বাবার এ গাড়িটা তিতলীর খুব পছন্দ। ঝড়ের গতিতে চালালেও চলে পানির মতো, বাড়তি কোনো শব্দ নেই। ঢাকায় এখন অনেক মেয়েই গাড়ি চালায় তবুও লোকজন ড্যাবড্যাব চোখে তাকায় কেন কে জানে!
ওর মন অসম্ভব খারাপ। কেমন দমবদ্ধ ভাব হচ্ছে, ভাইয়া যে ওকে চড় মারল এ জন্যে না। ওদের পরিবারটা একটা অস্বাভাবিক পরিবার। সবাই যেন একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, একাকী। কারো সঙ্গে কারো প্রাণের যোগ নেই। মা’র থাকা না থাকা সমান। চিররুগ্না এই মহিলা বিছানা থেকে উঠতেই পারেন না। বিজয়নগরে এসে স্পীড কমাতে বাধ্য হল। ঢাকায় এই এক মহা সমস্যা। গাড়ি চালিয়েও সুখ নেই। স্পীড কমতে কমতে শূণ্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে। যথারীতি ট্রাফিক জ্যাম, রাগে হাত কামড়াতে ইচ্ছা করছে। গাড়ি এখানে ফেলে হেঁটে যেতে পারলে বেশ হত। এ অচিন্তনীয়, বাবা জ্যান্ত পুঁতে ফেলবেন।
সামনের ট্রাকটার পেছনে লেখা, একশো হাত দূরে থাকুন অথচ সাফারী নাক ঠেকিয়ে আছে। এইসব লেখা সম্ভবত নিয়ম হয়ে গেছে। একশো হাত দূরত্বে থাকতে হলে তো বাংলাদেশের জন্য পুরো এশিয়া লেগে যাবে। একবার বাসে উঠেছিল, নানা উপদেশ: বেবোহারে ভংশের পরিচয়, পকেট সাবদান, আপনার অভিযুগ চালককে বলুন। মজার ব্যাপার হল, চালক বাবাজী একের পর এক সিগারেট টেনে বাস অন্ধকার করে ফেলছিল।
তিতলী ফিক করে হেসে ফেলল। বাঁ পাশের ট্রাকটার ফুয়েল ট্যাঙ্কারে জ্বলজ্বল করছে: জন্ম থেকে জ্বলছি, মাগো। প্রচুর ট্রাকের গায়ে দেখেছে: আমাকে কিছু খেতে দিন। আরেক দিন এক ট্রাকের গায়ে দেখেছিল: আপনিও বাঁচুন, আমাকেও বাঁচতে দিন। যন্ত্রদানবের গায়ে কী বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য!
ওয়ারী পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে! ও এখন যাচ্ছে জাকিয়ার বাড়িতে। জাকিয়া ওর একমাত্র মেয়ে বন্ধু। একসঙ্গে অনার্স করছে। কী চমৎকার একটা মেয়ে, কখনও মলিন মুখ দেখে নি। হাজার জটিলতায়ও দেখেছে হেসে কুটি কুটি হতে।
জাকিয়াদের ছোট গেট দিয়ে খুব কায়দা করে গাড়ি ঢোকাতে হল। জাকিয়া বাগানে ফুলের চারা লাগাচ্ছিল। ধুলো কাদায় মাখামাখি হয়েও হাসি একটু মলিন হয়নি। এর ভাব দেখে মনে হচ্ছে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে কঠিন পরিশ্রম করা জলভাত। জাকিয়াকে এ মুহুর্তে দেখে ওর মন আরও বিষণ্ন হলো। কী সুখী একটা মেয়ে! বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না পৃথিবীর কোনো মালিন্য একে ছুঁতে পারে।
জাকিয়া মাথা সজোরে ঝাঁকিয়ে কপাল থেকে ঝাঁকড়া চুল সরাল। চারদিক আলো করে বলল, ‘ওমা, কী কান্ড, তুই, আয়-আয়। মোড়াটা টেনে বোস, না-কী চেয়ার এনে দেব।’
তিতলীর চোখ অজান্তেই ডবডবে, ‘প্লিজ জাকিয়া, তুই অন্তত আমার সঙ্গে এমন করিস না।’
জাকিয়ার বিস্ময়ের সীমা রইল না। তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে তিতলীকে জড়িয়ে ধরল। গলায় সমস্ত মায়া ঢেলে বলল, ‘এ্যাই পাগল, ঠাট্টা করলাম, বন্ধুর সঙ্গে ঠাট্টাও করতে পারব না। তবুও আমি সরি, খুব সরি। তারপরও রাগ না কমলে আয় আমরা চুলোচুলি করি। ভয় পাস নে, আমার দু’হাত পেছনে বাঁধা থাকবে।’
পরক্ষণেই ছিটকে সরে গেল। আধ হাত জিব বের করে বলল, ‘হায়-হায়, মাটি লাগিয়ে তোর সুন্দর ড্রেসটা নোংরা করে দিলাম।’
‘দিয়েছিস, বেশ করেছিস।’
জাকিয়া কচলে কচলে হাতের মাটি ধুয়ে মোড়া টেনে বসল, ‘তোর আজ খুব মন খারাপ, না?’
