আমি বিভিন্ন সাইটে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শত-শত পোস্ট দিয়েছি। আমার লেখাগুলো ছিল অনেকটা, চালু ভাষায় খাপছাড়া। এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যাদের নাম শুনতে শুনতে কানে তালা লেগে যায় তাঁদের নিয়ে লিখতে আমি উৎসাহ বোধ করতাম না। এদের নিয়ে লেখার লোকের তো অভাব নাই, আমি কেন?
আমার আগ্রহ ছিল, এই দেশে অতি সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধে অবদান নিয়ে: মুক্তিযুদ্ধে একজন সুইপার, একজন আদিবাসী নারী; আদিবাসি একজন কমান্ডার, একজন সাধারণ হিন্দু বালিকা, একজন বালক, একজন কৃষক, একজন অন্যদেশি, একজন ক্যামেরাবাজ, একজন সাধারণ নেতা(!), একজন কথাবাজ, বীরাঙ্গনাদের কথা; এইসব অজস্র মানুষ।
কেমন কেমন করে যেন আমাদের ধারণা দেয়া হয়েছে, গুটিকয়েক মানুষই এই দেশটা স্বাধীন করে ফেলেছেন, অন্য আর কারও অবদান ছিল না। এবং ওইসব মানুষদের ছায়াতলে আমাদের আজীবন নতজানু হয়ে থাকতে হবে। বুশ ইস্টাইল, হয় তুমি আমার দলে নইলে তুমি খেলা থেকে বাদ, রাজাকার।
আমার অফ-ট্র্যাকের লেখার ভঙ্গি অনেকেই পছন্দ করতেন না, কেন আমি অতি বিখ্যাতদের নিয়ে লিখি না এই নিয়ে পারলে আমাকে শূলে চড়ান, এমন। কখনও কখনও এটাও বলতে ছাড়তেন না, আমি একজন রাজাকার ভাবপন্ন, বয়সে কুলাতে রাজাকার উপাধি দিয়ে দিতেন।
তখন মুক্তিযুদ্ধের উপর ওইসব লেখায় অসংখ্য মন্তব্য পেয়েছি, ভাল লাগল, প্লাসাইলাম, মাইনাইসিলাম, স্যালুট ইত্যাদি। অবশ্য এইসব প্রতিক্রিয়া আমাকে লেখা চালিয়ে যেতে জোর তাগিদ দিত, লেখা তরতর করে লেখা এগুতো। এমনও দেখা গেছে, টাইপ করতে করতে ভোর হয়ে গেছে, নিজের অজান্তেই কখন গাল ভিজে গেছে টেরটিও পাইনি! লিখতে গিয়ে সত্যি সত্যি তখন দমবন্ধ হয়ে আসত। তখন মাথায় কেবল ঘুরপাক খেত, আহারে, কেমন করে এইসব মানুষদের ঋণ খানিকটা শোধ করার চেষ্টা করি।
সুরুয মিয়া (তাঁর প্রতি সালাম), যিনি ২০০৫ সালে ঠিক ১৬ ডিসেম্বর ভোরে আত্মহত্যা করেন। সুরুয মিয়ার স্ত্রীর সঙ্গে যখন আলাপ করি তখন আমার মধ্যে খানিকটা পরিবর্তন আসে। কেন, আজ বলি:
এই ভদ্রমহিলার ছেলেও বিয়ে করে তাঁকে ছেড়ে গেছে, তিনি কেমন করে সংসার চালান আমি জানি না- তিনবেলা আদৌ খেতে পান বলে আমার মনে হয়নি! তিনি যখন তাঁর গাছের আম-পেপে কেটে আমাকে খেতে জোরাজুরি করছিলেন তখন আমার কেবলই মনে হচ্ছিল এখান থেকে ভোজবাজির মত উধাও হয়ে যেতে পারতাম যদি। না খেলে মানুষটা বড়ো কষ্ট পাবেন। কিন্তু খাবার গলা দিয়ে কী নামতে চায় শালার, আমার কেবল মনে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে খাবারগুলো চিবুচ্ছি। কী দীর্ঘ সেই খাওয়ার সময়- মনে হচ্ছিল এই মহিলার মাংস চিবুচ্ছি।
আমার অন্য রকম কষ্ট হচ্ছিল, মুক্তিযুদ্ধটাকে আমরা সবাই মিলে একটা ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছি। কেউ এটা থেকে টাকা কামাচ্ছি, কেউ নাম! কিন্তু এই মানুষগুলোর মুখে সামান্য হাসি আনার কোন চেষ্টা আমাদের নাই। কেবল প্লাসাইলাম আর মাইনাইসিইলাম, ব্যস, একেকজন অনেক বড়ো বড়ো দেশপ্রেমিক হয়ে বসে রইলাম! লম্বা-লম্বা বাতচিত সার, সরকার কেন কিছু করছে না? সরকার এসে রাস্তার কলার ছিলকাটা সরিয়ে দিলে আমরা হাঁটব!
ফাঁকতালে আমারও দেশপ্রেমিকের একটা তকমা জোটার সম্ভাবনা দেখা দিল!
