একটা ওয়েবসাইটে তখন লেখালেখি-ব্লগিং করি। ওখানকার একজন সহ-ব্লগার 'মিথিলা'। হঠাৎ তার পোস্টে জানা গেল, সে একটা দূরারোগ্য রোগে ভুগছে- যার হাতে আছে অল্প কটা দিন। কী কষ্টই না লাগছিল তখন! আহারে, যেন আমি নিজেই মৃত্যুর গা ঘেঁষে বসে আছি অথচ চারদিক ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে সব! তার বুক ভেঙ্গে আসা পোস্টগুলোয় চোখের জল নিয়ে মন্তব্য করতাম। আপাততদৃষ্টিতে হাস্যকর কিন্তু আন্তরিক আশ্বাসবাণী শোনাতাম। আহা, মেয়েটার মৃত্যুর শেষ দিনগুলো খানিকটা বদলে দেয়া যায় যদি! ক্ষতি কী!
মিথিলাকে নিয়ে তখন একটা পোস্ট দিয়েছিলাম:
মিথিলাকে নিয়ে তখন একটা পোস্ট দিয়েছিলাম:
"মিথিলা, আমি সরি...
মিথিলা, আমি সরি। আমার আন্তরিক আশ্বাসগুলো আজ বড়ো খেলো হয়ে গেল, যেন তোমায় মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছি! ট্রাস্ট মী, আমি তো তোমায় মিথ্যা আশ্বাস দেইনি।
আসলে কী বোকা আমি! যার পিপড়ে ছাড়া আর কিছু মারার ক্ষমতা নাই, সে কিনা পরম ক্ষমতাধরকে চ্যলেঞ্জ করে আশ্বাসের বাণী শোনায়।
চ্যালেঞ্জই তো! তোমার দিকে ব্রক্ষ্মাস্ত্র ছুড়ে দেয়া হয়েছে, ফিরিয়ে নেয়ার জন্য তো না।
এটা তুমি ঠিকই বুঝে গিয়েছিলে, আমরাও যে খানিকটা আঁচ করতে পারিনি এমন তো না। তবুও তোমায় কেন আশ্বাসের বাণী শোনালাম দিনের পর দিন! তোমার শেষের পোস্টগুলোয় বাঁচার কী তীব্র আকুতি, তখন বড়ো তুচ্ছ মনে হতো নিজেকে, জানো! মনে হতো, আমাদের পায়ের সবচেয়ে শক্ত শেকলটা বাজে ঝনঝন করে, যে শেকলটা দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে মানুষকে বেঁধে রাখা হয়েছে, ডার্কনেস! অন্ধকার জগতের কাছে পরাজিত মানুষ। যে শেকল একজন মানুষকে দানব হওয়া থেকে আটকে রাখার চেষ্টা করে অবিরাম...।
আফসোস, বুশের মতো দানব মটর সাইকেল এক্সিডেন্ট করে, গলায় কুকি বিস্কুট আটকে মরতে মরতে বেঁচে যায়। কে জানে, তার তিরোধানে হয়তো লক্ষ লক্ষ প্রাণ বেঁচে যেত!
অথচ দেখো, মিথিলাকে অকালে চলে যেতে হয়। যার ছিল চারপাশের প্রিয়মানুষ, প্রকৃতির জন্য অগাধ ভালবাসা! তাকে আটকে রাখা যায় না, কেমন...। মানুষ হিসাবে কী কাতর, অসহায়ই না লাগে তখন। বুক ভেঙ্গে আসে।
মানুষ যে কতটা ভঙ্কুর-তুচ্ছ, এটা বোঝাবার জন্য মিথিলাদের রহস্যময় জগতে চলে যাওয়া ব্যতীত কোন বিকল্প নাই। আমরা কী জাঁক করেই না বলি, নেক্সট সামারে হেন করবো, তেন করবো। হায়, নেক্সট সামার কে দেখেছে! হায়রে মানুষ, তবুও তার ক্ষমতার কতো দম্ভ, দানব হওয়ার কী আপ্রাণ চেষ্টা...!
মিথিলা, শুভ’র মতো একজন তুচ্ছ মানুষের চোখ ভিজে আসা ব্যতীত কিই বা করার আছে! কেবল ভাববে এটা, তোমার চারপাশে আমরা হাত ধরে আছি। ভাল থেকো গো সোনামেয়ে...।"
এই পোস্টটা দেয়ার পরই জানা গেল মিথিলা বলে আসলে কেউ নাই! এই চরিত্রটা সৃষ্টি করা হয়েছে আমাদের বোকা বানাবার জন্য। 'রুবেল' নামের একজন ব্লগার আরও কিছু ব্লগারের যোগসাজশে এই কান্ডটা করেছেন! এদের মধ্যে একজন ডাক্তারও আছেন!
