Search

Sunday, June 6, 2010

প্রকৃতি চিৎকার করে করে বলছে...

আজ দেশে শোক দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। 

এটা মৃতদের কী কাজে লাগবে কে জানে? এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না আজ এটা পুরান ঢাকায় ঘটেছে, কাল নতুন ঢাকায় ঘটবে- পুরো ঢাকা শহরটাই হয়ে আছে বসবাস অযোগ্য এক মৃত্যু-নগরীতে। 
আমরা কয়টা শোক দিবস পালন করব, কত দিন পর পর?

অভাগা দেশ! এখানে আগুনে পোড়া রোগী মেঝেতে পড়ে থাকে, হাসপাতালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যথেষ্ঠ ব্যবস্থা নেই। আগুনে পোড়া রোগী যখন গরমে মেঝেতে আধজবাই পশুর মত কাতরাতে থাকে তখন আমাদের নেতারা তাদের সমবেদনা জানাতে গিয়ে এদের কষ্টটা বহু গুণ বাড়িয়ে দেন!
একেকজন নেতার সঙ্গে থাকেন এক দঙ্গল মানুষ, মিডিয়ার হুড়াহুড়ি, ক্যামেরায় চমৎকার ছবি উঠাবার জন্য কদর্য প্রতিযোগীতা। 
আহা, এই মানুষগুলো যদি এই সব আগুনে পোড়া রোগীর কষ্টটা এক পার্সেন্টও সত্যি সত্যি বুঝতে পারতেন। তাহলে এই সমবেদনা জানাবার জন্য অন্তত হাসপাতালে গিয়ে এদের কষ্টটা আরও বাড়িয়ে দিতেন না। একের পর এক নেতারা দল বেঁধে হাসপাতালে ছুটতেন না- নেতাদের মধ্যে প্রতিযোগীতাও শুরু হয়ে যেত না।

এটা বোঝার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না, বাইরের এই লোকজনের আনাগোনা এই সব রোগীর জন্য কতটা অস্বাস্হ্যকর, বিপদজনক, ভয়ংকর! উপকার বলতে রোগীর মৃত্যুর গতি কেবল ত্বরিত হবে, আর কিছু না। 
এটা কেবল আমাদের দেশেই সম্ভব। উন্নত দেশ হলে যত বড়ো লাটসাহেবই হোক না কেন ডাক্তার সোজা এঁদের হাঁকিয়ে দিতেন! রোগীর ধারেকাছেও ভিড়তে দিতেন না।

এই সব রোগীদের জন্য এখন যেটা অতি প্রয়োজন সেটা হচ্ছে সুচিকিৎসা। প্রয়োজনে সচিবালয় থেকে এসি খুলে নিয়ে আসুন, পোর্টেবল এসি, এয়ারকুলার বসান। প্রয়োজনে জেনারেটর হেলিকপ্টারে করে উড়িয়ে নিয়ে আসুন। 
৫০ শয্যা বিশিষ্ট বার্ন ইউনিটের বেহাল অবস্থা, একা ডাঃ সামন্তলাল সেন লম্বা সময় ধরে 'বুড়ো সান্তিয়াগো'-এর মতো ভাঙ্গা হাল ধরে আছেন। 
হাসপাতালে ছুটাছুটি না করে আজই প্রতিজ্ঞা করুন, একটা করে স্বয়ংসম্পূর্ণ বার্ন ইউনিট সমস্ত জেলায় করা হবে। আজকের পর যেন আগুনে পোড়া কোন রোগীকে অন্তত মেঝেতে পড়ে থাকতে না হয়।

প্রকৃতি চিৎকার করে করে বলছে, তোমাদের জন্য এটা একটা সামান্য নমুনা মাত্র। এখনও সময় আছে সতর্কতার অবলম্বন করো। কিন্তু প্রকৃতির বোকা, উদাসিন, লোভী সন্তানদের এটা শোনার সময় কোথায়?
কেউ কেউ বলবেন দুর্ঘটনার উপর কারও হাত নাই। বটে রে, ঢাকার অধিকাংশ রাস্তায় ফায়ার ফাইটিংয়ের গাড়ি ঢোকে না, আগুন নেভাবার জন্য পর্যাপ্ত পানি নাই। আগুন নেভাবার জন্য যথেষ্ঠ উঁচু মই নাই [১], ডুবন্ত লঞ্চ টেনে তোলার মত উদ্ধারকারী জাহাজ নাই [২]। নর্দমার সঙ্গে মিশে আছে খাওয়ার পানি! কোটি-কোটি শ্রমঘন্টা নষ্ট হচ্ছে জ্যামে আটকে থেকে। 
কেবল আমরা পাগল হয়ে যাই ফ্রিগেট, মিগ কেনার জন্য।

ঢাকা নামের কংক্রিটের বস্তি, ম্যাচবক্সের মতো গায়ে গা লাগানো এই সব অথর্ব জিনিসগুলো রিখটার স্কেলে কতটা ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারবে এটা বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। ঝাঁকুনি ব্যতীতই একেকটা ভবন হেলে পড়ছে, পড়বে। এই না শুরু, দেখুন না কালে কালে কী হয়! প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবে ঠিকই।
আমি ভেবে শিউরে উঠি সেই দিন হয়তো আর দূরে না যেদিন প্রায় পুরো শহরটাই ধসে পড়বে। ঢাকা আর পারছে না অসম্ভব-অতিরিক্ত ভার সইতে!

