Search

Tuesday, June 29, 2010

বৈদেশ পর্ব: সাত

বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন আমাকে আটকে দিল। এরা আমার পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে বলল, আসেন আমার সঙ্গে।
আমি মনে মনে বলি, হে পরম করুণাময়, ড্রেনটা কেন রাস্তার মাঝখানে এসে পড়ে! কারণ আমার অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর না। সালটা সম্ভবত ৮৪, সার্ক দেশগুলো ঘুরতে বেরিয়েছি। ঠিক এমন করেই ইমিগ্রেশনে আমার পাসপোর্টটা নিয়ে গেল। গেল তো গেল, ব্যাটাকে আর খুঁজে পাই না। আমার সঙ্গি যিনি ছিলেন তাঁর পাসপোর্টটাও নিয়ে গেছে। তিনি সেসময় ওই বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন টাকার বিনিময়ে।

এবার আমার কপালে দুর্ভোগ আছে কারণ 'স্পীড মানি' নামের ঘুষ তো আমি দেব না। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো তার পদস্থ কর্মকর্তার কাছে। আমি পুলিশ-আর্মির পদবির ব্যাজ নাট-বল্টু মনে রাখতে পারি না তবে অনুমান করি এই ভদ্রমহিলার পদবি এ.সি। এই ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করছিলেন যথেষ্ঠ মার্জিত ভঙ্গিতে।
'আপনি তাহলে জার্মান যাচ্ছেন'?
'জ্বী'।
'কি, প্লেজার ট্রিপে'?
আমি কেন যাচ্ছি বিস্তারিত বলার পর এই ভদ্রমহিলা আন্তরিক ভঙ্গিতে কিছু সদাশয় কথা বললেন, আরে, এ তো আমাদের দেশের জন্য একটা অতি চমৎকার সংবাদ ইত্যাদি। তারপর বললেন, 'যে ডেস্কে আপনি দাঁড়িয়ে ছিলেন ওখানে ফিরে যান। আমি বলে দিচ্ছি। কোন সমস্যা হবে না'।
আমি খানিকটা হোঁচট খেলাম। পুলিশ-টুলিশ টাইপের কারও মুখে এমনটা শুনব অন্তত এটা আশা করিনি! মনটা ভাল হয়ে যায়, অভিমান নিয়ে [১] আমার দেশত্যাগের বিষণ্নতা নিমিষেই নিস্প্রভ হয়ে আসে।

অন্যরা যেমন একজন চীনাম্যানের সঙ্গে অন্য একজন চীনাম্যানের চেহারা আলাদা করতে পারেন না তেমনি আমিও একজন ইউনিফর্মধারীর সঙ্গে অন্য একজন ইউনিফর্মধারীকে আলাদা করতে পারি না। তবুও আমি প্রায় নিশ্চিত, আমি ঠিক ডেস্কের সামনেই এসে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু ওই ডেস্কে বসা মানুষটি ষাড়ের মত চেঁচিয়ে উঠলেন, 'ন-আ-আ, আমার এখানে না'
আমার সঙ্গে সঙ্গে ওই ভদ্রমহিলাও হতভম্ব। আমি ওই ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'এটা কি হলো? হতে পারে আমার ভুল হয়েছে, তাই বলে তিনি এমন করে চেঁচাচ্ছেন কেন'? 
ভদ্রমহিলা বিব্রত, বিড়বিড় করে বলছেন, 'এ পাগল নাকি, দেখছে তার সিনিয়র বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে'!
আমি ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম, 'একটা এয়ারপোর্টই প্রথম একটা দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। এখানকার একজনের আচরণ গোটা দেশ সম্বন্ধে অন্যকে বাজে ধারণার জন্ম দেয়। এটা খুব বাজে হলো, খুব বাজে'।
ভদ্রমহিলা নীচু স্বরে বলছেন, 'আসলে বুড়া মানুষ, অনেকক্ষণ ধরে লাগাতার ডিউটি করছেন। আমি রিপোর্ট করলে, তার বাচ্চা-কাচ্চা...বোঝেনই তো'।
আমি বললাম, 'এটা তো কোনো ব্যাখ্যা হলো না! বুড়া মানুষ, লাগাতার ডিউটি! এমনটা হলে এদের এখানে না বসালেই হয়'।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন।
আমাদের দেশের পুলিশ-টুলিশ টাইপের লোকজন দুঃখ প্রকাশ করেন এই অভিজ্ঞতাও আমার কাছে নতুন! আমি ক্রমশ ভুলে যাই চোরের মত দেশত্যাগের বেদনা।

আমি এয়ারক্রাফটের ক্ষুদ্র জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। সেই পূর্বের মতই বিচিত্র অনুভূতি হয়, যে মেঘগুলো সর্বদা মাথার উপর সগর্বে ঘুরে বেড়ায় সেই মেঘগুলো এখন আমার পায়ের নীচে! 
আবার কী বিশালই না মনে হয় গোটা বিশ্বটাকে। অন্য ভুবনের এই দৃশ্যটার নীচে শত-শত কোটি মানুষ কী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েই না হরদম অহেতুক লড়ে যাচ্ছে! আফসোস, একটাই জীবন আমাদের, কোনো অর্থ হয় না এর...। 

যাচ্ছি এমিরাটসে। টিকেটটা কাটা হয়েছে জার্মানি থেকে। সদাশয় একজন মানুষ, আরাফাতুল ইসলাম আমাকে আগেই বলে দিয়েছিলেন, আপনি ঢাকা থেকেই দুবাই হোটেলের কনফার্মেশনটা করে নেবেন নইলে আপনার কষ্ট হবে। 
দুবাই এয়ারপোর্টে আট ঘন্টা স্টপওভার ছিল। ওখান থেকে কানেকটিং ফ্লাইটে ডুজলডর্ফ। নিয়ম অনুযায়ী আট ঘন্টা স্টপওভারের কারণে আমার জন্য হোটেলের ব্যবস্থা করার কথা। এমিরাটসের ঢাকা অফিস থেকে কনফার্ম করে হোটেল কূপন আমি সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। এটা করতে গিয়ে বিস্তর ঝক্কি পোহাতে হয়েছে!

দুবাই এয়ারপোর্ট নামার পূর্বেই এয়ারক্রাফটের জানালা দিয়ে রাতের দুবাই শহরটা দেখছিলাম। এরা যে আলোর কী অপচয় করে এর নমুনা দেখে আমার বুকের গভীর থেকে কষ্টের শ্বাস বেরিয়ে আসে। এই গ্রহের আবহাওয়া পরিবর্তন করার জন্য এরাই দায়ী! আমরা প্রকৃতির বিনাশ করি ক্ষিধার জ্বালায় আর এরা করে টাকার উৎকট প্রদর্শনীর নামে অসভ্যতার কারণে। 
'গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম'-এর সমস্ত আয়োজন ছিল, 'ক্লাইমেট চেঞ্জ, দ্য হিট ইজ অন' এই নিয়ে সারগর্ভ আলোচনায়। আমি জানি না ওখানকার আলোচনায় ওরা কি কি সমাধান পেয়েছে? ওখানে আমাদের ভাবনা জানাবার ন্যূনতম কোন ভূমিকা ছিল না, থাকলে ভাল হতো। 
এই নিয়ে আলাদা করে আমার সাইটে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে পরের কোন পোস্টে। 'ক্লাইমেট চেঞ্জ, আমার ভাবনা-চোখ দিয়ে।

তো, দুবাই এয়ারপোর্ট দেখে আমি বিরক্ত। সুবিশাল অথর্ব এক জিনিস বানিয়েছে! ওই অনুযায়ী যথেষ্ঠ লোকবল চোখে পড়েনি। সহায়তা নামের কোনো জিনিস এদের অভিধানে নাই! অসংখ্য পুরুষ নামের মহিলা চোখে পড়েছে- হাঁটার ভঙ্গি অদ্ভুত, হেলেদুলে। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পিচ্ছিল সাদা কাপড় গায়ে দিয়ে হিজড়াদের মত হাঁটাহাঁটি করতে থাকা লোকজন দেখে মনে হচ্ছে, বাসাবাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
যাত্রির লম্বা লাইন অথচ এই নিয়ে এদের কোন বিকার নাই! ডেস্কে দায়িত্বে থাকা লোকগুলো নিজেদের মধ্যে ফালতু আলাপ করছে। এটা বোঝাই যাচ্ছে কারণ একজন অন্যজনের গায়ে হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। 
ক্রমশ যাত্রির লাইন লম্বা হয়, এতে এদের কিছুই যায় আসে না। স্রেফ দম্ভ, বেশুমার টাকার অহংকার! এই অসভ্যদের বোঝার এই বুদ্ধিটুকু কখনই হবে না যে যাত্রিরা এখানে দাঁড়িয়ে আছে এঁরা এই মুহূর্তে এদের অতিথি। আমি অন্য সময়ে প্রয়োজনে কঙ্গো এয়ারলাইন্সে ভ্রমণ করব কিন্তু এই সব অসভ্য এয়ারপোর্টে ব্লাডার হালকা করতেও আগ্রহী হবো না, শপথ আমার লেখালেখির।

প্রকৃতি ব্যত্যয় পছন্দ করে না। টাকার দম্ভে যে নগরী এরা বিয়েবাড়ির মত ঝলমলে আলোয় সাজিয়েছে এটা তছনছ করে দিতে প্রকৃতির এক মিনিটও লাগবে না। ভাগ্যিস, প্রকৃতি এদের তেল দিয়েছে নইলে আমাদের দেশে এসে চাকু ধার করত। ইরানিরা যে আমাদের দেশে চাকু ধার করত এটা দেখার জন্য আমাদের দাদার প্রয়োজন হয়নি, বাবাই যথেষ্ঠ ছিলেন! আসলে এদের মাঝখানে সিড়ির ধাপগুলো নেই- ক্যামেল টু ক্যাডিলাক। উত্থান অতি দ্রুত। এদের পতনও হবে অতি দ্রুত।

দীর্ঘ সময় পর ডেস্কের সামনে যখন আমি দাঁড়ালাম, ভদ্রতা করে বললাম, গুড মর্নিং। ব্যাটা অন্য একটা ডেস্ক দেখিয়ে উত্তর দিল, নেক্সট। অথচ এই ডেস্কটায় এ তেমন ব্যস্ত না! এ সম্ভবত এটাই ভাল শিখেছে, নেক্সট! অন্য ডেস্কে গেলে ব্যাটা যেটা বলল, শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এ বলছে, 'তুমি তো জার্মানি যেতে পারবে না, তোমার তো ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে'।

আমি হতভম্ব হয়ে এর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। এই নির্বোধদের বসিয়ে দেয়া হয়েছে এয়ারপোর্টের মত গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গায়! আমি পাসপোর্টে ভিসার অংশে লেখা ভাল করে দেখিয়ে দিলাম, মোটেও আমার মেয়াদ শেষ হয়নি। এটা দেখিয়ে দেয়ার পরও এর কোন লাজ হয়েছে বলে তো আমার মনে হলো না। এরপর শুরু হলো আমি কেন জার্মানি যাচ্ছি এই নিয়ে এক লক্ষ প্রশ্ন। আমার একে বোঝাতে হয় ডয়চে ভেলে কি, কেন ওখানে যাওয়া ইত্যাদি। এর ইংরাজি দেখি আমার চেয়েও জঘন্য! পাশের একটার সঙ্গে হিন্দি একটা শব্দ বলার পর আমি চলনসই হিন্দিতে বলা শুরু করলে এ চোখ সরু করে আমার কাছে জানতে চায়, 'তুমি দেখি ভাল হিন্দি বলো, শিখলে কোথায়'?
লে বাবা, হিন্দি বলাটাও কি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে নাকি! এ আমার কাছে একের পর এক কাগজ চাইতে থাকে, আমি দেখাতে থাকি।
এক পর্যায় আমি হোটেল বুকিং-এর কূপন দেখালে সে আমাকে একটা অফিস দেখিয়ে বলল, 'তুমি ওখান থেকে সিল মেরে নিয়ে আসো'।

ওখানে যাওয়ার পর দায়িত্বে থাকা মানুষটার কাছ থেকে সিল-টিল মেরে আবারও আমি এই ডেস্কে ফেরত আসলে এ আবার আমাকে অন্য একটা অফিস দেখিয়ে বলে, 'যাও এখান থেকে সিল মেরে নিয়ে আসো'। এই অফিসে যাওয়ার পর যে মানুষটা বসা ছিলেন তিনি আমাকে একটা প্রশ্নও করলেন না, খসখস করে লিখে দিলেন, ক্যানসেল। মোদ্দা কথা, আমাকে বেরুতে দেবে না, হোটেলে যেতে দেবে না। একটা দুঃখ প্রকাশ না, একটা শব্দ না। আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব, এমন কুৎসিত মুখ-অভিব্যক্তি আমি জীবনেও খুব একটা দেখিনি!