আমার মত আরও কিছু মানুষের বোকামি দেখে অন্যদের সেকি হাসি! হাসতে হাসতে একজন অন্যজনের গায়ে ঢলে পড়ে!
আমার মত বোকামানুষ নিজের এই বোকামি নিয়ে আবারও একটা পোস্ট দিল:
"হায়রে শুভ, হায়...!
শিরোনামটা আমার দেয়ার ইচ্ছা ছিল, হায়রে গাধামানব শুভ, হায়...! কিন্তু এতে আমার সঙ্গে অন্যরাও জড়িয়ে যাবেন। এঁদের অপমান করা হবে ভেবে আমি শেষ মুহূর্তে শিরোনামটা পরিবর্তন করলাম। মিথিলার বিষয়টা আমাকে হতভম্ব করেছে। আজই প্রথম এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি এমন না, পূর্বেও এমনটা হয়েছে। যখন মস্তিষ্কের বদলে হৃদয়ের কথা শুনেছি, তখনই ব্যাপারটা ঘটেছে।
একজন আবেক্রান্ত দুর্বল মানুষ আমি, বিভিন্ন সময়ে এই আবেগই আমার দফারফা করেছে। আমি বড়মাপের মানুষদের সঙ্গ পাওয়ার চেয়ে তীব্র সুখি হই, একজন আবেগময় মানুষের হাত ধরতে পেরে। এই একটা দুর্বলতা নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ-লজ্জিত না।
অতীতে আমার অনেক আবেগীয় কান্ডকারখানা দেখে আমার কাছের মানুষরা নির্দয় ভঙ্গিতে বলেছেন, বেনাপোল বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে যে ২০টা গাধা আমদানী করা হয়েছিল, আমিও নাকি এদের মধ্যে ছিলাম। এ নিয়ে আমার অমত ছিল, আজ সংশয়মুক্ত হলাম! তাই তো, একগাদা আবেগ থাকবে কেন আমার মতো ছদুমদু টাইপের মানুষের মধ্যে!
মিথিলার ব্যাপারটা আমাকে আলোড়িত করেছিল এটা সত্য। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে দূর থেকে এড়িয়ে গেলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু কোন বিষয়ে জড়িয়ে পড়লে এর কাছ থেকে আমার মুক্তি নাই, মনে হয় ওই মানুষটা আমি! যথারীতি মিথিলার জায়গায় আমার নিজেকে মনে হচ্ছিল।
মৃত্যু নামের অন্ধকারের জীবটার মুখোমুখি হয়ে অনেক সাহসী-বীরদেরও বাহ্যেজ্ঞান লোপ পায়, আমি কোন ছার! আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, আমি নিজেই রহস্যময় এক জগতে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছি। ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে আমার সময়; মাত্র আর ক’টা দিন, আমার বাঁচার কী যে তীব্র আকুতি!
আমি পূর্বে কোথাও লিখেছিলাম, জীবনকে চিনতে হয় একজন মৃত্যুপথযাত্রীর চোখ দিয়ে! তখন বিবর্ণ পাতা দেখে মনে হয়, আহা কী চকচকে, আগে কখনও দেখিনি তো এমন! কদাকার একজন মানুষকে দেখে কী মায়াই না হয় তার জন্যে।
হ্যাঁ, মমতা দেখানো যদি অন্যায় হয়, এই দোষে আমিও দুষ্ট। আমার মত অনেকে তাদের বোকামি ঢাকার জন্য এখন অস্বীকার করছেন। কিন্তু আমি স্পষ্টভাবে বলি, আমি মিথিলার পোস্টে মন্তব্য করেছি, মিথিলাকে নিয়ে পোস্ট দিয়েছি। কাতর হয়েছি।
তারপরও আমি নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দেই যে এখনও মানুষের বেদনা আমাকে স্পর্শ করে। আধুনিক সভ্যতা আমাকে পুরোপুরি রোবট বানাতে পারেনি! আহ, কী যে ভাল লাগা!
আমি দেখেছি, মুমূর্ষু একজন, ডাক্তারের হাত খামচে আছে, ডক, আমাকে আর ক-টা দিন বাঁচিয়ে রাখতে পারো না, না?
