সালটা ৯২-৯৩। তখন ভোরের কাগজ-এ 'একালের রূপকথা' নামে ফি-হপ্তাহে নিয়মিত লিখছিলাম, বছর দেড়েক ধরে। প্রতিটা লেখার জন্য পেতাম ৫০ টাকা। মাসে হতো ২০০/ ২৫০ টাকা।
টাকাটা আমার নামে ডাকে পাঠিয়ে দিলেই হয়, বেঁচে যেতাম। কিন্তু না, এদের অফিসে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। লে বাবা, যে টাকা পাব তারচে বেশিই আসা-যাওয়াতেই খরচ হয়ে যাবে।
কী আর করা, কয়েক মাসের টাকা জমিয়ে নিতে যেতাম। 'উঠ ছুঁড়ি তোর বিয়া'-'উঠল বাঁই ঢাকা যাই' বলে গাট্টি-বোচকা নিয়ে মাসের যে-কোন দিন রওয়ানা দিলেই হবে না। নিয়মটা ছিল সম্ভবত এরকম, ২১ তারিখের পূর্বে গেলে হবে না, আবার ২৬ তারিখের পর গেলেও 'নাক্কো'-হবে না।
গেলাম তারিখ মিলিয়ে। ওয়াল্লা, গিয়ে শুনি এ মাসে হবে না, ফান্ড নাই! এইরকম কয়েকবার হওয়ার পর আমার মেজাজ খুব খারাপ হলো। যাকেই বলি, সেই বলে, করো লেখালেখি, তোমার এতো লালচ কেন? পত্রিকায় টাকা দেয় এই তো ঢের! তাছাড়া তুমি কি এই টাকা দিয়া চাউল কিনবা!
বটে রে, এটা আমাকে কেন জনে জনে বলতে হবে, এই টাকা দিয়ে আমি চাউল কিনব, নাকি বেশ্যালয়ে যাব। ফাজিলের দল, এটা আমার অধিকার-প্রাপ্য। আমার পাওনা নিয়ে কেন ভিক্ষুকের মত দাঁড়াতে হবে!
আমি এইসব নিয়ে এই পত্রিকার জন্যই কঠিন একটা লেখা লিখে বসলাম। কিন্তু জমা দেয়ার পর এই পাতার সম্পাদক বললেন, করেছেন কী! সম্পাদক ভাইয়া ক্ষেপে লাল! যান, সরি বলে আসেন।
আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম, যে অন্যায় আমি করিনি এটার জন্য কেন সরি বলব? বলব না।
মনে মনে বললাম, হুশ সম্পাদক, হুশ!
প্রায় ১ মাস পর লেখাটা হুবহু ছাপা হলো। আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসল। আমার মত মফস্বলের অখ্যাত একজন কলমচির জন্য বিশাল এক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ এক অসাধারণ বিজয়!
পরে আর এখানে জমল না। আমার এই লেখাটা না-ছাপানোর কারণে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ছিলাম। মানের কারণে না-ছাপানো হলে আমার বলার কিছু ছিল না কিন্তু আমাকে বলা হয়েছিল, এই লেখাটা নাকি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে!
আসলে এইসব বিজয় নামের নির্বোধ আচরণের কোন অর্থ হয় না। এইসব ছাতাফাতা কান্ডের জন্য ক্রমশ আমার লেখালেখির ক্যারিয়ার হয়ে গেল টিফিন ক্যারিয়ার । টিফিন ক্যারিয়ার-ঝুলিতে কেবল রয়ে গেল ব্রেভহার্টের সেই বিখ্যাত সংলাপ, "কেউ-কেউ যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যায়, কেউ বিছানায়"।
... ... ...
ভোরের কাগজে এদের নিয়ে যে লেখাটা লিখেছিলাম:
টাকাটা আমার নামে ডাকে পাঠিয়ে দিলেই হয়, বেঁচে যেতাম। কিন্তু না, এদের অফিসে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। লে বাবা, যে টাকা পাব তারচে বেশিই আসা-যাওয়াতেই খরচ হয়ে যাবে।
কী আর করা, কয়েক মাসের টাকা জমিয়ে নিতে যেতাম। 'উঠ ছুঁড়ি তোর বিয়া'-'উঠল বাঁই ঢাকা যাই' বলে গাট্টি-বোচকা নিয়ে মাসের যে-কোন দিন রওয়ানা দিলেই হবে না। নিয়মটা ছিল সম্ভবত এরকম, ২১ তারিখের পূর্বে গেলে হবে না, আবার ২৬ তারিখের পর গেলেও 'নাক্কো'-হবে না।
গেলাম তারিখ মিলিয়ে। ওয়াল্লা, গিয়ে শুনি এ মাসে হবে না, ফান্ড নাই! এইরকম কয়েকবার হওয়ার পর আমার মেজাজ খুব খারাপ হলো। যাকেই বলি, সেই বলে, করো লেখালেখি, তোমার এতো লালচ কেন? পত্রিকায় টাকা দেয় এই তো ঢের! তাছাড়া তুমি কি এই টাকা দিয়া চাউল কিনবা!
