সঞ্জীব বর্মন দাউদ ভাইকে নিয়ে পড়েন। 'আচ্ছা, দাউদ ভাই, আপনি রাত দুইটার দিকেই সব সময় মেইল করেন কেন'?
আমি খানিকটা শুনেছিলাম দাউদ ভাইয়ের কম্পিউটারের সঙ্গে তেমন সখ্যতা নাই। তিনি এখনও তাঁর লেখা লিখেন কাগজ-কলমে।
দাউদ ভাই অবাক হন, 'তুমি এটা জানলে কেমন করে, মানে সময়টা'?
সঞ্জীব বর্মন হেলাফেলা ভঙ্গিতে বলেন, 'এটা জানব না মানে? মেইল পাঠালে ওখানে সময় থাকে না, সব থাকে'?
দাউদ ভাই আরও অবাক, 'বলো কী'!
সঞ্জীব বর্মনের মুখে ফিচেল হাসি, 'আরে, কেবল মেইল পাঠাবার সময়ই না, ওই সময় মানুষটা কি কি করছে তাও দেখা যায়। দাউদ ভাই চিন্তা করে দেখেন, সময়টা কিন্তু বিপদজনক, রাত দুটো। তখন আপনি কি কি করেন, না করেন সব কিন্তু দেখা যায়'।
এবার তিনি বলটা পাঠিয়ে দেন আমার দিকে, 'এই যে শুভকেই জিজ্ঞেস করেন না। এই শুভ, আপনি স্কাইপি-তে তিন ঘন্টা আটকে ছিলেন না'?
আমি হাসি গোপন করে বলি, 'না, ঠিক তিন ঘন্টা না, আড়াই ঘন্টা হবে'।
দাউদ ভাই চিন্তিত, 'শুভ, তাই নাকি'!
আমি মুখ যথাসম্ভব গম্ভীর করে বলি, 'না, দাউদ ভাই, ঠিক আড়াই ঘন্টাও না, দুই ঘন্টা বিশ-পচিঁশ মিনিট হবে'।
দাউদ ভাই মহা চিন্তিত। তিনি তাঁর পছন্দের কোন একজনকে (মানুষটার পরিচয়ের বিশদে যাচ্ছি না) ফোন করেন। ফোনে কথা বলার সময় আমরা দাউদ ভাইয়ের এপাশের কথা বলা শুনতে পাই, 'না-না, আমি তো কেবল মেইল ব্যবহার করি। স্কাইপি ব্যবহার করি না'।
ফোনে কথা বলা শেষ হলে তিনি পরম আনন্দে বলেন, 'তোমরা আমাকে বোকা বানিয়েছে। ধ্যাত, খামোখা 'ডুমকফ' শুনতে হলো'।
আমি জানতে চাই, 'দাউদ ভাই, 'ডুমকফ' কি'?
তিনি হা হা করে হাসতে হাসতে বলেন, ডুমকফ মানে হচ্ছে নির্বোধ।
আমি অবাক হয়ে দাউদ হায়দার নামের শিশুটিকে দেখি! হয়তো তিনি আমাদের এই নির্দোষ খেলায় উল্টো আমাদেরকেই বোকা বানিয়েছেন। সবটাই তাঁর ভান কিন্তু তাতে কী আসে যায়!