আমি দেখেছি, আমার বাবার সেই শীর্ণ হাত। ১৬ বছরের বালকের হাত আঁকড়ে ধরেছে, খোকা, বড়ো কষ্ট, খানিকটা অক্সিজেনের ব্যবস্থা কর। এ্যাহ, বললেই হলো আর কি, ১৬ বছরের কিশোর বুক পকেটে অক্সিজেন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়; যেন মামাবাড়ীর আবদার!
কাউকে কাউকে দেখছি, মিথিলাকে নিয়ে মমতা দেখানোর কারণে যারা আমার মতো এই দোষে দুষ্ট, পারলে এদের শূলে চড়ান। বলুন না কি শাস্তি হবে আমাদের? আমার মতো যারা এই অন্যায়টা করেছেন প্রত্যেকের জন্য একটা করে গালি ধরে, আমার পোস্টে এসে সবগুলো গালি আমাকে দিয়ে যান।
বিশ্বাস করা অন্যায় না, বিশ্বাস ভঙ্গ করা অন্যায়। 'বিশ্বাস নামের চাদর' নামের চামড়াটা গা থেকে সরে গেলে থাকে কেবল কুৎসিত কিছু হাড়! এই যদি হয় সত্যি: ব্লগার ‘রুবেল’ এই কাজটি জেনেশুনে করেছেন। আমি তার প্রতিভায় আক্ষরিক অর্থেই মুগ্ধ।
আমার কখনই জাঁকালো কোন স্বপ্ন ছিল না। আমার স্বপ্ন ছিল একজন লেখক হবো, হতে পারিনি। লেখকদের যা যা গুণ থাকা প্রয়োজন তা হয়তো আমার ছিল না।
কেবল লিখে গেলেই তো আর হয় না- একজন লেখক রিপোর্টার না। লেখকের কাজ হচ্ছে বিভ্রম সৃষ্টি করে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়া, পাঠককে আনন্দ-বেদনায় জড়িয়ে ফেলা। ফ্যাক্ট হয়ে যায় তমোময়- তখন সত্য মিথ্যা আলাদা করা সুকঠিন হয়ে দাঁড়ায়!
আমি বলি, ফিকশনের জন্ম হচ্ছে রিপোটিং এর গর্ভে! তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই, একজন সুলেখক হচ্ছেন ফিকশনবাজ!
মহা ফিকশনবাজ রুবেল এই কাজটি চমৎকার করে করতে পেরেছেন। কিছূ বুদ্ধিমান মানুষ ব্যতীত অধিকাংশ মানুষকে বোকা বানাতে পেরেছেন। এটা একজন সুলেখকের পক্ষেই সম্ভব। এই মানুষটা লেখালেখি করলে খুব নাম করবেন। আমার মতো ছাতাফাতারা পেট ভাসিয়ে তার বই পাঠ করব এতে কোন সন্দেহই নাই!
কিন্তু তাই বলে মৃত্যু নিয়ে রসিকতা! একজন সুস্থ মানুষ পাগলের ভান করেও তো অনেককে বিভ্রান্ত করতে পারেন। আমি মনোবিদ নই কিন্তু ভাবছি রুবেল নামের ব্লগার কেন এমনটা করলেন?
একটা কারণই আমার কাছে যথার্থ মনে হচ্ছে, সেটা হচ্ছে, দৃষ্টি আকর্ষনের অপচেষ্টা।
কিছু কিছু মানুষ যখন নিজ যোগ্যতার উপর ভরসা করতে পারেন না তখন তারা অহেতুক নিজেকে অবহেলিত মনে করেন, লাইম লাইটে আসার জন্য, অন্যদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টায় উম্মাদপ্রায় হয়ে উঠেন। কেউ হাত কেটে ফেলেন, তো কেউ বা, জনসমক্ষে 'এই বেয়ারা' বলে ষাড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠেন।
আমাদের রুবেল সাহেব হয়তো বেছে নিয়েছিলেন, এই উপায়। আগে ক’জন আর ঢুঁ মারতেন তার পাতায়- এখন কত্তো মানুষের পদচারণা তার পাতায়, মুখে মুখে ফেরে রুবেল...রুবেল...। যেন কারও চুলায় সর্বদা বেড়াল ঘুমায়, বিশেষ সময়ে রাজপথ কাঁপে তার পায়ের শব্দে!
