আমাদের বিবাহের প্রায় এক যুগ পার হলো কিন্তু কেমন কেমন করে যেন আমরা দু-জন কখনও একসঙ্গে বইমেলায় যাইনি। এবারের মেলায় যাওয়াটা তাই খানিকটা ব্যতিক্রম ছিল। সঙ্গে আমাদের দু-সন্তান। বাচ্চাগুলো কখনই বইমেলায় যায়নি। এবারই প্রথম। বাচ্চাগুলো প্রচন্ড উত্তেজনায় ছটফট করছে।
শত-শত বার ঢাকা গেছি কিন্তু ঢাকার লোকেশন আমার মনে থাকে না। বাড্ডার আগে ফার্মগেট নাকি ফার্মগেটের আগে বাড্ডা এই নিয়ে তালগোল লেগেই থাকে। কোথাও যাওয়ার হলে, ক্যাব-স্কুটার-রিকশার চালক আমাকে যখন জিজ্ঞেস করেন, 'কোন দিগ দিয়া যামু'?
আমি রাশভারী গলায় বলি, 'যেই দিক দিয়া সুবিধা হয় হেই দিক দিয়া যান। আমারে জিগাইতাছেন কেন'!
বাহনে উঠে বসে আলাদা গাম্ভীর্য নিয়ে বসে থাকি, ব্যাটা যেন বুঝতে না পারে ঢাকার রাস্তা-ঘাট আমি কিছুই চিনি না। বুঝে ফেললে সর্বনাশ!
(এ এক বিচিত্র কান্ড! রাজশাহী-খুলনার রাস্তা, ওখানকার বিখ্যাত স্থাপনা না-চিনলে কোনো লাজ নাই কিন্তু ঢাকার ভূতের গলির নাম না-শুনলে, না-চিনলে জনে জনে জবাবদিহি করো; ওরি বাবা, ঢাকার এইটা চিনো না!)।
যাই হোক, এবারও যথারীতি স্কুটারে এদের নিয়ে বসে আছি। কাফরুল থেকে যাব শাহবাগ। রাস্তায় আর্মি নামের দুই হাত, দুই পা-ওয়ালা একজন মানুষ আটকে দিলেন। কঠিন গলা, 'কোথায় যাবেন'?
আমি কিছু বলার আগেই আমার ছেলেটা ঝলমলে মুখে বলে বসল, 'চাচ্চু, আমরা বইমেলায় যাব'।
পাথুরে মুখটা শিশুটির দিকে না তাকিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলল, 'এই রাস্তা আপনার জন্য না'।
আমি শান্ত গলায় বললাম, 'দেখুন, স্কুটারওয়ালা আমাকে বলেনি যে এখান দিয়া যাওয়া যাবে না। জানলে, অবশ্যই এদিক দিয়ে আসতাম না। অনেক গাড়িই তো যেতে দিচ্ছেন, আমাদেরকেও যেতে দিন। আমাদের এখন ঘুরপথে যেতে হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। প্লিজ...'।
পাথুরে মুখে বিন্দুমাত্র চিড় ধরল না, 'উঁহু, সেটা আপনার সমস্যা। জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে যাওয়া যাবে না। এই রাস্তা আপনার জন্য না'।
আমার পরিচিত কিছু মানুষকে ফোন করে এর এই সিদ্ধান্ত বদলাবার চেষ্টা করতে পারতাম কিন্তু আমার ইচ্ছা হলো না। আমি কথা বাড়ালাম না। বলতে পারতাম: আমাদের ট্যাক্সের টাকায় দেশ আপনাদেরকে কেবল যুদ্ধ করার জন্যই লালন-পালন করে না। আর ফাও আমাদেরকে এটা শেখাবার জন্য, এই রাস্তা আমাদের না! আজ এটা বলছেন, কাল বলে বসবেন, এই দেশ আপনাদের জন্য না! আমি ব্লাডি সিভিলিয়ান, অন্তত এটা আপনার কাছ থেকে শিখতে আগ্রহ বোধ করি না। কেন এটা বললাম না বা কেন কথা বাড়ালাম না এটা পরে বলছি।
এই মানুষটা উপরঅলার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। সবই হয়তো ঠিক ছিল কিন্তু এই কথাটা আমার বুকে গিয়ে ধাক্কার মত লাগল। যেন খুব কাছ থেকে গুলি খাওয়ার অভিজ্ঞতা। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে বুক ভেঙ্গে আসছিল, মাথায় আটকে গেল, এই রাস্তা আমার না-এই রাস্তা আমার না...! প্রকারান্তরে মনে হচ্ছে, এই দেশ আমার না-এই দেশ আমার না। এই দেশ আমার না?
