গজদন্ত দেখে প্রাইমারি স্কুলের টিচার বলতেন: কুক্কু, তোর 'দাঁতের উপর দন্ত, শয়তানীর নাই অন্ত'। বদ বন্ধুরা খেপাত আগামী দিনের ড্রাকুলা বলে।
দিনে-দিনে কুক্কু ড্রাকুলা হলো না ঠিকই কিন্তু কালে কালে দুষ্টের শিরোমনি হলো। টিভিতে দেখল একজন ব্লাকবেল্ট হোল্ডার হাতের এক কোপে আটটা বরফের স্ল্যাব গুঁড়িয়ে ফেলল।
কুক্কু নয়টা খালি ম্যাচের বাক্স একটার উপর আরেকটা সাজিয়ে চোখের নিমিষে গুড়ো করে ফেলল। কুক্কু নিজের কাজে নিজেই মুগ্ধ। কোমরে লাল গামছা বেঁধে ক্রমাগত মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে লাগল: পৃথিবীতে একজনই রেডবেল্ট আছে সে আমি, আমি; হা হা হা, হি হি হি, হো হো হো।
এ দুষ্টের শিরোমনি, কিন্তু মনটা ভারী নরোম! এক ফোঁটা রক্ত দেখলে মাথা ঘুরে পড়ে যায়- কেউ কাঁদলে তারচেয়ে বেশি কান্না করে ও!
পশুর চোখের ভাষা কি মানুষ বুঝতে পারে, কে জানে! বা পশু কি তার আগাম মৃত্যু টের পায়, জানা নেই!
কোরবানি ঈদের আগের বিকেলে, কুক্কুদের সদ্য কেনা গরুটা ঘাস খাচ্ছিল। গরুটার হাতির শরীর অথচ কী ভিতু! কুক্কু হুম বললেই লাফিয়ে দশ পা পিছিয়ে যায়।
কোরবানি ঈদের আগের বিকেলে, কুক্কুদের সদ্য কেনা গরুটা ঘাস খাচ্ছিল। গরুটার হাতির শরীর অথচ কী ভিতু! কুক্কু হুম বললেই লাফিয়ে দশ পা পিছিয়ে যায়।
বিকেলের নির্জীব আলো মরে আসছে- আকাশ সিদুরে মাখামাখি। গরুর বড় বড় চোখ কী টলটলে, পাতা ফেললেই জল উপচে পড়বে এমন। গোটা চোখ জুড়ে আটকে আছে আস্ত সূর্যটা, পলক ফেললেই হারিয়ে যায়।
কী অপার্থিব দৃশ্য, তাকাতে ইচ্ছে করে, অথচ তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কুক্কুর মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। ঝড়ের গতিতে বাবাকে খুঁজে বের করে ভাঙ্গা গলায় বলল: বাবা-বাবা গরুটাকে কেটো না।
বাবা চোখে আগুন ছড়িয়ে বললেন: ইস, পাগল কয় কী!
বাবা গরুটা কাঁদতে কাঁদতে বলছে: এ আমার শেষ খাওয়া, আগামীকাল আমি ই-ই-ই থাকব না।
বাবা খুব রাগ করলেন, তুই আমার সাথে ফাইজলামি করছ, ফাজিল কোথাকার। থাপড়াইয়া কানপট্টি ফাটায়া দিমু, দূর হ আমার সামনে থিক্যা।
কোরবানির দিন। সকাল। কুক্কু আবারও গোল বাঁধাল, বাবা-বাবা, তোমার পায়ে ধরি, এটাকে কেটো না।
বাবা দাঁত ঘসে বললেন, আবার শুরু করলি! দরদ উথলাইয়া পড়ে? ক্যান রে বান্দর, তুই গরুর মাংস খাস না?