বটে রে, এটা আমাকে কেন জনে জনে বলতে হবে, এই টাকা দিয়ে আমি চাউল কিনব, নাকি বেশ্যালয়ে যাব। ফাজিলের দল, এটা আমার অধিকার-প্রাপ্য। আমার পাওনা নিয়ে কেন ভিক্ষুকের মত দাঁড়াতে হবে!
আমি এইসব নিয়ে এই পত্রিকার জন্যই কঠিন একটা লেখা লিখে বসলাম। কিন্তু জমা দেয়ার পর এই পাতার সম্পাদক বললেন, করেছেন কী! সম্পাদক ভাইয়া ক্ষেপে লাল! যান, সরি বলে আসেন।
আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম, যে অন্যায় আমি করিনি এটার জন্য কেন সরি বলব? বলব না।
মনে মনে বললাম, হুশ সম্পাদক, হুশ!
প্রায় ১ মাস পর লেখাটা হুবহু ছাপা হলো। আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসল। আমার মত মফস্বলের অখ্যাত একজন কলমচির জন্য বিশাল এক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ এক অসাধারণ বিজয়!
পরে আর এখানে জমল না। আমার এই লেখাটা না-ছাপানোর কারণে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ছিলাম। মানের কারণে না-ছাপানো হলে আমার বলার কিছু ছিল না কিন্তু আমাকে বলা হয়েছিল, এই লেখাটা নাকি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে!
আসলে এইসব বিজয় নামের নির্বোধ আচরণের কোন অর্থ হয় না। এইসব ছাতাফাতা কান্ডের জন্য ক্রমশ আমার লেখালেখির ক্যারিয়ার হয়ে গেল টিফিন ক্যারিয়ার । টিফিন ক্যারিয়ার-ঝুলিতে কেবল রয়ে গেল ব্রেভহার্টের সেই বিখ্যাত সংলাপ, "কেউ-কেউ যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যায়, কেউ বিছানায়"।
... ... ...
ভোরের কাগজে এদের নিয়ে যে লেখাটা লিখেছিলাম:
"সহনশীল প্রাণী
একজন লেখক অখ্যাত কুখ্যাত পরের কথা, কিন্তু কী সীমাহীন তার ক্ষমতা! ইচ্ছে হলেই একটা চরিত্র সৃষ্টি করে হাসায় কাঁদায়- বিষণ্নবোধ করলে মেরে ফেলে। কাল্পনিক সৃষ্টির মিছে স্রষ্টার এ সম্বোধন ভালো না লাগারই কথা। লেখক রাগ চেপে বললেন, ‘ভাই ভূত, আপনি সভ্য না অসভ্য দেশের ভূত?’
ভূত দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ‘পেটা গাইল্যা ফালামু (এটার অর্থ হবে সম্ভবত এরকম, অমানুষিক শক্তি প্রয়োগে নাড়ী ভুঁড়ি ভর্তা করে ফেলা হবে)। রাস্কেল, ইউ নো, আমার গায়ে নীল রক্ত বইছে।’
লেখক: আ বেগ য়্যু’ পার্ডন স্যার। নীল রক্ত, আপনি দেখি অতি সভ্য ভূত! তা আপনি স্যার একটু ভুল বললেন, এখন আপনার ধমনীতে নীল রক্ত দূরের কথা, লাল-সবুজ-সাদা-কালো কোনও রক্তই এক ফোঁটা বইছে না।
ভূত (জাঁক করে): ইয়েস-ইয়েস, সভ্য দেশের অতি সভ্য ভূত আমি।
লেখক: সভ্য দেশে মৃত্যুদণ্ড উঠিয়ে দেয়া হয়েছে, আপনি দিচ্ছেন, এটা কি ঠিক হচ্ছে? আর তুই-তোকারি করছেন এটাই বা কেমন কথা!