সুপ্রিয়দা ফোন করেন। কাজে আটকে পড়ার কারণে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। দীর্ঘ সময় ফোনে সদাশয় কিছু কথা বলেন।
ডিনার শেষ হলে একে একে সবাই জানা, সঞ্জীব বর্মন, ফারুক ভাই বিদায় নেন। ফারুক ভাই বুকে জড়িয়ে বলেন, 'শুভ, ভাল থেকো'।
আমার মনটা অন্য রকম হয়। আমি জার্মানি থেকে কালই চলে যাব কিন্তু এই মানুষগুলোর আন্তরিকতা বিস্মৃত হবো না। আমি ভুলে গেলেও আমার মস্তিষ্ক ভুলবে না।
থেকে যাই আমি এবং দাউদ ভাই। বেচারা আরাফাত-মায়াবতীদের মোমের আলোয় স্নিগ্ধ ঘরটা সিগারেটের ধোঁয়ায় অন্ধকার করতে ইচ্ছা করে না। বাইরে হিম হিম ঠান্ডা। আমরা বাইরের ঝুল-বারান্দায় সিগারেট ধরাই। মানুষটার সঙ্গে কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে কথা হয়।
মানুষটার সঙ্গে সাবধানে কথা বলতে হবে এটা আমি ভুলে যাই। আমি 'মুখবন্ধ' শব্দটা ভুল উচ্চারণ করায় বিকেলেই তাঁর তোপের মুখে পড়েছিলাম। আরে, কী মুশকিল! আমি কি লেখক নাকি? যে মানুষটা লোককে বলে 'লুক', পেয়ারাকে বলে 'গয়াম', এই মানুষটা ভুল উচ্চারণ করবে নাতো কে করবে? অবশ্য আমি এখনও অধ্যাপক কাম প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে [১] ছাড়িয়ে যেতে পারিনি।
দাউদ হায়দারকে নিয়ে আমি কিছু লেখা লিখেছিলাম [২] [৩] [৪]। এই মানুষটাকে এবং আমাকে জড়িয়ে কিছু নাটকও হয়েছিল। প্রথম আলোর মত মিডিয়া টাইকুন [৫] সেই নাটকের নাট্যকার। প্রথম আলো আমাকে খাটো করতে গিয়ে দাউদ হায়দারকে কেবল খাটোই করেনি, তাঁর প্রতি ভয়াবহ অন্যায় করেছিল!
আমি ববস প্রতিযোগীতা জেতার জন্য দাউদ হায়দারকে তৈল মর্দন করেছি ইত্যাদি। প্রথম আলোর অন-লাইন পত্রিকায় [৬]। এরা নিজেরাই এমন মন্তব্য করেছে এটা বোঝার জন্য রকেট বিজ্ঞানী হতে হয় না। মিডিয়ার লোকজন ব্যতীত একজন সাধারণ পাঠকের পক্ষে এটা জানাটা অবাক হওয়ার মতই ঘটনা যে দাউদ হায়দার ডয়চে ভেলের সঙ্গে জড়িত। এবং দু-জন পাঠকেরই মন্তব্যের টোনও একই রকম। একজন তবলা ধরেছেন, অন্যজন ধরেছেন গান।
এখানে অবিশ্বাস্য যেটা, সেটা হচ্ছে, এটা কিন্তু প্রথম আলোর ব্লগ ছিল না, ছিল প্রথম আলো পত্রিকা। এখানে ইচ্ছা করলেই কোন মন্তব্য করা যায় না। মন্তব্য যাচাই-বাছাই করেই ছাপানো হয়। না-হলে আমি যদি মন্তব্য করি, আসলে প্রথম আলোর সম্পাদক মোসাদের মিঃ ভক্স, এটা কি প্রথম আলো ছাপাবে?
অথচ দাউদ হায়দারকে নিয়ে আমি প্রথম লেখাটা লিখি ২১ ফ্রেব্রুয়ারি, ২০০৯-এ। তখন ববসের প্রতিযোগীতায় বাংলা ভাষা যোগ হবে কি না এটাই সম্ভবত ঠিক হয়নি। আর আমি যে তখন থেকেই লবিং করা শুরু করেছি এটা আমার নিজেরও জানা ছিল না!
সত্যি বলতে কি আমার এটাও জানা ছিল না দাউদ হায়দার ডয়চে ভেলের সঙ্গে জড়িত। এটা আমি জেনেছি এই সেদিন। তারপরও প্রথম আলো যে নিম্ন রূচির আচরণ করল এটা দেখে কমিউনিটি ব্লগের ঈর্ষাম্বিত চিকিৎসার বাইরের লোকজনকে দোষ দেই কোন মুখে!
