দুলা মিয়ার (তাঁর প্রতি সালাম) প্রথম খোঁজ পাওয়ার ছোট্ট একটা কাহিনী আছে। তাঁকে নিয়ে প্রথম পড়ি, 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ' ১৬ খন্ডের ১০ম খন্ডে। 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ' ১ম থেকে ১৬ খন্ড যোগাড় করতে আমাকে খানিকটা তকলীফ করতে হয়েছিল। যেখানে এই খন্ডগুলো পাই ওটা ছাপা হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। সরকারী পাঠাগারের সম্পদ এই বইগুলোর অবস্থা যা-তা, পাতা সব আলাদা হয়ে গেছে।
এখানকার দায়িত্বে থাকা মানুষটাকে আমি যখন বললাম, আমি কি এগুলো ফটোকপি করতে পারি? তিনি আমাকে হাইকোর্ট-সুপ্রীমকোর্ট দেখাতে লাগলেন। এটা সরকারী সম্পদ, ফটোকপি করা যাবে না ইত্যাদি। আমি পড়ার নাম করে একেকটা খন্ড আনি, ফটোকপি করি এরপর ফেরত দিয়ে আরেক খন্ড এনে আবারও ফটোকপি। এভাবে প্রায় ১৫০০০ পৃষ্ঠা ফটোকপি করলাম, খাস বাংলায় চোর হলাম। এই নিয়ে আজ আমার কোন অনুশোচনা নাই।
'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ'-এর ১০ম খন্ডে যখন দুলা মিয়ার খোঁজ পাই, মানুষটার সাহস দেখে আমি হতভম্ব। একজন মানুষের পক্ষে কেমন করে এমন সাহস দেখানো সম্ভব? একজন কোত্থেকে পান এমন সাহস, কী তাঁর উৎস!
দুলা মিয়াকে নিয়ে প্রথম একটা পোস্ট দিলাম 'মুক্তিযুদ্ধে একজন অখেতাবধারী দুলা মিয়া'। ওই লেখায় পড়েছিলাম, দুলা মিয়ার যুদ্ধে যাওয়ার পেছনে ছোট্ট একটি মেয়ে আছে। আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল এই মেয়েটা আজ কোথায়, দুলা মিয়াই কি জীবিত আছেন? কোথাও কোন তথ্য পাই না কারণ এই মানুষটাকে যুদ্ধে কোন খেতাব দেয়া হয়নি। আপাততদৃষ্টিতে বাতিল একজন মানুষ, কার দায় পড়েছে তাঁর খোঁজ রাখার!
তাঁর সম্বন্ধে কিছুই না-জেনে গাধার মত বেরিয়ে পড়ি। খড়ের গাদায় সুই খোঁজার মত। এমন একজন অগ্নিপুরুষকে নিয়ে কেউ কিচ্ছু জানে না। তার উপর আরেক জ্বালা, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে পাল্টা জানতে চায়, আপনে কি সাম্বাদিক, কোন পরতিকার?
আমি যখন বলি, না আমি সাংবাদিক না তখন তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অন্য দিকে তাকিয়ে দাঁত খোঁচাতে থাকেন, অথচ এই মানুষটা শেষ কবে মাংস খেয়েছে এটা মনেও করতে পারবেন না।
যাই হোক, অনেক যন্ত্রণা করে দুলা মিয়াকে খুঁজে বের করি কিন্তু মৃত দুলা মিয়াকে। এখানে এসে অনেকক্ষণ আমি হাত-পা ছড়িয়ে বসে ছিলাম। এমন একজন অগ্নিপুরুষকে এমন অবহেলায় ফেলে রেখেছে। অন্তত তার কবর পাকা-কাঁচা দূরের কথা, কোন চিহ্নও নাই। জাস্ট জঙ্গল! অথচ পাশেই এক অখ্যাত ফকিরের কবর চমৎকার করে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। ফিরে এসে পোস্টটা টাইপ করছিলাম, ঝাপসা মনিটরে, 'আমরা দুধ বিক্রি করে শুটকি খাওয়া জাতি'।
তখন পত্রিকার লোকজনকে অনুরোধ করেছিলাম, দুলা মিয়াকে নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য। এঁদের বক্তব্য, 'ডিসেম্বরে করব। এখন করলে পত্রিকা নিউজটা ধরবে না।'
আমার বোধগম্য হচ্ছিল না, ডিসেম্বরে কেন? বাকি মাসগুলো কী দোষ করেছে?
