এই 'তৃতীয় মাত্রা' আমাদের দেশে এক অভাবনীয় কান্ড করে ফেলেছে। সঠিক মনে নেই সম্ভবত ৩০০০ দিন অতিক্রম করেছে! এটা একটা মাইল ফলক!
তবে এর উপস্থাপক জিল্লুর রহমান এখানে মিডিয়া ঈশ্বরের ভূমিকা পালন করেন, তার ইচ্ছাই এখানে প্রধান। তিনি কাকে কাকে এখানে বকবক করার জন্য নিয়ে আসবেন এটা তিনিই ঠিক করেন। দর্শকের ইচ্ছা খুব একটা আমলে আনা হয় বলে আমার মনে হয় না।
কারণ ঘুরেফিরে কিছু মুখ দেখতে দেখতে বমন উদ্রেক হয়। কারও কারও বাতচিত শুনে মনে হয় এরা একেকজন চলমান দেবতা! দয়া করে ধরায় নেমে বঙ্গাল দেশ উদ্ধার করছেন!
একদিন একজনকে দেখলাম (দুর্বল স্মৃতির অবদান, নাম ভুলে গেছি) কী তার ব্যক্তিত্ব, কী চমৎকারসব কথা। আমি চেপে রাখা তৃপ্তির শ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবছিলাম, এতদিনে তাঁহারে পাইলাম। সর্বদা আমি হাঁ করে অপেক্ষায় থাকি, এই দেশে একজন আইডল খুঁজে বের করার জন্য। যাকে অনুসরণ করে নিজেকে বদলাতে পারব, অন্ধের মত যাকে অনুসরণ করতে পারব।
ওরি আল্লা, সন্ধ্যায় এক খবরে দেখি এই মানুষটাই একটা রাজনৈতিক দলের অফিস থেকে বেরিয়ে আসছেন। ওই রাজনৈতিক দলের শেখানো বুলি তোতা পাখির মত আউড়ে যাচ্ছেন! আমি বুঝি না একটা মানুষকে কেন কোন একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়াতে হবে! একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁর পরিচিতির জন্য পিঠে রাজনৈতিক দলের ট্যাগের প্রয়োজনটা কী? আমার কাছে অনেকটা মনে হয় এমন, দুধের বদলে ঘোল খাওয়ার আকুলতা! তখন মানুষটাকে স্রেফ নির্বোধ মনে হয়।
আজ তৃতীয় মাত্রায় অতিথি ছিলেন একজন সচীব জনাব মুসা এবং ৮ নং সেক্টর কমান্ডার লে কর্নেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী। জিল্লুর রহমান বলছিলেন, লে কর্নেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরীকে, 'আজ আপনি প্রথমবারের মত এই অনুষ্ঠানে এসেছেন, আপনাকে অভিনন্দন'।
ভাল-ভাল! জিল্লুর রহমানের কি ধারণা, এই দেশে কয়েক লক্ষ সেক্টর কমান্ডার আছেন? তাই হবে! নইলে আবু ওসমান চৌধুরী কয়েক বছর ধরে চলে আসা এমন অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মত আসেন অথচ তানভীর চৌধুরীর মত মানুষদের হপ্তাখানেকের ব্যবধানে এখানে অনল বর্ষন করতে দেখি। তিনি অন্জনার সঙ্গে বসে রগড় করেন, উপদেশ কপচান! তাঁর কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি, একসময় টেলিফোন নাকি ফ্রিজ ঢাকায় মাত্র ২টা ছিল, তার মধ্যে একটা তানভীর সাহেবদের। তিনি নাকি বিরাট অভিনেতাও, ছবিটা রিলিজ হয়নি, হলে ফাটিয়ে ফেলবেন। তিনি একটু পর পর রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃতি করায় আমরা বুঝতে পারি তিনি কী বিশাল মাপের সংস্কৃতি জগতের মানুষ!
আর জনাব মুসাকে নিয়ে বাক্য ব্যয় করি না। এই মানুষটা সবসময় একগাদা ছবি সঙ্গে নিয়ে আসেন। একটু পরপর এককটা ছবি আমাদের দিকে তাক করে, কথা জড়িয়ে হাউহাউ করে বলতে থাকেন, একে স্যালুট করুন, একে চুমা দেন, আপনারা যে যেখানে আছেন উঠে দাঁড়ান, উঠবস করেন ইত্যাদি।
আমার প্রচন্ড আগ্রহ ছিল আবু ওসমান চৌধুরীর প্রতি। অমিত সাহসী এই মানুষটাকে নিয়ে খুব বিশেষ একটা আমরা জানি বলে আমার মনে হয় না। তিনি কষ্ট চেপে বলছিলেন, আমরা যারা আছি, একসময় থাকব না, প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এই প্রজন্মের জেনে রাখাটা প্রয়োজন! তিনি সাবলিল ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছিলেন সেইসব আগুন দিনগুলোর কথা।
তাঁর সহযোদ্ধা জুনিয়র কমিশন্ড একজন জনাব মুজিবরের (নামটা ভুল হলে আগাম ক্ষমা প্রার্থনা) অসম বীরত্বের কথা। এই মানুষটা একাই পাক আর্মিকে রুখে দিয়েছিলেন। প্রাণ রক্ষা করেছিলেন ওসমান চৌধুরীসহ অসংখ্য যোদ্ধার। একসময় যখন তাঁর মেশিনগানের গুলি শেষ হয়ে গেল তখন পিস্তল বের করে গুলি ছোঁড়া শুরু করলেন। ওসমান চৌধুরী বারবার বলছিলেন, 'মজিবর তুমি পিছিয়ে আসো'।
তখন এই অগ্নিপুরুষ বলেছিলেন, 'স্যার মজিবর পিছিয়ে আসতে জানে না'। তাঁর পিস্তলের গুলিও যখন শেষ হয়ে গেল তখন তিনি খালি হাতে পাক আর্মির উপর লাফিয়ে পড়লেন। ধস্তাধস্তির সময় একজন পাকআর্মি খুব কাছ থেকে তাঁর মাথায় গুলি করলে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
সেক্টর কমান্ডার ওসমান চৌধুরী বলছিলেন, 'এই মানুষটাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেয়ার জন্য ৩ জন আই উইটনেসসহ সমস্ত উপাত্ত দেয়ার পরও তাকে খেতাবটা দেয়া হয়নি। কেন দেয়া হয়নি এটা আমি এখন আর বলতে চাই না'।
আমরা এখন আঁচ করতে পারি খেতাব দেয়া নিয়েও অনেক কু-রাজনীতি হয়েছে (বীরশ্রেষ্ঠদের মধ্যে একজনও সিভিলিয়ান নাই) এইসব এই প্রজন্মের জানাটা অতি জরুরি। একজন মেজরের (ক্ষমা চাচ্ছি, নামটা উদ্ধার করতে পারিনি) এ লেখাটায় পদকের কিছু বিষয় আমরা জানতে পারি।
এখানে এসে আমার বুক ভেঙ্গে আসে, একজন সেক্টর কমান্ডার যদি এইসব অন্ধকার দিক উম্মোচন না-করেন তাহলে এই প্রজন্মের আমরা প্রকৃত ইতিহাস জানব কেমন করে?
বিষাদে বলি, আমাদের জন্য সর্বত্র একই শিক্ষা, আগে দলবাজ হও তারপর মানুষ হও।
No comments:
Post a Comment