুড়ি উড়ানো খেলায় আমার সঙ্গে কেউ পারত না। সুতোয় এমন মাঞ্জা দিতাম. . . ।
বুক্কার বিস্ময়ের শেষ নেই, মাঞ্জা কি বাবা?
বাবার শিশুর উচ্ছ্বাস, সুতোয় কাঁচ ভাঙ্গার গুড়ো, হেনতেন মিশিয়ে একটা দ্রবণের মতো তৈরী করা হতো। বিশেষ পদ্ধতিতে সুতোয় মিশিয়ে নাটাইয়ের ওই সুতোয় মেশানো হতো। ব্যস, কেল্লা ফতে। অন্য ঘুড়ির সুতো লাগলেই, ঘ্যাচ ঘ্যাচ ঘ্যাচ। হা, হা, হা। কী মজা!
বুক্কা হ্যারী পটারের চশমার মতো চোখগুলো গোল করে অপার বিষ্ময়ে দেখছে বাবাকে। তাঁকে কী ছেলেমানুষই না দেখাচ্ছে! বাবা যেভাবে লাফাচ্ছেন, ছাদে না মাথা ঠুকে যায়! কী আশ্চর্য- বয়স্ক এই মানুষটার মধ্যে লুকিয়ে আছে কী ছোট্ট একটা শিশু!
বুক্কারা থাকে বিশতলা এপার্টমেন্টে। চারপাশে উঁচু উঁচু দালান। বুক্কার কোন খেলার মাঠ নাই। আকাশ নাই!"
*পুরনো লেখা। এখানে দিলাম এই কারণে...।
'বুক্কা এবং একচিলতে আকাশ' এই লেখাটা লিখেছিলাম তা বছর দশেক হবে। লিখেছিলাম কিশোর-ছোটদের জন্য। প্রকাশক সাহেব ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এই ধরনের আলাদা-আলাদা লেখা নিয়ে ৫টা বই বের করবেন। ৫টা বইয়ের একটা প্যাকেট। 'এক ব্যাগ কিশোর' এই টাইপের। এইসবের জন্য প্রকাশক সাহেবদের মাথায় অনেক বুদ্ধি থাকে!
আমি সানন্দে লিখে দিলাম। কী এক লোভে আমার চোখে লোভ চুঁইয়ে পড়ছিল। আমার লেখালেখির শপথ, ক-টা টাকা পাব সেটা বিষয় না। অন্য কিছু না, শিশুদের জন্য কখনও লেখা হয়নি আমার। এই দেশে শিশু-কিশোরদের জন্য লেখার কাজটা খুব কম মানুষই করেছেন।
লেখাগুলো ছিল যতটুকু মনে পড়ে:
ভূত দিবস
মা হাতি
খুকি এবং দৈত্য
কিটি মাস্ট ডাই: ১
কিটি মাস্ট ডাই: ২
২টা বইয়ের ইলাস্ট্রেশন হয়ে যাওয়ার পর আর্টিস্ট ভদ্রলোক উধাও। খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ। প্রকাশক সাহেবের এক গোঁ, তিনি অন্য কাউকে দিয়ে করাবেন না, ইনি নাকি আঁকাআঁকির ভুবনে 'পাকোয়াজ' টাইপের মানুষ। আবার এদিকে প্রকাশক সাহেব ৫টার কমে বইও করবেন না, 'এক ব্যাগ কিশোর' না-করলে তাঁর নাকি পোষাবে না।
আমি বললাম, আমি আঁকার চেষ্টা করে দেখব?
তিনি মুখ লম্বা করে বললেন, আপনি কী আর্টিস্ট, আশ্চর্য! সোজা একটা লাইনও তো টানতে পারেন না। আপনার আঁকা দেখলে যে কেউ বলবে এটা বাচ্চারাদের হাতের কাজ।
আমি বললাম, এক কাজ করলে কেমন হয় আর্টিস্টের নামের আগে খুদে লাগিয়ে দিলে কেমন হয়, খুদে-আর্টিস্ট। দেখেন না, খুদে-গানরাজ?
প্রকাশক সাহেব মুখ আরও লম্বা করে ফেললেন। উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না। রসিকতাটা সম্ভবত তাঁর পছন্দ হয়নি।
পরে শুনলাম তিনি (আর্টিস্ট সাহেব) নেশা-টেশা করেন, আর্টিস্টরা নাকি এমনিই হন। যাই হোক, প্রকাশক সাহেবের ওই প্রজেক্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। বাচ্চারাও আমার গু-মুত টাইপের লেখা পড়া থেকে বেঁচে গেল!
