মহাঘাতকের সঠিক পরিচয় কেউ জানে না। কেউ বলে যাদুকর, কেউ বা বলে ভিনগ্রহের লোক বিভিন্ন কথাবার্তা শোনা যায়। ওঁর চামড়া ধবধবে সাদা, পছন্দের একমাত্র রং কুচকুচে কালো। গায়ে যেটা দেন এটা আলখেল্লা বলা হবে, না হাতকাটা পাঞ্জাবি, এটা গবেষণার বিষয়। স্বল্প আলোয় দেখলে মনে হবে ধবধবে দুহাত আর একটা মাথা হেলেদুলে এগুচ্ছে। সে এক ভয়াবহ ব্যাপার, বেশিরভাগ লোক হার্টবিট মিস করে।
আজকাল মাথা খুব গরম থাকে। ডায়েটিং করছেন । প্রায় তিনবেলায়ই ঘাস খেয়ে থাকেন। মানে যেটা খান ঘাসের মতোই মনে হয় আর কী! প্যাচপ্যাচে কাদার মতো আঠালো জাউ, গলা দিয়ে নামতে চায় না। চিবানোর সময় মনে হয় অনন্তকাল ধরে রাবার চিবুচ্ছেন। আহ আফসোস, খেতে পারেন না; টাকা পয়সা কোনো সমস্যা না। গরীব দেশের মূর্খ জনগণ, অদৃষ্ট দেখার নাম করে যা বলা হয় তাই বিশ্বাস করে। একগাদা টাকা দেয়।
তাছাড়া কয়েকটা দৈনিক সাপ্তাহিকীতে নিয়মিত ভবিষ্যৎ বাণী করেন। কিছু নমুনা দেয়া যাক। একটি দৈনিকে সিংহ রাশির জাতকের জন্য হয়তো লিখলেন: দিনটা আপনার জন্য অশুভ, ঘাতকের সঙ্গে দেখা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। প্রতিকার: ৬ রতি রক্ত প্রবালসহ অষ্টধাতুর আংটি ডান তর্জনিতে পরিধান করুন। ঘাতকের দেখা পেলে ডান তর্জনি তাক করুন। সাবধান বাণী: বাজারে যেসব অষ্টধাতুর আংটি রয়েছে সবই ভেজাল। গ্যারান্টি দেয়া যাচ্ছে ওমুক...।
আরেকটা দৈনিকে হয়তো এই রাশির জাতকের জন্য ঐ দিনই লিখলেন: দিনটা আপনার জন্য খুবই শুভ। গায়ের উপর দিয়ে যন্ত্রদানব চলে গেলেও ধুলো ঝেড়ে দেখবেন আপনি চ্যাপ্টা হননি।
অফিসটা সাজিয়েছেন ভালোই, রীতিমতো জাঁকালো। দিন হোক রাত হোক, প্রায় অন্ধকার থাকে, ঢুকলেই গা ছমছম ভাব হয়। অসংখ্য মানুষের খুলি ছড়ানো ছিটানো। ফুটবল মাঠের মতো টেবিলে আগুপিছু করে বারোটা খুলি সাজানো। চারকোণায় চারটা খুলিতে বিরামহীনভাবে ধূপ জ্বলে। ধোঁয়া দেখে বেশ ক’বার ফায়ার ব্রিগেড চলে এসেছিল।
‘স্যার, আপনার কাছে একজন লোক আসছে’, পিয়ন বলল ভয় চেপে। এ ঘরে ঢুকলেই তার বুক ধড়ফড় করে, হাঁটুতে জোর থাকে না। মহাঘাতক করমচার মতো চোখ তুলে কটমট করে তাকালেন। পরক্ষণেই মহাঘাতকের মনে পড়ে গেল একদিন বেশি তাকাতে গিয়ে এই নমরুদ কার্পেট নষ্ট করে ফেলেছিল। সাত হাজার টাকার পারসিয়ান কার্পেট। তাড়াহুড়ো করে চোখ নামিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, ‘পাঠিয়ে দাও।’
আগত লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে আলাভোলা ধরনের লোক। লোকটার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন যেন নর্দমার কীট দেখছেন, অসংখ্য হাড় থেকে ঘুণ ধরা হাড় (অবজ্ঞা প্রকাশ করতে এটা ব্যবহার করেন) তাক করে চেয়ার দেখিয়ে দিলেন। চেয়ারে বসে লোকটা অবজ্ঞা ভরে চারপাশ দেখতে লাগল, বারবার নিচের ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে। মহাঘাতক বিস্মিত হলেন। তা’বড় তা’বড় লোক ঠান্ডা হয়ে গেছে, এর ভয় না পাওয়ার উৎস কী! কেন জানি মনে হচ্ছে, এ বড়ো যন্ত্রণা করবে। মাথায় ছিদ্র করা একটা খুলি এগিয়ে দিয়ে রাশভারী গলায় বললেন, ‘পাঁচশো টাকা পঁচানব্বই পয়সা।’
লোকটা খুলিতে টোকা মেরে মধুর হেসে বলল, ‘প্লাস্টিক নাকি, এটার এতো দাম! ঠকেছেন!’
