এরশাদ-খালেদা জিয়ার সময় যেভাবে লেখা গেছে, ক্যারিকেচার, কার্টুন আঁকা গেছে আওয়ামী শাসনামলে সেটা ছিল স্রেফ একটা স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন! একদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (!) শহিদুল আলমকে নগ্ন পায়ে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল। কোথায় নিয়ে গেল সেটা আবার অনেক পরে জানা গেল। কোর্টে আবার 'মাই লর্ড' বিচারক পুলিশকে জিজ্ঞেস করছেন, পুলিশ আসামীর (শহিদুল আলমের) ফোনের পাসওয়ার্ড নিয়েছে কিনা, সেদিনই লেখালেখির কফিনে পেরেক ঠোকা হয়ে গেল...!
Tuesday, October 13, 2009
কাজীদা: একজন লেখক বানাবার মেশিন!
চিঠিটা ছাপিয়ে ঠিক করলাম কিনা কে জানে? যেহেতু চিঠিটা কাজীদা প্রতিষ্ঠানের প্যাডে লিখেছেন; এটাকে অন্তত ব্যক্তিগত চিঠি বলা চলে না, এটাই ভরসা। আমার কেবল মনে হচ্ছে, কাজীদা নামের এই লেখক বানাবার মেশিনটার সমস্ত খুঁটিনাটি এই প্রজন্মের না-জানাটা অন্যায়। এই মানুষটার অসাধারণ গুণ হচ্ছে, তিনি প্রত্যেকটা পান্ডুলিপি খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পড়েন, প্রতিটা অক্ষর! এবং বানানের ব্যপারে অতি সাবধানী একজন মানুষ। একসময় আমি কাউকে বলতাম, অভিধান না-দেখে প্রজাপতি-সেবার কোন বই দেখে মিলিয়ে নিন।
বাংলা একাডেমীর কথা শুনলে আমরা বিনম্র শ্রদ্ধায় হাঁ করে থাকি, গা কাঁপে। আহা, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক যখন বলেন, শেখ হাসিনা একজন বিশিষ্ট লেখক হিসাবে বই-মেলা উদ্বোধন করছেন; তখনও গা কাঁপে, অন্য কারণে। তখন আমরা গা দুলিয়ে হাসি, নইলে হাসিটা ঠিক জমে না।
বাংলা একাডেমী থেকে ৯৩ সালে আমার যে উপন্যাস ছাপা হয়েছিল ওটায় যে-কেউ খুঁজলে শতেক বানানের ভুল বের করতে পারবেন, আমি নিশ্চিত। হা ঈশ্বর, বাংলা একাডেমীর কি প্রুফ-রীডার বলতে কারও অস্তিত্ব নাই?
ভদ্রলোকের নাম বলে লজ্জা দিতে চাচ্ছি না। লেখালেখি ভুবনের একজন তুখোড় মানুষ, বাংলা একাডেমীর পরিচালককে 'কনক পুরুষ' উপন্যাসের সৌজন্য কপি দিলে; তিনি এটার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন যেন এটা একটা শুয়োঁপোকা! নিতে না পারলে বেঁচে যান এমন। এই বেট, আমি চলে আসার পর এটা তিনি ট্রাশ-ক্যানে ফেলে দিয়েছিলেন।
এ বড়ো বিচিত্র, আমাদের দেশের যারা সাহিত্য কপকপ করে চিবিয়ে খান, অন্য প্রকাশী হলে সমস্যা নাই কিন্তু এঁদের প্রজাপতি-সেবা প্রকাশনীর প্রতি আছে সীমাহীন তাচ্ছিল্য। অথচ এ দেশের অধিকাংশ প্রকাশনীর প্রকাশক মহোদয়গণ কাজী আনোয়ার হোসেনের নখের যোগ্য বলে আমি মনে করি না। কসম, একজন প্রকাশক আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কোন বাংলা একাডেমী? ভাবতে আমার গা গুলায়, এরাই নির্ধারণ করে দেন কে লেখক, কে লেখক নন!