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বেটারে, আহা, কী সব দিন ছিল।
বুক্কা বলল, বাবা, ছোটবেলায় তুমি কি কি করতে? খুব দুষ্ট ছিলে বুঝি?
বাবা লাজুক গলায় বললেন, হুঁ, একবার মৌমাছির চাকে ঢিল দিলাম। দিল কামড়। মুখ ফুলে ঢোল। বাবা ছাতা দিয়ে দিলেন এক বাড়ি। জীবনে সেই প্রথম বাবার হাতে মার খেলাম। কেন জানি বাবার মেজাজ সেদিন খুব খারাপ ছিল।
বুক্কা বলল, মৌমাছির চাক কি বাবা?
বাবা বললেন, এই যে মধু; অ, তুই চিনবি কি করে! তুই তো ব্রেডের সঙ্গে খাস জ্যাম-জেলী। ফুল থেকে মৌমাছি মধু নিয়ে তার বাসায় জমায়। আগুনের ধোঁয়া দিলে মৌমাছিরা বাসা ছেড়ে চলে যায়। তখন ওদের বাসা ভেঙ্গে মধু সংগ্রহ করা হয়।
বুক্কা অবাক হয়ে বলল, বাবা আগুনে মৌমাছিরা মারা যায় না?
বাবা বিব্রত গলায় বললেন, তাতো মরবেই। তবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মৌমাছি চাষ করলে অবশ্য মৌমাছিরা মরে না।
বুক্কা চোখ গোল গোল করে বলল, বাবা মৌমাছির বাসা কি রকম দেখতে, এ্যাকুরিয়ামের মতো?
বাবা হাসলেন, ধুর পাগল। দাড়া তোকে সিডি এনে দেব। খুঁজে দেখি পাই কিনা, কম্পিউটারে দেখতে পারবি।
বুক্কা ঠোঁট উল্টে বলল, সে তো আমিই পারি। জিসানের কাছে কত্তো সিডি।
বাবা অবাক হলেন, জিসান কে?
বুক্কা হড়বড় করে বলল, আমার বন্ধু। বাবা, তুমি ওকে চেন না, আশ্চর্য! ওর বাবা একজন মন্ত্রী!
বুক্কার বাবা গভীর শ্বাস ফেললেন, তোর বন্ধু-বান্ধব, সচিব-মন্ত্রীর ছেলে। অথচ আমার শৈশব-কৈশোরের বন্ধু ছিল কেউ ধোপার ছেলে, কেউ বা মুচির ছেলে।
বুক্কা আর্তনাদ করে উঠল, হোয়াট দ্য হেল য়্যু আ টকিং এবাউট . . .!
বাবা তীব্র গলায় বললেন, শাটআপ বুক্কা । এসব কি অভদ্র কথা!
বুক্কা মাথা নীচু করে বলল, সরি বাবা
বাবা বললেন, তো, যা বলছিলাম, আমার শৈশব-কৈশোর এদের কাছে ঋণী। আজ আমি যা কিছু, এর পেছনে এদের অনেক অবদান আছে। এটাই বাস্তব, আমি ওখান থেকেই উঠে এসেছি। আহা কী সব দিন! এদের সঙ্গে কতো ডাংগুলি খেলেছি।
বুক্কার বিস্মিত গলা, ডাংগুলি কি বাবা?
বাবা ঝলমলে মুখে বললেন, খুব মজার একটা খেলা। এক লাল হলে আস্ত একটা গুদাম কেনা যেত। এড়ি, দুড়ি, তেলকা, চুড়ি, চম্পা, ডেগ, সুতেগ . . . এভাবে গুণে গুণে এক লাল হত। মুচির ছেলে গাদুরার কাছে আমি নিয়মিত হারতাম। সে গুদাম-টুদাম, নদী সব কিনে ফেলত। আমি ফতুর হয়ে যেতাম। পরে অসংখ্য কিল নিতে হতো।’
কিল কি বাবা?
বাবা হাসলেন, ইসরে বেটা বলিস না, পিঠে দুমদুম করে মার!
বুক্কা এবার সত্যি সত্যি আগ্রহী হলো, বাবা এই খেলার কি সিডি পাওয়া যাবে?
বাবা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, মনে হয় না। আজকাল তোরা কী সব খেলা খেলিস- ব্যাকগ্যামন, পেসেন্স, গল্ফ, বিলিয়ার্ড, তাও কম্পিউটারে!
বুক্কা বলল, আর কি খেলা ছিল তোমাদের সময়, বাবা?