আমার সঙ্গে মুকিত বিল্লাহ নামের ইউরোপিয়ান কমিশনের একজন ছিলেন, তিনি যাবেন ফ্রাঙ্কফুট হয়ে ব্রুসেলস। তাঁর বেলায়ও একই অবস্থা। মুকিত চাচ্ছিলেন এই নিয়ে প্রশ্ন করতে। আমি তাঁকে বাংলায় বললাম, এরা অভব্য-অমানুষ, এদের সঙ্গে খামাখা কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নাই। কারণ এ কূপনের একটা অংশ ছিঁড়ে আবর্জনার বাক্সে ফেলে দিয়েছে। চলেন এখান থেকে, আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। চলেন-চলেন!

আমরা দুইজন দুবাই এয়ারপোর্টে এমিরাটসের ডেস্কে যোগাযোগ করার পরও এরা কোনো সমাধান দিতে পারল না।  এদের বক্তব্য, আপনাকে বেরুতে না-দিলে আমাদের কীই-বা করার আছে?
তবে এই বিষয়ে আমার স্পষ্ট বক্তব্য, তাহলে এমিরাটস কেন হোটেলের রাখা হবে বলে লিখিত সম্মতি দিল? এটা আমার জানার বিষয় না কোন এয়ারপোর্ট কোন অসভ্য মানুষদের আয়ত্বে। এরা প্রয়োজনে এয়ারপোর্টের ভেতর রাখার ব্যবস্থা করবে। প্রয়োজন বোধ করলে এয়ারক্রাফটের ভেতরে। প্রয়োজনে আকাশে। এটা এদের সমস্যা, আমার না।
আমার প্রয়োজন ঘুম। কারণ এই সমস্তটা রাত আমার কেটেছিল নির্ঘুম। এই বিষয়ে এমিরাটসের কাছে লিখিত আকারে ব্যাখ্যা চাওয়ার আছে আমার

আমি এই গ্রহের এক নির্বোধ কারণ আমি স্মোক করি। এই বিষয়ে আমি কোনো ঠুনকো অজুহাত দাঁড় করাতে চাই না। সলাজে কবুল করি, আমি এক আহাম্মক নইলে কী আর স্মোক করি?
ওয়াল্লা, মুকিত বিল্লাহও দেখি একই পথের পথিক (তবে আমি অন্য কাউকে এই বিশেষণের আওতায় আনতে চাই না। এ আমার অধিকার বহির্ভূত)! আমরা পাগলের মতো দুবাই এয়ারপোর্টে সিগারেট খাওয়ার জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি, ঢাকা ছাড়ার পর আমার আর সিগারেট খাওয়ার সুযোগ হয়নি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা কক্ষ পাওয়া গেল। ঢোকার পর আমার মনে হলো, এ নিশ্চিত হিটলারের গ্যাস-চেম্বার। 
ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না! একজস্ট সিস্টেম ভালো কাজ করছে না বা কুলিয়ে উঠতে পারছে না। আমার কেবল মনে হচ্ছিল জ্ঞান হারিয়ে ফেলব। সিগারেট ফুঁকে এখান থেকে বেরুবার পর মনে হলো, আহ, হাতে প্রাণ ফিরে পেয়েছি।
কেবল আপনাকেই কানে কানে বলি, অন্যদের বলবেন না যেন, এই গ্যাস-চেম্বারে আরও কয়েকবার ঢুকেছিলাম :)! সুবিশাল গামলায় উপচে পড়ছিল সিগারেটের অবশিষ্টাংশ।

'গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম' আমাকে যে টিকেট পাঠিয়েছে এটা এমন, ২০ জুন সাড়ে নটায় আমি ঢাকা ছাড়ব, ডুজলডর্ফে পৌঁছব ২১ জুন বিকেলে। ২২ জুন আমার মূল অনুষ্ঠান। পরদিন ২৩ জুনেই আমি ফেরার ফ্লাইট ধরব।
আমার মোটা মাথায় এটা আসেনি, ফেরার সময়টা আর দুয়েকটা দিন হাতে রাখলে টিকেটের জন্য এদের কী চার আনা পয়সা বেশি লাগত? এরা তিন দিনের জন্য আমাকে হোটেলে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। অবশ্য এটা বলতে পারত, দুঃখিত, তোমাকে তিন দিনের বেশি আমরা হোটেলের সুবিধা দিতে পারব না। 
এটা কোন সমস্যা ছিল না। কারণ জার্মানিতে সহৃদয় মানুষের অভাব নাই আর আমার ঘুমাতে খুব একটা জায়গাও লাগে না। কোনো ব্যবস্থা না-হলে মেট্রো, রেল স্টেশন আছে না...।

সমস্যা এই সব না, সমস্যা হচ্ছে এরা হিটলারের আচরণ থেকে এখনও বেরুতে পারেনি। অথচ অতি দ্রুত গা থেকে এই গন্ধটা মুছে ফেলাটা এদের জন্য অতি জরুরি। এটা যত দ্রুত এরা বুঝতে পারবে ততই মঙ্গল। এরা কি কেবল এটাই চেয়েছে, অন্য একটা দেশের মানুষ এসে পুরষ্কারের নামে কাঁচের একটা চারকোনা বাক্সই কেবল নিয়ে যাবে? তাহলে ডিএইচএল সার্ভিসে কাঁচের বাক্সটা পাঠিয়ে দিলে সমস্যা কী ছিল? অহেতুক এই হুজ্জত, আমার পেছনে বেশুমার টাকা খরচের আদৌ প্রয়োজন ছিল না। এদের ভাষায়ই বলি, 'ডুমকফ'। নির্বোধ!
এরা কি এটাই চেয়েছে, আমি একজন অমানুষ হিটলারের ভাবাদর্শে গোটা জার্মান জাতিকে দেখি, এই ভুল ধারণা নিয়েই থাকি? কিন্তু এটা তো আমি করতে পারি না, হিটলারের মত মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য গোটা জাতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা। জার্মান একজন মা যখন কাঁদবেন তার সঙ্গে আমিও কাঁদব, তিনি হিটলারের মা হলেও...।

*বৈদেশ পর্ব, আট: http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post.html

সহায়ক লিংক: 
১. বৈদেশ পর্ব, ছয়: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_29.html    

বৈদেশ পর্ব: ছয়

শেষ পর্যন্ত আমার জার্মানি যাওয়াটাই স্থির হলো। এর পূর্বে তিতাসের পানি কোথায় কোথায় গড়িয়েছে সেটা খোদ তিতাসেরও জানা নেই!
আমি জানতেও পারিনি কখন অপরাধটা করে ফেলেছি, আস্ত এক অপরাধি হয়ে বসে আছি। ববসের প্রতিযোগিতায় আমার সাইটটা নির্বাচিত হয়ে গেছে।
আমি নিরিবিলিতে দু-কলম লিখতাম, সেই বেশ ছিলাম। হঠাৎ করে পেছনের কাতারের মানুষটা সামনের কাতারে চলে এসে বড়ো একটা ভজকট হয়ে গেল! এরপর শুরু হলো একের পর এক নাটক। নাটকের একেক কুশীলবের কী দুর্ধর্ষ সব অভিনয়। যিনি সকালে ফোন করে অভিনন্দন জানান তিনি অন্য নামে বিকালে আমার বাপান্ত করেন। কী একেকজনের নসিহত- আমাকে কেমন করে বসতে হবে, হাঁটতে হবে এই সব এরা শেখাবার চেষ্টা করেন।

এরিমধ্যে জার্মান দূতাবাসের সঙ্গে আমার ভয়াবহ ঝামেলা হলো [১]। যারা গ্রে-মেটার নিয়মিত সাবান দিয়ে ধৌত করেন তারা মূল সুরটাই ধরতে পারলেন না। ঘটা করে আমাকে জানাতে লাগলেন, তিনি কয়টা দূতাবাসে দাঁড়িয়েছেন। যেন এই ভদ্রলোকের মত আমার বিদেশে চাকরির বড়ো শখ যে আমি দূতাবাসে দূতাবাসে লাটিমের মত ঘুরপাক খেতে থাকব।
একজন গভীর সন্দেহ পোষণ করলেন, এটাই আমার প্রথম বিদেশ সফর তাই আমার ধারণা নেই ইত্যাদি। ইনার কাছেও আমাকে প্রমাণ দিতে হবে ইনি যখন ডায়াপার ভিজিয়ে ফেলেন তখন আমি বিমানে ব্লাডার হালকা করি।

তিতিবিরক্ত হলেও এই সব নিয়ে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছিলাম না। তবে দূতাবাসের বিষয়টা আমি কোন অবস্থাতেই সহজ ভাবে নিতে পারছিলাম না। অশালীন, অভদ্র, অমার্জিত আচরণ করার কোন অধিকার কোন দূতাবাসের নাই। এই অধিকার অন্তত আমি কাউকে দেই না। একটা স্বাধীন দেশে একটা দূতাবাসের এই আচরণ ধৃষ্টতার পর্যায়ে পড়ে। আমার স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, দূতাবাস প্রয়োজন মনে করলে ভিসা দেবে না এই নিয়ে আমি দ্বিতীয়বার একটা শব্দও ব্যয় করব না। 
কিন্তু এখানে আমার ব্যক্তিগত অপমান ছাড়িয়ে যাচ্ছিল আমার নিজের দেশের প্রতি তাচ্ছিল্য। এদিকে বাক স্বাধীনতার নামে অতি কুৎসিত ছবি, ততোধিক কুৎসিত কথা লেখা হতে থাকে আমার নামে। আমি অপেক্ষায় ছিলাম, এই বাক স্বাধীনতাটা নিজের উপর পড়লে কেমন লাগে- হিস্ট্রি রিপিট! 

আমি আয়োজকদের আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়ে দিলাম আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এটা কোন ঝোকের মাথার সিদ্ধান্ত ছিল না। আমার সমস্ত জীবনে ঠান্ডা মাথার কোন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি এমন উদাহরণ প্রায় নেই বললেই চলে। 
আমার আপন একমাত্র মামা সঙ্গে আমার সম্পর্ক এতোটাই শীতল আজও তাঁর সঙ্গে কথা বলি না। আমার বাবা যখন মারা যান তখন আমার বয়স কেবল সতেরো। মামা নামের মানুষটার অপরাধ ছিল এটাই তিনি তখন আমাদের হাত ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই দিনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই মানুষটাকে আমার প্রয়োজন নাই। মানুষটা পরে অনুতপ্ত হয়েছিলেন কিন্তু আজও তাঁকে আমি ক্ষমা করিনি। প্রবাসী এই মানুষটা অনেক চেষ্টা করেও আমার সেল নাম্বারটা এখনও যোগাড় করতে পারেননি, সে সুযোগ তাকে দেয়া হয়নি।

তো, সিদ্ধান্তটা জানিয়ে নিজেকে নির্ভার মনে হলো। কারণ আমার হাতে আছে প্রতিজ্ঞার ভয়াবহ অস্ত্র। আমার প্রতিপক্ষের সংখ্যা এবং তাদের আস্তিনে লুকানো ভালবাসার অস্ত্রগুলো সম্ভবত খাটো করে দেখেছিলাম। এঁরা সবাই মিলে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আমি গা করি না, প্রতিজ্ঞা নামের আমার অতি চেনা এই অস্ত্রটা নিয়ে অতীতে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা অভাব নেই।
প্রতিপক্ষের লোকজন একের পর এক অস্ত্র ছুঁড়তেই থাকেন, অপমানিত হয়েছে বলে তুমি যে কেবল তোমার দেশ দেশ করছ, এটা আমাদের ভারতীয়দের গায়ে লাগছে না? বাংলা ভাষায় কি কেবল বাংলাদেশের লোকজনই কথা বলে? আমরা বলি না?
শেষে এঁরা ব্রক্ষ্মাস্ত্র ছুঁড়ে দেন। কে কবে ব্রক্ষ্মাস্ত্র ফেরাতে পেরেছে? এঁরা গাঢ় স্বরে বলেন, কই, হিন্দি ভাষায় তো বাংলায় চেয়ে অনেক বেশি মানুষ কথা বলে কিন্তু হিন্দি তো এখানে নাই। আমরা এবারই প্রথম বাংলা ভাষাটাকে অনেক ভাষার সঙ্গে এখানে যোগ করতে যুদ্ধ করেছি। তুমি যদি না আসো তাহলে এই সব জটিলতায় হয়তো আগামিতে বাংলা ভাষাটা এখান থেকে বাদ পড়বে। তুমি কি চাও তোমার কারণে এটা হোক?

