আলবার্ট আইনস্টাইন ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ, জার্মানীর মিউনিখ শহর হতে চুরাশি মাইল দূরে উলম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এই মহান বিজ্ঞানী কচুরিপানার মতো সারাটা জীবন কাটিয়েছেন।
একজন বিজ্ঞানীর কোনও দেশ হয় না- গোটা পৃথিবীই তার দেশ। তবুও তাঁকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো, আপনার দেশ কোনটি? কি বলতেন তিনি, বলার মতো আদৌ কি কিছু ছিল? তাঁর শৈশব কেটেছে জার্মানীতে, কৈশোর ইতালী, যৌবন সুইট্জারল্যান্ডে, পৌঢ়ত্ব জার্মানী আর বার্ধক্য আমেরিকায়।
এ নিয়ে তাঁর বেদনার শেষ ছিলো না। ১৯২০ সালে বন্ধু ম্যাক্স বর্নকে চিঠিতে লিখেন, "AS A MAN WITHOUT ROOTS ANYWHERE..., I MYSELF HAVE WANDERED CONTINUALLY HITHER AND THITHER A STRANGER EVERYWHERE".
আইনস্টাইনের শৈশব মোটেও সুখকর ছিল না। শিক্ষকদের মতে তিনি ছিলেন হাবা শিষ্য- গাধার গাধা। বিখ্যাত গণিতজ্ঞ মিনস্কি তাঁর ওপর এমন খেপেছিলেন, প্রায়ই গালির খই ফোটাতেন, 'তুমি একটা অলস কুত্তা'।
এই অলস কুত্তাই, আইনস্টাইন আপেক্ষিক মতবাদ দিয়ে সারা পৃথিবী কাঁপিয়ে দিলেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ১৯৪৪ সালে ক্যানসাস সিটিতে তার তৃতীয় প্রবন্ধের পান্ডুলিপি ৬০ লক্ষ ডলারে বিক্রি হয়। সারাটা জীবন যেমন দু-হাতে টাকা কামিয়েছেন তেমনি দুস্থদের অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। দুস্থদের জন্যে বেহালা বাজিয়েছেন। চমৎকার বেহালা বাজাতেন তিনি। তৎকালীন নামকরা পত্রিকাগুলো বিখ্যাত বেহালাবাদক আইনস্টাইন শিরোনামে বাড়াবাড়ি রকম প্রশংসা করেছিল।
একবার জাপানে মানুষে টানা রিকশায় তাঁকে উঠতে বলা হলে, ব্যথিত হয়ে তিনি বলেন: 'একজন মানুষ পশুর মতো টানবে, আমি নির্বিকারচিত্তে বসে থাকব তা কি করে হয়'!
বহু অনুরোধ করেও ফল হয়নি। উঠানো যায়নি রিকশায়।
অহংকারী ছিলেন না, কিন্তু আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল না। জার্মানী শেষবার ছাড়ার পর সে সময়কার একশ বিজ্ঞানী তার তত্ত্ব ভুল বলে মহা হইচই শুরু করে। আইনস্টাইন রাগ করলেন না, ব্যাপারটা সহজভাবেই নিলেন। অসম্ভব আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন: 'আরে এসব কি, একশ জনের কি প্রয়োজন, মাত্র একজন ভুল ধরিয়ে দিলেই তো হয়'!
নিউইয়র্কে প্রথমবার যাবার পর সাংবাদিকরা তাঁকে ছেঁকে ধরল। একজন মজার এক প্রশ্ন করল: 'আচ্ছা বিষয়টা কি বলুন দেখি, আপনার আপেক্ষিকবাদের নাম শুনে মেয়েরা এতো উচ্ছ্বসিত কেন'?