বাবা বললেন, কতো ধরনের খেলা- দাড়িয়াবান্ধা, এক্কা-দোক্কা। গুলতি দিয়ে একবার বিরাট একটা পাখি মেরেছিলাম।
বুক্কা থেমে থেমে বলল, কী নিষ্ঠুর ছিলে তুমি, বাবা!
বাবা দুঃখিত হলেন, জানিস এখন মনে পড়লে বড় কষ্ট হয়। আমার এক বন্ধুর এয়ারগান ছিল। ওরা শুধুমাত্র একবেলা খাওয়ার জন্য চল্লিশ-পঞ্চাশটা চড়ুই পাখি মারত!
বুক্কা শিউরে উঠলো, কী বিভৎস!
বাবা এক বুক কষ্ট নিয়ে বললেন, বুক্কা, জীবনে একবার আমি খুব বড় একটা অন্যায় করেছিলাম। বন্ধুর এয়ারগান দিয়ে একটা কাক মেরেছিলাম। ওই সময় কষ্ট লাগেনি। হতভম্ব হয়েছিলাম, যখন বন্ধুটি মৃত কাককে ফুটবলের মতো লাথি দিয়েছিল!
বুক্কা আর্তনাদ করে উঠলো, বাবা, তোমার পায়ে পড়ি আর বলো না।
বাবা কথা ঘুরাবার জন্য বললেন, জানিস আমার না একটা রাখাল বন্ধুও ছিল। নামটা মনে নাই। ছোটবেলা থেকে আমি তো খুব বই পড়তাম। ক্লাসের বই না, আমাদের ভাষায় আউট বই। স্কুলের নাম করে বের হতাম, বাসা থেকে একটু দুরে ওই রাখালের গোয়ালঘর ছিল। আমার রাখাল বন্ধু আমাকে ভেতরে রেখে তালা বন্ধ করে গরু চরাতে বেরিয়ে যেত। আমি ধুমসে বই পড়তাম। কোন অনুবাদ, দস্যু বনহুর, দস্যু রাণী, ফাল্গুণি, নিহার রঞ্জন, যা পেতাম তাই।
বুক্কা চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি স্কুল ফাঁকি দিতে, বাবা!
বাবা বিব্রত গলায় বললেন, হুঁ। ওই আর কি, মানে সব সময় যেতাম না আর কি।
বাবা টিচাররা তোমায় কিছু বলত না?
বাবা উত্তর দিলেন না। স্কুল ফাঁকি দেয়ার ব্যাপারটা বুক্কার সঙ্গে আলোচনা করতে ভাল লাগছিল না, কথা ঘুরাবার জন্য বললেন, বুক্কা, তোরা তো আবার বিদেশী লেখা ছাড়া এখন আর পড়িস না। কীসব যেন হ্যারী পটার . . . ।
বুক্কা মন খারাপ করা গলায় বলল, দেশে আমাদের জন্য দেশে কেউ লেখে নাকি?
বাবা বললেন, দেশে তোদের জন্য লেখালেখি করেন না এমন না, অনেকেই আছেন. . .। ছোট বেলায় রাশিয়ান একটা গল্প পড়েছিলাম, জানিস। লেখকের নামটা মনে নাই।
বুক্কা বলল, কি ছিল গল্পটা?
বাবা বললেন, বলি শোন: 'কুয়োতলায় সব মায়েরা জড়ো হয়েছেন। মারা একসঙ্গে হলে যা হয় আর কি? রান্না-বান্না, শাড়ি-গহনা, এইসব নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। সবশেষে প্রসঙ্গ এলো কার সন্তান কতো প্রতিভাবান এই নিয়ে। দূরে সবার সন্তানরা খেলা করছিল।
এক মা তার এক সন্তানকে কাছে ডাকলেন। তার সন্তান চমৎকার ডিগবাজী খেল। সবাই মুগ্ধ। ওই সন্তানের মার মুখ ঝলমলে।
অন্য একজন মার সন্তান চমৎকার গান গাইল। কেউ বা কবিতা আবৃত্তি করল।
কেবল মাত্র একজন মা বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যরা বলল: কিগো তোমার ছেলেকে ডাকলে না। ওই মা চোখ নীচু করে বললেন, আমার খোকার যে কোন গুণ নাই, বলে ভারী বালতিটা উঠিয়ে তিনি গুটিগুটি পায়ে এগুতে লাগলেন। রোগা দুবলা কালো কালো মতো তার সন্তান কোত্থেকে জানি ঝড়ের গতিতে এলো, মার ভারী বালতিটা ছিনিয়ে নিল। সোজা বাড়ীর দিকে হাঁটতে লাগল।'
বাবার চোখে জল। কিন্তু বাবা বুক্কার কাছ থেকে লুকাবার কোন চেষ্টাই করলেন না।
বাবা সামলে নিয়ে বললেন, মজার আরেকটা খেলা ছিল- রস, কস, সিঙ্গা, বুলবুল, মালেক, মুসতাক। জানিস, ঘুড়ি উড়ানো খেলায় আমার সঙ্গে কেউ পারত না। সুতোয় এমন মাঞ্জা দিতাম. . . ।
বুক্কার বিস্ময়ের শেষ নেই, মাঞ্জা কি বাবা?