‘হুঁ।’
‘হয়েছে কী?’
‘জানি না, জাকিয়া, আসলেই জানি না। কিচ্ছু ভাল্লাগে না। আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে। কোথাও কোনো আনন্দ নাই, বাড়ির অবস্থা তো জানিস।’
‘পাগল না-কী, কি সব বলছিস।’
তিতলির মাথা নিচু হতে হতে হাঁটুতে ঠেকেছে। প্রাণপণ চেষ্টা করছে চোখের জল আটকাতে। জাকিয়ার উপর খুব রাগও হচ্ছে। এ মেয়েটার নিজের জীবনে কোনো সমস্যা নেই বলে এর ধারণা পৃথিবী নামের এ গ্রহটায় কারো কোন সমস্যা নেই।
জাকিয়া আলতো করে তিতলীর মাথায় হাত রেখে স্থির বিশ্বাসে বলল, ‘অসাধারণ কোনো ছেলের সঙ্গে যখন তোর পরিচয় হবে, দেখবি চারপাশ কী মায়াবীই না মনে হচ্ছে।’
তিতলি চোখ মুছে সোজা হল, ‘তুই খুঁজে পেয়েছিস মনে হচ্ছে?’
‘ইশ্শ্, হিংসুক।’
‘এ দেশে সব পাওয়া যায়। অসাধারণ ছেলে কোথায় পাওয়া যায়, বল। তুই-ই দে না একটা খুঁজে?’
‘আরে, এ বলে কী, এটা কী আলু-পটল, বাজার থেকে খুঁজে এনে দেব? এ্যাই, কিছু খাবি? বেশি করে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে মুড়ি বানাই।’
‘জলদি-জলদি।’
জাকিয়া জামবাটিতে মুড়ি বানিয়ে নিয়ে এসেছে। পেঁয়াজের ঝাঁঝে ওর টলটলে চোখ থেকে পানি গড়াচ্ছে। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে হাসতে হাসতে বলল, ‘বাবাকে দিয়ে এলাম এক বাটি। বাবা কী বলল জানিস? ইয়ে, জাকিয়া, তোর বন্ধুর সঙ্গে তুইও কী মুড়ি খাবি? না খেলে, তোর দাঁতগুলো একটু দিয়ে যা, আরাম করে মুড়ি খাই। হি হি হি। বাবাকে নিয়ে কী যন্ত্রণা, সারাটা দিন হাসিয়ে মারে!’
নিজের বাবার কথা মনে করে তিতলি দীর্ঘশ্বাস চাপল। রিটায়ার্ড জজ জাকিয়ার বাবাটা কী প্রাণবন্ত, এখনও হাসেন শিশুর মতো করে। এ সংসারে মাত্র দু’জন লোক। তিতলি একবার জাকিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল: হ্যাঁ রে, তোর বাবার কোন জিনিসটা তোর খারাপ লাগে?
জাকিয়া অনেকক্ষণ ভেবে বলেছিল: বাবা কাক-কোকিলের দরে বাজার করেন।
কী রকম?
