"যে চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে পাকিস্তানি সেনার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, একদিন তিনি এলেন। সব কিছু জেনেও আমি তার পা জড়িয়ে ধরলাম।
বললাম, 'কাকাবাবু, আমাকে বাবার কাছে রেখে আসুন। ছোট্টবেলা থেকে আপনি আমাকে চেনেন। আপনার মেয়ে সুলতানার সঙ্গে আমি একসঙ্গে খেলাধুলা করেছি, স্কুলে পড়েছি। আমাকে দয়া করুন'।
উনি পা ঝাড়া দিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
...প্রথমে আমার উপর পাশবিক অত্যাচার করে একজন বাঙালী। আমি বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।
...আমাদের শাড়ি পরতে বা দোপাট্টা ব্যবহার করতে দেয়া হত না। কোন ক্যাম্পে নাকি কোন একটা মেয়ে গলায় শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
...প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে সব রমণী মাতৃভূমির জন্য তাদের সতীত্ব , নারীত্ব হারিয়েছে তিনি তাদের বীরাঙ্গনা আখ্যায় ভূষিত করেছেন। অন্তরের শ্রদ্ধা জানালাম সেই মহানায়কের উদ্দেশ্যে। আমি বীরাঙ্গনা, এতোবড় সম্মান আমি পেয়েছি। আমি ধন্য কিন্তু চোখের জল কেন জানি না বাঁধা মানে না।
বাবাকে দেখবার জন্য, তাদের খবর নেবার জন্য অস্থির হয়ে গেছি। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য এমন কাউকে দেখি না যাঁকে অনুরোধ করা যায়। শেষে পুনর্বাসন কেন্দ্রের কার্যনির্বাহী অফিসার মোসফেকা মাহমুদকে বাবার ঠিকানা দিলাম। পথের দিকে তাকিয়ে থাকি, যেন খবর পেয়েই বাবা ছুটে আসবেন। কিন্তু না দিন গড়িয়ে সপ্তাহ গেল। খবর পেলাম বাড়িঘর ভেঙ্গে গেছে সে সব মেরামত করা নিয়ে বাবা ব্যস্ত, আসবেন কয়েক দিনের মধ্যে। শুধু উচ্চারণ করলাম,‘বাবা তুমিও’!
ইত্যবসরে আমার গর্ভপাত করানো হল, কারণ এতদিনে বাস্তবতা বুঝে গেছি।
...আপা (নীলিমা ইব্রাহীম), আপনি তো দেখেছেন মেয়েরা কিছুতেই গর্ভপাতে রাজি হয়নি। আপা, আপনার মনে আছে মর্জিনার কথা? সেই যে ফ্রকপরা মেয়েটি। আপনাকে দেখলেই চিৎকার করত, আর বলত, আপনি তার ছেলেকে চুরি করে বিদেশ পাঠিয়ে দেবেন। আপনি মর্জিনার কষ্ট দেখে পাঠাতে আগ্রহি ছিলেন না।
...বঙ্গবন্ধুকে যখন বলেছিলাম (নীলিমা ইব্রাহীম) উনি বল্লেন, ‘না আপা, পিতৃপরিচয় যাদের নেই সবাইকে পাঠিয়ে দেন। মানুষের সন্তান মানুষের মতো বড় হোক। তাছাড়া ওই দুষিত রক্ত আমি এদেশে রাখতে চাই না’।
...নিয়েলের ভালবাসা, স্নেহ, মমতা আমার অতীতকাল মুছে ফেলল। তারা ব্যানার্জী থেকে আমি হলাম মিসেস টি নিয়েলসন ।
...স্বদেশে আমার সত্যিকার পরিচয় নেই, তারা ব্যানার্জী মরে গেছে ... আমি কোথায়? ওদের কাছে আমি ঘৃণ্য, নিন্দিত, মৃত।
...দেশে সম্মান মর্যাদা যা পেয়েছি মিসেস টি নিয়েলসন আর টমাসের মা হিসাবে।
...জন্ম দিলে জননী হওয়া যায় কিন্তু লালন পালন না করলে মা হওয়া যায় না। আমি জন্মেছিলাম সোনার বাংলায়, লালিত হচ্ছি ডেনমার্কের ভূমিতে। তবুও সেই মাটিতেই হবে আমার শেষ শয্যা...।"
...........................................
(আমরা পাকিস্তানিদের বর্বর বলি কিন্তু এই চেয়ারম্যান সাহেব? যিনি তার কন্যার খেলার সাথিকে তুলে দিয়েছিলেন পাক-আর্মির হাতে। তার এই ভয়াবহ অন্যায়ের কারণে শাস্তি দেয়া হবে না?
তারা ব্যানার্জীর উপর যে বাঙ্গালি বীরপুরুষ সর্বপ্রথম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? এ? এই পশুটাকে কাঠগড়ায় উঠানো যাবে না?
