Search

Sunday, September 13, 2009

ওরে জীবন, তোকে বলি, দূর-দূর!

এখন আমি ভারী অকাজের একজন মানুষ। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠারও তাড়া নাই। গদাইলস্করি চালে ঘুম থেকে উঠলে আমাকে জানানো হলো একজন আমাকে খুঁজে গেছেন। মানুষটার বিস্তারিত বর্ণনা শুনে থমকে যাই। হায় খোদা, আগুনমানুষটা আমাকে খুঁজে গেছেন! কেন-কেন?
এই দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আমার বেশ কিছু আলাপচারিতা হয়েছিল, প্রচলিত ভাষায় যাকে সাক্ষাৎকার বলে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা দিক জানতে পেরেছি এই মানুষটার কল্যাণে। যুদ্ধকালিন সময়ে মানুষটার সাহস দেখে আমার 'ব্রেভহার্ট' মুভিটার কথা মনে পড়ে যেত। একজন মানুষের এমন সাহসের উৎস কোথায়, কেমন করে পারে একজন মানুষ এমন সাহস দেখাতে? যে মানুষটার ভয়ে পাক-আর্মি থরথর করে কেঁপেছে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমার কথা জড়িয়ে আসত। আমি ছল করে তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতাম- আমার মতো একজন ভীতু মানুষের মধ্যে যদি কোন এক উপায়ে খানিকটা সাহস সঞ্চারিত হয় যদি! কী যে লোভ আমার!
এই আগুন মানুষটা আমাকে খুঁজে গেলেন আর আমি কিনা দিব্যি ঘুমাচ্ছিলাম। কী লজ্জা!

মানুষটাকে খুজেঁ বের করি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কথা বলছি। কিন্তু মানুষটার মধ্যে খানিকটা অন্যমনস্কতা, অসঙ্গতি লক্ষ করি- কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। আজ আগুনমানুষটাকে বড়ো ভঙ্কুর-অসহায় দেখায়। বয়সে অনেক বড়ো এই মানুষটা আমাকে আদর করে মামা বলেন। অনেকক্ষণ ইতস্তত করে বলেন, 'মামা, তুমার তো নিজেরই অনেক সমস্যা। দেড় বছর ধইরা কিছু করো না, রুজিপাতি নাই। কেমনে যে তুমারে কই। না কইয়া কী করুম কও, আর কার কাছে কমু কও, কওয়ার কুনু জায়গা নাই, বুঝলা। আচ্ছা মামা, তুমি জাকাত তো এইবার দিবা না, না? না-না, বুঝতাছি; কোত্তিকা দিবা! আচ্ছা মামা, ফিতরা থিক্যা যদি কিছু টাকা আমারে দিতা। বাচ্চাগুলা বড়ো যন্ত্রণা করতাছে...'।

তিনি বিজবিজ করে আরও কীসব বলছিলেন আমি বুঝতে পারছিলাম না কারণ আমার চোখে জল। ঝপ করে কোত্থেকে জলে চোখ ছাপাছাপি। জনসমুদ্রে আমি চোখের জল লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

.........
মানুষটার নাম বলে তাকে আর অসম্মান করি না- তাঁর এই অসহায়ত্ব আমার বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখি। এখন নিজের উপর এতটাই রেগে আছি- নিজের মুখে নিজেই থুথু দিতে ইচ্ছা করছে। কী হয় এইসব ছাতাফাতা লেখালেখি করে। আমার ধারণা, যাদের কিছুই করার সামর্থ্য নাই এরাই আমার মত লেখার চেষ্টা করে। এদের লেখালেখির নাম করে হাতি-ঘোড়া খুন করা ব্যতীত আর করার কিছুই নাই। আমি অভিশাপ দেই এদের। আমি নিশ্চিত হিজড়ারা লেখালেখি করলে ভাল করতে পারতেন!
দূর-দূর! এতো সীমাবদ্ধতা নিয়ে পৃথিবীতে আসার আদৌ প্রয়োজন ছিল না। মস্তিষ্কে গাদাগাদি করে থাকা এইসব কষ্ট বয়ে বেড়াতে হতো না।

কোন রাজাকার ভাবাপন্ন কার সঙ্গে কে খিচুড়ি খেয়েছে- কে কোন তেলের ড্রামের উপর দাড়িয়ে ঘোষণা দিয়েছে- বালকবেলায় কে বাথরুমে বসে দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছে, এইসব চুলচেরা বিশ্লেষন নিয়ে আমাদের জীবন কাবার। অন্যত্র তাকাবার সময় কোথায় আমাদের।
আমি আগেও লিখেছিলাম আমাদের দেশটা বড়ো বিচিত্র
বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের জন্য সমগ্র দেশের চোখের জলে পাটলুন ভিজে যাচ্ছে। অথচ এই মানুষটাই কী বেদনা নিয়েই না বলেছিলেন:
"এত সংবর্ধনা, সম্মান দিয়ে আমার কী হবে!
সংবর্ধনা বিক্রি করে দিরাই বাজারে এক সের চালও কেনা যায় না"। (প্রথম আলো)

আধুনিক ইদ নামের অসভ্য এই পর্বে আপাদমস্তক অসৎ বাবার বখা মেয়ে লাখ টাকা দামের হাঙ্গা নাকি লেহাঙ্গা কিনবে এটা মিডিয়া খুব ফলাও করে জানাবে কিন্তু কত বাবার কত সন্তান একটা কাপড়ের টুকরার জন্য আত্মহত্যা করবে এটা আমাদের জানা হবে না। কারণ এইসবের তথ্য ভ্যালু নাই!