কুক্কু অনিচ্ছায় মাথা নাড়ল, খাই।
তাইলে তোর সমস্যা কি? মাইয়া মানুষের মত ফিচফিচ কইরা কান্দা থামা। আমার ঘরে একটা আবাল হইছে, তোরে দিয়া বংশের বাতি থাকব না। আয় আমার লগে। বেডা মাইনষের মুরগির কইলজা হইলে হয় না।
বাবা কুক্কুকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। কুক্কু জোর করছে দেখে এবার ঘাড় ধরে উড়িয়ে নিয়ে চললেন।
ওখানে গরুটাকে শুইয়ে ফেলা হয়েছে। ছুরি দিয়ে পোঁচ দেয়া মাত্রই গলগল করে রক্ত বেরুনো শুরু হল। যারা ধরে আছেন তাদের মুখে রক্ত, একজন দাঁত খিঁচে রেখেছিলেন, তার দাঁত রক্তে লাল হয়ে আছে।
জবাইয়ে কোন একটা সমস্যা হয়েছিল সম্ভবত, গরুটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠল। যারা ধরে ছিল তারা ছিটকে পড়ল। আধ-জবাই গরুটা বিচিত্র ভঙ্গিতে উঠোনময় দৌড়াতে লাগল। সবাই খানিকটা ধাতস্ত হয়ে গরুটার পিছু ছুটছে। একসময় গরুটাকে কাবু করে ফেলা গেল। এইবার কোন ভুল করা হলো না, নিখুঁত ছুঁরি চালানো হলো। একবার, বারবার। কুক্কুর অজান্তেই ওর গোটা ভুবন এলোমেলো হয়ে গেল।
কবে থেকে যে পরিবর্তনটা শুরু হয়েছে কেউ এটা নিয়ে আদৌ মাথা ঘামায়নি, ও নিজেও না। এখন কুক্কুর অনেক সাহস! একদিন এক বয়স্ক রিকশাওয়ালাকে চড় দিয়ে কুক্কু হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ভয়ে, লজ্জায়, দুঃখে মনে হচ্ছিল মাটিতে মিশে যায় কিন্তু অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করল, কেউ কিচ্ছু বলল না! একজন তো রিকশাওয়ালাটাকে এই মারে তো সেই মারে, হারামজাদা পেসেন্জারের লগে দিগদারি করস। খান... পুত, বড়ো ভাইয়ের পা ধইরা মাপ চা। তোর রিকশা যে ভাঙ্গছে না এইডাই তো বাপের কাম করছে।
এখন কুক্কু চুইংগাম চিবুতে চিবুতে ইট দিয়ে গাড়ির কাঁচ গুড়িয়ে দেয়। কাঁচ ভাঙ্গার ঝনঝন শব্দে শরিরে ঝিরঝিরে একটা ভাললাগা ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কিচ্ছু বলে না!
এখন কুক্কু যে আগুন দিয়ে সিগারেটটা ধরায় ওই একই আগুনে পেট্রোল ঢেলে একজনের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। চড়চড় করে যখন আগুনে চামড়া, চুল পোড়ে তখন কী একটা অনাবিল আনন্দে মনটা ভরে যায়। কেউ কিচ্ছু বলে না!
ক্ষুর দিয়ে কারও শরিরে যখন আকিঁবুকি খেলা খেলে, ফিনকি দিয়ে যখন রক্ত বের হয়, এই গন্ধের সঙ্গে কিসের তুলনা চলে!
কেউ কিচ্ছু বলে না!
কেউ কিচ্ছু বলে না!
পিচ্ছিল উষ্ণ রক্তে পা মাড়িয়ে কুক্কু এগিয়ে যায়, একজন পুরুষ, সাহসি পুরুষ। সবাই সমীহের দৃষ্টিতে তাকায়, বীরভোগ্যা নারীর বীরবর সন্তান!
*ছবি-স্বত্ব: সংরক্ষিত
**লেখাটা নিয়ে আমার এক সিনিয়রের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মানুষটা করপোরেট ভুবনের। করপোরেট ভুবনের মানুষ হলেও তাঁকে শৈশবের কিছু সুখ-স্মৃতি এখনও হরদম তাড়া করে ফেরে! ভিড়ের মাঝে থেকেও কেউ কেউ বড়ো একা হয়ে পড়েন, মানুষটা তার একটা উদাহরণ!