আর ওই বাবা নামের কাপুরুষটা? ওই মানুষটা এবং আমাদের সাবেক সেনাপ্রধান কাপুরুষ শফিউল্লা এরা এখনও পেট চিরে আত্মহত্যা করেননি, আশ্চর্য!এরা কি? আমার মনে হয়, পাক-আর্মি এদের কাছে নস্যি!
এও বিচিত্র! এই দেশ বীরাঙ্গনা নামের এইসব অভাগাদের কেউ মনে রাখেনি! কয়টা বীরাঙ্গনার নামে কয়টা স্কুল-কলেজ-কালভার্টের নামকরন করা হয়েছে এটা একটা গবেষণার বিষয়!)
* লেখা ঋণ: নীলিমা ইব্রাহীম
** ভাষারীতি সামান্য পরিবর্তিত
***ছবি-স্বত্ব: রবীন্দ্র সেনগুপ্ত, আগরতলা। সংগ্রহ: দুলাল ঘোষ
****অসম্ভব জরুরি একটা বিষয় আমার চোখ এড়িয়ে গেছে (যেটা নীলিমা ইব্রাহীমের 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি', বইয়ের ২৪ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে)! আমি লিখেছিলাম, "আমরা পাকিস্তানিদের বর্বর বলি কিন্তু এই চেয়ারম্যান সাহেব? যিনি তার কন্যার খেলার সাথিকে তুলে দিয়েছিলেন পাক-আর্মির হাতে। তার এই ভয়াবহ অন্যায়ের কারণে শাস্তি দেয়া হবে না?"
Ripon Majumder এক মন্তব্যের মাধ্যমে জানিয়েছেন, "প্রতিকার কিছুটা হয়েছে। ১৯৭২ এর ১৮ ডিসেম্বর ঐ চেয়ারম্যানকে (মকবুল) মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করে মেরেছে। তবে নতুন হায়েনা অলরেডি তৈরী হয়ে গেছে বলে জানা যায়। ঐ চেয়ারম্যানের ছেলে। অনেক আগে থেকেই সে নাকি বাপের পথ ধরেছে।
বাছাধনের নাম জানি না। "
Ripon Majumder, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে...।
বললাম, 'কাকাবাবু, আমাকে বাবার কাছে রেখে আসুন। ছোট্টবেলা থেকে আপনি আমাকে চেনেন। আপনার মেয়ে সুলতানার সঙ্গে আমি একসঙ্গে খেলাধুলা করেছি, স্কুলে পড়েছি। আমাকে দয়া করুন'।
উনি পা ঝাড়া দিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
...প্রথমে আমার উপর পাশবিক অত্যাচার করে একজন বাঙালী। আমি বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।
...আমাদের শাড়ি পরতে বা দোপাট্টা ব্যবহার করতে দেয়া হত না। কোন ক্যাম্পে নাকি কোন একটা মেয়ে গলায় শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
...প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে সব রমণী মাতৃভূমির জন্য তাদের সতীত্ব , নারীত্ব হারিয়েছে তিনি তাদের বীরাঙ্গনা আখ্যায় ভূষিত করেছেন। অন্তরের শ্রদ্ধা জানালাম সেই মহানায়কের উদ্দেশ্যে। আমি বীরাঙ্গনা, এতোবড় সম্মান আমি পেয়েছি। আমি ধন্য কিন্তু চোখের জল কেন জানি না বাঁধা মানে না।
বাবাকে দেখবার জন্য, তাদের খবর নেবার জন্য অস্থির হয়ে গেছি। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য এমন কাউকে দেখি না যাঁকে অনুরোধ করা যায়। শেষে পুনর্বাসন কেন্দ্রের কার্যনির্বাহী অফিসার মোসফেকা মাহমুদকে বাবার ঠিকানা দিলাম। পথের দিকে তাকিয়ে থাকি, যেন খবর পেয়েই বাবা ছুটে আসবেন। কিন্তু না দিন গড়িয়ে সপ্তাহ গেল। খবর পেলাম বাড়িঘর ভেঙ্গে গেছে সে সব মেরামত করা নিয়ে বাবা ব্যস্ত, আসবেন কয়েক দিনের মধ্যে। শুধু উচ্চারণ করলাম,‘বাবা তুমিও’!
