সর্বজয়া (মা): "...মৃত্যু আসিয়াছে। ...কিন্তু তার ছেলের বেশে, তাকে আদর করিয়া আগু বাড়াইয়া লইতে...এতই সুন্দর...কি হাসি!...কি মিষ্টি হাসি!"
অপু (সন্তান)"...সর্বজয়ার মৃত্যুর পর কিছুকাল অপু এক অদ্ভুত মনোভাবের সংগে পরিচিত হইল। প্রথম অংশটা আনন্দ-মিশ্রিত- এমন কি মায়ের মৃত্যুসংবাদ প্রথম যখন সে তেলি-বাড়ির তারের খবরে জানিল, তখন প্রথমটা তাহার মনে একটা আনন্দ, একটা যেন মুক্তির নিঃশ্বাস...একটা বাঁধন-ছেঁড়ার উল্লাস...অতি অল্পক্ষণের জন্য- নিজের অজ্ঞাতসারে...।"
(অপরাজিত/ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)
মার মৃত্যুর সংবাদে অপুর মধ্যে মুক্তির একটা উৎকট উল্লাস ক্ষণিকের জন্য বয়ে যায়। চোখের নিমিষে অপুর ভেতরের যে পশুটা বেরিয়ে এসেছে যাকে নিয়ে তার লজ্জার শেষ নেই, সত্রাসে সে পশুটিকে লাগাম পরাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে।
কোথাও আমি লিখেছিলাম, আমাদের ভেতরে একটা শিশু এবং একটা পশু ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে। পশু বনাম শিশু। এদের মধ্যে হরদম মারামারি লেগেই আছে। কখন যে কে জেতবে এটা আগাম বলা মুশকিল। অবশ্য মহামানব-টহামানবদের কথা আলাদা! আমরা কখন এই পশুটির মুখোমুখি হবো, কেমন করে একে লাগাম পরাব কাগজে-কলমে এটা শেখানো যায় না- এর কোন মাস্টার নেই, মাস্টার মানুষটা নিজেই, ছাত্রও!
কখনও কেউ পশুটার মুখোমুখি হয়ে হাল ছেড়ে দেয়- কেউ হতভম্ব, লজ্জিত, কেউ পাগল হয়ে যায়, কেউ-বা নিজের প্রাণই নস্ট করে ফেলে।
যারা সত্যিকার অর্থে মানুষের কল্যাণ চান তাঁদের আমৃত্যু চেষ্টা থাকে পশুটিকে শেকল পরাবার নানান কায়দা-কানুন বের করা। হরেক পদের শেকল- শিক্ষার, ধর্মের, পছন্দের মানুষ, তৎকালিন সমাজের চাপ ইত্যাদি।
একটি দৈনিকে (প্রথম আলো, ০২.০১.১০) যখন পড়ছিলাম, বয়স্কভাতা নির্বিকার ভঙ্গিতে নিয়ে গেছেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অনারারি ক্যাপ্টেন মো. আবুল হাশেম তখন সব কেমন গুলিয়ে যায়। মানুষটার বয়স ৬২, তিনি বয়স্কভাতা পেতেই পারেন এই তার যুক্তি। টাকার অংকটা হচ্ছে, ১৮০০ ছয় মাসের জন্য অর্থাৎ মাসে ৩০০ টাকা করে। কিন্তু এ জন্য সামান্য একজন চা-র দোকানদার আলফাজ উদ্দিনকে ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে! এই অনারারি ক্যাপ্টেন সাহেবের তিনটা পাকা বাড়ি আছে, তার দুই ছেলে চাকরি করে জাহাজে।
তিনি সামান্য ৩০০ টাকার লোভ সামলাতে পারেননি, কেন? নাকি এটা বোঝার ক্ষমতাই অর্জন করতে পারেননি এত কাল ধরে, এতো শিখেও? সমস্যাটা কোথায়?
এখন আমার কেন যেন এই মানুষটার জন্য করূণা হচ্ছে, আহা, বেচারা, আহা- দোষ কী! মানুষটা যে একজন পাইপ-মানুষ! মানুষটা এসেছে লম্বা একটা পাইপ হয়ে, যার একপাশে মুখ অন্য ধারে পায়ু আর কিসসু নাই। একদিকে খাবার ঢেলে দিলে সময় করে সেটা অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ওই যে একটা পাইপ! এরা দুনিয়ায় এসেছে পাইপ-মানুষ হয়ে। কপাল!
এইসব পাইপমানুষের কীইবা করার আছে? ওদের ভেতরের পশুটা কালেভদ্রে উঁকি দেবে কী, দিব্যি কাঁধে সওয়ার হয়েই ছিল, আছে, থাকবে।
No comments:
Post a Comment