ফাঁকতালে কাজীদাকে দেখে, আমাদের পাছাভারী প্রকাশক-সম্পাদক মহোদয়গণ যদি খানিকটা শেখার চেষ্টা করার তকলীফ-ক্লেশ স্বীকার করতেন, তাহলে বেশ হতো! আফসোস, এদের শেখা শেষ, মাদ্রাসা-পাশ হুজুরদের যেমন শেখার কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, তেমনি।
কনক পুরুষ উপন্যাসটা লিখেছিলাম খুব তাড়াহুড়া করে, ঝড়ের গতিতে। লেখা হয়েছিল সম্ভবত একরাতে। শেখ আবদুল হাকিমের উপর বিরক্ত হয়ে, ডাকে এটা কাজীদাকে পাঠালে তিনি এই চিঠিটা লিখে দেখা করতে বলেছিলেন। চিঠি পড়ে আমার কান-টান লাল! ইশরে, এটা পাঠাবার আগে পান্ডুলিপিটা খানিকটা যত্ম নিয়ে দেখে দিলাম না কেন? অবশ্য চেষ্টা করলেও বানান ভুল নিয়ে খুব বেশি কিছু করতে পারতাম না। আমার মধ্যে বড় ধরনের সমস্যা আছে! বানান এখনও আমাকে বড় ভোগায়- যে শব্দ অজস্রবার লিখেছি এটা নিয়ে এখনও কস্তাকস্তি করতে হয়। হ্রস্ব-ই কার নাকি দীর্ঘ-ই কার? দরজা, জরদা গুলিয়ে ফেলি, টপটেন নাকি টেনটপ ইত্যাদি।
কাজীদার কথা লিখেছিলাম, আমার দেখা একজন চমৎকার মানুষ- লেখক বানাবার কারিগর! তিনি আমার বই ছাপিয়েছেন বলেই তাঁর প্রতি মুগ্ধতা চুঁইয়ে পড়ে এমনটা না। তাঁর কিছু বিষয় আমার মোটেও পছন্দ না, এই প্রকাশনীর প্রচ্ছদগুলো বড়ো খেলো, যা-তা!
আরেকটা বিষয়, তিনি লেখক হিসাবে টিংকু ওরফে কাজী শাহনুরকে সবাইকে ছাপিয়ে বড়ো বেশি সামনে নিয়ে এসেছিলেন। এই সিদ্ধান্তটা আমার কাছে বড়ো ধরনের ভুল মনে হয়, তিনি পরিবারতন্ত্রের খোলস থেকে বের হতে পারেননি- অনেক দুঁদে লেখক ছিটকে পড়লেন। এঁদের মধ্যে আমার নিজের কথা বলার স্পর্ধা দেখাচ্ছি না। আমার সঙ্গে সমস্যাটা ভিন্ন! ক্রমশ তার প্রকাশনীর দবদবা কমে এলো। যাগগে, কে কিভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠান চালাবেন এটা তাঁর এখতিয়ার কিন্তু কষ্ট হয়!
যাগ গে, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বই নিয়ে কিছু কথাবার্তা হলো। কাজীদার আগ্রহ নিউজপ্রিন্টে ছাপানো। ছাপার হিসাবটা সম্ভবত এমন; প্রজাপতি-হোয়াইট প্রিন্টে ছাপা হয় ১২০০, সেবা-নিউজপ্রিন্টে ৩৩০০। সেবা-নিউজপ্রিন্টের পাঠক বেশি, রয়্যালটির টাকাও বেশি তবুও নিউজপ্রিন্টে ছাপার বিষয়ে আমি রাজি হলাম না।
তিনি চাচ্ছিলেন লেখাটায় কিছু পরিবর্তন আনতে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে, লেখাটায় পরিবর্তন, যোগ-বিয়োগ করার কিছু নাই এটাও বললাম। আমি কাজীদার কাছে ভারী কৃতজ্ঞ তিনি আমার মত অতি অখ্যাত একজন কলমবাজের আবদার মেনে নিয়েছিলেন। আজীবন তাঁর এই সহৃদয়তার কথা ভুলব না।
তিনি মূল লেখাটার (কনক পুরুষ) কোন পরিবর্তন করেননি। কেবল অসংখ্য ভুলভাল বানান, বাক্যরীতি সংশোধন করে দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য 'রূপবান মার্কা' প্রচ্ছদটা দেখে মন অনেকখানি বিষণ্ন হয়েছিল কিন্তু এটার ব্যাপারে আমার কোন হাত ছিল না!