মহাঘাতক স্তম্ভিত। এ মনে হয় মহাবদ। রাগ চেপে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘পাঁচশো টাকা পঁচানব্বই পয়সা এটা আমার ফি, ছিদ্র দিয়ে টাকাটা ফেলুন।’
‘আপনি কি ভাই বাটা নাকি! পঁচানব্বই পয়সার যন্ত্রণায় এদের জুতা কেনা ছেড়ে দিয়েছি।’
‘ঠিক আছে পাঁচশো এক টাকাই ফেলুন, ’ মহাঘাতক এবার একটু নরম হয়ে বললেন।
লোকটা চট করে একটা পাঁচশো টাকার নোট খুলিতে ফেলল। এক টাকার জন্য এ পকেট ও পকেট হাতাতে লাগল। এক ফাঁকে বলল, ‘পাঁচশো দিলে হয় না?’
‘না, হয় না। শূন্যের কাজ আমি করি না। শূন্য বড় গোলমেলে জিনিস।’
লোকটা অনেক খুঁজে চারটা সিকি বের করল। ফেলতে ইতস্তত করছে দেখে মহাঘাতক রাগী গলায় বললেন, ‘কি হলো ফেলুন।’
লোকটা বিড় বিড় করে ভাংতি পয়সাগুলো ফেলে দিল।
‘কি নাম আপনার, ’ মহাঘাতক হাসি মুখে বললেন।
‘জামাল মিয়া।’
‘জামাল মিয়া! এ কি ধরনের নাম! এর আরবী অর্থ হয় 'উট একশ'। একশ তো দূরের কথা, আপনাকে দেখে তো একটা উটও মনে হচ্ছে না।’
‘ভাই আমি উট না দুম্বা নাকি ছাগল এতে তো আপনার দরকার নাই। মহাঘাতকের আরবী অর্থ কি হয় আমার জানা নাই কিন্তু বাংলাতেই এর অর্থ মহাখুনী।’
মহাঘাতক তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, জামাল মিয়া পাত্তা না দিয়ে সহজ গলায় বলল, ‘কাজের কথা হোক।’
‘আপনার ভবিষ্যৎ জানতে চান?’
‘জ্বী না, আমার কিছু না। জাতকের হাতের ছাপ নিয়ে এসেছি।’
‘জন্ম তারিখ কতো?’ মহাঘাতকের প্রশ্ন।
‘ইয়ে তাতো জানি না।’
‘জাতকের নাম কি?’
জামাল মিয়া থেমে থেমে বলল, ‘নাম-নাম, এমনিতে শুভু বলে ডাকি আর কি।
মহাঘাতক বিরক্তি চেপে বললেন, শুভু, এটা আবার কী নাম! সম্ভবত শুভ হবে?
না শুভুই।
মহাঘাতক অনেক ছক-ফক কাটলেন, অল্প সময়ে ছত্রিশবার নিচের ঠোট টানলেন, অবশেষে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এ কুম্ভ রাশির জাতক। এর প্রতীক হচ্ছে পাত্র হতে পানি বর্ষণকারী ব্যক্তি। এরা বিজ্ঞানধর্মী, চিন্তাবিদ, অনলবর্ষী বক্তা এবং জীবনের প্রতি মানবতাতপূর্ণ। এরা শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত অত্যন্ত ভালবাসে। ’
‘আঃ, এতো ফড় ফড় করছেন কেন, এসব কে জানতে চাচ্ছে। জাতক সম্বন্ধে বলুন, ’ জামাল মিয়া অসহিষ্ণু।
‘ও আচ্ছা। জাতকের তো দেখি রাজকপাল। টাকা পয়সা এর কাছে বাদামের খোসা। দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়া বিচিত্র কিছু না। ইউরেনাস ও শনির প্রভাবে এদের ভাগ্যে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন হয়্। ইয়ে, চার বিয়ের যোগ দেখা যাচ্ছে।’
জামাল মিয়া হাসতে হাসতে বাঁকা হয়ে লম্বা হয়ে গেলেন, সামলে নিয়ে হাসি একান ওকান করে বলল, ‘ব্যস-ব্যস, ভাই আর বলবেন না, নাইস জোক। পেট ফেটে মারা যাব। এ রকম মজার জোক বহু দিন শুনিনি। ওটা বানরের হাতের ছাপ।’
মহাঘাতক বিচলিত বোধ করলেও লুকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, যাক টাকাটা মার যায়নি।
জামাল মিয়া এবার রসিয়ে রসিয়ে বলল, ‘ভালো কথা, পাঁচশ টাকার নোটটা কিন্তু জাল। কে যেন আমাকে গছিয়ে দিয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী পুলিশকে জানানোর কথা; ধুর-ধুর কে যায়? বাঘে ছু’লে আঠারো ঘা, পুলিশ ছু’লে ছত্রিশ ঘা। যাইহোক, বেশ মজা হলো আজকে। হা হা হা।
No comments:
Post a Comment