স্কুটার অনেক ঘুর পথে এগুচ্ছে। আমার ছেলে বারবার বলছে, 'বাবা-বাবা, অ বাবা, আমরা কেন এই রাস্তা দিয়ে যেতে পারব না'?
আমি আমার সন্তানের চোখাচোখি বাঁচিয়ে স্কুটারের খাঁচার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখি। আমি আমার সন্তানের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, কী তীব্র সেই চোখের দৃষ্টি! কি বলব আমার সন্তানকে? আমি কি এখনই তাকে অন্ধকারের ভাষা শেখাব? নাকি বলব, তোমার বাবা একটা কাপুরুষ!
কোনো সভ্য দেশে শহরের মাঝখানে ক্যান্টেনমেন্ট থাকা সমীচীন কি না এই কুতর্কে আমি যাব না। কেউ শখ করে বা নিজেদের নিরাপত্তার উদ্বেগে ক্যান্টনমেন্ট শহরে জুড়ে রাখতে চাইলে, ১০০ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেললেই হয়। বা রাস্তার শুরুতে বিলবোর্ড লাগিয়ে দিলেই হয়, এই রাস্তা ব্লাডি সিভিলিয়ান এবং কুকুরের জন্য নিষিদ্ধ। সমস্যার তো কিছু নাই।
এমনিতেও ঢাকা বসবাস অযোগ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে। ঢাকার উপর চাপ কমানো অতি জরুরি। ঢাকায় কেবল ক্যান্টনমেন্ট রেখে সমস্ত ব্লাডি সিভিলিয়ানদের এখান থেকে সরিয়ে দিলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান পাওয়া যাবে! আমরাও ঢাকায় যাওয়ার যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যাই। খোদার কসম, আমি অন্তত মুত্রত্যাগ করার জন্যও ঢাকামুখি হবো না।
তখন আমি কথা বাড়াইনি ইচ্ছা করেই। কেন বলছি। ধরা যাক কথা কাটাকাটি শুরু হলো। কে জানে এ হয়তো তখন ফট করে বলে বসত: 'এই নীচে নাম। কান ধরে উঠবস কর'।
এই নিয়মটা এদের আছে। স্বামীর হেলমেট না থাকার অপরাধে জনবহুল রাস্তায় স্ত্রীর সামনে স্বামীকে কান ধরে উঠবস করতে বাধ্য করেছে। অথচ এরা নিজেরা স্বামীর কাছে স্ত্রীর মর্যাদা এতটাই উঁচুতে রাখে; একজন সৈনিকের সঙ্গে লেডি থাকলে জেনারেল পর্যন্ত কেয়ার করেন। বাহ, বেশ! নিজেদের লেডির জন্য এক নিয়ম অন্যদের জন্য আরেক রকম!