আমি আমার হাত থেকে অস্ত্রটা ফেলে দিলাম। পরাজিত আমি কিন্তু কিছু পরাজয়েও সুখ। আমি অনেক কিছুই হয়তো ভুলে যাব কিন্তু এই মানুষদের মমতার কথা বিস্মৃত হবো না। আমার যখন মৃত্যুযন্ত্রণা উপস্থিত হবে তখন কি এই সুখ-স্মৃতিগুলো মনে পড়বে, মস্তিষ্ক কি তখন সচল থাকবে? থাকলে বেশ হতো, যন্ত্রণাটা খানিকটা হয়তো কমত।

আমি নিস্তেজ হয়ে বলি, আচ্ছা যাও, আমি যাব। এঁরা অতি উঁচু পর্যায় থেকে দূতাবাসের জন্য জার্মান ভাষায় বিশদ লিখে চিঠি পাঠান। যেখানে লেখা, হের আলী মাহমেদকে এখানে কেন থাকা প্রয়োজন ইত্যাদি। সঙ্গে ই-টিকেট [২]
অবশেষে জার্মান দূতাবাস ভিসা দেয়।

২০ জুন রাত সাড়ে নটায় আমি দেশ ত্যাগ করি, অনেকটা চোরের মত। কারণ বাংলা ভাষার জন্য কেবল দায় পড়েছে ডয়চে ভেলের এবং আমার। সাহেবরা একটা লাড্ডু ডয়চে ভেলের হাতে ধরিয়ে দেবে, অন্যটা আমার হাতে। আমাদের যে লাড্ডু খাওয়ার বড়ো শখ...।

*বৈদেশ পর্ব, সাত: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_3252.html

সহায়ক লিংক: 
১. বৈদেশ পর্ব: চার: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/this-is-my-land.html
২. বৈদেশ পর্ব: পাঁচ: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_04.html  

Tuesday, June 22, 2010

জয় হোক বাংলা ভাষার, বাংলা ব্লগিংয়ের, বাঙালির...!



আজ (২২.০৬.১০), 'বেস্ট অফ দ্যা ব্লগস' (ববস) এর যে সেরা বাংলা ব্লগ পুরষ্কারটি গ্রহণ করলাম, এটা কেবল আমার নিজের অর্জন নয়, সমগ্র বাংলা ব্লগারদের অর্জন। আমাদের সবার অর্জন। এখানে আমি আলী মাহমেদ কেউ না। আমি সারা বিশ্বের সামনে নিজের ভাষাকে তুলে ধরতে পেরেছি, আমার জন্য এটাই সবচেয়ে আনন্দের। এমন দিনে মরে গেলে কী আসে যায়...!
**অন্যত্র এই প্রসঙ্গে একটা মন্তব্য করেছিলাম। লেখাটা এখানে থাকার প্রয়োজন বোধ করছি বিধায় এই লেখার সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছি:
ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ছয় হাজার ভাষার মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। 
লাটভিয়ায় ‘লিভোনিয়ান’ ভাষায় কথা বলেন এমন একজনই মাত্র জীবিত আছেন, তিনি মারা গেলে সেই ভাষারও মৃত্যু হবে। এটা ২০০৯ সালের কথা, এরিমধ্যে তিনি মারা গেছেন কিনা আমি জানি না।
আলাস্কার ‘আইয়াক’ ভাষা জানা শেষ ব্যক্তিটি মারা যান ২০০৮ সালে। তাঁর সঙ্গেই মৃত্যু হয় ‘আইয়াক’ ভাষার।
যে আড়াই হাজার ভাষা এই গ্রহ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে আমাদের বাংলা ভাষাও থাকতে পারত কিন্তু আমাদের অপার সৌভাগ্য আমাদের বাংলা ভাষা যে কেবল টিকেই আছে এমন না, আছে সদর্পে, সীমাহীন গৌরবে!
বাংলা নামের আমাদের মায়ের ভাষা- এটা তো আর এমনি এমনি হয়নি, কেউ আমাদেরকে এটা মুফতে-দানে দেয়নি। এর জন্য আমরা কেবল দিনের-পর-দিন, মাসের-পর-মাস, বছরের-পর-বছর ধরেই লড়াই করিনি; লড়াই করেছি যুগের-পর-যুগ ধরে!
এই দেশের অসংখ্য সেরা সন্তান তাঁদের রক্ত অকাতরে বিলিয়ে গেছেন আমাদের জন্য। আমাদের বেদনার কথা যে অক্ষর দিয়ে লিখি সেই কালির সঙ্গে মিশে আছে তাঁদের রক্ত। জান্তব স্বপ্ন নামের সেই মানুষগুলোর অনেকেই আজ নেই কিন্তু তাদের মায়াভরা সুশীতল ছায়া ছড়িয়ে আছে আমাদের মাথার উপর।
তাঁদের ছায়ার পাশে যখন আমার মত অভাজন দাঁড়াই তখন নিজেকে কী ক্ষুদ্র, লজ্জিতই না মনে হয়। নতচোখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে না-থেকে কোন উপায় থাকে না।

আমরা যারা ব্লগস্ফিয়ারে লেখালেখি করি, বাচ্চার দুধ কিনতে না-পারার বেদনা. প্রাণনাশের হুমকি, কতশত রাতজাগা ভোর- তাঁদের প্রতি প্রিন্ট মিডিয়ায় কী তাচ্ছিল্য! যেন এরা একেকজন চলমান জ্ঞানের ভান্ডার হয়ে বসে আছেন। এঁরা হাটেন পা ফাঁক করে, বড়ো সাবধানে- জ্ঞান গড়িয়ে পড়বে এই ভয়ে।
কিন্তু আজ এটা আমাদের সবার বিজয়, ব্লগস্ফিয়ারে লেখালেখির সুবাদে আন্তর্জাতিক একটা পরিমন্ডলে এই প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষা দাঁড়িয়েছে, দানবীয় শক্তি নিয়ে।
এ সত্য, আমি হয়তো ভাল করে আমার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি কিন্তু আমার আন্তরিক বিশ্বাস, আমার পরে অন্য একজন চমৎকার করে পারবেন।
আমি স্বপ্ন দেখি, আমি হয়তো থাকব না কিন্তু আমার স্বপ্ন থেকে যাবে। আমার গলিত শব থেকে জন্ম নেবে সত্যিকার একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। যে যোদ্ধা বাংলা ভাষা নামের তরবারী দিয়ে সমস্ত অন্ধকার ফালাফালা করবে, কাঁপিয়ে দেবে এই গ্রহটাকে। আমি সেই মানুষটার জন্য অপেক্ষায় আছি...।
ভাল থাকুন গো সবাই। বাংলা ভাষার জন্য, অভাগা এই দেশমার জন্য অহেতুক একগাদা ভালোবাসা-আবেগ-মমতা নিয়ে...।
সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ।

Sunday, June 20, 2010

পিতা ও পুত্র: অন্য পিঠ

প্রতিদিন সকালে জামির গা রাগে জ্বলে যায়। ব্যাপারটা ঘটে ঠিক তখনি যখন ওর টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। এই বিশাল বাড়ির সব ক-টাই হাই কমোড, একটাও লো-প্যান নেই। আধুনিকতার সমস্ত উপকরণের সঙ্গে ও মানিয়ে নিয়েছে কিন্তু হাই কমোড বড় ভোগাচ্ছে! 
প্রথমবার হাই কমোড ব্যবহার করার কথা মনে পড়ে গেল। বেশ আগের কথা তখন বয়স কতই বা! মাঝারি ধরনের হোটেল। রিসেপশনিষ্ট জানতে চেয়েছিল: এ্যাটাচ বাথ কী নিবেন, বাংলা না ইংলিশ?
জামি একরাশ আলগা গাম্ভীর্য এনে অবজ্ঞা ভরে বলেছিল: ইংলিশ-ইংলিশ।
হোটেল রুমে ঢুকে ইংলিশ জিনিসটা দেখে জামির বুক কেঁপে উঠেছিল। সকাল বেলায় চোখ ফেটে কান্না আসছিল। শুরু হল অসামান্য কসরত। স্পঞ্জের স্যান্ডেল নিয়ে পিচ্ছিল কমোডের সরু দু’ধারে বসার চেষ্টা। আপ্রাণ চেষ্টার ফল দু-মিনিটেই মিলল। পিছলে পড়ে এক পা বেকায়দা ভঙ্গিতে কমোডে আটকে গেল। বিশ মিনিটের মাথায় জামি অসাধ্য সাধন করল। স্বস্তিতে বিড়বিড় করেছিল, ওয়াট আ রিলিফ-ওয়াট আ রিলিফ।


আজ বিরস মুখে বেরিয়ে বাবাকে খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। জামির বাবা মন্তাজ মিয়া এখন লেখেন, এম. এইচ. মেন্টাজ। এই এম. এইচ-এর অর্থ কী মেল্টাজ সাহেব নিজেও জানেন ন। আড়ালে আনেকে তাঁকে তিমিঙ্গিল বলে। টাকার গন্ধ পেলে ইনি নাকি তিমিকেও গিলে ফেলতে পারেন! খুব অল্প সময়ে ধাঁ করে বেশ ক-কোটি টাকা বানিয়ে ফেললেন, এক্সপোর্ট ইমপোর্ট করে। জামি খুব ভাল একটা জানে না ইনি আসলেই কী করেন! তবে এটা বেশ জানে, ওর বাবা আপাদমস্তক একজন অসৎ লোক। নীতি-ফীতি প্রতিবার নিঃশ্বাসের সঙ্গে বের করে দেন। সততা এঁর কাছে খোলামকুচি।

অবশেষে খাবার ঘরে পাওয়া বাবাকে গেল। মন্তাজ সাহেবের শালপ্রাংশু দেহ, রগরগে একটা গাউন গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন। কারিগরী ফলানো রুপার চামচ দিয়ে প্যাচপ্যাচে কাদার মতো জাউ খাচ্ছেন। জামি ভাবল, আহ আফসোস, এসব অসাধু লোকগুলো প্রচুর ভালো ভালো খাবার থাকার পরও খেতে পারে না। এরকম একজন মন্দ লোকের মন্দ সন্তান না হয়ে উপায় কী!
জামি মুখ কালো করে বলল, ‘বাবা, তোমার খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে একটা কথা বলব। কথাটা জরুরী।’
মেন্টাজ সাহেবের নিষ্প্রভ চোখ, এ পাথরের চোখ, স্বাভাবিক মানুষের হতে পারে না, আশ্চর্য! এ মুহূর্তে ভয় পেলে চলবে না। বাবার সামনে একবার ভেঙ্গে পড়লেই হয়েছে।


‘বাবা বলছ কেন স্টুপিডের মতো, বিশ্রী শোনাচ্ছে, ‘মেন্টাজ সাহেব বললেন, যথাসম্ভব কম মুখ নাড়িয়ে।
‘ড্যাড-ফ্যাড বলতে আমার ইচ্ছা করে না। তো, বাবা, যা বলতে চাচ্ছিলাম, মানুষের আবিষ্কার একটা কুৎসিত এবং একটা চমৎকার জিনিসের নাম বলতে পারো?  দুটা জিনিসই কিন্তু ব্যঞ্জনবর্ণের প্রথম অক্ষর দিয়ে?’
মেন্টাজ সাহেব এ নিয়ে মাথা ঘামানো দূরের কথা, উত্তরই দিলেন না। ওঁর ধারণা ছেলেটার মাথায় গন্ডগোল আছে। এ দেশে মাথার সমস্যার চিকিৎসা কি হয়, নাকি বিদেশে কোথাও চেষ্টা করে দেখবেন! এ ছেলে দিনে দিনে জটিল সমস্যা সৃষ্টি করবে এটা চোখ বুজে বলে দেয়া যায়। আঠালো জিনিসটা বেশ কায়দা করে মুখের ভেতর নাড়াচাড়া করছেন। গলায় আটকাচ্ছে, গিলে ফেলা যাচ্ছে না।
কল্লোল মুখ আরও অন্ধকার করে বলল, ‘অসাধারণ জিনিসটা হলো কম্পিউটার আর কুৎসিত জিনিসটা হলো হাই কমোড। হাই ড্যাড, হাই কমোড।’
মেন্টাজ সাহেব মেঘ গর্জনে বললেন, ‘তুমি কী আমার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করছ!’
‘তুমি কি রসিক লোক, যে তোমার সঙ্গে রসিকতা করব। আমি ঘুরিয়ে যেটা বলতে চাচ্ছি, কমোডে বসে আরাম পাই না। প্রতিদিন এ যন্ত্রণা ভালো লাগে না।’
‘তোমার কী ধারণা, এ কথায় খুব প্রভাবিত হয়ে কমোডগুলো সব ভেঙে বাঁশের টাট্টি বানিয়ে দেব?’
‘বাঁশের টাট্টি একবার ট্রাই করে দেখো, সেটা কমোডের চেয়ে আরাম।’
‘হাউ ডেয়ার য়্যু! তোমার অবাধ্যতা দেখে বিস্মিত হচ্ছি। কী পড়াশোনা করেছ,  কে কী পছন্দ-অপছন্দ করছে এই জ্ঞানটুকুও তোমার নাই।’


‘তোমার অনেক কিছুতে আমরাও অবাক হই, বাবা। ম্যানেজার জলিল কাকু, যে লোক চল্লিশ বছর বিশ্বস্ততার সঙ্গে তোমার সেবা করেছে, তাকে তুমি লাথি মেরে বিদায় করে দিলে।’
মেন্টাজ সাহেব আঠালো জিনিসটা চিবানো বন্ধ করে খরখরে চোখে বললেন, ‘মুখ সামলে কথা বলো। বানিয়ে বানিয়ে বলছ কেন, তুমি দেখেছ জলিলকে লাথি মেরেছি!’
ওই এক কথাই হল। সরকার কাকু, কাকীমা ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে হররোজ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। তুমি দেখা করো না। দারোয়ানকে বলে দিলে ভেতরে ঢুকলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে। তোমার মতো একজন অমানুষের সন্তান আমি, ভাবতে খুব কষ্ট হয়।’
মেন্টাজ সাহেব দূর্দান্ত রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে লাফিয়ে উঠলেন, ‘ফাজিল, তোকে জুতিয়ে লম্বা করে দেব।’
জামি সহজ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল। সমস্ত শরীর অজান্তেই ঋজু-টানটান হয়ে গেছে। এ মুহূর্তে মোটেও বাবাকে ভয় পাচ্ছে না। প্রলয়ংকরী রাগ ফুঁসে উঠছে। জলিল কাকু, কাকীমা রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকেন। কী নিদারুণ লজ্জার মাথা খেয়ে ফি রোজ অপেক্ষা, একটুখানি দয়ার জন্যে! 

ছোটবেলায় ও কাকীমার গলা ধরে ঝুলে পড়ত: কাকীমা আরেকটা গল্প বলো। ওর শত অত্যাচারেও কাকীমার হাসি মলিন হতো না। 
এখন বাসা থেকে বের হলেই কাকীমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। মুখ নিমিষে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। কাকীমা বরাবরের মতো স্নেহ ভরা নরম গলায় বলেন: খোকা, ভালো আছিস? দিনে-দিনে তুই কেমন শুকিয়ে যাচ্ছিস রে।

জামির কী ইচ্ছাই না করে কাকীমাকে জড়িয়ে ধরে গলা ফাটিয়ে কাঁদে। জামি চোখ তুলে তাকাতে পারে না। অন্য দিকে তাকিয়ে চোখের পানি গোপন করে। দ্রুত অন্যদিকে তাকিয়ে সরে পড়ে। একদিন খুব সাহস করে বলেছিল: কাকীমা তোমাকে কিছু টাকা দেই? 
তীব্র বেদনায় কাকীমা কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। কান্না ভেজা গলায় বলেছিলেন: ছি জামি, ছি!

জামি বাবার চোখে চোখ রেখে ভাবছিল, বাবা কী ওর গায়ে হাত তুলবেন? সমস্ত জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা কী এ মুহূর্তে করতে যাচ্ছেন?
জামির মা হাত মুছতে মুছতে ভেতরে না ঢুকলে হুলস্থূল কান্ড একটা হয়েই যেত। এই অসাধারণ মহিলা এক পলকে অনেকটা আঁচ করে ফেললেন। অসম্ভব শান্ত গলায় বললেন, ‘জামি, তোমার রুমে যাও।’
জামি টুঁ-শব্দ না করে মাথা নুইয়ে হাঁটা ধরল। বেরিয়ে যেতে যেতে অবাক হচ্ছিল, ভদ্রলোক যেভাবে লাফাচ্ছেন ছাদে না মাথা ঠুকে যায়।


জামি তিতিবিরক্ত। বেরিয়েই তিতলীর সামনে পড়ে গেল। ওর ইচ্ছা করছে চোঁচা দৌড়ে এর সামনে থেকে পালিয়ে যেতে। তিতলীর পাশ কাটিয়ে এটা এখন সম্ভব না। এ মেয়েটা বাবার দ্বিতীয় সংস্করণ। ক’দিন পর পর সাপের খোলসের মতো বয়ফ্রেন্ড বদলায়। তিতলীর চোখে বিদ্রুপ উপচে পড়ছে, ‘হ্যালো বদ, কিসের হইচই?’
জামি রাগ চেপে বলল, ‘বড় ভাইয়ের সঙ্গে এসব কী ফাজলামো।’
‘আহা চটচিস কেন; বাবা-মা, ড্যাড-মম হলে ব্রাদার বদ হবে না? বল, ভুল বললাম? হি হি হি। আর তুই  তো নিরেট বদ।’
জামি দাঁতে দাঁত ঘসে বলল, ‘বদ আমি, না তুই। তুই-তুই, তুই বদের হাড্ডি। ইউ ব্লাডি নোংরা মেয়ে, কাল তোর রুমে ক্যাসেট খুঁজতে গিয়ে তোষকের নিচে কন্ট্রাসেপটিভ পিল পেয়েছি, ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠছে।’
তিতলী বিপন্ন চোখে তাকিয়ে রইল। হায়-হায়, এ ভুল ও কী করে করল, তোষকের নিচে আহাম্মকের মতো রাখল!
সামলে নিয়ে রাগে জ্বলতে জ্বলতে বলল, ‘কেন তুই আমার রুমে ঢুকলি?’
‘বেশ করেছি, দাঁড়া বাবাকে বলছি।’
তিতলী ঠোঁট উল্টে নির্লজ্জের মতো বলল, ‘যা-যা, বলে দে, এসবে আমার প্রেজুডিস নাই। আর তুই কী ধোয়া তুলসী পাতা? তোর মানিব্যাগে খুঁজলে কনডম পাওয়া যাবে।’


জামির দু-কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। মাথায় কেমন ঝিমঝিম ভাব। কখন তিতলীর গালে ঠাস করে চড় মেরেছে বলতেও পারবে না। সত্য-মিথ্যা যাই  থাকুক কোনো মেয়ে কী তার বড় ভাই সম্বন্ধে এমন বলতে পারে!
তিতলী গালে দুহাত চেপে আগুন চেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তুই কী ভাবিস, পুরুষেদের বেলায় সাত খুন মাপ, না?’
জামি স্তব্ধ মুখে পা টেনে টেনে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলতে থাকল, ‘কী কুৎসিত একটা দিন, কী কুৎসিত একটা পরিবার!
দরজা ধাক্কানোর শব্দে কর্কশ গলায় বলল, ‘কে-কে?’
জামির মা পৃথিবীর সমস্ত মমতা ঢেলে বললেন, ‘আমি, দরজা  খোল।’
জামি দরজার দিকে এগুতে এগুতে ভাবল, এই পরিবারের সব কুৎসিত যে মহিলা স্বর্গীয় ডানা দিয়ে আড়াল করে রেখেছেন, এই মুহূর্তে তাঁকে এড়াবার কী কোন উপায় নেই!

Friday, June 18, 2010

মুদ্রার এ-পিঠ ও-পিঠ

আমাদের পোড়া এই দেশে স্বপ্নবাজদের বড়ো অভাব! একজন মাকসুদুল আলম আমাদের স্বপ্ন দেখান, জান্তব স্বপ্ন।
তিনি পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করেছেন। যুগান্তকারী এক আবিষ্কার! ইতিপূর্বে তিনি ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পেপে এবং ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ায় রাবারের জীবনরহস্য আবিষ্কারে নেতৃত্ব দেন। এরপরই তাঁকে বাংলাদেশে উড়িয়ে নিয়ে আসা হয়।
যারা তাঁকে দেশে নিয়ে আসতে সহায়তা করেছেন, মিডিয়া, সরকারী কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ সবাই অসম্ভব ভালো একটা কাজ করেছেন। তাঁদের জন্য আন্তরিক সাধুবাদ। কারণ আমাদের দেশে কোন একটা গবেষণার জন্য ১০ কোটি টাকার ব্যবস্থা করে দেয়াটা চাট্টিখানি কথা না!

এই দেশের যেসব সেরা সন্তান প্রবাসে তাঁদের মেধা বিক্রি করছেন তাঁদেরকে যতো দ্রুত সম্ভব দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। বিষয়টা এতো সহজ না কারণ দেশে এঁদেরকে নিয়মানুযায়ী যে টাকা দেয়া হবে তাতে দু-একজন ব্যতীত কেউ উৎসাহী হবেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। 
প্রবাসে এঁরা যে অংকের টাকা পান তার কাছে দেশে টাকার অংক কিছুই না। দু-নম্বরি না করে অন্তত ভদ্রস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব না। আমাদের এটা বুঝতে হবে এঁদেরকে প্রচলিত ছকে ফেলা যাবে না। আবার এঁদের জন্য অন্য বেতন-কাঠামোও করা কঠিন। কিন্তু উপায় একটা তো বের করতেই হবে। 
এইসব সেরা সন্তানরা এই গ্রহের যেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন সেখানে তিনি আমাদের দেশের টাকায় যে অংকের সুবিধা পান দেশে অন্তত এর চার ভাগের এক ভাগ সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে। 
মোদ্দা কথা, এদেঁর জন্য আলাদা করে ভাবতে হবে।

নইলে আজীবন একজন মাকসুদুল আলমের কথাই মিডিয়া ঘটা করে লিখতে থাকবে, সংসদে আলোচনা চলতে থাকবে। সংসদে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, "শোক-দুঃখের পাশাপাশি আমাদের আনন্দেরও অনেক খবর থাকে। আজ সংসদে আমি সে ধরনের এমনই একটি আনন্দ সংসবাদ দেব। আমি মনে করি, সংসদই হলো সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা...।" (প্রথম আলো, ১৭.০৬.২০১০)
ভাল। আমিও একমত।

একজন এফসিপিএস ডাক্তারের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। তিনি দুঃখিত গলায় বলছিলেন, জানেন, এইডস নিয়ে কাজ করার জন্য দাতাদের দেয়া কোটি-কোটি টাকা ফেরত গেছে। কারণ আর কিছুই না। আমাদের বিজ্ঞ আমলারা ফাইল চালাচালি করতে করতে দিনের পর দিন-মাস-বছর পার করে দিয়েছেন।
সত্যি বলতে কি তাঁর কথা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল, কেউ কি এভাবে নিজের কফিনে নিজেই পেরেক ঠুকতে পারে? কোন জাতি কি এতোটা নির্বোধ হতে পারে!

কিন্তু এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে সম্ভব, এই দেশে সবই সম্ভব। প্রথম আলো জানাচ্ছে, জাপানের জাইকা ডিএনএ পরীক্ষাগার তৈরির জন্য ২৫ কোটি টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। কিন্তু এক বছর চলে গেছে এখনো কিছুই করা সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাতেও কাজ হয়নি। যথারীতি আমাদের বিজ্ঞ আমলারাদের
আমলাগিরির কারণে এখন টাকাটা ফেরত যাচ্ছে।

এই দেশের সামান্য সচেতন একজন মানুষও জানেন আমাদের দেশে একটা আধুনিক ডিএনএ পরীক্ষাগার কতোটা জরুরি। অপরাধিকে কাবু করার জন্য এর কোন বিকল্প নেই। কারণ দু-জন মানুষের ডিএনএ (ডিঅক্সিরিবো নিউক্লিক এসিড) কখনও এক রকম হয় না, হতে পারে না।

প্রধানমন্ত্রী যেমন সংসদে মাকসুদুল আলমের মত একজন স্বপ্নবাজের কথা শেয়ার করেন তেমনি তিনি কি এই সব দুঃস্বপ্নবাজ আমলাদের কথাও শেয়ার করবেন? আমরা কি জানতে পারব, এইডস নিয়ে কাজ করার জন্য, ডিএনএ পরীক্ষাগার নিয়ে কাজ করার জন্য যে টাকাগুলো ফেরত গেল; যারা এর জন্য দায়ী সেইসব দুঃস্বপ্নবাজ আমলাদের কি শাস্তি হয়েছে? কেবল মুদ্রার একপিঠ দেখালে তো হবে না আমরা মুদ্রার অন্যপিঠও দেখতে চাই।
আর কেবল একজন স্বপ্নবাজকে নিয়েই দিনের পর দিন গল্প চালিয়ে না গিয়ে এই সব স্বপ্নবাজদের [১] কথাও বলুন। কেমন করে এঁরা সরকারি সহায়তা ব্যতীত পাটকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন, রেখেছেন।

সহায়ক লিংক:
১. পাট, ঘুরে দাঁড়ায় স্বপ্ন: http://www.ali-mahmed.com/2010/01/blog-post.html
 

Wednesday, June 16, 2010

গোল্ডফিস মেমোরি জাতি!

আমার কুখ্যাত স্মৃতিশক্তির জন্য বিস্তর হাসাহাসি হয়। ওদিন চিবিয়ে চিবিয়ে একজন বলছিলেন, আই বেট, গোল্ডফিসের স্মৃতিশক্তিও তোমার চেয়ে খারাপ না। 
আমার অপরাধ এটুকুই, ওনাকে বলেছিলাম, আমার সঙ্গে একটু গুলশান যাওয়ার জন্য। ওনার রাগের কারণ হচ্ছে, গুলশানের ওই ভবনে পরপর দু-হপ্তা আমি গিয়েছি (যদিও দু-বারই আমার সঙ্গে একজন ছিলেন), তো তৃতীয়বার না চেনার কোন কারণ নেই।
এখন ওনার বদ্ধমূল ধারণা আমি রসিকতা করছি।

কী আর করা, জ্যাম না থাকলে আধ-ঘন্টায় যাওয়া যায় তবুও হাতে ঘন্টা তিনেক সময় নিয়ে আল্লাহ ভরসা বলে নিজে নিজেই রওয়ানা দিলাম। হাতে যথেষ্ঠ সময় এটাই ভরসা। স্কুটারওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি গুলশান দুই-এর এই ভবনটা চেনেন তো?
আমার দেখার ভুল না হয়ে থাকলে স্পষ্ট দেখলাম, মানুষটা মাথা ঝাঁকালেন। যাক, চিন্তার কোন কারণ নেই তাহলে। স্কুটারে আমি মুখ কঠিন করে বসে রইলাম। মুখ কঠিন করার প্রয়োজন আছে, ব্যাটা যদি একবার বুঝতে পারে আমি কিছুই চিনি না তাহলেই সেরেছে।

আমি জানতাম ভজকট একটা হবেই, হলোও তাই। গুলশানে ঢুকে এ জিজ্ঞেস করছে, এইবার কোন দিক দিয়া যামু?
আমার সত্যি সত্যি মেজাজ খারাপ হলো। আমি বললাম, উড়াল দিয়া যান। আপনি না বললেন আপনি চেনেন!
মানুষটা আর কথা বাড়ালেন না, একে-ওকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কেউ সামনে বলে তো কেউ পেছনে। লোকজনও বদ, না চিনলে বল চিনি না। ভুল রাস্তা বলে দেয়ার মানে কী!
এক সময় বিরক্ত হয়ে স্কুটার থেকে নেমে আমি হাঁটা ধরলাম।

বাহ, আমাকে নিয়ে লোকজন একটা তামাশার পাত্র বানিয়ে দিয়েছে দেখি! গোটা জাতিই যে গোল্ডফিস মেমোরির এতে বুঝি দোষ হয় না, না? তখন দেখি এতে কোন লাজ নাই!
এরশাদ সাহেব যখন তিন তিনটা আসন থেকে সংসদ সদস্য পদের জন্য দাঁড়ান তখন আমি এটাকে বছরের সেরা কৌতুক মনে করে হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে উল্টে পড়ার দশা হয়েছিল। কিন্তু এই তিনিই যখন তিনটা আসন থেকেই জয়ী হন তখন আমার হাসি লজ্জার কাশিতে পরিণত হয়।

কবি এরশাদ সাহেবের সমস্ত কুকর্ম বিস্মৃত হলেও [১] না-হয় আমি মেনে নিতাম কিন্তু তিনি এমন একটা অন্যায় করেছিলেন যা ক্ষমার অযোগ্য। তিনি যদি অমর হন তাহলে কোন কথা নেই কিন্তু মরণশীল হলে মৃত্যুর সময় এর শাস্তি অবশ্যই ভোগ করবেন।

সেলিম নামের একটি শিশুকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সেলিমের ফাঁসির আদেশ রদ করার জন্য আবেদনও জানিয়েছিল। কিন্তু এরশাদ সাহেব সে আবেদন উপেক্ষা করে সেলিমের মৃত্যুদন্ডাদেশকে অনুমোদন দেন।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা সে সময়ের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের কাছে জরুরি আবেদনে এটাও জানায়, সেলিমের মৃত্যুদন্ড দিলে সেটা হবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের সুস্পষ্ট লংঘন।
কারণ ১৮ বছরের নিচে কাউকে মৃত্যুদন্ড দেয়া যায় না, দিলে সেটা হবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লংঘন।

এবং যেহেতু সেলিমের বিচার হয়েছে সামরিক আদালতে (সামরিক আদালত চালু করা হয়েছিল ১৯৮২-র মার্চ মাসে)। সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই। যদিও প্রত্যেক নাগরিকেরই আছে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার।

১৯৮৫ সালে ঢাকার মিরপুরের ১৪ বছরের মোহাম্মদ সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় খুনের। মামলা চলার পুরোটা সময় তাকে রাখা হয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে। 
অবশেষে ২৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাতে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তাকে ফাঁসি দেয়ার পূর্বে তার বাবা মাকে একটা খবর পর্যন্ত দেয়া হয়নি।

কেবল আমার স্মৃতিশক্তিই যাচ্ছেতাই, না? আমাকে নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করতে বড়ো উল্লাস হয়, না? আমার মেমোরি গোল্ডফিসের মত? আর জাতি হিসাবে আমাদের মেমোরি গোল্ডফিসের চাইতেও খারাপ এটা বললে বুঝি সূর্য একহাত নিচে নেমে আসে! 
নইলে কী আর ধার্মিক এরশাদ সাহেব [২] তিন তিনটে আসন থেকে দাপটের সঙ্গে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাও একটা আবার ঢাকার আসন থেকে। যেখানে সমস্ত শিক্ষিত মানুষের বাজার, প্রখর স্মৃতিশক্তির লোকজন! নির্বাচনের পূর্বে নিজেদের দলে টানার জন্য দুই নেত্রী ওনার হাত ধরে কম টানাটানি করেননি। ভাগ্যিস, এরশাদ সাহেবের যে হাত ছিঁড়ে যায়নি! আমরা কত দ্রুত সব ভুলে যাই! বড়ো বিচিত্র এই দেশ!

*ঋণ: আ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নিউজ লেটার, আজকের কাগজ ০৬.০৭.৯১ 

সহায়ক লিংক:
১. কবি এরশাদ: http://www.ali-mahmed.com/2009/03/blog-post_09.html
২. মহান এক শাসক: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_3701.html

Tuesday, June 15, 2010

এ গ্রহের গ্রহপিতা: ইসরাইল

ইসরাইল [১]। লোকজন কেন দেশটাকে ছোট বলে শিশুসুলভ আচরণ করে আমি জানি না। কেউ যেমন এটম বোমা দেখে নির্বোধের মত মুখ ফসকে বলে ফেলে, আরে, এইটা এতো ছোট! ইসরাইলের থাবা এই গ্রহের কোথায় নাই, কত রকমে নাই [২]?

এই গ্রহ কার? ইসরাইলের। এই গ্রহ চালাচ্ছে কে? ইসরাইল। এই গ্রহের গ্রহপিতা কে? কে আবার নেতানিয়াহু। এই গ্রহের অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের উচিৎ সকালে গ্রহপিতা নেতানিয়াহুর নাম জপ করা, বাধ্য থাকা। ইসরাইলের নির্বাচনের পূর্বে, ওবামাকে ম্যাসেজ দেয়ার জন্য কিছু খেলা খেলতে হয়। সভ্য জাতিদের জন্য এমন খেলা খেলাটা বড্ডো জরুরি [৩]

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামার দুঃসাহস দেখে আমি আঁতকে উঠি। কী পাগলামি এটা! ওবামার কী মাথা খারাপ, মানুষটার মাথা কী আউলা-ঝাউলা হয়ে গেছে? ওবামা কি না নেতানিয়াহুর সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত ডিনার বাতিল করে দেন? যৌথসংবাদ সম্মেলন হয় না, এমন কি ওবামার সঙ্গে নেতানিয়াহুর বৈঠকের কোনও ছবিও প্রকাশ করা হয়নি। সম্ভব?

বেচারা জাতিসংঘ, বেচারা জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা! বেচারা, মহাসচিব বান কি মুন। বেচারাদের জন্য বড়ো মায়া হয়। এরা কি জানে না গ্রহপিতা হচ্ছেন ব্রিটেনের রানীর মত। সব কিছুর উর্ধ্বে। সীটবেল্ট না বাঁধলেও তাঁকে আটকানো যাবে না কারণ রানীকে কোন আইনের আওতায় আনা যায় না। তিনি নিজেই নিজের বিচার করবেন, চাইলে।

অবরুদ্ধ গাজাবাসীর জন্য জাহাজযোগে ত্রাণসহায়তা দেয়ার সাহস আসে কোত্থেকে? ইসরাইল ফটাফট গুলি করে মেরে ফেললে এর জন্য ইসরাইলকে দোষারোপ করা হবে কেন? ইসরাইল কি বলেছে, যাও গিয়ে গাজায় ত্রাণ দাও। তাহলে?
৩১ মে গাজা অভিমুখী ত্রানবাহী জাহাজে ৯জন তুর্কি নাগরিক নিহত হয়। তুরস্কের উপপ্রধানমন্ত্রী বুয়েন্ত আরিনক মৃত, জীবিতদের স্বাগত জানিয়ে ইসরাইলের সমালোচনা করে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার জন্য বাচ্চাদের মত আবদার করেছেন।
বড়োরা বাচ্চাদের সব আবদার পূরণ করে বুঝি? নেতানিয়াহু এটুকু বলেছেন এই তো ঢের, ইসরাইল যা করেছে তার জন্য তিনি মোটেও অনুতপ্ত-দুঃখিত নন এবং এই কারণে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

ইসরাইলের মনটা বড়ো নরোম! গাজাগামী ত্রানবাহ জাহাজ থেকে আটক তুরস্কের নাগরিক নিলুফার কেতিন এবং তার ১ বছরের শিশুকে ইসরাইল ছেড়ে দিয়েছে। নিলুফার আবার কেমন করে এটা বলেন, ইসরাইলি সেনারা আমার এবং আমার বাচ্চার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করেছে। সামান্য কৃতজ্ঞতা বোধ কী তাঁর নাই?
শোনো কথা, মেরে যে ফেলেনি এটাই কি যথেষ্ঠ না?

আমার মনে হয় সৌদি আরবই সবচেয়ে সুবোধ বালক, গ্রহপিতাকে মান্য করে। সৌদি আরব ইরানে হামলা চালাবার জন্য ইসরাইলকে বিমান চলাচলের জন্য সুযোগ করে দিয়েছে। সৌদি শাসক গ্রহপিতা নেতানিয়াহুর পাদোদক (বৃদ্ধাঙ্গুলি স্পর্শ করা পানি, চরণামৃত) পান করে ব্রেক ফাস্ট শুরু করেন এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। অন্যরা যে কেন সৌদি শাসকদের মত সুবোধ বালক হতে চান না এটা দুর্বোধ্য। বোকার দল, সৌদিদের দেখে শেখে না কেন এরা? 
ইরাকের পবিত্র স্থানগুলো যখন আমেরিকান সৈন্যরা পদদলিত করে তখন সৌদি আরব তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। হিস্ট্রি রিপিট- সৌদির পবিত্র স্থানগুলো যখন আক্রান্ত হবে তখন সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। ইয়ে যখন অবধারিত...।

সহায়ক লিংক:
১. জুইশ শিশু: http://www.ali-mahmed.com/2009/01/blog-post_7757.html
২. জুইশদের দানব হয়ে উঠা: http://www.ali-mahmed.com/2009/01/blog-post_10.html 
৩. অন্য রকম খেলা: http://www.ali-mahmed.com/2009/05/blog-post_493.html 

Monday, June 14, 2010

ইশকুল: স্বপ্ন পাঁচ

পুর্বের পোস্টে [১] লিখেছিলাম, এই বিচ্ছুদের কাবু করা নিয়ে। আজ বাচ্চাদের বই দেয়া হয়েছে। ঠিক এখুনি বইয়ের প্রয়োজন ছিল না কিন্তু এদের একের পর এক ফাঁদে না ফেলে উপায় নেই। ঝাঁ-চকচকে, ছবিঅলা রঙিন বইগুলোর আবেদন এদের কাছে কেমন এটা নিজ চক্ষে দেখলাম। একজনের পর একজনের অনুরোধ, সবগুলো বিচ্ছুর ছবি তুলতে হয়েছে আমাকে!



মাস্টার মশাইয়ের হাতে বেত দেখলাম, আমার অপছন্দের কথা জানিয়ে দিলাম। তাঁকে আমি বললাম, প্রচলিত পড়ানো আমি চাচ্ছি না। এদের অক্ষর জ্ঞানের পাশাপাশি যেটা দেখা প্রয়োজন, খাবার আগে হাত ধোয় কি না, হাতের নোখ বড়ো কি না, দাঁত মাজে কি না? কারণ আপনি যে বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন এরা শিক্ষিত বাবা-মার সন্তান না। এখুনি অক্ষর নিয়ে মারামারি করার প্রয়োজন নাই। বই থেকে ছবিগুলো চিনুক, ছবিগুলো নিয়ে গল্প করুন।
আর ভুলেও কখনও আমাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবেন না কারণ আমি চাই এই বাচ্চারা বুঝতে শিখুক শিক্ষকের উপরে আর কেউ নাই।

গত পোস্টে বলেছিলাম, বাচ্চাদের বাবারা, বয়স্করাও শিখতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। আজ থেকে এটা চালু হলো, ৮জন ছাত্র পাওয়া গেল। খারাপ কী! বয়স্করা পড়বেন সন্ধ্যা ৭টা থেকে। এরা মিনমিন করে বললেন, আমরা কিন্তু পড়ব ঘরের ভেতর।
সমস্যাটা বুঝতে পারি। আমি হাসি গোপন করে বললাম, যেখানে আপনাদের ভাল লাগে সেখানে পড়েন, আমার সমস্যা কি।

আজ হয়েছে আরেক কান্ড! মহিলারাও পড়তে চাচ্ছেন। আমি বললাম, বেশ কিন্তু আমি মহিলা শিক্ষক পাব কোথায়?  আপনারা কি এই শিক্ষকের কাছে পড়বেন? এতে তাঁদের কোন আপত্তি নাই।
মাস্টার মশাই অবশ্য বয়স্ক এবং মহিলাদের পড়ার বিষয়ে খানিকটা সন্দিহান। আমি মাস্টার মশাইকে এঁদের অলক্ষ্যে শিখিয়ে দিয়েছি, এঁদের কানের কাছে তোতা পাখির মত জপ করবেন। টিপসই দেয়া বড়ো লজ্জা। যে সই করতে জানে তাকেই শিক্ষিত ধরা হয়, কে এম.এ পাশ কে এস.এস.সি ফেল সেটা পরের কথা।

দেখা যাক...।
(আজ রাত ৯টার আপডেট: সন্ধ্যা ৭টায় সময়টা এঁরা সবাই মিলে পরিবর্তন করেছেন। কারণটা আমি ধরতে পারছি, এটা এখানে শেয়ার করা যাবে না। এঁরা সবাই মিলে সময়টা ঠিক করেছেন দুপুর ১২ টায়) 

*স্বপ্ন: http://tinyurl.com/3y7bpz3 

সহায়ক লিংক: 
১. স্বপ্ন চার, আপডেট: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_14.html 

স্বপ্ন, চার: আপডেট

পূর্বের পোস্টে আমি লিখেছিলাম, স্বপ্ন চার [১]। এটার কাজ শেষ। আজ সকালে বাচ্চাদের এই স্কুলটা চালু হওয়ার কথা। অথচ আমি থাকতে পারছিলাম না। বাংলাদেশের বিখ্যাত এক রক্তচোষার খপ্পরে [২] আমাকে সকালে-সকাল ভৈরব যেতে হবে বলে নটায় স্কুলের প্রথম দিনে থাকা হবে না!

কপাল, যেখানে আমি যেতে চাই না সেখানেই আমাকে যেতে হয়! এমনিতে কোথাও যেতে আমার ভাল লাগে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি তো কোথাও যেতে চাই না [৩]

নটায় স্কুলের কাজ শুরু হওয়ার কথা। আমি মত পরিবর্তন করলাম, ভৈরব পরে যাব। ভাগ্যিস, মত পরিবর্তন করেছিলাম।
আজই প্রথম এখানে এলাম। আক্ষরিক অর্থেই আমি মুগ্ধ। 'মেথর পট্টি' নামের এই জায়গায় যারা বসবাস করেন তাঁদের কাজই হচ্ছে আবর্জনা নিয়ে অথচ এখানকার ঘরবাড়িগুলো ঝকঝকে-তকতকে! 
প্রথমেই আমি পড়ে গেলাম তোপের মুখে। সর্দাররা সর্দারি শুরু করলেন। একজনকে দেখলাম, হাত-পা নেড়ে বলছেন, 'হে যে আমার ঘরে স্কুল বসাইতে কইল, হের ঘর নাই? হের ঘরে জায়গা দিল না ক্যান'?

আমি আয়োজন পন্ড করার সুযোগই দিলাম না। বললাম, আমার ঘরের প্রয়োজন নাই। কেবল উপরে ছাউনি আছে, বৃষ্টি পড়বে না এমন একটা জায়গা ঘন্টাখানেকের জন্য আমাকে দেন। আর পড়বে তো আপনাদের বাচ্চারাই। আমি এনজিও-ফেনজিওর কোন লোক না। আমার অন্য কোন উদ্দেশ্য নাই। আমি কেবল চাইছি আপনাদের বাচ্চাগুলো অক্ষর শিখুক। আমাকে কিছুটা সময় দিন, দেখুন। এরপর আপনাদের পছন্দ না হলে এই স্কুল আমি বন্ধ করে দেব।

উপরে আবরণ দেয়া উঁচু যে চাতাল বাচ্চাদের পড়াবার জন্য আমি বেছে নিলাম তা এতোটাই পরিছন্ন যে আমার ওখানে পা ছড়িয়ে বসতে বিন্দুমাত্র অস্বস্তি লাগেনি!
বিস্ময়ের আরেক ধাক্কা, মাস্টার মশাই কাঁটায়-কাঁটায় নটায় চলে এসেছেন। এমন না আমি আসব বলে, আগেই এটা জানিয়ে দেয়া হয়েছিল আজ আমি থাকব না।

আমি ধারণা করেছিলাম, ৮/১০ জন বাচ্চাও হবে না কিন্তু আমার ধারণা ছাড়িয়ে ১৫জন ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া গেল!
আমার পরিচিত দু-একজন আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন মুফতে এদের পড়াবার জন্য কিন্তু আমি গা করি নি। এর পেছনে আমার যুক্তি আছে। আমরা বড়োই আবেগ প্রবণ জাতি। কাউকে এটার দায়িত্ব দিলে প্রচন্ড আবেগে কিছু দিন পড়াবে তারপর আর হয়তো তার ভালো লাগবে না।

আমি খুঁজছিলাম একজন প্রফেশনাল, একজন দক্ষ শিক্ষক, যিনি বাচ্চাদের পড়াবার জন্য ওস্তাদ। এবং যথারীতি জনাব বকুল নামের মানুষটাকে মাস শেষে উপযুক্ত সম্মানী দেয়া হবে। আমার সৌভাগ্য সম্ভবত ঠিক মানুষটিকেই আমি খুঁজে পেয়েছি। 
তো, বাচ্চারা ইতস্তত এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাস্টার মশাইকে বললাম, মাস্টার সাব, আপনি ছিপ ফেলার আগে মাছের চারা করেন। আজ কোন পড়া না, চকলেট দেন, বাচ্চাদের সঙ্গে গল্প করেন। দেখবেন, চকলেটের লোভে এরা সুড়সুড় করে চলে আসবে।
হলোও তাই। আমি মনে মনে বলি, বাচ্চারা রসো, এরপর আসছে পড়া। বাছাধনরা, না পড়ে উপায় নাই।
তবে অধিকাংশ বাচ্চাদের পেটভরা কৃমি। একদিন এখানে একজন ডাক্তার নিয়ে আসতে হবে। এবং কোন ডাক্তার মুফতে দেখুক এটাও আমি চাই না। কেন না, এর প্রয়োজন হবে প্রায়ই। 

এমনিতে মাস্টার মশাইকে দেখলাম, বাচ্চাদের পড়াবার জন্য উদগ্রীব হয়ে অছেন। আমি তাঁকে বললাম, আমি এটা চাই না আপনি এদের কেবল গতানুগতিক পড়া পড়ান। এদের সঙ্গে আমার কিছু খেলা আছে। একদিন ১৬টা চকলেট রেখে ১৫জন বাচ্চাদের বলবেন, সবাই একেকটা করে নিয়ে যাও; যখন দেখবেন একটা চকলেটও পড়ে নাই তখন বুঝবেন ঘাপলা আছে। তখন এদের এটা বোঝাবার চেষ্টা করবেন তোমাদের মধ্যে কেউ একজন মন্দ কাজ করেছ। এ অন্যায়।

এরপর আমার বিস্ময়ের শেষ ধাক্কা! পুরুষ-মহিলা, এঁদের সবার মধ্যে আমি যে বিপুল উৎসাহ লক্ষ করেছি এটা আমার আশাতীত! ঘর তেকে, রাস্তা থেতে ধরে ধরে বাচ্চাদের নিয়ে আসছিলেন। অন্তত এতোটা আমি কল্পনা করিনি। একেকজন অভিভাবকের কী উদ্দীপনা!

এঁদের কথাবার্তা খানিকটা প্রলম্বিত, কয়েকজন বুড়া আমাকে চেপে ধরলেন, 'বা-বু, হা-মা-দের পড়ার একটা বে-বু-স্তা করা যায় না'?
আমি মনে মনে হাতে কিল মেরে বলি, চিয়ার্স-চিয়ার্স-চিয়ার্স, তিন চিয়ার্স! আমার স্বপ্নগুচ্ছের মধ্যে এটাও ছিল, বয়স্কদের জন্যও একটা স্কুল করা। মনে মনে ভাবছিলাম, এই স্কুলটা দাঁড়িয়ে গেলে পরবর্তীতে ওটায় হাত দেব। কিন্তু এটা কোথায় শুরু করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। দেখো দিকি কান্ড, এ যে না চাইতে জল- আমি কুয়ার কাছে যাব কী, কুয়াই আমার কাছে চলে এসেছে!

আমি আমার উল্লাস গোপন করে গম্ভীর হয়ে বলি, হুম। ভেবে দেখতে পারি কিন্তু আগে বাচ্চাদের স্কুলটা আপনারা ঠিকভাবে চলতে দিন। বাচ্চাদের বই-খাতা কিচ্ছু লাগবে না আপনারা কেবল নটা বাজলেই বাচ্চাদের এখানে পাঠিয়ে দেবেন। এই আপনাদের কাজ।
বুড়ারা ঘন ঘন মাথা নাড়েন, 'আলবাত-আলবাত'।
তাহলে ঠিক আছে আপনাদের পড়ার ব্যবস্থাটাও হবে। বুড়াদের ফোকলা দাঁত বেরিয়ে পড়ে। আমি জানতে চাই, আপনারা কয়জন পড়বেন? এঁরা নিশ্চিত করেন অন্তত ১০ জন। ওয়াল্লা, এ তো অনেক!
আমি ঠিক করেছি, এই জায়গায় সকালে বাচ্চারা পড়বে, রাতে বুড়ারা।

আমি হেঁটে হেঁটে ফিরে আসছি। এঁদের কি আনন্দ হলো, না হলো এ নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় কোথায় আমার! আমার নিজের আনন্দ রাখার জায়গা কই- হাঁটছি, নাকি ভাসছি? এই আনন্দের তুলনা কিসের সঙ্গে হয় এটা আমি জানি না, জানলে ভাল হতো। 
কে জানে, মৃত্যুর সময় আমার মস্তিষ্ক সচল থাকলে এই সব সুখ-স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেলে মৃত্যু যন্ত্রণা হয়তো বা অনেকখানি লাঘব হবে।

ফিরে আসার সময় দেখি, ৭/৮ বছরের এক শিশু 'নাংগাপাংগা' হয়ে মহা আনন্দে উপর থেকে পড়া পানিতে গোসল করছে। ওর নাচের কাছে সাম্বা নৃত্য কোন ছার!