দাউদ হায়দারকে নিয়ে এই সব লেখাগুলো তো তাঁর জন্য ছিল না, ছিল আমার জন্যে। তাঁর জায়গায় আমি নিজেকে কল্পনা করলে নিজেকে পাগল-পাগল লাগত।
তো, দাউদ ভাইয়ের সঙ্গে রাজ্যের বিষয় নিয়ে আলাপ হতে থাকে। তিনি তাঁর জন্য একজনের দেশের মাটি নিয়ে আসার প্রসঙ্গে বলছিলেন।
আমার মনটা খানিকটা বিষণ্ন হয়। আরাফাতের একটা অনুরোধ ছিল আমি যেন আসার সময় তাঁর জন্য খানিকটা দেশের মাটি নিয়ে আসি। আমি আমার বাসা থেকে বেরুবার পূর্বে তাঁর জন্য খানিকটা মাটি নিয়েও ছিলাম। আমিও মেইলে এই সন্দেহও প্রকাশ করেছিলাম এটা আনতে দেবে কি না। সোয়াইন ফ্লুর পর থেকে এই সব নিয়ে খুব কড়াকড়ি।
পরে আরাফাতই নিষেধ করেছিলেন, শুভ, অহেতুক এরা আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দেবে। বাধ্য হয়ে ঢাকায় সেই মাটি আমাকে ফেলে দিতে হয়েছিল। দেশের মাটি প্রসঙ্গে আমার একটা লেখা ছিল, মাটি বিক্রি করব [৭]। পরে ঠিক করলাম, বাতাস বিক্রি করব [৮]। দাউদ ভাইয়ের সঙ্গে এই সব হাবিজাবি বিষয় নিয়ে কথা চলতে থাকে। মানুষটা হয়তো মনে মনে ভাবছিলেন, আরে, এইটা আবার কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম!
রাত গড়ায়। আমার আবার সকালে ফ্লাইট ধরার জন্য ছুটতে হবে। দাউদ ভাই বলেন, 'শুভ, তুমি শুয়ে পড়ো। তোমাকে তো আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। আমার কিছু লেখালেখির কাজ শেষ করতে হবে'।
আমি মনে করে দাউদ ভাইয়ের আমাকে দেয়া তাঁর বই, "নদীর উৎস ছিল এখানে" গুছিয়ে রাখি। সকালে তাড়াহুড়োয় না আবার বইটা ফেলে আসি। তাঁর কবিতার এই অংশ পড়ে দম আটকে আসে:
"দোহারপাড়ার ভূগোল বলতে কিছু নেই আর-
বাঁশবাগান, পঞ্চবটীর মাঠ, দিগন্তহীন পদ্মার
গান, গাজনের উৎসব, এখন স্মৃতির অস্পষ্ট কোলাজ...।"
আমি মনে মনে বলি, কবি, নদীর উৎস ছিল এখানে। কোন নদীর, কবি? তোমাকে তো আমরা কোন নদী দেইনি! কোন দোহারপাড়া? তোমার জন্য আমরা তো কোন দোহারপাড়া রাখিনি!এ বড়ো বিচিত্র দেশ! এখানে ধর্মের দোহাই দিয়ে একজন মানুষকে তাঁর মার কাছে, তাঁর দেশমার কাছে ফিরতে দেয়া হয় না। আমাদের দেশের যেসব মানুষ ধর্ম নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, এঁরা অবলীলায় কতোসব তুচ্ছ বিষয়ে ফতোয়া দেন কিন্তু দুজন নারী বছরের পর বছর ধরে দেশ শাসন করছেন এই বিষয়ে ফতোয়া দেয়া থেকে বিরত থাকেন। কেন যেন তখন এদের ফতোয়া ফুরিয়ে যায়!