ওই আর কী, সবাই বাবাকে ঠকায়।
ওদিন তিতলিকে উঠে যেতে দেখে জাকিয়ার বাবা ছদ্ম রাগে বলেছিলেন: এই যে, ইয়াং মেয়ে, চলে যাচ্ছ যে বড়, আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না বুঝি? ওহ-হো, তুমি বুঝি আমার রূপালী চুল দেখে ধন্ধে পড়ে গেছ। শোনো, চুলের গল্পটা তোমায় বলি। এক রাতে ভয়াবহ এক স্বপ্ন দেখলাম।
বুঝলে, স্পষ্ট দেখলাম, জাকিয়ার মা খাটে বসে প্রবল বেগে পা নাচাচ্ছে। আমি তো ভয়ে কাঠ। ভয় চেপে কাঠ-কাঠ গলায় বললাম, জাকিয়ার মা, যাও তো, এমন বুড়ো একটা মানুষের মাঝ রাতে ঘুম ভাঙানো ঠিক না।
জাকিয়ার মা নাকি ঘুরে বলল, ইঃ, এক রাতের ঘুমের সমস্যায় মরে যাচ্ছে। আমি যে কতো কাল ঘুমাই না তা বুঝি কিছু না। আর তোমার শরীরে কী বিকট গন্ধ, আজকাল বিড়ি ধরেছ না কি! আসো আমার কাছে, বিড়ি খাওয়া বের করছি। বুঝলে ইয়াং মেয়ে, ভোর বেলায় উঠে দেখি ভয়ে আমার সব চুল ধবধবে সাদা। হা হা হা।
তিতলি ওদিন আন্তরিক ভাবে বলেছিল: চাচা আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে মনটা অসম্ভব ভালো হয়ে যায়।
জাকিয়া কেমন কুচুর-মুচুর করে মুড়ি চিবুচ্ছে। মুখ ভরা মুড়ির দলা নিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, ‘তিতলী, ওদিন বাবা কী বলল জানিস? ইয়ে জাকিয়া, তোর জন্য এবার তাহলে ছেলে-টেলে দেখতে হয়। বল দেখি কী লজ্জা। আমি মুখ-টুখ লাল করে বললাম, যা-ও বাবা, তুমি বড়ো ফাজিল।
না-না, তোর একটা পছন্দ-অপছন্দ আছে না, বাবা ঝকমকে চোখে বলছিলেন।
আমি তোমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না।
বাবার হাল ছেড়ে দেয়ার কোনো লক্ষণই নেই, জানি-জানি, এসব তোদের বলতে হয়। বিয়ের আগে তোর মাও বলেছিল, তুই বললি, তোর মেয়েও বলবে। আমি পালিয়ে যেতে চাইলাম, বাবা নিমিষে আমার হাত ধরে ফেললেন। আমি বাবার হাত থেকে বাঁচার জন্য বললাম, আচ্ছা যাও বাবা, তোমার পছন্দই আমার পছন্দ।
তাই? আমার যে বুড়োদের বড়ো পছন্দ। বাবার কী হাসি, একটা শিশুও লজ্জা পেয়ে যাবে।
তিতলির মনে হচ্ছে ঝালের তীব্রতায় চোখ কোটর ছেড়ে টুপ করে বাটিতে পড়বে। মুখ হাঁ করে লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। জাকিয়া ভয় পেয়ে গেল, ‘কী রে, খুব ঝাল?'
তিতলী একটু ধাতস্ত হয়ে বলল, ‘হুঁ।’
‘তুই কি একেবারেই ঝাল খাস না?’
‘হুঁ। শোন, বললে বিশ্বাস করবি না, আমাদের বাসায় কল্লোল ভাই একদিন আট-দশটা কাঁচা মরিচ কচকচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলল। আমি একটার এক কোনায় কামড় দিয়েছিলাম। মাগো, কী ঝাল!’
জাকিয়া মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল। এ মুহুর্তে তিতলির মুখখানা কেমন ঢলঢল করছে, চোখ কী কমনীয়! জাকিয়া বিস্ময় চেপে বলল, ‘কল্লোল ভাইটা কে?’
