যে যার বিশ্বাসমতে পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনার সময়, কাউকে হত্যা করার মত জঘণ্য কাজ আর কিছু হতে পারে না।
আমি কোথাও লিখেছিলাম, "মানুষ যেহেতু প্রাণ সৃষ্টি করতে পারে না তার কোন অধিকার নাই কারও প্রাণ নেয়ার, এমন কি নিজেরও"।
কিন্তু যারা প্রার্থনাস্থলে হামলা চালায় এই সব দানবদের মেরে ফেলতে হবে, চোখের পলক না ফেলে। আমার এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, মানুষ নামের কোন দানব এমন কান্ড করতে পারে!
তারচেয়েও বেশি আমি এটা পড়ে স্তম্ভিত, হতভম্ব। আমাদের কিছু কম্যুনিটি ব্লগ নামের সো-কলড দেশপ্রেমের চাদর গায়ে দেয়া দেশপ্রেমিকরা এই বর্বরোচিত হত্যা নিয়ে উল্লাস করেছে, রসিকতা করা হয়েছে!
কেন? আর কিছু না, এদের বক্তব্য, এই পাকিস্তানিরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের উপর ভয়াবহ অন্যায় করেছে। উল্লাসটা এর শোধ! আমি নিজে যদি এটা না পড়তাম তাহলে বিশ্বাস করতাম না, আমার দেশের মানুষ এতোটা হৃদয়হীন হতে পারে!
এরা কারা? এরা কি ৭১-এর পরবর্তী কাল্পনিক মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ করা 'নব্য মুক্তিযোদ্ধা'? যারা স্বঘোষিত দেশপ্রেমিক(!)। দেশপ্রেমিক, হাহ, এত্তো সোজা? এটা কি মুড়ি-মুড়কি যে বাজারে কেজি দরে বিক্রি হয়? দেশপ্রেমিক কাকে বলে এই মানুষটাকে দেখে শেখেন [২]।
এখন মুক্তিযুদ্ধটা একটা ফ্যাসানের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আসল মুক্তিযোদ্ধা, দুধর্র্ষ নৌকমান্ডো এখন ঠেলা চালান [৩], একজন ট্যাংকমানব [৪] আকাশপানে তাকিয়ে হাহাকার করেন। আর যারা এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা হয় একাত্তরে গর্তে লুকিয়ে ছিলেন নয়তো তখন জন্মই হয়নি। এরাই এখন বড়ো দেশপ্রেমিক সাজেন, ভার্চুয়াল ভুবন কাঁপিয়ে তোলেন।
এরা গালির বন্যা বইয়ে দেন। দেশপ্রমিক(!) সাজার জন্য কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করার নিয়ম আছে। অন্যের মা, প্রকারান্তরে নিজের মাকে নিয়েই কুৎসিত ভাষায় আক্রমন করারও প্রয়োজন আছে। যে গালিগুলো দিতে এই গ্রহের অতি নোংরা মানুষগুলোও দ্বিতীয়বার ভাববে এরা এখানে এসে অবলীলায় বলেন।
আমার পূর্বে ধারণা ছিল, এই অসভ্য মানুষগুলো অসুস্থ, এদের চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এরা চিকিৎসার বাইরে।
আসলে আমরা বড়ো গুজুগে জাতি [৫]। বিশ্বকাপের আবেগে একটা পতাকা নাহয় লাগালামই কিন্তু একজন ১০ গজ কাপড়ের লাগাচ্ছে তো অন্যজন ২০ গজ কাপড়ের পতাকা! অথচ আমি নিজের চোখে দেখেছি, সরু বাঁশের ঝাড়ুর উল্টোদিকে স্বাধীনতা দিবসে আমাদের বিবর্ণ পতাকা লাগাতে!
একজন মুক্তিযোদ্ধার উদাহরণ দেই। তার সনদ-সার্টিফিকেটের বহর দেখে আমার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। কয়টা না, বলুন কয় শো।
অথচ যুদ্ধের সময় এর বয়স ছিল খুব জোর সাত। শেলের একটা টুকরা পড়ে এর নিম্নাঙ্গ উড়ে যায়। একে চিকিৎসার জন্য ভারতে নেয়া হয় এরপর রাশিয়ায়। এটাকে পুঁজি করে এ একের পর এক সার্টিফিকেট যোগাড় করেছে। এখন তাকে মুক্তিযোদ্ধাসংক্রান্ত যে কোন সভায় সামনের কাতারে পাওয়া যায়। যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা এ ভোগ করছে, প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত!
আচ্ছা, এই শিক্ষাটা এরা কোত্থেকে পেল? গোটা একটা দেশকে, গোটা একটা জাতিকে ঘৃণা করার? একাত্তরের কি পাকিস্তানের সমস্ত মানুষ মিলে আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল? আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি আর্মি, গুটিকয়েক মানুষের নির্দেশে।
এরা কেন আমেরিকাকে একই ঘৃণা করতে আগ্রহ বোধ করে না- আমেরিকায় যাওয়ার কথা আসলে দেখি লালায় পা ভিজে যায়!
আসলে আমাদের শিক্ষায় গলদ আছে, একজন প্রফেসর সাহেব করেন বাথরুম উদ্বোধন [৬] করেন, মিডিয়া আমাদের ঘটা শেখায় কেমন করে একটা লাশকে [৭] অপমান করতে হয়। বিশেষ মাসে কেমন করে আয়োজন করে [৮] কাঁদতে হয়!
পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশের সৈনিকদেরই গড়ে তোলা হয় একেকটা রোবট হিসাবে। এদের নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলতে কোন শব্দ থাকে না। নির্ভর করে তার কমান্ডারের কমান্ডের উপর [৯]। এদের ঘিলুর ব্যবহার করার অধিকার হরণ করা হয়!
