দুটি বিচ্ছিন্ন সত্তা- মানব মানবীকে ঘিরে কী অপার্থিব রহস্য!
একদিন অপাপবিদ্ধ ভুমিষ্ঠ শিশু প্রাণপণে চেঁচিয়ে ওঠে। মানব মানবী বিস্ময়ে অভিভূত হয়, এই, এই তাহলে রহস্য! ছোট্ট একটা শেকড় ক্রমশ বিস্তৃত হয় জ্যামিতিক হারে, ছেয়ে ফেলে সবকিছু। মহাবিশ্বের সমস্ত কর্মকাণ্ড এই বিশাল শেকড়কে ঘিরে।
পৃথিবীতে এক ধরনের জীব নিয়ে মানুষ খানিকটা সমস্যায় পড়ল। এরা না মানুষ, না জন্তু, না জড় পদার্থ- কি নামে পরিচিত হবে এরা? মানুষ অনেক মাথা খাটিয়ে এঁদের নাম দিল, হিজড়া-ক্লীব-নপুংসক। এক নিঃসঙ্গ পরিত্যক্ত শেকড়, যাদের নিয়ে কোনো রহস্য নেই- এদের কোন শেকড় নেই! পৃথিবীর এই বিশাল রঙ্গমঞ্চে কি ভূমিকায় এরা নিষ্ঠার সঙ্গে অভিনয় করছে, কে জানে? যে জানে, তাঁর এইসব বিষয় নিয়ে আলোচনায় আগ্রহ নাই।
তাই জানা হয় না, কেনই বা পৃথিবীতে অবহেলা ভরে এঁদের ছুড়ে ফেলা হয়েছে! প্রবল আশা, প্রকৃতির কোন সৃষ্টিই অযথা হয়নি, নিশ্চয়ই কোন না কোন কারণ রয়েছে। থাকতে বাধ্য।
সৃষ্টিই যাদের কুৎসিত কৌতুক, সেরা জীব মানুষ ফেলনা এইসব অ-মানুষদের নিয়ে ব্যঙ্গ করবে এ আর আশ্চর্য কি! আমাদের কী আনন্দই না হয় এঁদের দেখে। ছায়াছবিতেও এঁদের ছায়া দেখে আমরা দর্শক, একজন আরেকজনের গায়ে হাসতে হাসতে ঢলে পড়ি। আহা, এমনটা হবেই না কেন? পৃথিবীতে এঁদের কোনও ভূমিকা নির্দিষ্ট নেই বলে কি মানুষ হাসাতেও ভূমিকা থাকবে না!
এমনই এক অ-মানুষের সঙ্গে কথোপকথন। এঁদের গলার স্বর অত্যন্ত কর্কশ, সম্বোধন তুই তুই করে, প্রকাশ ভঙ্গি উগ্র। কথোপকথন খানিকটা মার্জিত আকারে এবং খানিক ভাবানুবাদে (ইনি যখন উপর দিকে আঙ্গুল তোলেন তখন বুঝে নিতে হয়, উপরলোকের বাসিন্দার কথা বলা হচ্ছে) :
আপনার নামটা বলবেন?
অ-মানুষ: আমার নাম মিনু।
মিনু তো মেয়েদের নাম- ইয়ে মানে আপনি...?
অ-মানুষ: আমি মেয়ে না এটাই তো বলতে চান? এ নাম রাখা ঠিক হয়নি, এই তো? কিন্তু এই নাম রেখেছি। বেশ করেছি, আপনার কোনো অসুবিধা আছে? মিনু রাখতে পারব না, বলবেন আমরা মেয়ে না। মনা রাখলে আবার বলবেন ছেলে না। কি হওয়া উচিত ছিল আমার নাম; মন!
আপনারা নারীর মতো সাজগোজ করেন, এটা কেন?
