(এই লেখা বয়স্ক মানুষদের জন্য না। অহেতুক তাঁদের সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।)
তিতলির বিরক্তির একশেষ। এর মানে কী? কল্লোলের আসার কথা চারটায় এখন বাজে প্রায় পাঁচটা। সময়ের কী কোন দাম নেই, একঘন্টা কিছুই না! আর বসে থাকার কোন মানে হয় না। উঠতে যাবে, চোখের কোন দিয়ে দেখল; ওই তো আসছে, আসছে ভুট্টা কমড়াতে কামড়াতে। তিতলি স্ধির চোখে চুপ করে দেখছে।
কল্লোল হাসিমুখে বলল, ‘ভুট্টা খাবে, প্রচুর ক্যালোরী?’
তিতলির খুব ইচ্ছা করছে খামচে একে ফালাফালা করে ফেলে। সামলে নিয়ে হিম গলায় বলল, ‘ভুট্টা ঘোড়া খায় আরাম করে, তুমি তো ঘোড়া না’, রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। এ কেমন কপকপ করে খাচ্ছে!
‘ঘোড়া খায় না ছাগল, সেটা কথা না। তুমি খাবে কিনা বলো, প্রচুর ক্যালোরি, শরীরের জন্য উপকারী,’ কল্লোল প্রবলবেগে মুখ চালাতে চালাতে বলল।
‘না তুমি খাও, ক্যালোরি তোমার প্রয়োজন। ঘোড়ার খাবার খেয়েই এ অবস্থা। তুমি তো নরকংকাল হিসাবে ভাল দামে বিক্রি হবে। মেডিকেল পড়ুয়া কারও সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখতে পারো।’
কল্লোল ঠিক ধরতে পারছে না এর রাগের কারণ। ভুট্টা কী এতই খারাপ জিনিস, ফেলে দেবে? দশ টাকা দিয়ে জাম্বো সাইজ দেখে কিনেছে, মাত্র চার ভাগের একভাগ খাওয়া হয়েছে। আমতা আমতা করে বলল, ‘ইয়ে তিতলি, এটা ফেলে দেব?’
‘যা খুশি কর, আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন!’
‘জাস্ট এক কামড় দিয়ে ফেলে দেব।’
তিতলি পণ করেছিল হাসবে না। এর এক কামড়ের নমুনা দেখে সব ভেসে গেল। ও চাচ্ছে এক কামড়ে যেন ভুট্টার একটা বিচিও না থাকে। কল্লোল ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঘটনা কি?’
তিতলি মুখের হাসি ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিল। রাগ-রাগ গলায় বলল, ‘কেন, তুমি জান না।’
‘বারে, কি জন্যে রেগে আছ আমি জানব কী করে, আমি কি এস্ট্রডমাস!’
‘তোমার ঘড়িতে ক’টা বাজে?’
‘ক’টা বাজে?’
‘দেখ, দেখলেই হয়।’
‘আমার তো ঘড়ি নাই, নাই মানে পরি না আর কি।’
‘চমৎকার, দারুন তো। ঘড়ি পরা হয় না। সূর্য-চন্দ্র দেখে সময় বলা হয়। তুমি দেখি বিরাট প্রতিভা।’
‘আসলে ঘড়ির প্রয়োজনই হয় না। ধরো, একজন অন্যজনকে জিজ্ঞেস করল, ক’টা বাজে? ব্যস আমি জেনে গেলাম। তারপর ধরো, পাশে একজন বসে আছে বা বাসের হ্যান্ডেল ধরে বাদুর ঝুলে আছে, চট করে দেখে ফেললাম কটা বাজে। এই ধরো, তোমার ঘড়িতে এখন বাজে পাঁচটা তিন। জিয়াউর রহমানের মানি ইজ নো প্রব্লেম, আমার ঘড়ি ইজ নো প্রব্লেম।’
‘ধরো-ধরো, এত কী ধরাধরি। প্রত্যেক বাক্যে একবার ধরো বলছ,’ তিতলি এবার পলক না ফেলে বলল, ‘এভাবে তুমি মেয়েদের হাতের ঘড়ি দেখে সময় জেনে যাও।’
‘হুঁ, এ আর কী।’
তিতলির মুখ শক্ত, চোখ শীতল, ‘শোনো কল্লোল, আজকের পর তুমি আর আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবে না।’
কল্লোল হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তিতলি এসব কি বলছে! ও এমন নিষ্ঠুর করে বলতে পারল, ‘তিতলি, এই সব কী!