তাই না? নাকি, একটা ছুঁরি দিয়ে কেউ আপেল কেটে খায়, কেউ কারও চোখ উপড়ে ফেলে। বেচারা ছুঁরিটা কার হাতে সেটাই আসল কথা!
আমি আগেও বলেছি, আবারও বলি, এই সাইটে না আসলে অনেক কিছু শেখা থেকে মিস করতাম। অনেক কিছু শিখেছি এখান থেকে। নতুন একটা দেশ সম্বন্ধে যেমন প্রাথমিক আঁচ করা যায় ওই দেশের এয়ারপোর্ট দেখে।
একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গায়ের অজস্র রং দেখে যেমন আঁচ করা যায় ওই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবস্থাপনায় জড়িত মানুষদের শিক্ষা সম্বন্ধে। তেমনি এই সাইটটা যেন গোটা বাংলাদেশের আয়না। অবলীলায় এখানে উঠে আসে পরম মমতা, নিখাদ ভালবাসা, নীচ হিংসা, তীব্র অহংকার।
বাকী ছিল আবেগ নিয়ে প্রতারণা, এই ষোলকলা আজ পূর্ণ হলো, রুবেল আপনার কল্যাণে।
আপাতত, নোটিশবোর্ডের বদান্যতায় মুগ্ধ হয়ে আমি পোস্ট দেয়া থেকে বিরত ছিলাম। কিন্তু আপনি মিথিলা নামের ভার্চুয়াল অবেগের আফিম আমায় খাইয়ে আমাকে পোস্ট দিতে বাধ্য করেছেন।
রুবেল, আপনি আমাদেরকে নিয়ে খেলেছেন, খেলেছেন আমাদের আবেগ নিয়ে, দিনের পর দিন। মৃত্যুর মত এক ভয়ংকর অস্ত্রের হাত ধরে। আপনি নিজেও জানেন না, নিজের অজান্তেই আমাদের কী প্রভূত ক্ষতি করে দিলেন!
একজন মানুষ যখন তার বিশ্বাস নামের শার্টটা অফিসে, শোবার ঘরে কোথাও রাখার জায়গা পায় না তার মতো অভাগা আর কেউ নাই! আপনি আমাদেরকে 'বিশ্বাস নামের শার্টটা' রাখার কোন জায়গা রাখেননি। পরিণাম, ভয়াবহ! দিনের পর দিন নোংরা শার্টটা গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ানো ব্যতীত আমাদের আর উপায় কী!
আপনাকে অভিশাপ দেই এই বালখিল্য বাক্য বলি না। তবে আমি কায়মনে চাই, আপনার নিজের মৃত্যুর সময়ও যেন এমন কোন একটা ভারী মজার কান্ড ঘটে।
পৃথিবীতে কতো বাতাস অথচ আপনি একফোঁটা বাতাসের জন্য মুখ হাঁ করে রেখেছেন...সবাই দাঁত বের হাসছে আর বলছে, দেখ, দেখ, মানুষটা কী চমৎকার অভিনয়ই না করছে, ফানী, ভেরী ফানী, মজার লোক যা হোক, যা হাসিয়েছে না... ।
(হাসের মত তুচ্ছ প্রাণ নিজেদের মধ্যে আনন্দ-বেদনা ভাগ করে নেয় কেবল মানুষেরই যত দোষ!)
*ছবিস্বত্ব: সংরক্ষিত
2 comments:
আমি "মিথিলা কথন" নিয়ে আমি সব বলেছি । হয়তো বা আপনার চোখে পড়েনি । আমি নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেছি । আবারো দুঃখ প্রকাশ করছি । এ ব্যাপারটা বিশাল করেছে তৎকালীন সামুর ডেভু হাসিন হায়দার ও ত্রিভুজ । তারা পোষ্টটাকে স্টিকি করে হিট গেইম খেলে । যা আমি অনেক পরে বুঝি । কারণ তখন আমি নেট ইউজ করতাম সাইবার ক্যাফে থেকে । তারপরও আমার এটা করা ঠিক হয়নি । কিন্তু আমি সেটা বুঝিনি । যেহেতু সামুতে আমার সব ঐ নিক ব্যান । নাহলে সামুর লিংকগুলো দিতাম । তারপরও আমারব্লগ এর একটা লিংক দেই ।
http://dewdropsreturn.amarblog.com/posts/86389
আপনি ভুল বুঝতে পেরেছেন জেনে ভাল লাগল।
Post a Comment