পাশাপাশি দুইটা বিশ্ববিদ্যালয়। এইগুলো নাকি বিশ্ববিদ্যালয়! আপনাদের কি ধারণা আছে এখানে খরচ কতো? অধিকাংশ ছাত্রদের বাবার আয়ের উৎস খুঁজলে সাপ বেরুবে নাকি অজগর এটা বলা মুশকিল। 
আমি যে ইনকাম ট্যাক্স অফিসে ট্যাক্স দিতাম সেই অফিসের জয়েন্ট কমিশনারের অফিসের পিয়নের এক ছেলে এমন একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। 
তো, এখান থেকে ফার্মের মুরগির মত কতগুলো রোবট বেরুবে। এদের হাতে যখন ক্ষমতা থাকবে, এরপর যা হওয়ার তাই হবে। এদের হাত ধরেই এমন সব বিজ্ঞাপন বের হবে। ডাবের পানি আর সফট ড্রিংকসের মধ্যে কোন ফারাক নাই। হরলিকসের মত ৩ পয়সার ড্রিংকস দিয়ে বাচ্চারা হবে টলার-স্ট্রংগার!

বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি ৮২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০টি ঢাকায়।
৩৮টি মেডিকেল কলেজের ৩২ টি ঢাকায়।
তৈরি পোশাকশিল্পের ১৮ লাখ শ্রমিক ঢাকায়।
১৫ লাখ নির্মানশ্রমিক এবং রিকশাচালক ঢাকায়।
প্রতিদিন ২১৩৬ জন মানুষ ঢাকায় ঢুকছে আর বের হচ্ছে না।

আমি পূর্বের একটা লেখায় বলেছিলাম, "আমরা সব লাটিম বনবন করে ঘুরাচ্ছি ঢাকাকে কেন্দ্র করে! এটা দ্রুত বন্ধ করতে হবে। ঢাকার উপর থেকে যত দ্রুত সম্ভব চাপ কমানো অতি আবশ্যক। এখান থেকে সরাতে হবে ক্যান্টনমেন্ট, সরকারি যত আপিস। তারচেয়ে জরুরি হচ্ছে কল-কারখানাগুলো সরানো। 
সরানো মানে নতুন করে হতে না দেয়া, সরিয়ে নিতে লোভ দেখানো। জোর করে তো এটা করা যাবে না। এ জন্য মোটা মাথা থেকে চিকন বুদ্ধি প্রসব করতে হবে। যেসব উদ্যোক্তা ঢাকার বাইরে রংপুর, খুলনায় শিল্প-প্রতিষ্ঠান করবেন তাদের জন্য থাকবে ট্যাক্সসহ অন্যান্য কর দেয়ার বেলায় বিরাট ছাড়। এবং রাষ্ট্রীয় বিশেষ সম্মান থাকবে এদের জন্য। 
আমার ধারণা, এরা প্রয়োজনে বায়ারকে হেলিকপ্টার ভাড়া করে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ওই বায়ার লাফাতে লাফাতে রাজি হবে। না-হওয়ার কোন কারণ দেখি না। এই বায়ার মহোদয় শত-শত বার প্লেনে চড়েছেন কিন্তু হয়তো-বা হেলিকপ্টারে কখনও চড়া হয়নি। তিনি বিমলানন্দে দেশে গিয়ে গল্প করবেন, 'হেই ম্যান, গেসিলাম বেংলাডেশে... ইমাজিন, হোল হেলিকাপ্টার হামার জইন্যে বুক করেছে।"


এখন আমি মনে করি, যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা থেকে স্থানান্তর করা প্রয়োজন সচিবালয়-প্রধানমন্ত্রীর অফিস। প্রধানমন্ত্রীর অফিস সরানো বড্ডো বেশি জরুরী কারণ এই দেশের সব কিছু ঘুরপাক খায় এই ভবনটাকে ঘিরে।