আজ খানিকটা বুঝি এদের জন্য দেশের লোকজনের এমন তীব্র রোষ কেন। সাধারণ মানুষ কেন এদের নিজেদের কেউ না ভেবে এলিয়েন ভাবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, এদের ক্রাইসিসে আমার চোখের জলের সঙ্গে রক্ত মিশে ছিল। আহারে-আহারে, এরা তো আমাদেরই ভাই-বন্ধু। আমার বুক ভেঙ্গে আসত যখন দেখতাম ইন্টারনেটে এদের নিয়ে, এদের বিপক্ষে কী উল্লাস। এদের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে গিয়ে অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে আমাকে। কেউ কেউ সামরিক বাহিনীর দালালও বলেছেন আমাকে।
অবশ্য এও বুঝি, নিরামীষভোজী হলেই কাউকে ষাড় গুতাবে না এমনটা আশা করা বোকামী। এদের প্রতি সাধারণ মানুষদের ভালোবাসা-মমতা ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমাতাটাই এদের নাই আসলে।
আফসোস, এদের জন্য কেবলই অনর্থক বেদনা বোধ, কোনো মানে নাই আসলে! আজ বুঝতে পারি, কেন এরা আমাদের কেউ কখনই হতে পারবে না, পারা সম্ভব না। এরা এলিয়েন...।
আমাদের দেশে তো ফলোআপের চল নাই। পরবর্তীতে আমাদের আর জানা হয়নি সেই কান ধরে উঠবস করা স্বামীটির কি হয়েছিল? আচ্ছা, ওই স্বামীটা কী দুর্দান্ত লজ্জায়-অভিমানে আত্মহত্যা করেছিলেন? জানি না আমি। কেবল আমার নিজেরটা জানি, এ আমাকে কান ধরতে বললে আমি কান ধরতাম না। কক্ষণও না, আমার লেখালেখির কসম, আমার বাচ্চার কসম। আমি বলতাম, তারচেয়ে আমাকে মেরে ফেল। কারণ এমনটা না করলে এরপর হয়তো প্রাণে বেঁচে থাকতাম কিন্তু আমার স্ত্রী, সন্তানদের চোখে চোখ রাখতাম কেমন করে? একবার মরার চেয়ে প্রতিদিন মারা যাওয়াটা বড়ো কষ্টের, বড়ো কষ্টের।
আচ্ছা, আমি কান ধরে উঠবস করতে অস্বীকার করলে তখন কি এ সত্যি সত্যি হোলস্টার থেকে রিভলবার বের করে দুম করে আমাকে গুলি করে বসত? রক্তে ভাসতে ভাসতে রাস্তায় আমি থেতলে যাওয়া কুকুরের মত মরে পড়ে থাকতাম, হাত পা ছড়িয়ে? আমার সন্তানরা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকত, 'বাবা-বাবা, তোমার গায়ে এতো রক্ত কেন! বলো না, বাবা- বলো না, তোমার গায়ে এতো রক্ত কেন? বাবা-বাবা, অ বাবা...'।
হিজড়া নামের কিছু লোকজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখত। হয়তো মিডিয়ায় লোকজন খুব আগ্রহ নিয়ে আমার মৃতদেহের ছবি উঠাতো। ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক। চেষ্টা করত আমার টকটকে রক্তে সূর্যের প্রতিফলনটা আটকে ফেলতে। আমার মতো অখ্যাত একজনের পত্রিকার পাতায় ছবি ছাপা হওয়া, এও কী কম!
আমি আসলে মরতে চাইনি। আমার যে এখনও অনেক কাজ বাকী! কতশত লেখা মাথায় ঘুরপাক খায়- লিখব লিখব করে আলস্যে আজও লেখা হয়ে উঠেনি। এখনও তো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাটাই লেখা হয়নি। আমার সন্তানকে বলি, এমন সময়ে দুম করে মরে যাওয়াটা কোনো কাজের কাজ না রে, ব্যাটা...। ব্যাটা, বড়ো হলে বুঝবি, একজন মানুষকে কেন কাপুরুষ হতে হয়...।
অফ-টপিক: মূল পোস্টের সঙ্গে এই ছবির সম্পর্ক খোঁজা বৃথা।
(কী আশ্চর্য! এলিয়েনরা কাঁদেও নাকি!)
*ছবি পরিচিতি: বাম পাশের ছবি একজন এলিয়েনের, ডান পাশেরটা মানুষের।
**ছবি সূত্র: গুগল
শত-শত বার ঢাকা গেছি কিন্তু ঢাকার লোকেশন আমার মনে থাকে না। বাড্ডার আগে ফার্মগেট নাকি ফার্মগেটের আগে বাড্ডা এই নিয়ে তালগোল লেগেই থাকে। কোথাও যাওয়ার হলে, ক্যাব-স্কুটার-রিকশার চালক আমাকে যখন জিজ্ঞেস করেন, 'কোন দিগ দিয়া যামু'?