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কতই না আবেগ আমাদের! কী অবলীলায় আমরা ভুলে যাই জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনকে। হায়রে অসভ্য আমরা, যে মানুষটা স্মৃতিসৌধ নির্মান করল, উদ্বোধনের দিন তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি, অনুষ্ঠান চলাকালিন ঢুকতে দেয়া হয়নি।
এই মানুষটার হাত সবাই ছেড়ে দিয়েছে (এটা ২০০৬ সালের কথা, এখনকার তথ্য আমার কাছে নাই)। তখন অপ্রকৃতস্থ, পশুর মত জীবন-যাপন করছিলেন; তেমন কেউ এগিয়ে আসেনি। শ্লা, এই দেশে আই পি, ভি আই পির পল্লী হয়। ওখানে এই দেশের সেরা সন্তানদের জায়গা না হয়ে হয় কতগুলো চোরচোট্টার!

ফাদার মারিনো রিগন। যে মানুষটাকে উচিৎ ছিল মাথায় করে রাখা তাঁকে চরম অপমানিত করেছি আমরা। মানুষটা বারবার কাতর অনুরোধ করেছেন তাঁকে এই দেশের নাগরিকত্ব দিতে। ৩৭ বছরে ধরে আমরা গা করিনি, মাত্র অল্প ক-দিন পূর্বে তাঁকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে!

কী অবলীলায়ই না আমরা বিস্মৃত হই লালুর কথা , ভাগিরথীর কথা, প্রিনছা খেঁ , বীরাঙ্গনা রীনাউক্য চিং-কে ১০০ টাকার প্রাইজ বন্ড দিয়ে সম্মান জানাই! (শেরাটনের বল-রুম ব্যতীত আমরা তো আবার মুক্তিযুদ্ধের কথা গুছিয়ে বলতে পারি না!)

১৬ ডিসেম্বরে মুক্তিযোদ্ধা সুরুয মিয়া আত্মহত্যা করেন এতে আমাদের কোন শোক নাই, লাজ নাই! আত্মহত্যা করায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হবে কিনা এই নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে স্যারদের চুল যায় যায়! লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে।

এই দেশেই সম্ভব তাহেরের মত অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিতে ঝোলাবার নাম করে স্রেফ খুন করা। কোনও শারীরীক প্রতিবন্ধীকে ফাঁসি দেয়ার কোন আইন আছে? এটা জানার আমার প্রচন্ড আগ্রহ। হায় সভ্যতা, হায় সোনার বাংলা!

একজন গোলাম আযমগোলাম আযমকে আজ অবধি ১ দিনের জন্যও আটকে রেখে শাস্তি দেয়া গেল না। গোলাম আযম নাগরিকত্ব পাবেন কিন্তু ফাদার মারিনো রিগনের বেলায় যত সমস্যা! স্রেফ লম্বা লম্বা বাতচিত, এতে আমাদের ক্লান্তি নাই! মতিউর রহমান নিজামীর গাড়িতে এই দেশের পতাকা উড়ে পতপত করে এতে আমাদের কোন সমস্যা নাই- স্বাধীনতা হয়ে যায় বাদামের খোসা(!)। হায়, শুয়োরখেকো প্রিন্স হ্যারীকে সামান্য একটা পোশাকের কারণে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেও পার পেতে বেগ পেতে হয়!
জজ সাহেব কত ন্যায়ই না আমাদের দিয়েছেন। এই জজ সাহেবকে খুঁজে বের করা হয়েছে কী?

একজন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রকাশ্যে লাথি মেরেছে যে সোনার ছেলেটি, আজ অবধি তাকে ধরা হয়েছে বলে তো শুনিনি!

মুক্তিযুদ্ধ মানেই বিশেষ দল, মুক্তিযোদ্ধা মানেই বিশেষ কিছু মানুষ- এ থেকে আমাদের মুক্তি নাই! মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাগলিং করবেন যখন যার যেমনটা ইচ্ছা করবে। কে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ছিলেন এটা নিয়ে আগামি আরও ৩৮ বছর আমরা বাহাস করব, ইনশাল্লাহ!

গোটা বছর শীত-নিদ্রায় থেকে, নব্য মুক্তিযোদ্ধা হওয়া, বছরের বিশেষ মাসে চোখের জলে কপোল(!) ভিজিয়ে ফেলা কোন কাজের কাজ না।

No comments: