সাবা বলল, ভাইয়া, যুনিপা এসেছে।
রেজা বিরক্ত মুখে বসার ঘরে বসতে বললেও মনের চাপা আনন্দ লুকিয়ে রাখতে পারছে না। এর মানে কী! এমন হবে কেন? প্রত্যেকবার কঠিন প্রতিজ্ঞা করে যুনিকে কঠিন কিছু কথা বলবে কিন্তু ও সামনে এলে সব কেমন গুলিয়ে যায়! কেন হয় এমন? কী আশ্চর্য, তখন পৃথিবীর সমস্ত বিধিনিষেধ তুচ্ছ মনে হয়।
যুনির সঙ্গে পরিচয়টা হয়েছিল খানিকটা অন্য সূত্রে। ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে রেজা পড়াশোনাটাও চালিয়ে যাচ্ছিল। সেবার ও প্রাইভেটে মাস্টার্স ফাইনাল দিচ্ছে। একদিন বাসায় অপরিচিত একজন মানুষ এলেন। ফর্সা, চোখে কালো চশমা, হাঁটেন লাফিয়ে লাফিয়ে, যেন কাউবয়! হড়বড় করে বললেন, আপনিই রেজা সাহেব?
রেজা বলল, জ্বী।
আপনি এবার প্রাইভেটে মাস্টার্স দিচ্ছেন?
রেজা এবার খানিকটা বিরক্ত। বিরক্তি চেপে বলল, জ্বী।
এইবার ওই মানুষটা রেজার হাত ধরে বললেন, ভাই, আমাকে একটা ফেভার করবেন। না বলবেন না, প্লিজ। আমার বউও এবার মাস্টার্স দিচ্ছে। আমি খোঁজ নিয়েছি আপনাদের প্রায় সাবজেক্টই কমন। আপনি যদি দয়া করে নোট-টোট দিয়ে সহায়তা করতেন। না-না, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, ওই এসে আপনার এখান থেকে যা যা লাগে নিয়ে যাবে, আবার সময় করে ফেরত দিয়ে যাবে। না করবেন না, প্লিজ। আমার তো কঠিন অফিস, ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় নইলে আপনাকে কষ্ট দিতাম না।
ওই মানুষটার বউ হচ্ছে, যুনি। এরপর থেকে যুনি সহজ ভঙ্গিতে আসা-যাওয়া শুরু করল। একটুও জড়তা নেই। মাকে অবলীলায় খালাআম্মাজান ডাকা শুরু করল। সাবার সঙ্গে খুব খাতির। রেজাকে তুমি বলা শুরু করল। একবার আসলে আর যাওয়ার নাম নেই।
একদিন বেশ একটু রাত হয়ে গেল। সাবা না খাইয়ে ছাড়বে না। রেজার মার চোখে স্পষ্ট বিরক্তি। তিনি বিরক্তি নিয়েই বললেন, একা একা যাবে কেমন করে, তুই রিকশায় করে দিয়ে আয়।
যুনি রিকশার হুড উঠিয়ে দিল। সরে বসার জায়গা নেই, উরু ছুঁয়ে আছে। তারপরও রেজা সরে বসার চেষ্টা করতে গেলে যুনি খসখসে গলায় বলল, আহ, নড়াচড়া করছো কেন!
ঢিমেতালে রিকশা এগুচ্ছে। প্রচন্ড ঠান্ডা হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। জমাট কুয়াশা। তিন হাত দূরের কিছুও দেখা যাচ্ছে না। যুনি তার সমস্ত শরীর দিয়ে ধরে রেখেছে। ক্রমশ যুনির শরীরের উত্তাপ রেজার শরীরে ছড়াচ্ছে। রেজা ঘোরলাগা চোখে কাঠ হয়ে বসে রইল। ওর মাথা কাজ করছিল না, শরীরে এক অন্য রকম ভাঙ্গচুর।
যুনি রিকশা থেকে নেমে গটগট করে বাসার ভেতর চলে গেল। রেজাকে ভেতরে আসতে বলা দূরের কথা ফিরেও তাকাল না।
পরদিন রাস্তায় যুনির স্বামী জুবায়ের সাহেবের সঙ্গে দেখা। তিনি মুখ হাসি-হাসি করে বললেন, ভাই, আমি কিন্তু আপনার উপর রাগ করেছি। ওদিন বাসায় এসেও ভেতরে আসলেন না। এতো রাতে কষ্ট করে ওকে দিয়ে গেলেন কিন্তু আমাকে একটা ধন্যবাদ দেয়ার সুযোগও দিলেন না।
রেজা পূর্ণদৃষ্টিতে মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করছিল। এই মানুষটা কী ওকে অন্য কিছু বলার চেষ্টা করছেন, মিয়া, তুমি এতো রাতে আমার বৌকে পৌঁছে দিয়ে পালিয়ে গেলে কেন? নিশ্চয়ই তোমার মনে কু আছে!
এখন বসার ঘরে যুনিকে দেখে রেজা ধাক্কার মত খেল। কামিজ পরাতেই কিনা কে জানে একে কিশোরী-কিশোরী লাগছে। কিন্তু চোখের নীচে গাঢ় কালি, অসুখ করেছে নাকি? কী ভাঙ্গাচোরাই না দেখাচ্ছে! রেজা দুঃখিত হয়ে বলল, যুনি!