শ্লা, প্রবাসে আমরা কয়েক ক্যান বিয়ার খেয়ে পেশাবের সঙ্গে যে টাকা বের করে দেই এই টাকা দিয়ে অন্তত একজন মুক্তিযোদ্ধার ঘরে ঈদ নিয়ে আসা যায়, অবিশ্বাস্য হলেও এটা সত্য!
এরপর থেকে অন্য কোন ওয়েব সাইটে লেখা আমি পুরোপুরি বন্ধ করে দিলাম। ওখানে লিখলে অনেক পাঠক পড়ল, অনেক হিট হলো, অনেক মন্তব্য আসল। কী লাভ, কার লাভ- তাতে দেশের এইসব সেরা সন্তানদের কী আসে যায়! এটা একজন নৌকমান্ডো, ফজু ভাইয়ের ঠেলা চালাবার জন্য কী কাজে লাগবে? কী কাজে লাগবে সুরুয মিয়ার স্ত্রীর? কেবল ওনাদের লাল সেলাম লিখে খালাশ! এই লাল সেলাম জিনিসটা কি? কি করে এইটা দিয়ে?
তারচেয়ে নিজের সাইটে লিখে খুব আরাম পাই। যে দু-চারজন পাঠক পড়েন এতেই আমার ভারী সুখ। বাড়তি কোন চাপ নাই।
ক-দিন পূর্বে প্রবাসী একজন দুম করে আমাকে বেশ কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলেন। এর একটা অংশ মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডোকে দেয়ার জন্য। মানুষটার টাকার অংক এবং নাম প্রকাশে অনীহা বিধায় এই প্রসঙ্গটা আপাতত উহ্য থাকুক।
কিন্তু ফজু ভাইকে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়। অবশেষে পাওয়া যায়, অসুস্থ, প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট তাঁর। তাঁর হাতে টাকা দিলে তিনি তাঁর শীর্ণ হাতে আমার হাত খামচে ধরে রাখেন। এখনও ফজু ভাইয়ের গায়ে কী জোর! আমি তাঁকে বলি, বিদেশ থেকে একজন মানুষ আপনাকে সালাম জানিয়েছেন।
ফজু ভাইয়ের যে অভিব্যাক্তি আমি দেখেছি এটা কি কুবরিক তাঁর ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন? বা মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতি তাঁদের লেখার মাধ্যমে? আমি জানি না, জানি না আমি।
আমি এর ছবি উঠিয়ে রাখতে পারতাম। ইচ্ছা করেনি। পৃথিবীর সব ছবি কি উঠানো যায়, নাকি উঠানো উচিৎ?
প্রবাসী ওই মানুষটি এই টাকা খরচ করার জন্য আমাকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন। এখনও তাঁর টাকা থেকে কিছু টাকা আছে,
আমি ঠিক করেছি সুরুয মিয়ার স্ত্রীকে এটা দেব। শেষবার আসার সময় এই মহিলা তাঁর দুর্বল হাত দিয়ে আমার হাত ধরে বলেছিলেন, কথা দেও, তুমি আমারে আবার দেখতে আইবা।
আমি কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু কথা রাখিনি। যাইনি, গিয়ে কি করতাম? আবারও কি তাঁকে জিজ্ঞেস করতাম, আইচ্ছা, কইনছেন দেহি, আপনের সোয়ামি যুদ্ধ যাওয়ার আগে কেমুন স্বপ্ন দেখছিল? শোনো কথা, যুদ্ধে যাওয়ার আগে আবার স্বপ্ন দেখে নাকি, এইসব স্বপ্ন তো দেখতেন আমাদের বড়ো বড়ো ন্যাতারা!
আমার মনটা অনেকখানি খারাপ হলো, আহা, যে প্রবাসী মানুষটা ফযু ভাইয়দের জন্য এই উপহার পাঠিয়েছেন সেই মানুষটা কী অভাগা, প্রবাসে থাকার কারণে এই দুর্লভ অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হলেন, আহা!
কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে, প্রবাস থেকে যখন কেউ বরফ পড়া নিয়ে লেখেন, অন্য ভুবনের আনন্দ নিয়ে বরফের বল একজন অন্যজনের গায়ে ছুঁড়ে দিচ্ছেন, আমি সেইসব বর্ণনা পড়ে যেমন তার চোখ দিয়ে এটা দেখি তাহলে ওই মানুষটা কেন আমার চোখ দিয়ে এমন দৃশ্য দেখতে পাবেন না?
2 comments:
>Ai montobber madhome `probashi` manush ta ke pa dhore salam korlam<
আপনার মন্তব্যটা টাচি, খুব টাচি!
প্রবাসী ওই মানুষটার সঙ্গে এইসব বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা হয় না- কারণ মানুষটা এইসব বিষয় আলোচনায় বিব্রত বোধ করেন। কিন্তু নিয়মিত লেখা পড়েন বিধায় আপনার মন্তব্য তাঁর চোখে পড়বে।
Post a Comment