আইনস্টাইন হা হা করে হেসে বললেন: 'কেন আবার, ফি বছরই তো নতুন নতুন ফ্যাশনের হুজুগ শুরু হয়, লেটেস্ট হলো আপেক্ষিকবাদ।
ঢিলেঢালা আটপৌরে বেশভূষা, মাথায় কাকের বাসা, প্রায় সবসময়ই ঠোঁটে ঝুলছে সিগার, বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে চোখ- এসব নিয়েই আইনস্টাইন।
তার ধারণা ছিল, নাৎসীরা যদি আণবিক শক্তির প্রয়োগ করে তাহলে ভয়াবহ অবস্থা হবে। কিন্তু জাপানের ওপর আমেরিকার আণবিক বোমা নিক্ষেপ এবং এর পরিণাম দেখে ভীষণ আঘাত পান। মানুষের কল্যাণে এ শক্তি মুঠোয় আটকাতে গিয়ে ফল হলো সম্পূর্ণ উল্টো। নিমিষেই হাজার হাজার প্রাণ জড় পদার্থ হলো, লাখ লাখ লোক চিরতরে পঙ্গু।
আইনস্টাইন চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলেছিলেন: 'ফর গড সেক, শুধু যদি একটু ইঙ্গিত পেতাম জার্মানরা আণবিক বোমা তৈরি করতে পারবে না, তাহলে কখনই এ বোমা বানাতে সহায়তা করতাম না, কখখনো না'।
আইনস্টাইন ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়। একটা নমুনা এরকম, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চৌদ্দজন বিজ্ঞানীর নাম বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে গোপন ভোটের মাধ্যমে চাওয়া হলে, বিভিন্ন নাম ওঠে এলো। কিন্তু আইনষ্টাইনের নাম কারও পছন্দ থেকে বাদ পড়ল না।
তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল: 'আপনার ল্যাব কোথায়'?
উত্তরে মাথায় টোকা মেরে বললেন: 'এই তো, এটাই'। এক টুকরো কাগজ আর একটা পেন্সিল দেখিয়ে বললেন, 'এটাই আমার ল্যাব-ইন্সট্রুমেন্ট'।
সাংবাদিকরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল: আচ্ছা ধরুন আপনার আপেক্ষিকতত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হল। ফল কি দাঁড়াবে মনে করেন?
তিনি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে থেমে থেমে বললেন: 'হবে আর কি, ফ্রান্সের লোকেরা বলবে: ওহ, ঐ ব্যাটা তো জার্মান আর জার্মানরা ঠোঁট ওল্টে বলবে, ও তো ইহুদী'।
অশান্ত নরকতুল্য পৃথিবী দেখে হতাশাগ্রস্ত হয়ে বলেছিলেন: আহ, আবার যদি যৌবন ফিরে পেতাম। নিজ ইচ্ছার পেশা বেছে নিতে বলা হলে, মোটেও বিজ্ঞানী হতাম না। হকার হতাম। ক্ষীণ আশা, কিছুটা হলেও স্বাধীনতা পেতাম।
যে ছোট বালক বাবার কাছ থেকে কম্পাস উপহার পেয়ে বিজ্ঞানের যাদু দেখে প্রবল নাড়া খেয়েছিল। পরবর্তীকালে সেই বালকটি বিজ্ঞানের চমক দেখিয়ে পৃথিবীর জড়শুদ্ধ নাড়িয়ে দিল। এই মহান বিজ্ঞানী ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট হারব্লক সৌরজগত এঁকে পৃথিবীর ওপর লিখে দিলেন, "ALBERT EINSTEIN LIVED HERE..."।
*যেসব প্রবন্ধের সহায়তা নেয়া হয়েছে:
আণবিক নয় মানবিক: রশীদ হায়দার,
আইনস্টাইন: তপন চক্রবর্তী,
আইনস্টাইনের জগৎ: আব্দুল্লাহ আলমুতী,
আইনস্টাইন শতবর্ষের আলোক: শাহজাহান তপন,
আইনস্টাইন এত বিখ্যাত কেন: আলী আসগর।
**ছবিসূত্র: প্রথম আলো। প্রথম আলোর সূত্র কী এটা এরা উল্লেখ করেননি (হোমওয়ার্ক হয়ে থাকলে ঠিক আছে!)।
No comments:
Post a Comment