‘অ, তুই তো চিনিস না। ভাইয়ার বন্ধু, গাধার গাধা একটা। ওদিন ট্রাফিক জ্যামে আটকে বিরক্ত হচ্ছি। অলস ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। পেছনের রিকশায় দেখি কল্লোল ভাই। পাশের রিকশায় কী চমৎকার একটা মেয়ে, আমারই চোখ ফিরিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। অথচ কল্লোল ভাই একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল। দ্বিতীয়বার ভুলেও তাকাল না। কী গাধা, বল দেখি।’
‘ছি, তিতলী, ভাইয়ের বন্ধুকে কেউ এভাবে বলে!’
‘বলব, একশোবার বলব। লোচ্চা মার্কা ছেলে দেখে দেখে চোখ পচে গেছে, কী যে রাগ হয় জানিস। একদিন ভাইয়ার খোঁজে বাসায় এলো। ভাইয়া ছিল না। কল্লোল ভাই সোফায় গা এলিয়ে বসে ছিল। আমাকে দেখে লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল। আমি তো হতবাক। সামলে নিয়ে বললাম: প্লিজ কল্লোল ভাই বসুন, আমি তো আপনার অনেক ছোট।
কল্লোল ভাই লাজুক হাসলেন: আফটার অল তুমি মেয়ে, একজন লেডিকে সম্মান দেখাব না? আমি গল্প করার জন্য পাশে বসতেই মিছে ছল করে পাঁচ হাত দূরে সোফায় বসলেন। এমন মেজাজ খারাপ হল। চোখ মুখ শক্ত করে বললাম: কল্লোল ভাই, আপনার কী ধারণা আমার কুষ্ঠ রোগ আছে?’
জাকিয়া ফিচেল হাসি গোপন করার চেষ্টা করছে দেখে তিতলি চিড়বিড় করে বলল, ‘ষ্টুপিড, হাসছিস যে?’
জাকিয়া বুয়ার হাত থেকে চা’র কাপ নামাতে নামাতে যথাসম্ভব গম্ভীর মুখ করে বলল, ‘এখন কিন্তু আমি তোকে অসাধারণ একটা ছেলের খোঁজ দিতে পারি। ছেলেটার নাম হচ্ছে, কুমড়া, সরি, কল-।’
তিতলী চোখের পলকে জাকিয়ার চুল ধরে ফেলল।...
ওর মন অসম্ভব খারাপ। কেমন দমবদ্ধ ভাব হচ্ছে, ভাইয়া যে ওকে চড় মারল এ জন্যে না। ওদের পরিবারটা একটা অস্বাভাবিক পরিবার। সবাই যেন একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, একাকী। কারো সঙ্গে কারো প্রাণের যোগ নেই। মা’র থাকা না থাকা সমান। চিররুগ্না এই মহিলা বিছানা থেকে উঠতেই পারেন না। বিজয়নগরে এসে স্পীড কমাতে বাধ্য হল। ঢাকায় এই এক মহা সমস্যা। গাড়ি চালিয়েও সুখ নেই। স্পীড কমতে কমতে শূণ্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে। যথারীতি ট্রাফিক জ্যাম, রাগে হাত কামড়াতে ইচ্ছা করছে। গাড়ি এখানে ফেলে হেঁটে যেতে পারলে বেশ হত। এ অচিন্তনীয়, বাবা জ্যান্ত পুঁতে ফেলবেন।
সামনের ট্রাকটার পেছনে লেখা, একশো হাত দূরে থাকুন অথচ সাফারী নাক ঠেকিয়ে আছে। এইসব লেখা সম্ভবত নিয়ম হয়ে গেছে। একশো হাত দূরত্বে থাকতে হলে তো বাংলাদেশের জন্য পুরো এশিয়া লেগে যাবে। একবার বাসে উঠেছিল, নানা উপদেশ: বেবোহারে ভংশের পরিচয়, পকেট সাবদান, আপনার অভিযুগ চালককে বলুন। মজার ব্যাপার হল, চালক বাবাজী একের পর এক সিগারেট টেনে বাস অন্ধকার করে ফেলছিল।
তিতলী ফিক করে হেসে ফেলল। বাঁ পাশের ট্রাকটার ফুয়েল ট্যাঙ্কারে জ্বলজ্বল করছে: জন্ম থেকে জ্বলছি, মাগো। প্রচুর ট্রাকের গায়ে দেখেছে: আমাকে কিছু খেতে দিন। আরেক দিন এক ট্রাকের গায়ে দেখেছিল: আপনিও বাঁচুন, আমাকেও বাঁচতে দিন। যন্ত্রদানবের গায়ে কী বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য!