আমি রাশভারী গলায় বলি, 'যেই দিক দিয়া সুবিধা হয় হেই দিক দিয়া যান। আমারে জিগাইতাছেন কেন'!
বাহনে উঠে বসে আলাদা গাম্ভীর্য নিয়ে বসে থাকি, ব্যাটা যেন বুঝতে না পারে ঢাকার রাস্তা-ঘাট আমি কিছুই চিনি না। বুঝে ফেললে সর্বনাশ!
(এ এক বিচিত্র কান্ড! রাজশাহী-খুলনার রাস্তা, ওখানকার বিখ্যাত স্থাপনা না-চিনলে কোনো লাজ নাই কিন্তু ঢাকার ভূতের গলির নাম না-শুনলে, না-চিনলে জনে জনে জবাবদিহি করো; ওরি বাবা, ঢাকার এইটা চিনো না!)।
যাই হোক, এবারও যথারীতি স্কুটারে এদের নিয়ে বসে আছি। কাফরুল থেকে যাব শাহবাগ। রাস্তায় আর্মি নামের দুই হাত, দুই পা-ওয়ালা একজন মানুষ আটকে দিলেন। কঠিন গলা, 'কোথায় যাবেন'?
আমি কিছু বলার আগেই আমার ছেলেটা ঝলমলে মুখে বলে বসল, 'চাচ্চু, আমরা বইমেলায় যাব'।
পাথুরে মুখটা শিশুটির দিকে না তাকিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলল, 'এই রাস্তা আপনার জন্য না'।
আমি শান্ত গলায় বললাম, 'দেখুন, স্কুটারওয়ালা আমাকে বলেনি যে এখান দিয়া যাওয়া যাবে না। জানলে, অবশ্যই এদিক দিয়ে আসতাম না। অনেক গাড়িই তো যেতে দিচ্ছেন, আমাদেরকেও যেতে দিন। আমাদের এখন ঘুরপথে যেতে হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। প্লিজ...'।
পাথুরে মুখে বিন্দুমাত্র চিড় ধরল না, 'উঁহু, সেটা আপনার সমস্যা। জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে যাওয়া যাবে না। এই রাস্তা আপনার জন্য না'।
আমার পরিচিত কিছু মানুষকে ফোন করে এর এই সিদ্ধান্ত বদলাবার চেষ্টা করতে পারতাম কিন্তু আমার ইচ্ছা হলো না। আমি কথা বাড়ালাম না। বলতে পারতাম: আমাদের ট্যাক্সের টাকায় দেশ আপনাদেরকে কেবল যুদ্ধ করার জন্যই লালন-পালন করে না। আর ফাও আমাদেরকে এটা শেখাবার জন্য, এই রাস্তা আমাদের না! আজ এটা বলছেন, কাল বলে বসবেন, এই দেশ আপনাদের জন্য না! আমি ব্লাডি সিভিলিয়ান, অন্তত এটা আপনার কাছ থেকে শিখতে আগ্রহ বোধ করি না। কেন এটা বললাম না বা কেন কথা বাড়ালাম না এটা পরে বলছি।
এই মানুষটা উপরঅলার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। সবই হয়তো ঠিক ছিল কিন্তু এই কথাটা আমার বুকে গিয়ে ধাক্কার মত লাগল। যেন খুব কাছ থেকে গুলি খাওয়ার অভিজ্ঞতা। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে বুক ভেঙ্গে আসছিল, মাথায় আটকে গেল, এই রাস্তা আমার না-এই রাস্তা আমার না...! প্রকারান্তরে মনে হচ্ছে, এই দেশ আমার না-এই দেশ আমার না। এই দেশ আমার না?
স্কুটার অনেক ঘুর পথে এগুচ্ছে। আমার ছেলে বারবার বলছে, 'বাবা-বাবা, অ বাবা, আমরা কেন এই রাস্তা দিয়ে যেতে পারব না'?