গোটা দেশটা ঘুরপাক খাচ্ছে ঢাকাকে কেন্দ্র করে। সব-সব! শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা-বানিজ্য কিছুই বাদ নাই। ঢাকার ভূতের গলি না চিনলে লাজে আমাদের কালো কান লাল হয়ে যায় কিন্তু রাজশাহীর রাজবাড়ি না চিনলে কোন সমস্যা নাই! 
এই দেশের অধিকাংশ মানুষের স্বপ্ন কোন-না-কোন প্রকারে ঢাকায় থাকার একটা ব্যবস্থা করা। এই জন্য পরনের কাপড় খুলে নগ্ন হয়ে যেতেও আপত্তি নাই! আপত্তি নাই নিজের দেশ-মাকেও বিক্রি করে দিতে। দেশ-নীতি-ধর্ম-জাহান্নামে যাক তবুও ঢাকায় থাকা চাই। সরকারী আমলা-ডাক্তার-প্রফেসর-নব্য ধনী, কেউ বাদ নাই; ঢাকার বাইরে থাকার কথা এঁরা কল্পনাও করতে পারেন না।

ঢাকায় আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। দায়ে না পড়লে আমি ঢাকায় যাওয়ার কথা চিন্তাও করি না। ঢাকায় আমার আত্মীয়-বন্ধুর অভাব নাই কিন্তু রাতে ঢাকায় থাকার কথা মনে হলেই গায়ের উত্তাপ বেড়ে যায়। 
এমব্যাসিতে কিছু কাগজপত্র জমা দিতে হবে। যাচ্ছি গুলশান। ‌হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যথা পেলাম, স্কুটারের চাকা ম্যানহোলে পড়ে গেছে। ড্রাইভারের দোষ দিয়ে লাভ নাই। একটা গাড়ি অন্য একটা গাড়ির পেছনে নাক ঠেকিয়ে আছে। সামনের গাড়ির নীচে ম্যানহোল থাকায় ড্রাইভার দেখেনি। স্কুটারের গতি বেশি হলে ওদিনই ছিল শেষ দিন। বকবক করা একজন ব্লগারের অপমৃত্যু।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করছি। আটকে যাওয়া চাকা ম্যানহোল থেকে টেনে তোলার পর রাস্তার মাঝখানে ম্যানহোলটার ছবি উঠাবার জন্য যখন চেষ্টা করছিলাম তখন আশেপাশের লোকজনরা বলছে, কয়টা ছবি তুলবেন।
আমি বিভ্রান্ত, আমরা কোন পর্যায়ে চলে গেছি? একটা অসম্ভব ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে ম্যানহোলের ঢাকনা থাকবে না এটা কোন বিষয়ই না!

তবুও ঢাকায় এখনও রোদ উঠে, বৃষ্টি হয় কেন? এখনও মানুষগুলো পুরোপুরি অসভ্য হয়ে উঠেনি। এখনো কোথাও কোথাও টকটকে লাল কৃষ্ণচুড়া ফুল ফোটে। কংক্রিটের বস্তির ফাঁকে পেয়ারা গাছ কষ্টেসৃষ্টে কেবল বেঁচেই থাকে না! টসটসে পেয়ারাও ধরে!

আগেও লিখেছি:
"একা ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল যে কাজটা করছেন কোটি-কোটি মানুষ সেটা পারছেন না। এই দেশের কোটি-কোটি মানুষের স্বপ্ন, ঢাকায় একটা বাড়ি, ঢাকায় একটা চাকরি, ঢাকায় বাচ্চাদের পড়াশুনা। মায় ঢাকায় পেচ্ছাব করেও সুখ। 
অথচ ড. জাফর ইকবাল ইচ্ছা করলেই অনায়াসে ঢাকায় বসবাস করার সুযোগ নিতে পারতেন। আপাততদৃষ্টিতে তাঁর জীবনটা অনেক সহজ হতো! আমি নিজেই অনেকদিন তাঁকে পারাবত ট্রেনে দেখেছি সিলেট থেকে ঢাকা যাচ্ছেন। তাঁর এই একটা উদাহরণ তথাকথিত সুশীলরা ছড়িয়ে দিতে পারত যদি আমাদের মধ্যে, আফসোস! এই একটা কারণে এই মানুষটা একটা খুন করে ফেললেও অবলীলায় ক্ষমা করে দেব, আমার লেখালেখির কসম। স্যালুট, হে মানুষ, একজন স্বপ্নবাজ মানুষ।"

*ঋণ: প্রথম ২টা ছবি: প্রথম আলো

সহায়ক লিংক:  
১. আগুনের সঙ্গে শো: http://www.ali-mahmed.com/2009/03/blog-post_15.html
২. রুস্তম-হামযা: http://www.ali-mahmed.com/2009/12/blog-post_04.html

1 comment:

rahul said...

বিদেশে হাসপাতালে এভাবে গেলে এইসব নেতাদের লাথি মেরে বের করে দিত ।