ওহো, ভুলেই গিয়েছিলাম, বিশেষ একটা মাস ব্যতীত আমরা তো আবার কান্নাকাটি করতে পারি না। বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের ছেলে চায়ের দোকানে পানি টেনে দিন-গুজরান করেন, এটা আমরা আবিষ্কার করব ডিসেম্বরে! দুলা মিয়ার কবরের চিহ্ন নাই এটাও আমরা আবিষ্কার করব ডিসেম্বরে। কত কত আবিষ্কার যে আমরা ডিসেম্বর এলে করব এর ইয়াত্তা নাই।
১১ মাস আমরা ঘুমিয়ে দিন কাবার করে, প্রত্যেক ডিসেম্বরে হুড়মুড় করে জেগে উঠি। আমাদের আবেগে মৃত মুক্তিযোদ্ধারা পর্যন্ত জেগে উঠেন এবং জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা ১৬ ডিসেম্বরে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের একেকজনের কী কান্না, তহবন ভিজে যায়। বীরশ্রেষ্ঠর কবরে সারাটা বছর গু-মুতের কাথা শুকায়, ডিসেম্বরে গিয়ে আমরা তোপ দাগি। ভাল-ভাল! আমাদের খাসিলতই এটা, সমস্তটা জীবন চলব এলোমেলো, শেষ বয়সে হজ করে এসে দাড়ি-টাড়ি ছেড়ে ভালুমানুষ(!) হয়ে যাই!
তো, কালে কালে দুলা মিয়ার সমাধিস্থল নামের জায়গাটা আরও জঙ্গল হয়েছে, পাশাপাশি ফকিরের সমাধির জৌলুশ ক্রমশ বেড়েছে। এখন এটা পাকা করা হচ্ছে। আবার লিখলাম, 'আমরা চাউল বিক্রি করে কফের সিরাপ খাওয়া জাতি'।
আচ্ছা, এইসব লিখে আদৌ কোন ফায়দা হয়? তবে একটা অসাধারণ কাজ হয়, নিজের কাছে শান্তি শান্তি লাগে। এর কোন তুলনা নাই। নিজের আনন্দে নিজেই মাখামাখি হয়ে থাকা।
আমি যখন 'মুক্তিযুদ্ধের আবেগও একটি বিক্রয়যোগ্য পণ্য' পোস্ট দিলাম অনেকে খুব ক্ষুব্ধ হলেন, ফোন করে অনেকে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বেশ-বেশ! ২০০৯ সালে এসে অনেকের মনে পড়ে যাচ্ছে, তারা ১৯৭১-এ মরনপণ যুদ্ধ করেছিলেন। মাথায় শেল লাগার কারণে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছিলেন, ২০০৯ সালে ব্রেন মানে স্মৃতি ফেরত পেয়েছেন। একজন সচীব সুনীল কান্তি বোস যখন ২০০৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য আবেদন করেন চাকরির বয়স দু-বছর বাড়বে বলে তখন আমি এমন পোস্ট দিলে খুব দোষ হয়! আমাকে শূলে চড়াতে ইচ্ছা করে, না?
মিডিয়া আমাদের যা শেখাবে আমরা তাই শিখব, এর ব্যত্যয় হওয়ার যো নাই। ঠিক-ঠিক ১৬ ডিসেম্বরে দুলা মিয়াকে নিয়ে প্রথম আলো একটা রিপোর্ট করলে, অনেকে তাঁর কবর পাকা করার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বলে আজ ফলোআপ ছাপা হয়েছে। মিডিয়ার শক্তি বলে কথা! আমরা ছাপার অক্ষর ব্যতীত অন্য কোন অক্ষরের গুরুত্ব দেই না। মিডিয়ার শক্তির কাছে আমি সমর্পণ করি, ছাপার অক্ষরকে আসমানি কিতাব বলে স্বীকার করে নেই।
যাক, তবুও যদি দুলা মিয়ার একটা গতি হয়, পদক দিয়ে কী হয়...। মানুষটা শান্তিতে ঘুমাক।
No comments:
Post a Comment