অ-মানুষ : দেখেন, আমাদের প্রধান আয় হলো কোথায় কোথায় শিশু ভূমিষ্ঠ হচ্ছে খোঁজ খবর রাখা- নবজাতককে নিয়ে হইচই, নাচানাচি করা। এসব করে কিছু টাকা পাই। আমরা নারীর সাজ ধরে চট করে অন্দর মহলে ঢুকতে পারি, মহিলারা তেমন উচ্চবাচ্চ্য করে না। এমনিতে এখন তো শিশু জন্মের হার অনেক কমে গেছে- আয় তেমন নেই বললেই চলে। আগে একটা পরিবার ফি বছর বাচ্চা হতো। এখন কি সব বার্থ কন্ট্রোল-ফন্ট্রোল করে।
ছোট্ট, অত্যন্ত গরিব দেশ আমাদের। যে হারে মানুষ বাড়ছে, গিজগিজ করছে, এখনই ১৫ কোটি মানুষ এই দেশে। এই দেশে প্রায় তিরাশি ভাগ সৃষ্টির সেরা জীব পশুর ন্যায় জীবন যাপন করছে। বার্থ কন্ট্রোল না করলে চলবে কেন বলুন?
অ-মানুষ : এটা আপনাদের, মানুষদের সমস্যা, আমাদের না।
প্রঃ এ প্রশ্ন করার জন্যে আগেভাগে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনাদের কাউকে কাউকে নিয়ে বখা ছেলেরা বিশেষ উদ্দেশ্যে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করে। এরকম কিছু কথাবার্তা আমরা শুনতে পাই, এটা কতোটুকু সত্য?
অ-মানুষ : এটা যে পুরোপুরি অসত্য এমন না। শুধু বখা ছেলেরা না, বয়স্ক মহিলারাও অন্য রকম আগ্রহই দেখায়। কিন্তু বখে যাওয়া ছেলেরা নিজেরাও তো এমন কাণ্ড করে, করে না?
আমরা দেখি আপনারা দল বেঁধে চলাফেরা করেন। পেছনে থাকে আবালবৃদ্ধবণিতার আনন্দমুখর লম্বা মিছিল।
অ-মানুষ : আসলে আপনারা আমাদের নাম ভাঁড় রাখলেই পারতেন। আমাদের কোনো আনন্দ নাই। কেউ হাসি ঠাট্টা করে, খোঁচা মেরে আনন্দ পেলে পাক না। তবু তো আমাদের কিছুটা মিথ্যা অহংকার হয়, এই বিশ্ব সৃষ্টিতে নগন্য হলেও কাজে লাগছি।
এ জীবন আপনার কেমন লাগে?
অ-মানুষ : জীবন, এইটাকে আপনি জীবন বলেন? আমাদের কোনও ভবিষ্যৎ নাই, না আছে কারো প্রতি দায়বদ্ধতা। আমরা একেকজন মারা যাব কোন ছাপ না রেখেই। আপনারা তো সন্তান-সন্ততির মাঝে অমর হয়ে থাকবেন, আমরা কী? কেবল নরক যন্ত্রণার মাঝে বেঁচে থাকা।
মানুষ অতীত ইতিহাস থেকে না শিখুক আমাদের দেখে শিক্ষা নিতে পারত। ধারণা ছিল, এজন্যে আমরা আসছি। মানুষ যেন আমাদের দেখে, আর ভাবে, তারা কী সুখের জীবন-যাপনই না করছে।
অসম্ভব কষ্টে লাগে, ব্যথিত হই, যখন দেখি সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ ইচ্ছে করে যেসব হারাচ্ছে, পায়ে ঠেলছে, তা শ্রেষ্ঠ সময়ের অপচয়, কী কুৎসিত অপচয়! আহা, আহা রে!
তারপরও আমি বলি, কী চমৎকার আমার এ জীবন- ভাল লাগার অসংখ্য উপকরণ ছড়িয়ে আছে চার পাশে! জীবনটা মন্দ না, কী বলেন?
No comments:
Post a Comment