আমরা নিজেরা কি করেছি? বিভিন্ন সময়ে আদিমানুষদের বিরুদ্ধে আমাদের সুসজ্জিত আর্মি লেলিয়ে দিয়েছি। আমরা নিজেরাও এদের ভুবন তছনছ করে দিয়েছি [১০]। কিন্তু এই দেশের সবাই কি এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত?
এখন এটা কেমন হবে, আদিমানুষরা যখন এই দেশের সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা লালন করবে। আমাদের মা-রা যখন হাহাকার করে কাঁদবে এরা দাঁত বের করে হাসবে! এরা কি এদের সন্তানদের এই শিক্ষা দিয়ে বড়ো করবে এই দেশের আপামর জনগণের প্রতি ঘৃণা নিয়ে বেড়ে উঠো।
এরাও কি রোপণ করবে আমাদের মতো করে একেকটা বিষবৃক্ষ [১১]?
এটা সত্য, আমরা অভাগা-নপুংসক, পাকিস্তানি আর্মিদের নৃশংসতার বিচার করতে পারিনি। এও সত্য পাকিস্তান এখনও তার কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়নি- অবশ্য পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ নতজানু হয়েছেন।
পাকিস্তানিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার আমাদের খুব একটা চেষ্টা ছিল এমনটা বলা চলে না। পাকিস্তানি প্রাইম মিনিস্টার যখন আমাদের দেশে আসেন তখন আমরা লেজ নাড়তে নাড়তে তাকে স্মৃতিসৌধে নিয়ে যাই। এটা তো প্রটোকলের পর্যায়ে পড়ে না! তখন আমাদের এই সব দেশপ্রেমিকরা কই থাকেন? তখন সবাই অন্তত বুকে কালো ব্যাজ লাগিয়ে ঘৃণার প্রকাশটা করেন না কেন?
কেউ কেউ বলার চেষ্টা করবেন, এটাও আমাদের কম অর্জন না যে তাকে আমরা স্মুতিসৌধে নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করিয়েছি। আমার মত হচ্ছে, অন্যায় স্বীকার না করে কেবল দেখাবার জন্য এই নাটকের প্রয়োজন নাই।
ভার্চুয়াল ভুবনে দেশপ্রেমিক সাজা খুব সোজা কারণ এখানে গায়ে আঁচড়টিও লাগে না। আরও সোজা প্রবাসে বসে বসে দেশউদ্ধার করলে, ধর্ম নিয়ে লম্বালম্বা বাতচিত করলে। ওহে, নব্য মুক্তিযোদ্ধা, বৈদেশে না থেকে দেশে এসে দেশউদ্ধার করেন না কেন?
ধর্মের নামে দেশ রসাতলে যাচ্ছে, এটা দেশে এসে কোন এক জুম্মাবারে কোন মসজিদে দাঁড়িয়ে মুখ থেকে আগুন বর্ষন করুন, তবে বলসগুলো বাড়িতে রেখে আসবেন এই আমার পরামর্শ কারণ পরে এগুলো খুঁজে পাবেন না।
এদের শিক্ষাটাই এমন, বিষবৃক্ষ গাছে বিষবৃক্ষই ধরবে, জয়তুন ফল ধরবে না। আমাদের যে এসব শেখানো হচ্ছে অহরহ- যেসব মানুষগুলো একটা লাশকে সম্মান করতে জানে না তাদের কাছ থেকে এই সব অমানবিক আচরণ পাওয়া যাবে এ আর বিচিত্র কী!
৭১-এ পাকিস্তানি যে মানুষটা এই দেশে ভয়ংকর অপরাধ করেছে, ৩৯ বছর কেন ৩৯০ বছর পরও আমি তার বিচার চাইব কারণ রক্তের দাগ মুছে ফেলা যায় না [১২]। কিন্তু এই মানুষটারই মা যখন আকাশ ফাটিয়ে কাঁদবে, ওই মাটার সঙ্গে আমিও কাঁদব। এটা আমার ব্যক্তিগত কান্না।
আমার এই কান্নার জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করার আগ্রহ প্রকাশ করি না। আপনাদের মতো মুক্তিযুদ্ধের এমন আবেগেরও [১৩] আমার প্রয়োজন নাই।
সহায়ক লিংক:
১. দানব: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_15.html
২. দেশপ্রেমিক যারা: http://www.ali-mahmed.com/2009/10/blog-post_06.html
৩. মুক্তিযোদ্ধা, একজন ঠেলাওয়ালা: http://www.ali-mahmed.com/2009/04/blog-post_18.html
৪. মুক্তিযুদ্ধে একজন ট্যাংকমানব: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_03.html
৫. হুজুগে বাংগাল: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_25.html
৬. বাথরুম উদ্বোধন: http://www.ali-mahmed.com/2009/12/blog-post_20.html
৭. মিডিয়া- লাশ: http://www.ali-mahmed.com/2010/01/blog-post_28.html
৮. মিডিয়ার আয়োজন করে কান্না: http://www.ali-mahmed.com/2009/12/blog-post_18.html
৯. রোবট, আমি এখনই মরতে চাই না: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_15.html
১০. আদিমানুষ, পড়ো আমাদের নামে: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_23.html
১১. বিষবৃক্ষ গাছ: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_6667.html
১২. রক্তের দাগ: http://www.ali-mahmed.com/2010/01/blog-post_18.html
১৩. মুক্তিযুদ্ধের আবেগ: http://www.ali-mahmed.com/2009/10/blog-post_07.html