ইত্যবসরে আমার গর্ভপাত করানো হল, কারণ এতদিনে বাস্তবতা বুঝে গেছি।
...আপা (নীলিমা ইব্রাহীম), আপনি তো দেখেছেন মেয়েরা কিছুতেই গর্ভপাতে রাজি হয়নি। আপা, আপনার মনে আছে মর্জিনার কথা? সেই যে ফ্রকপরা মেয়েটি। আপনাকে দেখলেই চিৎকার করত, আর বলত, আপনি তার ছেলেকে চুরি করে বিদেশ পাঠিয়ে দেবেন। আপনি মর্জিনার কষ্ট দেখে পাঠাতে আগ্রহি ছিলেন না।
...বঙ্গবন্ধুকে যখন বলেছিলাম (নীলিমা ইব্রাহীম) উনি বল্লেন, ‘না আপা, পিতৃপরিচয় যাদের নেই সবাইকে পাঠিয়ে দেন। মানুষের সন্তান মানুষের মতো বড় হোক। তাছাড়া ওই দুষিত রক্ত আমি এদেশে রাখতে চাই না’।
...নিয়েলের ভালবাসা, স্নেহ, মমতা আমার অতীতকাল মুছে ফেলল। তারা ব্যানার্জী থেকে আমি হলাম মিসেস টি নিয়েলসন ।
...স্বদেশে আমার সত্যিকার পরিচয় নেই, তারা ব্যানার্জী মরে গেছে ... আমি কোথায়? ওদের কাছে আমি ঘৃণ্য, নিন্দিত, মৃত।
...দেশে সম্মান মর্যাদা যা পেয়েছি মিসেস টি নিয়েলসন আর টমাসের মা হিসাবে।
...জন্ম দিলে জননী হওয়া যায় কিন্তু লালন পালন না করলে মা হওয়া যায় না। আমি জন্মেছিলাম সোনার বাংলায়, লালিত হচ্ছি ডেনমার্কের ভূমিতে। তবুও সেই মাটিতেই হবে আমার শেষ শয্যা...।"
...........................................
(আমরা পাকিস্তানিদের বর্বর বলি কিন্তু এই চেয়ারম্যান সাহেব? যিনি তার কন্যার খেলার সাথিকে তুলে দিয়েছিলেন পাক-আর্মির হাতে। তার এই ভয়াবহ অন্যায়ের কারণে শাস্তি দেয়া হবে না?
তারা ব্যানার্জীর উপর যে বাঙ্গালি বীরপুরুষ সর্বপ্রথম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? এ? এই পশুটাকে কাঠগড়ায় উঠানো যাবে না?
আর ওই বাবা নামের কাপুরুষটা? ওই মানুষটা এবং আমাদের সাবেক সেনাপ্রধান কাপুরুষ শফিউল্লা এরা এখনও পেট চিরে আত্মহত্যা করেননি, আশ্চর্য!এরা কি? আমার মনে হয়, পাক-আর্মি এদের কাছে নস্যি!
এও বিচিত্র! এই দেশ বীরাঙ্গনা নামের এইসব অভাগাদের কেউ মনে রাখেনি! কয়টা বীরাঙ্গনার নামে কয়টা স্কুল-কলেজ-কালভার্টের নামকরন করা হয়েছে এটা একটা গবেষণার বিষয়!)
* লেখা ঋণ: নীলিমা ইব্রাহীম
** ভাষারীতি সামান্য পরিবর্তিত
***ছবি-স্বত্ব: রবীন্দ্র সেনগুপ্ত, আগরতলা। সংগ্রহ: দুলাল ঘোষ
****অসম্ভব জরুরি একটা বিষয় আমার চোখ এড়িয়ে গেছে (যেটা নীলিমা ইব্রাহীমের 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি', বইয়ের ২৪ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে)! আমি লিখেছিলাম, "আমরা পাকিস্তানিদের বর্বর বলি কিন্তু এই চেয়ারম্যান সাহেব? যিনি তার কন্যার খেলার সাথিকে তুলে দিয়েছিলেন পাক-আর্মির হাতে। তার এই ভয়াবহ অন্যায়ের কারণে শাস্তি দেয়া হবে না?"
Ripon Majumder এক মন্তব্যের মাধ্যমে জানিয়েছেন, "প্রতিকার কিছুটা হয়েছে। ১৯৭২ এর ১৮ ডিসেম্বর ঐ চেয়ারম্যানকে (মকবুল) মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করে মেরেছে। তবে নতুন হায়েনা অলরেডি তৈরী হয়ে গেছে বলে জানা যায়। ঐ চেয়ারম্যানের ছেলে। অনেক আগে থেকেই সে নাকি বাপের পথ ধরেছে।
বাছাধনের নাম জানি না। "
Ripon Majumder, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে...।
3 comments:
"...কিন্তু এই চেয়ারম্যান সাহেব? যিনি তার কন্যার খেলার সাথিকে তুলে দিয়েছিলেন পাক-আর্মির হাতে। তার এই ভয়াবহ অন্যায়ের কারণে শাস্তি দেয়া হবে না?"
প্রতিকার কিছুটা হয়েছে। ১৯৭২ এর ১৮ ডিসেম্বর ঐ চেয়ারম্যানকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করে মেরেছে। তবে নতুন হায়েনা অলরেডি তৈরী হয়ে গেছে বলে জানা যায়। ঐ চেয়ারম্যানের ছেলে। অনেক আগে থেকেই সে নাকি বাপের পথ ধরেছে।
বাছাধনের নাম জানিনা।
ওই চেয়ারম্যানের নামটা শেয়ার করেন না, প্লিজ @Ripon Majumder
মকবুল
Post a Comment