ওয়ারী পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে! ও এখন যাচ্ছে জাকিয়ার বাড়িতে। জাকিয়া ওর একমাত্র মেয়ে বন্ধু। একসঙ্গে অনার্স করছে। কী চমৎকার একটা মেয়ে, কখনও মলিন মুখ দেখে নি। হাজার জটিলতায়ও দেখেছে হেসে কুটি কুটি হতে।
জাকিয়াদের ছোট গেট দিয়ে খুব কায়দা করে গাড়ি ঢোকাতে হল। জাকিয়া বাগানে ফুলের চারা লাগাচ্ছিল। ধুলো কাদায় মাখামাখি হয়েও হাসি একটু মলিন হয়নি। এর ভাব দেখে মনে হচ্ছে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে কঠিন পরিশ্রম করা জলভাত। জাকিয়াকে এ মুহুর্তে দেখে ওর মন আরও বিষণ্ন হলো। কী সুখী একটা মেয়ে! বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না পৃথিবীর কোনো মালিন্য একে ছুঁতে পারে।
জাকিয়া মাথা সজোরে ঝাঁকিয়ে কপাল থেকে ঝাঁকড়া চুল সরাল। চারদিক আলো করে বলল, ‘ওমা, কী কান্ড, তুই, আয়-আয়। মোড়াটা টেনে বোস, না-কী চেয়ার এনে দেব।’
তিতলীর চোখ অজান্তেই ডবডবে, ‘প্লিজ জাকিয়া, তুই অন্তত আমার সঙ্গে এমন করিস না।’
জাকিয়ার বিস্ময়ের সীমা রইল না। তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে তিতলীকে জড়িয়ে ধরল। গলায় সমস্ত মায়া ঢেলে বলল, ‘এ্যাই পাগল, ঠাট্টা করলাম, বন্ধুর সঙ্গে ঠাট্টাও করতে পারব না। তবুও আমি সরি, খুব সরি। তারপরও রাগ না কমলে আয় আমরা চুলোচুলি করি। ভয় পাস নে, আমার দু’হাত পেছনে বাঁধা থাকবে।’
পরক্ষণেই ছিটকে সরে গেল। আধ হাত জিব বের করে বলল, ‘হায়-হায়, মাটি লাগিয়ে তোর সুন্দর ড্রেসটা নোংরা করে দিলাম।’
‘দিয়েছিস, বেশ করেছিস।’
জাকিয়া কচলে কচলে হাতের মাটি ধুয়ে মোড়া টেনে বসল, ‘তোর আজ খুব মন খারাপ, না?’
‘হুঁ।’
‘হয়েছে কী?’
‘জানি না, জাকিয়া, আসলেই জানি না। কিচ্ছু ভাল্লাগে না। আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে। কোথাও কোনো আনন্দ নাই, বাড়ির অবস্থা তো জানিস।’
‘পাগল না-কী, কি সব বলছিস।’
তিতলির মাথা নিচু হতে হতে হাঁটুতে ঠেকেছে। প্রাণপণ চেষ্টা করছে চোখের জল আটকাতে। জাকিয়ার উপর খুব রাগও হচ্ছে। এ মেয়েটার নিজের জীবনে কোনো সমস্যা নেই বলে এর ধারণা পৃথিবী নামের এ গ্রহটায় কারো কোন সমস্যা নেই।
জাকিয়া আলতো করে তিতলীর মাথায় হাত রেখে স্থির বিশ্বাসে বলল, ‘অসাধারণ কোনো ছেলের সঙ্গে যখন তোর পরিচয় হবে, দেখবি চারপাশ কী মায়াবীই না মনে হচ্ছে।’
তিতলি চোখ মুছে সোজা হল, ‘তুই খুঁজে পেয়েছিস মনে হচ্ছে?’