পারতপক্ষে আমি কারও বিশ্বাস, ধর্ম নিয়ে কুতর্কে যেতে চাই না, অসম্মান করতে চাই না। কিন্তু আমরা কেন এটাও মনে রাখি না, শত-শত বছর ধরে একেকটা ধর্ম সুতীব্র বিশ্বাসের উপর টিকে আছে। কারও ধর্ম তো কাঁচের বাসন না যে হাত থেকে পড়ল আর ভেঙে চাকনাচুর হয়ে গেল! কারও নিজ ধর্মের প্রতি এমন অহেতুক ভয় থাকলে সেটা অবশ্যই দুর্বল একটা ধর্ম। সেই ধর্ম নিয়ে অযথা বড়াই করার কিছু নেই।
দাউদ ভাই জেগে থাকেন। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। এক ঘুমে সকাল। ঘুম ভাঙে আরাফাতের কোমল ডাকে, 'শুভ উঠেন'।
আমার উঠতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু হোটেলে আমার লাগেজ পড়ে আছে এলোমেলো। গুছিয়ে ছুটতে হবে এয়ারপোর্টে। তীব্র অনিচ্ছায় উঠতে হয়। দাউদ ভাইকে পাই গভীর ঘুমে, মানুষটা রাতে কখন ঘুমিয়েছেন আমি জানি না। মানুষটা ঘুমের মধ্যে বিচিত্র শব্দ করছেন, শব্দগুলো ভারী বেদনার। কানে আটকে আছে এখনো আমার। আমি জানি না, ঘুমের মধ্যে দাইদ ভাই যে কাতর শব্দ করেন এটা তাঁর জানা আছে কি না? তাঁর কি ফেলে আসা দোহারপাড়ার কথা মনে পড়ে যায়? আমি জানি না।
টেবিলে তাঁর কবিতার বই, 'কেউ প্রতীক্ষায় নেই', পাশেই তাঁর সদ্য সমাপ্ত লেখার খসড়া। মানুষটার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্য ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছা করে না। ছোট্ট একটা চিরকূট তাঁর বইয়ে রেখে আসি, "দাউদ ভাই, গেলাম। আপনার সঙ্গে দেশে দেখা হবে, সহসাই"।
আমার মন খারাপ হয়ে যায়, কেন লিখে আসলাম এই কথাটা? দেশে দেখা হবে, সহসাই। কবির সঙ্গে কেন এই চাতুরি করলাম?
*দাউদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার কিছু ছবি আছে কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে জার্মানি সরকারের আপত্তির কারণে ছবিগুলো এখানে দেয়া সম্ভব হলো না।
*বৈদেশ পর্ব, এগারো: http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post_03.html
সহায়ক লিংক:
১. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ: http://www.ali-mahmed.com/2007/06/blog-post_8885.html
২. দাউদ হায়দার, শুভ জন্মদিন বলি কোন মুখে: http://www.ali-mahmed.com/2009/02/blog-post_21.html
৩. দাউদ হায়দার, তোমার কাছে খোলা চিঠি: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_7633.html
৪. দাউদ হায়দার, তোমাকে, আবারো: http://www.ali-mahmed.com/2010/04/blog-post_20.html
৫. পরম করুণাময়, এদের ক্ষমা করো: http://www.ali-mahmed.com/2010/04/blog-post_22.html
৬. প্রথম আলোর চালবাজি: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-04-20/news/57539
৭.মাটি বিক্রি করব: http://www.ali-mahmed.com/2009/02/blog-post_15.html
৮. বাতাস বেচব: http://www.ali-mahmed.com/2009/06/blog-post.html
2 comments:
Jarmany sorkar na chaile amader sonte hobe kano?
কেবল জার্মানি সরকারই না, এখানে মূখ্য হচ্ছে দাউদ ভাইয়ের নিরাপত্তার প্রশ্ন। আর দাউদ ভাইও মেইলে অনুরোধ জানিয়েছেন ছবি না দিতে। @Monir
Post a Comment