'যা বলার বললাম। একই কথা বারবার বলতে চাচ্ছি না।'
বেশ, তুমি না চাইলে আর কখনও যোগাযোগ হবে না।’
তিতলির সব কেমন ওলট-পালট হয়ে গেল। কল্লোল কী অবলীলায়ই না বলে ফেলল। এ সম্ভবত কোনো দিনই জানবে না এর জন্য তিতলির রয়েছে কী অপার্থিব ভালবাসা! ওর সুতীব্র এই ভালবাসার কথা কল্লোল কী কোন দিনই জানবে না? তিতলি কি বলবে বুঝে পেল না, চোখের পলকে কল্লোলকে জাপটে ধরে ফেলল, ‘এভাবে বলো না, আমি মরে যাব, আমি মরে যাব...।’
কল্লোল ভারী বিব্রত হচ্ছে। জোর খাটিয়েও একে ছাড়াতে পারছে না, তিতলি যে ভাবে ধরে আছে এ চেষ্টা বৃথা। তিতলির কোমল শরীর ক্রমশ সহ্যাতীত উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। কী কান্ড, একজন মায়াবী নারী এমন করে ধরে থাকলে চারপাশটা বুঝি এমন বদলে যায়! এ কুৎসিত গ্রহটা তখন কী এমনই মায়াবী, অসাধারণ মনে হয়! এর নাম তাহলে ভালবাসা! কল্লোল ঢোক গিলে বলল, ‘ছাড়ো-ছাড়ো।’
‘না।’
‘কী সব কান্ড, লোকজন দেখলে কী ভাববে! ’
‘ভাবুক, প্রমিজ করো, এমন করে কখ-খনও বলবে না।’
‘তুমি যে ওভাবে বললে এতে বুঝি দোষ হয় না। আমার রাগ হতে নেই?'
‘তুমি অন্য মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাক। মেয়েদের হাতের ঘড়ি দেখে সময় জেনে নাও।’
‘পাগল, এই ব্যাপার তাহলে! ঠিক আছে আর তাকাব না। এখন ছাড় তো।’
‘ছাড়ব না, কি করবে তুমি?’
‘বেশ, কিন্তু তোমার ইয়ে যে চ্যাপ্টা হচ্ছে সে খেয়াল আছে।’
তিতলি তীব্র গতিতে সরে গেল, ‘তুমি একটা ছোটলোক কল্লোল, তোমার মনে কু আছে ।’
কল্লোল ছদ্ম নিঃশ্বাস ফেলল, ‘আহ, ছোটলোক হতে পারলে বেশ হত। কী নির্বোধ আমি।'
‘ছি, কী নোংরা করে কথা বল, অসভ্য।’
অনেকক্ষণ পর কল্লোল থেমে থেমে বলল, 'তোমাকে যেটা প্রাণপণ চেষ্টায় বুঝাতে পারছি না। সেটা হচ্ছে, যেটা তুমি বুঝেও বুঝতে চাচ্ছ না। আমাদের এভাবে মেলামেশার কোন অর্থ হয় না। আমরা দু’জন দু’ভূবনের বাসিন্দা। আমি শালা সব বুঝেও তোমাকে এড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারি না। খুব রাগ হয়, আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিলে অযথাই। তিতলি আমরা কি পারি না পরস্পরকে ভুলে যেতে, অন্তত চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। আমরা যদি -।’
কল্লোলের কথা শেষ হল না তিতলি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ওর শার্ট ধরে প্রবল বেগে ঝাঁকাচ্ছে। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। যখন মুখ তুলল কল্লোলের অন্যরকম কষ্ট হতে থাকল। বড় বড় চোখ করে কী এক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে, এ চোখকেই কি শরবতী চোখ বলে? কী টলটলে এর চোখ- বিষন্ন, মায়াভরা!
তিতলি নিস্তেজ গলায় বলল, ‘আমার অসৎ বাবার অঢেল টাকা আছে এটাই কি আমার অপরাধ, অযোগ্যতার মাপকাঠি। শুধুমাত্র এ জন্য তুমি আমাকে বলতে চাইছ, এ গ্রহের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার হাত ছেড়ে দিতে? দিনে একশোবার ভালবাসি ভালবাসি বললেই ভালবাসা হয়, নইলে হয় না?’
কল্লোল স্তব্ধমুখে বসে রইল। তিতলির এ জটিল প্রশ্নের উত্তর কি হয় কে জানে!
*তিতলি তুমিও: ১
No comments:
Post a Comment