আমি আমার সন্তানের চোখাচোখি বাঁচিয়ে স্কুটারের খাঁচার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখি। আমি আমার সন্তানের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, কী তীব্র সেই চোখের দৃষ্টি! কি বলব আমার সন্তানকে? আমি কি এখনই তাকে অন্ধকারের ভাষা শেখাব? নাকি বলব, তোমার বাবা একটা কাপুরুষ!
কোনো সভ্য দেশে শহরের মাঝখানে ক্যান্টেনমেন্ট থাকা সমীচীন কি না এই কুতর্কে আমি যাব না। কেউ শখ করে বা নিজেদের নিরাপত্তার উদ্বেগে ক্যান্টনমেন্ট শহরে জুড়ে রাখতে চাইলে, ১০০ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেললেই হয়। বা রাস্তার শুরুতে বিলবোর্ড লাগিয়ে দিলেই হয়, এই রাস্তা ব্লাডি সিভিলিয়ান এবং কুকুরের জন্য নিষিদ্ধ। সমস্যার তো কিছু নাই।
এমনিতেও ঢাকা বসবাস অযোগ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে। ঢাকার উপর চাপ কমানো অতি জরুরি। ঢাকায় কেবল ক্যান্টনমেন্ট রেখে সমস্ত ব্লাডি সিভিলিয়ানদের এখান থেকে সরিয়ে দিলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান পাওয়া যাবে! আমরাও ঢাকায় যাওয়ার যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যাই। খোদার কসম, আমি অন্তত মুত্রত্যাগ করার জন্যও ঢাকামুখি হবো না।
তখন আমি কথা বাড়াইনি ইচ্ছা করেই। কেন বলছি। ধরা যাক কথা কাটাকাটি শুরু হলো। কে জানে এ হয়তো তখন ফট করে বলে বসত: 'এই নীচে নাম। কান ধরে উঠবস কর'।
এই নিয়মটা এদের আছে। স্বামীর হেলমেট না থাকার অপরাধে জনবহুল রাস্তায় স্ত্রীর সামনে স্বামীকে কান ধরে উঠবস করতে বাধ্য করেছে। অথচ এরা নিজেরা স্বামীর কাছে স্ত্রীর মর্যাদা এতটাই উঁচুতে রাখে; একজন সৈনিকের সঙ্গে লেডি থাকলে জেনারেল পর্যন্ত কেয়ার করেন। বাহ, বেশ! নিজেদের লেডির জন্য এক নিয়ম অন্যদের জন্য আরেক রকম!
আজ খানিকটা বুঝি এদের জন্য দেশের লোকজনের এমন তীব্র রোষ কেন। সাধারণ মানুষ কেন এদের নিজেদের কেউ না ভেবে এলিয়েন ভাবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, এদের ক্রাইসিসে আমার চোখের জলের সঙ্গে রক্ত মিশে ছিল। আহারে-আহারে, এরা তো আমাদেরই ভাই-বন্ধু। আমার বুক ভেঙ্গে আসত যখন দেখতাম ইন্টারনেটে এদের নিয়ে, এদের বিপক্ষে কী উল্লাস। এদের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে গিয়ে অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে আমাকে। কেউ কেউ সামরিক বাহিনীর দালালও বলেছেন আমাকে।
অবশ্য এও বুঝি, নিরামীষভোজী হলেই কাউকে ষাড় গুতাবে না এমনটা আশা করা বোকামী। এদের প্রতি সাধারণ মানুষদের ভালোবাসা-মমতা ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমাতাটাই এদের নাই আসলে।
আফসোস, এদের জন্য কেবলই অনর্থক বেদনা বোধ, কোনো মানে নাই আসলে! আজ বুঝতে পারি, কেন এরা আমাদের কেউ কখনই হতে পারবে না, পারা সম্ভব না। এরা এলিয়েন...।