এই শিশুটির এই অন্য ভুবনের আনন্দের সঙ্গে আমার আনন্দের পার্থক্য কোথায়? অন্তত আমি তো কোন ফারাক খুঁজে পাই না। ফারাক খুঁজতেই আমি চাই না।

*এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটাবার জটিল কাজটা করেছেন জুটন বণিক। তাঁকে আমার কৃতজ্ঞতা।
**স্বপ্ন: http://tinyurl.com/3y7bpz3 

সহায়ক লিংক:
১. স্বপ্ন চার: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_8254.html 
২. লাশ-বানিজ্য-পদক: http://www.ali-mahmed.com/2010/04/blog-post_23.html 
৩. আমি কোথাও যেতে চাই না: http://www.ali-mahmed.com/2009/07/blog-post.html  

Saturday, June 12, 2010

পেঁচবুক ওরফে ফেসবুক এবং বিবিধ

'পেঁচবুক' ওরফে ফেসবুক জিনিসটায় আমি খুব একটা আরাম পাই না। জানি না কেন আমার কাছে এটা হিজিবিজি হিজিবিজি মনে হয়! আমার একটা ফেসবুক একাউন্ট আছে বটে, কেউ বন্ধু হওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট পাঠালে চোখ বুজে কনফার্ম বাটনে চাপ দিয়ে দেই। এখন পর্যন্ত বন্ধুর সংখ্যা সম্ভবত দুশো ছাড়ায়নি।
কেউ কেউ যখন বলেন আমার বন্ধু সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার তখন আমি চোখ বড় বড় করে বলি, 'উরি বাবা', উরি বাবা!

ফেসবুকে আমার থাকা হয় খুবই কম। সলাজে কখনও আমার পছন্দের কোনো লেখা শেয়ার করি। কেউ কেউ পড়েন, এই-ই। এখানে, অন্যদের কিন্তু আমার উপর বিরক্তির শেষ নাই কারণ এঁরা বিভিন্ন বিষয়ে আমন্ত্রণ জানান কিন্তু এতে আমার কোনো যোগ নেই। বিরক্তির একশেষ এই সব মানুষদের মধ্যে দু-একজন ব্যতীত...।

একটা বিষয় এখানে খুব চালু, 'লাইক দিস'। ইহা পছন্দ করিলাম। একজন হয়তো লিখল, 'জানেন, আমার না চুল কাটাবার পয়সা নেই'। 
ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো 'লাইক দিস' পড়ল। একজনের চুল কাটাবার পয়সা নেই অথচ আমরা দাঁত কেলিয়ে রাখছি। কী চরম অমানবিকতা- কী নিষ্ঠুর রসিকতা!
সম্প্রতি দেখলাম, মাহমুদুল হাসান রুবেল তার একটা লেখা শেয়ার করেছেন, "মৃত্যুর কাছে অসহায়"- ওখানে তিনি লিখেছেন তার বাবা হাসপাতালে মারা যাচ্ছেন... এর হৃদয় বিদারক বর্ণনা। 
এখানে কোনো মন্তব্য নাই তবে এখানেও পাঁচজনের 'লাইক দিস'! একজনের বাবা মারা যাচ্ছেন এখানে লাইক দেয়ার কি আছে কে জানে!
কি জানি, এই সবই হয়তো এখানকার নিয়ম, যা আমি খুব ভালো একটা বুঝি না। মৃত্যু নিয়ে রসিকতা করাটাও হয়তো এক প্রকার রসিকতা! ফেসবুক তাহলে রসিকতার ভান্ডার হয়ে যাচ্ছে, কাত করলেই গড়িয়ে পড়বে!

তবে ফেসবুকের বিপুল ক্ষমতা দেখে আমার মুগ্ধতার শেষ নেই। নিমিষেই একটা লেখা বা প্রসঙ্গ পঙ্গপালের মত ছড়িয়ে যায়। এই দানবীয় ক্ষমতার প্রতি আমার সীমাহীন সমীহ আছে। 
ফেসবুক নিয়ে ক-দিন ধুন্ধুমার কান্ড ঘটে গেল আমাদের দেশে। আমাদের দেশের বুদ্ধিমান আমলারা এটা বন্ধ করে দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিলেন ডিজিটাল বাংলাদেশ [১] বলতে কি বোঝায়। 
প্রক্সি সার্ভার দিয়ে ফেসবুকে লগ ইন করে প্রায় সবাই দাঁত বের করে একজন অন্য জনকে বলত, আহারে, ফেসবুকে ঢুকতে পারছি না। অনেকে অবশ্য বিভিন্ন কারণেও মন খারাপ করতেন, তিনি নাকি তাঁর ফার্মের গরুকে খাওয়াতে পারছেন না, গরু ভেগে যাবে বলে। এই দেশের লোকজনের মাথা খারাপের মত হয়ে গেল! দেশটা বন্যায় ডুবে গেলেও সম্ভবত এতটা কাতরতা থাকত না- সম্ভবত কলাগাছের ভেলায় করে ফেসবুক ব্যবহার করতে পারলে আর কোন ক্ষোভ থাকত না।

কেবল বাংলাদেশেই নাকি এর ব্যবহারকারী ন-লাখ! ভাবা যায়! ফেসবুকে একটা একাউন্ট না থাকাটা এখন মাথা কাটা যাওয়ার মত অবস্থা, যেমন কেউ যদি শোনে কারও সেল ফোন নাই অনেকটা এমন। কারও ফেসবুক নাই এটা জানার সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবত তার শরীর থেকে ভক করে সরষে তেলের গন্ধ বের হয়! মানুষটাকে গ্রাম্য-গ্রাম্য মনে হয়।
...
সম্প্রতি ফেসবুক সংক্রান্ত, বিখ্যাত লেখক (!) আনিসুল হক সাহেবকে [২] নিয়ে কঠিন একটা লেখা আমাকে লিখতে হয়েছিল। লেখাটা কঠিন করে লেখার আদৌ ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু বিষয়টা কেবল একজনের ফেসবুকের স্ট্যাটাসই ছিল না। ছিল অধিকারের। বিষয়টা ইতিপূর্বেও অনেকেবার ঘটেছে। 
আনিসুল হকের মত প্রিন্ট-মিডিয়ার লোকজন এটা কবে বুঝবেন, এই গ্রহে অসংখ্য শব্দ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একজন পরম মমতায় শব্দগুলো জড়ো করে তাঁর নিজস্ব একটা ভুবন রচনা করেন। সেই মানুষটার সন্তানসম লেখা যখন অবলীলায় নিয়ে নেয়া হয় তখন এটাকে বলা যেতে পারে 'শব্দ ছিনতাই'!

অন্য কেউ হলে হয়তো আমি তেমন গা করতাম না কিন্তু তাই বলে একজন লেখক! আমরা তো আবার লেখকদের দেখে দেখে শিখি। এরা কেমন করে কপকপ করে জ্যোৎস্না খান, জ্যোৎস্নায় গোসল করেন, কেমন করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ডিম ভাজেন, শপিং মলের ফিতা কাটেন ইত্যাদি।

অভ্র-বিজয় বিতর্ক নিয়ে আমার একটা মন্তব্য চাওয়া হয়েছিল। গুগলে সার্চ দিয়ে এটা আমি খুঁজছিলাম। যে লিংকে গিয়ে আমি এটা পেলাম ওখানে এটা পড়ে আমি হতভম্ব [৩]। আমার মন্তব্যটা চাইল ডয়চে ভেলে আর লেখাটা লিখল গিয়ে এরা? বিষয় কী! 
পরে ডয়চে ভেলের সাইটে [৪] লেখাটা পেয়েছিলাম কিন্তু আমার জন্য বোঝা মুশকিল হয়ে দাঁড়াল কে কারটা কপি করল?
তো, একজন লেখক যখন এমন মনোভাব পোষণ করেন তখন ডয়চে ভেলের লেখাটা যে গণিমতের মাল মনে করে ছাপিয়ে দিল তাদের খুব একটা দোষ দেই কেমন করে?

প্রিন্ট-মিডিয়ার সঙ্গে লড়াইটা এই কারণেই আমার। বাচ্চাদের নিয়ে একটা আঁকাআঁকির অনুষ্ঠানে কাভার করতে আসা জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় সাংবাদিকরা আমার উপর প্রায় ঝাপিয়ে পড়লেন। এলাকার বলে আমার উপর এঁদের দাবীটা প্রবল, তাঁদের হইচই-এ কানে তালা লেগে যাওয়ার দশা। 
এঁদের স্পষ্ট বক্তব্য, আমি কেন এক সাক্ষাৎকারে [৫] এটা বলেছি, "...অনলাইনে যারা লেখালেখি করেন তাদের প্রতি প্রিন্ট মিডিয়ার আছে সীমাহীন তাচ্ছিল্য...এখন প্রিন্ট-মিডিয়ার গালে সজোরে একটা চপেটাঘাতের ব্যবস্থা হয়েছে"।
তাঁদের ক্ষোভ, এটা আমাদেরও গায়েও লাগে ইত্যাদি।
আমি বললাম, প্রিন্ট-মিডিয়ার মধ্যে ভানবাজিটা বড়ো বেশী প্রবল, সব মিলিয়ে আমি ওই মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এঁরা কেউ বুঝতে চাইলেন না। 

তখন আমি তাঁদের বললাম, বেশ, বিশদ উত্তরটা আমি এখন দেব না, দেব ৪৮ ঘন্টা পর। আমাকে কিছুই বলতে হয়নি, ৪৮ ঘন্টাও লাগেনি, ২৪ ঘন্টার মধ্যেই [৬] এঁরা উত্তরটা পেয়ে গিয়েছিলেন।

অবশ্য আমি এটা ভেবে ভেবে খুব মজা পাই, প্রিন্ট-মিডিয়ার, বিশেষ করে পত্রিকায় চাকরি করেন এমন কারো ব্লগ-সাইট যদি 'ববস' থেকে নির্বাচিত হতো তখন তাঁদের প্রতিক্রিয়াটা কেমন হতো? মতি ভাইয়ার মত মানুষরা এটা কাভার করার জন্য অন্তত অফিসের পিয়ন-চাপরাসী হলেও কাউকে পাঠাতেন। 

কোন কম্যুনিটি ব্লগে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে যখন আমাকে নিয়ে অতি কুৎসিত ছবি দেয়া হয়, ততোধিক কুৎসিত কথা বলা হয় তখন সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেন। হিস্ট্রি রিপিট- তামাশা দেখা ভাল, তবে এই তামাশাগুলো যখন নিজেদের উপর দিয়ে যাবে তখন কেমন লাগবে এটা দেখার অপেক্ষায় আছি। জয় হোক মত প্রকাশের স্বাধীনতার!
প্রিন্ট-মিডিয়ার, এমব্যাসির [৭] সঙ্গে আমার এই লড়াইটা যে কেবল আমার নিজের জন্য না এটা অনেকে বুঝতে চাইছেন না। এদের বোঝাতে আমার বয়েই গেছে।

সহায়ক লিংক:
১. ডিজিটাল: http://www.ali-mahmed.com/2009/04/blog-post_8733.html 
২. আনিসুল হক: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_08.html 
৩. অভ্র-বিজয়, bdnationalnews.com: http://tinyurl.com/33kuhj8 
৪. অভ্র-বিজয়, ডয়চে ভেলে: http://www.dw-world.de/dw/article/0,,5590862,00.html 
৫. সি-নিউজ: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_24.html 
৬. আয়োজন করে কান্না: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_05.html 
৭. বৈদেশ পর্ব, চার: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/this-is-my-land.html 
৮. এ থিফ অফ ব্লগ সাইট!: http://www.somewhereinblog.net/blog/sali75blog/29153062       

Friday, June 11, 2010

আবেগ-বিবেক!

নিমতলী অগ্নিকান্ড থেকে প্রকৃতি আমাদের যে শিক্ষাটা দেয়ার চেষ্টা করল তা থেকে আমরা কি শিখলাম কে জানে! পূর্বের একটা পোস্টে আমি লিখেছিলাম, প্রকৃতি চিৎকার করে করে বলছে...[১] । আমাদের আবেগ কখনো কখনো মাত্রাতিরিক্ত হয়ে পড়ে। ক-দিন পর গোল্ড ফিসের মত সমস্ত কিছু বিস্মৃত হই। এই নিমতলী অগ্নিকান্ডের ঘটনা ভুলতে আমাদের খুব বেশী একটা সময় লাগবে না।

পূর্বের পোস্টে আমি উল্লেখ করেছিলাম, ৫০ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালে রোগীদের বারান্দায় ফেলে রাখা হয়েছে। ঝলসানো সমস্ত শরীর, এই অসহনীয় গরমে বারান্দায় পড়ে থাকার কী অসহনীয় কষ্ট এটা ভুক্তভোগী ব্যতীত অন্য কেউ বুঝবে না, বোঝা সম্ভব না- এটা বোঝার ক্ষমতা অন্য কারও নাই! তার উপর আমাদের অতি উৎসাহী রাজনীতিবিদ, সুশীল, মিডিয়ার (এখন দেশে এদের সংখ্যা কত, আল্লাহ জানেন) পদভারে জায়গাটার সঙ্গে নরকের কোন ফারাক নাই!