‘ইশ্শ্, হিংসুক।’
‘এ দেশে সব পাওয়া যায়। অসাধারণ ছেলে কোথায় পাওয়া যায়, বল। তুই-ই দে না একটা খুঁজে?’
‘আরে, এ বলে কী, এটা কী আলু-পটল, বাজার থেকে খুঁজে এনে দেব? এ্যাই, কিছু খাবি? বেশি করে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে মুড়ি বানাই।’
‘জলদি-জলদি।’
জাকিয়া জামবাটিতে মুড়ি বানিয়ে নিয়ে এসেছে। পেঁয়াজের ঝাঁঝে ওর টলটলে চোখ থেকে পানি গড়াচ্ছে। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে হাসতে হাসতে বলল, ‘বাবাকে দিয়ে এলাম এক বাটি। বাবা কী বলল জানিস? ইয়ে, জাকিয়া, তোর বন্ধুর সঙ্গে তুইও কী মুড়ি খাবি? না খেলে, তোর দাঁতগুলো একটু দিয়ে যা, আরাম করে মুড়ি খাই। হি হি হি। বাবাকে নিয়ে কী যন্ত্রণা, সারাটা দিন হাসিয়ে মারে!’
নিজের বাবার কথা মনে করে তিতলি দীর্ঘশ্বাস চাপল। রিটায়ার্ড জজ জাকিয়ার বাবাটা কী প্রাণবন্ত, এখনও হাসেন শিশুর মতো করে। এ সংসারে মাত্র দু’জন লোক। তিতলি একবার জাকিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল: হ্যাঁ রে, তোর বাবার কোন জিনিসটা তোর খারাপ লাগে?
জাকিয়া অনেকক্ষণ ভেবে বলেছিল: বাবা কাক-কোকিলের দরে বাজার করেন।
কী রকম?
ওই আর কী, সবাই বাবাকে ঠকায়।
ওদিন তিতলিকে উঠে যেতে দেখে জাকিয়ার বাবা ছদ্ম রাগে বলেছিলেন: এই যে, ইয়াং মেয়ে, চলে যাচ্ছ যে বড়, আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না বুঝি? ওহ-হো, তুমি বুঝি আমার রূপালী চুল দেখে ধন্ধে পড়ে গেছ। শোনো, চুলের গল্পটা তোমায় বলি। এক রাতে ভয়াবহ এক স্বপ্ন দেখলাম।
বুঝলে, স্পষ্ট দেখলাম, জাকিয়ার মা খাটে বসে প্রবল বেগে পা নাচাচ্ছে। আমি তো ভয়ে কাঠ। ভয় চেপে কাঠ-কাঠ গলায় বললাম, জাকিয়ার মা, যাও তো, এমন বুড়ো একটা মানুষের মাঝ রাতে ঘুম ভাঙানো ঠিক না।
জাকিয়ার মা নাকি ঘুরে বলল, ইঃ, এক রাতের ঘুমের সমস্যায় মরে যাচ্ছে। আমি যে কতো কাল ঘুমাই না তা বুঝি কিছু না। আর তোমার শরীরে কী বিকট গন্ধ, আজকাল বিড়ি ধরেছ না কি! আসো আমার কাছে, বিড়ি খাওয়া বের করছি। বুঝলে ইয়াং মেয়ে, ভোর বেলায় উঠে দেখি ভয়ে আমার সব চুল ধবধবে সাদা। হা হা হা।
তিতলি ওদিন আন্তরিক ভাবে বলেছিল: চাচা আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে মনটা অসম্ভব ভালো হয়ে যায়।
জাকিয়া কেমন কুচুর-মুচুর করে মুড়ি চিবুচ্ছে। মুখ ভরা মুড়ির দলা নিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, ‘তিতলী, ওদিন বাবা কী বলল জানিস? ইয়ে জাকিয়া, তোর জন্য এবার তাহলে ছেলে-টেলে দেখতে হয়। বল দেখি কী লজ্জা। আমি মুখ-টুখ লাল করে বললাম, যা-ও বাবা, তুমি বড়ো ফাজিল।
না-না, তোর একটা পছন্দ-অপছন্দ আছে না, বাবা ঝকমকে চোখে বলছিলেন।
আমি তোমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না।
বাবার হাল ছেড়ে দেয়ার কোনো লক্ষণই নেই, জানি-জানি, এসব তোদের বলতে হয়। বিয়ের আগে তোর মাও বলেছিল, তুই বললি, তোর মেয়েও বলবে। আমি পালিয়ে যেতে চাইলাম, বাবা নিমিষে আমার হাত ধরে ফেললেন। আমি বাবার হাত থেকে বাঁচার জন্য বললাম, আচ্ছা যাও বাবা, তোমার পছন্দই আমার পছন্দ।
তাই? আমার যে বুড়োদের বড়ো পছন্দ। বাবার কী হাসি, একটা শিশুও লজ্জা পেয়ে যাবে।
তিতলির মনে হচ্ছে ঝালের তীব্রতায় চোখ কোটর ছেড়ে টুপ করে বাটিতে পড়বে। মুখ হাঁ করে লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। জাকিয়া ভয় পেয়ে গেল, ‘কী রে, খুব ঝাল?'