আমাদের দেশে তো ফলোআপের চল নাই। পরবর্তীতে আমাদের আর জানা হয়নি সেই কান ধরে উঠবস করা স্বামীটির কি হয়েছিল? আচ্ছা, ওই স্বামীটা কী দুর্দান্ত লজ্জায়-অভিমানে আত্মহত্যা করেছিলেন? জানি না আমি। কেবল আমার নিজেরটা জানি, এ আমাকে কান ধরতে বললে আমি কান ধরতাম না। কক্ষণও না, আমার লেখালেখির কসম, আমার বাচ্চার কসম। আমি বলতাম, তারচেয়ে আমাকে মেরে ফেল। কারণ এমনটা না করলে এরপর হয়তো প্রাণে বেঁচে থাকতাম কিন্তু আমার স্ত্রী, সন্তানদের চোখে চোখ রাখতাম কেমন করে? একবার মরার চেয়ে প্রতিদিন মারা যাওয়াটা বড়ো কষ্টের, বড়ো কষ্টের।
আচ্ছা, আমি কান ধরে উঠবস করতে অস্বীকার করলে তখন কি এ সত্যি সত্যি হোলস্টার থেকে রিভলবার বের করে দুম করে আমাকে গুলি করে বসত? রক্তে ভাসতে ভাসতে রাস্তায় আমি থেতলে যাওয়া কুকুরের মত মরে পড়ে থাকতাম, হাত পা ছড়িয়ে? আমার সন্তানরা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকত, 'বাবা-বাবা, তোমার গায়ে এতো রক্ত কেন! বলো না, বাবা- বলো না, তোমার গায়ে এতো রক্ত কেন? বাবা-বাবা, অ বাবা...'।
হিজড়া নামের কিছু লোকজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখত। হয়তো মিডিয়ায় লোকজন খুব আগ্রহ নিয়ে আমার মৃতদেহের ছবি উঠাতো। ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক। চেষ্টা করত আমার টকটকে রক্তে সূর্যের প্রতিফলনটা আটকে ফেলতে। আমার মতো অখ্যাত একজনের পত্রিকার পাতায় ছবি ছাপা হওয়া, এও কী কম!
আমি আসলে মরতে চাইনি। আমার যে এখনও অনেক কাজ বাকী! কতশত লেখা মাথায় ঘুরপাক খায়- লিখব লিখব করে আলস্যে আজও লেখা হয়ে উঠেনি। এখনও তো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাটাই লেখা হয়নি। আমার সন্তানকে বলি, এমন সময়ে দুম করে মরে যাওয়াটা কোনো কাজের কাজ না রে, ব্যাটা...। ব্যাটা, বড়ো হলে বুঝবি, একজন মানুষকে কেন কাপুরুষ হতে হয়...।
অফ-টপিক: মূল পোস্টের সঙ্গে এই ছবির সম্পর্ক খোঁজা বৃথা।
(কী আশ্চর্য! এলিয়েনরা কাঁদেও নাকি!)
*ছবি পরিচিতি: বাম পাশের ছবি একজন এলিয়েনের, ডান পাশেরটা মানুষের।
**ছবি সূত্র: গুগল
2 comments:
যাক, অবশেষে!
এই সফরটা গত বইমেলায় হলে "অসম্ভব মানুষ"টার সাথে দেখা হয়ে যেত। দেখা হতো ভাবি, আর বাচ্চাগুলোর সাথে।
আহারে, দেখা কি আদৌ কোনোদিন হবে?
---
জাগৃতি স্টলে কি বসেছিলেন?
আমার সঙ্গে আপনার দেখা হওয়ার চেয়ে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হওয়াটা জরুরী।
আমার সৃষ্ট চরিত্র তন্ময়কে আমি ভুলে গেছি কিন্তু আপনার মত মানুষ আজও তাকে বিস্মৃত হননি! এমন একটা মানুষের সঙ্গে দেখা না হওয়াটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
আর দেখা হবে না কেন? অবশ্যই দেখা হবে। ভালবাসার পৃথিবীটা একটা বৃত্তের মত। আমরা এর ভেতর ক্রমশ ঘুরপাক খাই- একজনের সঙ্গে অন্যজনের দেখা না হয়ে উপায় কী!
আমি স্টলে বসি না, আমার লজ্জা করে। কারণগুলো আর বলি বলি।
আর কিই-বা লিখি ছাতাফাতা যে লোকজন আমাকে খোঁজার জন্য মুখিয়ে থাকবে।
Post a Comment