বাবার শিশুর উচ্ছ্বাস, সুতোয় কাঁচ ভাঙ্গার গুড়ো, হেনতেন মিশিয়ে একটা দ্রবণের মতো তৈরী করা হতো। বিশেষ পদ্ধতিতে সুতোয় মিশিয়ে নাটাইয়ের ওই সুতোয় মেশানো হতো। ব্যস, কেল্লা ফতে। অন্য ঘুড়ির সুতো লাগলেই, ঘ্যাচ ঘ্যাচ ঘ্যাচ। হা, হা, হা। কী মজা!
বুক্কা হ্যারী পটারের চশমার মতো চোখগুলো গোল করে অপার বিষ্ময়ে দেখছে বাবাকে। তাঁকে কী ছেলেমানুষই না দেখাচ্ছে! বাবা যেভাবে লাফাচ্ছেন, ছাদে না মাথা ঠুকে যায়! কী আশ্চর্য- বয়স্ক এই মানুষটার মধ্যে লুকিয়ে আছে কী ছোট্ট একটা শিশু!
বুক্কারা থাকে বিশতলা এপার্টমেন্টে। চারপাশে উঁচু উঁচু দালান। বুক্কার কোন খেলার মাঠ নাই। আকাশ নাই!"
*পুরনো লেখা। এখানে দিলাম এই কারণে...।
'বুক্কা এবং একচিলতে আকাশ' এই লেখাটা লিখেছিলাম তা বছর দশেক হবে। লিখেছিলাম কিশোর-ছোটদের জন্য। প্রকাশক সাহেব ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এই ধরনের আলাদা-আলাদা লেখা নিয়ে ৫টা বই বের করবেন। ৫টা বইয়ের একটা প্যাকেট। 'এক ব্যাগ কিশোর' এই টাইপের। এইসবের জন্য প্রকাশক সাহেবদের মাথায় অনেক বুদ্ধি থাকে!
আমি সানন্দে লিখে দিলাম। কী এক লোভে আমার চোখে লোভ চুঁইয়ে পড়ছিল। আমার লেখালেখির শপথ, ক-টা টাকা পাব সেটা বিষয় না। অন্য কিছু না, শিশুদের জন্য কখনও লেখা হয়নি আমার। এই দেশে শিশু-কিশোরদের জন্য লেখার কাজটা খুব কম মানুষই করেছেন।
লেখাগুলো ছিল যতটুকু মনে পড়ে:
ভূত দিবস
মা হাতি
খুকি এবং দৈত্য
কিটি মাস্ট ডাই: ১
কিটি মাস্ট ডাই: ২
২টা বইয়ের ইলাস্ট্রেশন হয়ে যাওয়ার পর আর্টিস্ট ভদ্রলোক উধাও। খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ। প্রকাশক সাহেবের এক গোঁ, তিনি অন্য কাউকে দিয়ে করাবেন না, ইনি নাকি আঁকাআঁকির ভুবনে 'পাকোয়াজ' টাইপের মানুষ। আবার এদিকে প্রকাশক সাহেব ৫টার কমে বইও করবেন না, 'এক ব্যাগ কিশোর' না-করলে তাঁর নাকি পোষাবে না।
আমি বললাম, আমি আঁকার চেষ্টা করে দেখব?
তিনি মুখ লম্বা করে বললেন, আপনি কী আর্টিস্ট, আশ্চর্য! সোজা একটা লাইনও তো টানতে পারেন না। আপনার আঁকা দেখলে যে কেউ বলবে এটা বাচ্চারাদের হাতের কাজ।
আমি বললাম, এক কাজ করলে কেমন হয় আর্টিস্টের নামের আগে খুদে লাগিয়ে দিলে কেমন হয়, খুদে-আর্টিস্ট। দেখেন না, খুদে-গানরাজ?