অতি সভ্য ভূত: তুই-তাই না করলে ভূতদের বাজার পড়ে যায়। কি বললি, মৃত্যুদন্ড? মানুষ নামধারী অমানুষদের বিচার করে মেরে ফেলতে হবে না, আশ্চর্য! পৃথিবীটাকে চমৎকার বানাতে গিয়ে মানুষকে নিষ্ঠুর হতে হয়। এই-ই নিয়ম।
লেখক: সার, আপনি বোঝাতে চাচ্ছেন মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করা। কিছু বর্বর দেশ অবশ্য এ বিষয়ে বহু এগিয়ে আছে। এরা স্টেডিয়ামের মতো বিশাল জায়গায় উন্মুক্ত শিরচ্ছেদের ব্যবস্থা করে। রেডিও, টেলিভিশনে আগাম ঘোষণা দিয়ে টেলিভিশনে ঘটা করে দেখানো হয়। অবশ্য এরা দয়ার সাগর, ঘোষণা দিয়ে দেয়, শিশু এবং অসুস্থ লোকজনকে যেন এ অনুষ্ঠান দেখতে না দেয়া হয়। দলে দলে লোকজন শিরচ্ছেদ দেখে। অপার আনন্দ লাভ করে।
অ. স. ভূত: ভালোই তো, অপরাধীদের জন্যে উদাহরণ সৃষ্টি হবে।
লেখক: ‘অপরাধীর পায়ের চেয়ে আইনের হাত লম্বা’ এটা অন্যভাবেও বোঝানো যায়। ভারতে অসংখ্য প্রাণ হরণকারী একজন ডাকাতকে ধরার জন্যে এক হাজার সামরিক, আধা-সামরিক কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে। একে ধরতে গিয়ে এ পর্যন্ত পঁচিশ কোটি রুপী খরচ হয়েছে। ডাকাতের মাথার দাম ধরা হয়েছে চল্লিশ লাখ রুপী। একে আটকে মেরে ফেললে কি হবে? মৃত্যুর পর সবাই আনন্দ-বেদনার ঊর্ধ্বে? হেনরী শ্যারিয়ারের ‘প্যাপিলন’-এর প্যাপীকে ‘আইলস ডু স্যালুট’-এর নির্জন সেলে যে রকম আটকে রাখা হয়েছিল- ওরকম অন্ধকূপে চরম অপরাধীদের আজীবন আটকে রাখা উচিত। মাঝে মধ্যে এদের সাক্ষাৎকার নিয়ে ফলাও করে জানানো যেতে পারে। প্যাপীলনের মতো এদেরও সময় থেমে যাবে, মনে হবে এ কষ্ট পৃথিবীর কষ্ট না ।
অ. স. ভূত: দরিদ্র দেশগুলোর টাকা কই, ফটাফট মেরে ফেললেই তো সুবিধে?
লেখক: যে মানুষ তার মতো কাউকে সৃষ্টি করতে পারে না সে কোন অধিকারে একটা প্রাণ নষ্ট করবে। এসব থাক, এখন বলেন, আমাকে কেন মৃত্যুদণ্ড দিলেন।
অ. স. ভূত: তুই না কি আমাদের নিয়ে যা-তা লিখিস, লোকজন হাসি-ঠাট্টা করে। জন নামের একজন ভূতকে নিয়ে লিখেছিস ‘রাম ছাগল ভূত’। এইসব কি, অন্তত ‘জন ছাগল ভূত’ বললেও তো পারতি। এসব ছাই ভস্ম লিখে মাল কামিয়ে লাল হচ্ছিস।
লেখক (বেদনাহত হয়ে): সার-সার, এমন কুৎসিত ভঙ্গিতে বলবেন না। লাল-নীল জানি না এরকম একটা লেখা লিখে পাই ৫০ টাকা।
অ. স. ভূত: ৫০ টাকা দিয়ে কি করিস?
লেখক: এটা তো সম্মানী, এ দিয়ে আবার কি করব, ছবির বাঁধিয়ে রাখি। এটা সম্মানী তো, বিশেষ দিনে গিয়ে নিয়ে আসতে হয়। ‘অসৌজন্য কপি’ কিনে নিজের লেখা নিজেই পড়ি। আসলে লেখকদের লিখতে হাত চুলকায়। মহাপুরুষ ব্যতীত অন্য কেউ চুলকানি উঠলে না-চুলকে পারেন না, লেখক কোন ছার। গিলোটিনে মাথা পেতে এরা লিখে যান। ভরপেট খাবার খেতে, চকচকে পোশাক পরতে এদের কখনোই ইচ্ছা করে না- নিয়ম নেই। তবে হ্যাঁ, পাঠকের ভালোবাসার কথা যদি বলেন, তখন পৃথিবীর সব বেদনা তুচ্ছ মনে হয়।"
No comments:
Post a Comment