'ইভার মা'-র যে অংশটুকু, 'তন্ময়'-এর অতি সংক্ষিপ্ত পরিণতি নিয়ে কাজীদার আপত্তি ছিল: কনক পুরুষের কিছু জায়গায় জামাল সাহেব নামের মানুষটার তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে মোটা দাগের কিছু রসিকতা ছিল।
এই বিষয়টা আমরা অনেক শিক্ষিত মানুষরা অহরহ করি। অবলীলায় কারও শরীরের ক্রটি নিয়ে রসিকতা, এ অন্যায়, কুৎসিত অন্যায়। এ অন্যায়ে আমি কেন যোগ দিলাম, উপন্যাসে কেন তুলে আনলাম? আমি যে কথাটা প্রায়শ বলি, একেকজন পাঠককে আমি মনে করি একেকটা চলমান ক্ষুর- তাঁদের বিবেচনা বোধের উপর আমার শ্রদ্ধা অপরিসীম। হাস যেমন ঘোলা পানি থেকে পরিষ্কার পানিটুকু বের করে নেয় তেমনি তাঁরা তাঁদের সুবুদ্ধি দিয়ে সুভালাভালি-নিরাপদ ভাবনাটা খুঁজে নেন।
আজ আমি যদি আবারও এই লেখাটাই (কনক পুরুষ) লিখতাম, কিচ্ছু পরিবর্তন করতাম না। কেবল এই লাইনটুকু যোগ করতাম: 'ইভার মা-র চোখ জলে ভরে আসে, ইভার বাবা তার পৃথুল দেহ নিয়ে এমন করেন কেন? এতে তার নিজের কী হাত!' ব্যস এইটুকুই।
আর ইভার মাকে নিয়ে খুব বেশি কিছু লেখার আমার আগ্রহ ছিল না কারণ এই ধরনের রোবট টাইপের মানুষদের জীবনে গল্প করার মত গল্প খুব একটা থাকে না। এরা নির্দিষ্ট একটা বৃত্তে অনবরত ঘুরপাক খান- এর বাইরে বেরুবোর কথা ভাবতেই পারেন না।
'তন্ময়' নামের অভাগা চরিত্রটির অতি সংক্ষিপ্ত পরিণতি:
তন্ময়ের এ পৃথিবী থেকে দুম করে সরে না-গিয়ে উপায় ছিল না, আমি ইচ্ছা করলেই তার যাওয়াটা ঠেকাতে পারতাম না। কলম আমাকে টেনে নিয়ে যায়, জিম্মি আমি; একে আটকাবার ক্ষমতার আমার নাই!
তবে এখানে ছোট্ট একটা যোগসূত্র আছে: যোগসূত্রটা হচ্ছে, তন্ময় নামের একটা শেকড় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি অন্য একটা শেকড় ঊঁকিঝুকি মারছে।
অর্থাৎ, তন্ময় বিদায় নিচ্ছে, ইভা এবং জয় আরেকটা শেকড় ছড়িয়ে দিচ্ছে: "ইভা কান্না থামিয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল। ...। এক সময় শরীর তার নিজস্ব ভঙ্গিতে কথা বলা শুরু করল। এ ভাষার উৎস কী, কে জানে! এক সময় জয় ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবল, আসলে স্বর্গ বলে আলাদা কিছু নেই।" (কনক পুরুষ)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
2 comments:
কাজীদা লেখক বানাবার মেশিন কিনা জানিনা,তবে উনি যে পাঠক বানাবার মেশিন সেটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। আর "কনক
পুরুষ" এমন একটা উপন্যাসটা যেটা লেখার পর আপনি যদি আর কিছু নাও লিখতেন তারপরেও "কনক পুরুষ" পড়ার পর আমার আক্ষেপ-"ইশ্ !এই গুনটা যদি আমার থাকতো" সেটা আমাকে সারা জীবন তাড়া করতো- মোরসালিন,আবুধাবি
আপনার সহৃদয় মন্তব্যর জন্য ধন্যবাদ। আপনার ভালোলাগা জেনে মনটা অন্য রকম হয়।
খুব দ্রুত রয়্যালটির টাকা পেয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু 'কনক পুরুষ' যে পাঠক তেমন পছন্দ করেছেন এটা আমার জানা ছিল না। প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত কাউকে জিজ্ঞেস করতে আমার ভারী লাজ! এই রে, বলে বসল বুঝি, আজিব, আপনার বইয়ের কাছে তেলাপোকাও আসে নাই।
এই বইয়ের প্রতিক্রিয়া আমি জানতে পারি প্রায় ১০ বছর পর। তাও ই-নেটের কল্যাণে।
ভাল থাকুন, প্রবাসেও। দেশের মাটির সোঁদা গন্ধে মাখামাখি হয়ে...।
Post a Comment