চিকিৎসার পাশাপাশি অতি জরুরী ছিল ২৪ ঘন্টা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে এঁদের রাখার ব্যবস্থা করা। ওই লেখায় আমি যেটা বলেছিলাম, প্রয়োজনে সচিবালয় থেকে এসি খুলে নিয়ে আসুন, জেনারেটর আনার জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করুন কিন্তু ২৪ ঘন্টার মধ্যে এই সব সমস্যার সমাধান করুন।

আমার জানামতে, উল্লেখযোগ্য তেমন কোন পরিবর্তনই হয়নি। লাভের মধ্যে যা হয়েছে, অতি ফোকাসের কারণে নিমতলী রোগীদের (২৪জন) জন্য অন্য রোগীরা (২৩৮জন) সীমাহীন দুর্ভোগের সম্মুখীন হচ্ছেন। এই নিয়ে অসম্ভব তথ্যবহুল একটা লেখা লিখেছেন মশিউল আলম [২]। 
এমনিতেও ৫০ শয্যার এই হাসপাতালে গড়ে রোগি থাকেন আনুমানিক ৩০০ জন। এই ২৫০ জনের কি দুর্ভোগ হয় তা সহজেই অনুমেয়।

নিমতলী ট্রাজেডির শিকার তিন মেয়ের প্রতি প্রধানমন্ত্রী মমতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা অসম্ভব ভাল একটা উদ্যোগ। ক্ষমতাবান মানুষদের চারপাশের বর্ম একজন মানুষকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলে কিন্তু কখনও-না-কখনও সেই মানুষটা চোখেও জল আসে, মন কাঁদে। এতে চোখ সরু করে তাকাবার কিছু নেই। নিজ দায়িত্বে প্রধানমন্ত্রী এই তিনজন মেয়ের বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি নিজ মেয়ের সম্মান এদের দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আমি তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ দেই, মন থেকে। হয়তো কোন একটা উদ্যোগ না নিলে এই মেয়েগুলোর বিয়েই হতো না। অন্তত একটা গতি তো হলো।

কিন্তু এই বিয়েকে উপলক্ষ করে যে বিপুল আয়োজন করা হয়েছে আদৌ এর প্রয়োজন ছিল কি না এ নিয়ে আমার খানিক বক্তব্য আছে। এই বিয়ের অন্য প্রসঙ্গগুলো বাদ দিলেও (যৌতুকের বিষয়গুলো একরকম চলেই আসল) এই বিয়েতে অতিথি ছিলেন ৩০০০। এত অতিথির প্রয়োজন হলো কেন? এটা কি খুব ভালো একটা উদাহরণ সৃস্টি হলো?

মিডিয়ার খেলাও আমরা দেখলাম। ইলেকট্রনিক মিডিয়া তো লাইভ অনুষ্ঠানই প্রচার শুরু করল। ..., আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? আচ্ছা, ওখানকার এখন কি অবস্থা? আপনি কি বাবুর্চির সঙ্গে কথা বলেছেন, ইত্যাদি।

প্রধানমন্ত্রীর আপন মেয়ের বিয়ের সময়ও ৩০০০ মানুষকে অতিথি করা হয়ে থাকলে আমার পছন্দ করার কারণ ছিলনা। কারণ এটা একটা কু-উদাহরণ। এই সব মানায় সাকাচৌ টাইপের মানুষদের [৩] 
যে দেশের প্রায় ৭৫ লাখ লোক প্রতি রাতে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়, যে দেশের ৭৫ ভাগ মানুষ ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করে সেই দেশে একটা বিয়েতে ৩০০০ মানুষকে অতিথি করার ভাবনাটাই অস্বাভাবিক!
যতটুকু জানতাম, 'অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন' বলে একটা আইন ছিল। এটা এখনও চালু থাকার কথা। সম্ভবত ১০০-এর উপর হলে একটা অংকের টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হওয়ার কথা। এখানে সম্ভবত এটা প্রযোজ্য হবে না।

কু-উদাহরণ হচ্ছে একটা চেইন। এখন যেমন গোটা দেশ আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের পতাকা লাগাবার প্রতিযোগীতায় নেমেছে। কে কার চেয়ে বড়ো পতাকা লাগাতে পারে। একজন ১০ ফুট লাগিয়েছে তো অন্যজন ২০ ফুট। এখন পর্যন্ত ৬০০ ফুট দীর্ঘ পতাকা বানাবার রেকর্ড দেশে হয়েছে। এক পক্ষ আর্জেন্টিনার ৬০০ ফুট লাগিয়েছে তো অন্য পক্ষ ব্রাজিলের ৬০০ ফুট পতাকা! এই অসভ্যতা পত্রিকাওয়ালা আবার ঘটা করে ছাপায়!
দেশে ফুটবল খেলার মাঠের খবর নাই, খেলার কোন আয়োজন নাই, এতে আমাদের কোন লাজ নাই। একজন মি. সালাউদ্দিন যে কাজটা করে দেখিয়েছেন, মানুষটাকে স্যালুট না করে উপায় নেই।

আমি জানি ফুটবলপ্রেমিরা ক্ষেপে শার্টের হাতা গোটাচ্ছেন। আমি নিজে ফুটবল খেলা দেখি না এমন না। যার খেলা ভালো লাগে তার জন্যই আমার উল্লাস। কোথাও অতিরিক্ত ফোকাস হলে মূল প্রসঙ্গ অস্পষ্ট হয়ে যায়। এই গ্রহের সমস্ত দল বাদ দিয়ে কেবল দুই দলকে নিয়ে মাতামাতির কোন অর্থ হয় না। আমি খুশি হবো যদি বিশ্বকাপ থেকে আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল বিদায় হয়। এটা আমার নিজস্ব ইচ্ছা-মত, অন্য কারও মত পরিবর্তন করাবার খায়েশ আমার নাই।

দেশটা উন্নত কোন দেশ হলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে করদাতারা জানতে চাইতেন। চাইবে না কেন? কারণ সকালে দাঁত মাজার পেস্ট থেকে শুরু করে রাতে ফেস-ওয়াশ দিয়ে মুখ ধোয়া পর্যন্ত পরোক্ষ ট্যাক্স জনগণ তো দিয়েই যাচ্ছে। ওই সব দেশে এদের জন্য জানতে চাওয়াটা দোষের কিছু না। এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কত টাকা খরচ হয়েছে? যে টাকাটা খরচ হচ্ছে এটা কি ব্যক্তিগত? ব্যক্তিগত হলে এই টাকার উৎস কি? ব্যক্তিগত না হলে হাজারটা জবাব দাও। ভাগ্যিস, দেশটা বাংলাদেশ।

সহায়ক লিংক:
১. প্রকৃতি চিৎকার করে করে বলছে...: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_06.html 
২. মশিউল আলম: http://www.eprothomalo.com/index.php?opt=view&page=13&date=2010-06-11 
৩. সাকাচৌ: http://www.ali-mahmed.com/2007/06/blog-post_607.html 
৪. ক্ষুধার সঙ্গে রসিকতা: http://www.ali-mahmed.com/2009/10/blog-post_3172.html

আমাদের ফতোয়াবাজ


ফতোয়া নিষিদ্ধ করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন।

প্রায় ১০ বছর হতে চলল এর সুরাহা এখনও হয়নি! সুপ্রিম কোর্টির আপিল বিভাগে এখনও শুনানির অপেক্ষায় আছে! কবে শুনানি হবে, কবেই বা এর রায় হবে কেউ জানে না!

২০০০ সালে ফতোয়ার বিরুদ্ধে বিচারপতি গোলাম রব্বানী এবং বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার আদালত কেন ফতোয়া প্রদানকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে না এই বিষয়ে সুয়োমোটো রুল জারি করেন।

এই প্রেক্ষিতে মুফতি (!) ফজলুল হক আমিনী [১]। ২০০১ সালে বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রব্বানীকে মুরতাদ ঘোষণা দিয়ে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন এবং ২০১০ সালেও এসেও এই মৃত্যুদন্ড আমিনী বহাল রেখেছেন। আমিনী বলেন, "রাব্বানী, তোমার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলাম, সেটা এখনো বহাল আছে।" (প্রথম আলো ১৬.০৩.১০) 

একটা সভ্য দেশে একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে এমন হুমকি দেয়া যায়, বছরের পর বছর ধরে সেই মৃত্যুদন্ড বহালও রাখা যায় আবার এটা সেই বিচারপতিকে সদম্ভে মনেও করিয়ে দেয়া যায়! সেই দাম্ভিক মানুষটা আবার মুক্ত ঘুরেও বেড়ায়। 
এরপরও যদি বলা হয় সেই দেশে আইনের শাসন বহাল আছে, এটা বড়ো হাস্যকর শোনায়!

অন্য দেশের দেখাদেখি [২] এই দেশেও ফতোয়ার নামে বিভিন্ন সময়ে নারকীয় ঘটনা ঘটেছে; নারীদের দোররা মারা হয়েছে, জোর করে হিল্লা বিয়ে দেয়া হয়েছে। অসংখ্য উদাহরণ থেকে একটাই উল্লেখ করি, দাউদকান্দিতে এক মেয়েকে দোররা মারা হয়েছিল। 
এখানে আমাদের পুলিশ বাহিনীর মন্তব্যে আমি বড়ো বিচলিত হয়েছিলাম, দাউদকান্দি থানার ওসি সাহেব বলেছিলেন (ইনাদের নাকি এখন প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেয়া হবে), "বিষয়টি পুলিশের জানা ছিল না। কেউ অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে"। (আব্দুর রহমার ঢালী, প্রথম আলো, ২৪.০৫.০৯) 

এই প্রসঙ্গে আমি লিখেছিলাম, "কেউ অভিযোগ করলে...। আমিও ভাবছি, কোন একটা অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। যাকে সামনে পাব তাকেই আল্লাহু আকবর। এবং আমি অবশ্য এও লক্ষ রাখব, অভিযোগ করার জন্য যেন সংশ্লিষ্ট কেউ বেঁচে না থাকে।"[৩] 

ধর্ম থাকুক না ধার্মিকদের মাঝে তীব্র শ্রদ্ধা-বিশ্বাস নিয়ে [৪], যার যার প্রভু থাকুন না তার মত করে [৫] মোল্লাদের সমস্যা কোথায়? 
২০০১ সালে ফতোয়ার বিরুদ্ধে রায়ের পরপরই ইসলামী দলগুলো এর বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়। যাদের মধ্যে আমিনী এবং জামায়েত অন্যতম।
চুরি-চামারীর বিষয়ে ইসলাম কি বলে এটা জানার খুব ইচ্ছা, আমাদের ধর্মের বাহকগণের কাছে। ৯১ সালে ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি মহা-কবি [৬] এরশাদ সাহেবের বিরুদ্ধে কমিশন মোট ৫৩৪টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ চিহ্নিত করেছিল। প্রতিটি অভিযোগের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা মামলা দায়ের করা সম্ভব বলে অভিমতও প্রকাশ করেছিল। এবং অনেক মামলায় এরশাদ সাহেবের সাজাও হয়েছিল। এটাও আমি জানতে আগ্রহী কোন ধরনের চুরি করলে হাত কেটে ফেলার বিধান আছে।

বিচিত্র এই দেশ, ততোধিক বিচিত্র এই দেশের মানুষ! কত বিচিত্র শাসক [৭] আমাদের দেশ শাসন করে গেছেন! অন্ধকার ফিরে আসে বারবার [৮]

আর এই ছবিটিরই বা ব্যাখ্যা কি? আমাদের ধর্মবাজদের আবার খালেদা জিয়ার প্রতি অনেক অনেকখানি সমীহ আছে, ধর্মবাজরা আবার এও মনে করেন শেখ হাসিনা থাকলে ধর্মের পিলারটা নড়বড়ে হয়ে যাবে।

তো, ইসলাম ধর্মে এমন ছবির ভঙ্গির বিষয়ে কি বক্তব্য? আর যুগের পর যুগ ধরে এঁরা মহিলা শাসন কেবল মেনেই নিচ্ছেন না পুচ্ছও আন্দোলিত করছেন। এখানে ধর্ম রসাতলে যাচ্ছে না, না?

*ছবি সূত্র: প্রথম আলো

সহায়ক লিংক:
১. ফজলুল হক আমিনী: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_17.html 
২. পরম করুণাময় ভাজা ভাজা হন...: http://www.ali-mahmed.com/2009/04/blog-post_04.html 
৩. দোররা: http://www.ali-mahmed.com/2009/05/blog-post_24.html 
৪. ধর্মনিরেপেক্ষতা: http://www.ali-mahmed.com/2007/06/blog-post_6312.html 
৫. সন্তানরা যেন থাকে দুধে-ভাতে: http://www.ali-mahmed.com/2009/04/blog-post_06.html 
৬. মহা কবি: http://www.ali-mahmed.com/2009/03/blog-post_09.html 
৭. শাসক: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_3701.html 
৮. অন্ধকার ফিরে আসে বারবার: http://www.ali-mahmed.com/2009/07/blog-post_20.html