প্রকাশক সাহেব মুখ আরও লম্বা করে ফেললেন। উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না। রসিকতাটা সম্ভবত তাঁর পছন্দ হয়নি।
পরে শুনলাম তিনি (আর্টিস্ট সাহেব) নেশা-টেশা করেন, আর্টিস্টরা নাকি এমনিই হন। যাই হোক, প্রকাশক সাহেবের ওই প্রজেক্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। বাচ্চারাও আমার গু-মুত টাইপের লেখা পড়া থেকে বেঁচে গেল!
সম্প্রতি বুক্কারই মত একজন, 'ধ্রুব'-দের বাসায় গেলাম। ধ্রুব'র বাবার আপ্রাণ চেষ্টা তার ছেলেকে মাটির কাছাকাছি রাখার। এই চেষ্টাটুকু দেখে আমার চোখ নতুন গজানো চকচকে পাতার মত চকচক করে। 'পশ-ফ্ল্যাট' নামের ঝাঁ-চকচকে সিমেন্টের বস্তীর মাঝেও খানিকটা অন্য রকম।
ধ্রুব নাকি দৌড়াতে পারে না, মাঠে দৌড়ালেও আড়ষ্ট হয়ে দৌড়ায়। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের গারাজে কাগজের বল বানিয়ে ফুটবলের নামে লাত্থালাত্থি করে। এই হচ্ছে ধ্রুব'র শৈশব!
তার বাবাকে বলতে ভুলে গেছি এটা, এরা থাকেন দোতলায় না তিনতলায় মনে পড়ছে না, ওখানে যেতেও লিফট- তাহলে ধ্রুব কেমন করে শিখবে দুদ্দাড় করে সিড়ি ভাঙ্গার মজা?
এই ফ্ল্যাটটার যে বিষয়টা আমাকে মুগ্ধ করেছিল বেশ অনেকখানি মাটি। প্লাস্টিকের মাটি না সত্যি সত্যি মাটি (মাটি নিয়ে একটা লেখা ছিল...স্বপ্ন বিক্রি করব)। কেবল গাছ লাগাবার জন্যই না। বৃষ্টি আসলে বৃষ্টির পানিতে এই মাটি ভিজবে, নিশ্চিত সোঁদা গন্ধ বেরুবে *। বৃষ্টির পর বাতাসে যে গন্ধ, আহা! সেই গন্ধ, যে গন্ধে রোবটদের পাথুরে মুখ ক্রমশ মানবীয় হয়ে উঠে। কমনীয়, ঢলঢলে। একজন মানুষ, প্রকৃতির সন্তান মিলেমিশে থাকে প্রকৃতির সঙ্গে- ইচ্ছা করলেই প্রকৃতির বাইরে যেতে পারে না সে। তখন প্রকৃতির সব কিছুর জন্য জন্ম নেয় প্রগাঢ় মায়া, ভালবাসায় ছাপাছাপি দু-চোখ। একজন মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকে আধাআধি শিশু, পশু। বার করতে চায় না কেউ তবুও পশুটা বেরিয়ে পড়ে ফাঁকতালে! পশুটাকে আটকে রাখার জন্য প্রকৃতির কাছাকাছি থাকাটা জরুরি, খুব জরুরি। তখন তিল তিল করে গড়ে উঠা প্রকৃতির সন্তান তার ভেতরের পশুটার সঙ্গে মারামারিতে অনায়াসে জিতে যায়। প্রকৃতির, তার সন্তানের কাছে এরচেয়ে বড় আর চাওয়ার কিছু নাই।
আসলে বুক্কা এবং ধ্রুব'র একচিলতে আকাশে খুব একটা তফাৎ নাই- তফাৎ কেবল ওই মাটির অংশটুকুই!
* বিজ্ঞানিরা অবশ্য বলেন, বৃষ্টির পর বাতাসে যে গন্ধ পাওয়া যায়, সেটি আসলে 'অ্যাকটিনোমাইসিটিস' নামের একটা ব্যাকটেরিয়ার কারণে সৃষ্ট হয়।
এখানে ব্যাটা বিজ্ঞানির কী কাজ!
"The second reaction that creates petrichor occurs when chemicals produced by soil-dwelling bacteria known as actinomycetes are released. These aromatic compounds combine to create the pleasant petrichor scent when rain hits the ground. Another scent associated with rain is ozone."বিজ্ঞানিরা কী বলে বলুক তাতে আমাদের কী! একজন মানব-মানবী বৃষ্টিতে হাতে হাত রেখে ভিজবে আর তার চারদিকে সোঁদা মাটির মেঘ। এই মেঘে হারিয়ে গেলেই কী!
এখানে ব্যাটা বিজ্ঞানির কী কাজ!
2 comments:
just say, Great!
Post a Comment