যুনি ম্লান গলায় বলল, উঁ।
কি হয়েছে তোমার?
কিছু না।
বললেই হলো, তোমাকে ঝড়ো কাকের মতো দেখাচ্ছে।
দেখাক। আমি দেখতে কুৎসিত, আরও কুৎসিত দেখালে তোমার তো কোন সমস্যা নাই।
এবার রেজা হাসল, তুমি যে অসম্ভব রূপবতী এটা সম্ভবত জানো না, তোমার কেবল দোষ দেই কেমন করে। বেশীরভাগ রূপবতীই অবশ্য এটা জানে না।
যুনি এবার কঠিন গলায় বলল, এই সব কথা বলে আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করবে না। আমি খুকি না। এইবার বলো এতোবার তোমাকে খবর দিলাম, তুমি দেখি একবার যাওয়া দূরের কথা, খোঁজও নিলে না, আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি এটাও জানার চেষ্টা করলে না!
রেজা বিব্রত হলো, আমি সরি, যুনি। খুব ঝামেলা গেল ক-দিন। প্লিজ মনে কষ্ট পুষে রেখো না। সরি এগেইন। তা তুমি আমাকে খুঁজছিলে কেন?
যুনি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, রেজা-রেজা, আমি আর পারছি না। এখানে আর কিছুদিন থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব।
রেজা অবাক, কিসব বলছ, কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
যুনি থেমে থেমে বলল, রেজা, আমি-আমি, আমি না, জুবায়েরের সঙ্গে থাকতে পারছি না। সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওকে ডিভোর্স দেব।
রেজার অজান্তেই গলার স্বর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল, ক্কি, কি, কি বলছ এই সব পাগলের মতো। গড!
ঠিকই বলছি। আ ওয়্ন্ট আ বেবি, জুবায়ের কোন দিন এটা আমাকে দিতে পারবে না। আমি এখন আর ওকে সহ্য করতে পারছি না। দেখো, কোন একদিন ভয়ংকর কোন একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলব।
রেজার এটা জানা ছিল না। শুনে খানিকটা অবাকই হলো যদিও কারণ যুনি কখনও এই বিষয়ে বলেনি, আভাসও দেয়নি। তাছাড়া অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে ওর আগ্রহ খুব কম। ওর ধারণা ছিল, অনেকেই তো দেরী করে বাচ্চা নেয় এরাও হয়তো দেরী করছে। আসলে এ নিয়ে তেমন করে কখনো ভাবেনি।
সামলে নিয়ে রেজা বলল, ধুর পাগল, তাই বলে ডিভোর্স দিতে হবে বুঝি, পৃথিবীতে এমন কতই তো হয় যাদের সন্তান হয় না, নিঃসন্তান।
রেজা শোনো, অন্যরা কি করছে এ নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই, যা খুশী করুক। আমি একটা বাচ্চা চাই, ব্যস।
যুনি, তুমি এক কাজ করো না কেন, একটা শিশু দত্তক নিয়ে নাও না কেন। একটা পূণ্যও হলো, তোমারও একটা গতি হলো।
যুনি চেঁচিয়ে বলল, চুপ, আমার নিজের সন্তান আর রাস্তার ছেলে এক হলো!
আহা, শান্ত হও, কুল।
যুনি এবার স্থির গলায় বলল, আচ্ছা শোন, আমি তোমাকে যে জরুরী কথাটা বলতে এসেছিলাম, ফাজলামী না করে মন দিয়ে শুনবে। জুবায়েরকে আমি ডিভোর্স দেব এটা ক্লিয়ার। এখন তোমার কি মত বলো?
রেজা অবাক হলো, এটা তোমাদের পারিবারিক বিষয় এখানে আমার মতের কথাটা আসছে কেন?
কেন আসছে তুমি জানো না?
না, জানি না! প্লিজ, আমাকে বুঝিয়ে বলো।
রেজা, তুমি বাচ্চা না। দয়া করে বাচ্চার মতো আচরণ করবে না। তোমার মতটা বলো।
আমার আবার কী মত, আশ্চর্য!
যুনি এইবার পাগলের মত হয়ে গেল, না, তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত কিছু না বলবে আমি ততক্ষণ এখান থেকে একচুল নড়বো না।
প্লিজ যুনি, বাসায় যাও। কোন কারণে তোমার মন বিক্ষিপ্ত...।
যাওয়ার আগে যুনি রগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ইয়্যু ডার্টি কাওয়ার্ড, আর কখখনো আমার বাসায় আসবে না। আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করবে না। তোমাকে দেখে আমার বমি আসছে।
যুনি যাওয়ার পর রেজা হাত পা ছড়িয়ে বসে রইল। ওর মাথা এই মুহূর্তে কাজ করছে না। যুনির স্বামীটি বেকুব নাকি, এর কী এই সব জটিলতা চোখে পড়ছে না! এ কেন এখান থেকে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে না। নাকি...?
সহায়ক লিংক:
নিষিদ্ধ জোৎস্না, ২: http://www.ali-mahmed.com/2010/04/blog-post_9463.html
নিষিদ্ধ জোৎস্না,১: http://www.ali-mahmed.com/2010/04/blog-post_5922.html
No comments:
Post a Comment