যাই হোক, তিনি বলছিলেন, 'আজ যে ধর্মভীরুকে (link) ছুঁরি হাতে দেখছি হিংস্র ভঙ্গিতে, তিনি এটাকে দেখছেন ইতিবাচক ভঙ্গিতে। মানুষের ভেতরের লুকিয়ে থাকা এই হিংস্রতার বহি:প্রকাশ পশুর উপর এভাবে না-হয়ে অন্য রকম হলে সেটা হয়তো আরও ভয়াবহ হতে পারত! হয়তো সেটা হতো মানুষের উপর'।
তাঁর এই কথাটায় আমি অনেকাংশে একমত। এই ভাবনার সূত্র অন্য একটা জানালা খুলে দিল। গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আমি মনে করি, একজন মানুষের ভেতর একটা পশু এবং একটা শিশু লুকিয়ে থাকে, এদের মধ্যে অহরহ মারপিট লেগেই আছে। পশু, না শিশু? কখন কে বার হয়ে আসবে এটা আগাম বলা মুশকিল! আমরা আমাদের আদি-মানবের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে যে আদিমতা আমাদের রক্তে বহন করছি, এ থেকে সহজে আমাদের মুক্তি নাই। মস্তিষ্ক আমাদের নিয়ে কি খেলা খেলবে তা আগাম বলা মুশকিল! এ পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান, শিক্ষা আমাদের ভেতর ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা পশুটার কাছ থেকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে।
অফটপিক: আফসোস, আমরা কেবল একটা বৃত্তে অনবরত ঘুরপাক খাই, এটাই আমাদের নিয়তি! কেউ কেউ বৃত্তের বাইরে পা ফেলার চেষ্টা করেন, কিন্তু বৃত্তের বাইরে যাওয়ার পর্যাপ্ত জ্ঞান যে তাঁর নাই। এক পা বৃত্তে, এক পা বৃত্তের বাইরে- এদের চেয়ে অভাগা আর কেউ নাই!
2 comments:
Apni gosto khan na? Minus
ডিয়ার Anonymous ওরফে অজ্ঞাত,
সচরাচর আমি অজ্ঞাত কারও প্রশ্নের উত্তর দিতে আগ্রহ বোধ করি না। আমার খানিকটা সমস্যা আছে, মাস্কের পেছনের মানুষটাকে না-দেখলে কথা চালাচালি করে আরাম পাই না।
যাই হোক, আপনার মাইনাস নিয়ে খানিকটা বলি, প্লাস-মাইনাস নিয়ে আমি কাতর না। এটা আপনার কথা, আমার না!
ওয়েল,আপনি মাংস না লিখে লিখেছেন 'গোশত'- এই শব্দটাকে ব্যবচ্ছেদ করলে মাস্কের পেছনের মানুষটাকে খানিকটা আঁচ করা যায়। আশা করছি, আপনি আমার ইংগিতটা বুঝতে পেরেছেন। এক শ্রেনীর লোকজনের মাংস বলায় প্রবল আপত্তি থাকে, এটা বললে সম্ভবত মাংসটা 'হিন্দু মাংস' হয়ে যায়!
যাগ গে, আমি গোশত খাই কি খাই না এটা এ লেখার মূল উপজীব্য না, আলোচ্য বিষয়ও না। তাই এই বিষয় এখানে আলোচনা করার কারণ দেখছি না।
আমি আমার লেখার প্রত্যেক পাঠককে অসম্ভব বুদ্ধিমান মনে করি, আমার চেয়েও বুদ্ধিমান- অসংখ্য চলমান ক্ষুর।
তাই আপনাকে এটা বলতে চাচ্ছি না আপনি আমার লেখা বুঝেননি। তবে এটা সত্য, আপনি লেখাটার মূল সুর ধরতে পারেননি। এই ব্যর্থতা আমার, আমি আপনাকে বোঝাতে পারিনি। বিষাদে বলতে হয়, বিস্তারিত বলে বোঝাবার অপচেষ্টা-পন্ডশ্রম করতে ইচ্ছা বোধ করি না...।
ধন্যবাদ আপনাকে।
Post a Comment