তিতলী একটু ধাতস্ত হয়ে বলল, ‘হুঁ।’
‘তুই কি একেবারেই ঝাল খাস না?’
‘হুঁ। শোন, বললে বিশ্বাস করবি না, আমাদের বাসায় কল্লোল ভাই একদিন আট-দশটা কাঁচা মরিচ কচকচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলল। আমি একটার এক কোনায় কামড় দিয়েছিলাম। মাগো, কী ঝাল!’
জাকিয়া মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল। এ মুহুর্তে তিতলির মুখখানা কেমন ঢলঢল করছে, চোখ কী কমনীয়! জাকিয়া বিস্ময় চেপে বলল, ‘কল্লোল ভাইটা কে?’
‘অ, তুই তো চিনিস না। ভাইয়ার বন্ধু, গাধার গাধা একটা। ওদিন ট্রাফিক জ্যামে আটকে বিরক্ত হচ্ছি। অলস ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। পেছনের রিকশায় দেখি কল্লোল ভাই। পাশের রিকশায় কী চমৎকার একটা মেয়ে, আমারই চোখ ফিরিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। অথচ কল্লোল ভাই একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল। দ্বিতীয়বার ভুলেও তাকাল না। কী গাধা, বল দেখি।’
‘ছি, তিতলী, ভাইয়ের বন্ধুকে কেউ এভাবে বলে!’
‘বলব, একশোবার বলব। লোচ্চা মার্কা ছেলে দেখে দেখে চোখ পচে গেছে, কী যে রাগ হয় জানিস। একদিন ভাইয়ার খোঁজে বাসায় এলো। ভাইয়া ছিল না। কল্লোল ভাই সোফায় গা এলিয়ে বসে ছিল। আমাকে দেখে লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল। আমি তো হতবাক। সামলে নিয়ে বললাম: প্লিজ কল্লোল ভাই বসুন, আমি তো আপনার অনেক ছোট।
কল্লোল ভাই লাজুক হাসলেন: আফটার অল তুমি মেয়ে, একজন লেডিকে সম্মান দেখাব না? আমি গল্প করার জন্য পাশে বসতেই মিছে ছল করে পাঁচ হাত দূরে সোফায় বসলেন। এমন মেজাজ খারাপ হল। চোখ মুখ শক্ত করে বললাম: কল্লোল ভাই, আপনার কী ধারণা আমার কুষ্ঠ রোগ আছে?’
জাকিয়া ফিচেল হাসি গোপন করার চেষ্টা করছে দেখে তিতলি চিড়বিড় করে বলল, ‘ষ্টুপিড, হাসছিস যে?’
জাকিয়া বুয়ার হাত থেকে চা’র কাপ নামাতে নামাতে যথাসম্ভব গম্ভীর মুখ করে বলল, ‘এখন কিন্তু আমি তোকে অসাধারণ একটা ছেলের খোঁজ দিতে পারি। ছেলেটার নাম হচ্ছে, কুমড়া, সরি, কল-।’
তিতলী চোখের পলকে জাকিয়ার চুল ধরে ফেলল।...
No comments:
Post a Comment