পত্রিকায় ঘটা করে বেরিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন (১৮ জুলাই, ২০১০), "দেশের স্কুলগুলোতে মনস্তত্ত্ববিদ থাকা দরকার।...তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্কুলে মনস্তত্ত্ববিদ নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন"।
খুবই আনন্দের বিষয়। ঈশ্বরের বিশেষ সন্তানদের জন্য, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এবং অটিস্টিক শিশুদের জন্য এটা একটা অসাধারণ উদ্যোগ। প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাই।
তবে ছোট্ট একটা কিন্তু আছে, তাঁর বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, দেশে মনস্তত্ত্ববিদে গিজগিজ করছে। হাটে-বাজারে, বাইরে বেরুলেই দু-চারজন মনস্তত্ত্ববিদের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাবে।
আমার ধারণা ভুল হতে পারে কিন্তু অতি উন্নত দেশগুলোর সমস্ত স্কুলে মনস্তত্ত্ববিদ আছে কি না এতে আমার খানিক সন্দেহ আছে। কারণ হালি-হালি মনস্তত্ত্ববিদ পয়দা হয় না। এটা এমন এক জটিল বিজ্ঞান, যার কাজ হচ্ছে এই গ্রহের সবচেয়ে জটিল একটা বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো। যার চালু নাম মস্তিষ্ক, এক নিতল কুয়া- যেখানে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যেখানে খেলা করে আলো-আধার। একটু এদিক-সেদিক হলেই কেবল অন্ধকার, নিকষ অন্ধকার।
আমাদের দেশে মনস্তত্ত্ববিদ জেলা পর্যায়ের হাসপাতালেই নাই। সমস্ত মেডিকাল কলেজে আছে এতেই আমার সন্দেহ আছে। এই দেশে আদৌ মনস্তত্ত্ববিদ আছে কি না এ নিয়েও আমার ঘোর সন্দেহ আছে। সন্দেহের বীজটা কোত্থেকে আসল একটু বলি,
হুমায়ূন আহমেদ শিলালিপিতে (২৮ মে, ২০১০) লিখেছেন, "সাইকিয়াট্রিস্ট এবং লেখিকা আনোয়ারা সৈয়দ হক আমি ডিজোপেন খাই শুনে আঁতকে উঠে বলেছিলেন, এটা তো পাগলের ওষুধ। আপনি পাগলের ওষুধ খাচ্ছেন কেন?"
'পাগলের ওষুধ'? একজন মনস্তত্ত্ববিদ যখন পাগলের ওষুধ, পাগল, পাগলের ডাক্তার এই সব বলেন তখন তিনি যে একজন সাইকিয়ট্রিস্ট না এটা জানার জন্য রকেটবিজ্ঞানী হতে হয় না। হয়তো তাঁর কাছে ডিগ্রি নামের একটা কাগজ আছে কিন্তু মানুষটার মনস্তত্ত্ব শিক্ষায় গলদ আছে।
আর এটাই বা আমি কেমন করে ধরে নেই আনোয়ারা সৈয়দ হক এটা বলেননি! হুমায়ূন আহমেদের মত একজন লেখক যেখানে বলছেন! আবার লিখেও জানাচ্ছেন!
এই দেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে বাচ্চাদের যেসব বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় এতেও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় দেশে কোন মনোবিদ-মনস্তত্ত্ববিদ নাই। 'ডানো' নামের একটা দুধ কোম্পানি একটা বিজ্ঞাপন নিয়ম করে দেখাত। এই দুধ খেয়ে বাচ্চারা এমন 'তনদুরুস্ত'-বলশালী হয়, উঁচু গাছ থেকে ছাতা নিয়ে লাফ দেয় [১]।
আরেকটা দুধের বিজ্ঞাপন দেখায় 'এলডোরা' (নামটা সম্ভবত এটাই)। বেতমিজ টাইপের বাচ্চাটাকে ভাত-রুটি, ফল-মূল যা দেয়া হয়, সে বলে, থু! এরপর ওই কোম্পানির দুধ খাওয়ার পর বেতমিজ বাচ্চাটার বেতমিজ মা-বাবা বলে, বাবা, দেখো চাঁদ। বেতমিজ বাচ্চা বলে, খাব।
মূল বিষয় হচ্ছে এই কোম্পানির দুধ খেয়ে বাচ্চার বেতমিজ স্টমাক এমন দুর্ধর্ষ হয়েছে সে চাঁদও খেয়ে ফেলতে আগ্রহী।
বেতমিজ মিডিয়া হরদম এগুলো দেখিয়েই যাচ্ছে।
ডা. মোহিত কামাল নামের একজন মনস্তত্ত্ববিদ আছেন, তিনি আবার লেখকও বটে। আমরা জানি তিনি তাঁর বইগুলো নিজেই লিখেন এবং তাঁর বইয়ের বিজ্ঞাপনও নিজেই দেন। লক্ষ-লক্ষ টাকা ব্যয়ে বইমেলায় তাঁর বইয়ের যে বিজ্ঞাপনগুলো ছাপা হয় পূর্ণ পৃষ্ঠা, অর্ধ পৃষ্ঠা ব্যাপি; এটা প্রকাশক দেন বললে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে হবে। এটা তিনি সম্ভবত শিখেছেন সাহিত্য-গুরু আনিসুল হকের কাছ থেকে [২]।
তো, ডা. মোহিত কামাল একজন মনস্তত্ত্ববিদ, লেখক- কই, তাঁকে তো দেখলাম না এই সব ভয়াবহ বিজ্ঞাপন যা শিশুদের, শিশুদের বাবা-মার ভুবন এলোমেলো করে দিচ্ছে এটা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে। নাকি মাদক বিরোধী আন্দোলন করতে জোশ বেশী কারণ প্রথম আলোর মত মিডিয়ার কাভারেজ পাওয়া যায় বলে?
যাগ গে, মূল বিষয়ে ফিরে যাই, প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্কুলে মনস্তত্ত্ববিদ নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন। মন্ত্রী বাহাদুররা যখন কোন কথা বলেন এই কথার পেছনে কতটুকু বাস্তবতা আছে তা যে যাচাই করেন না এটা একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ!
দেশের স্কুলগুলোতে মনস্তত্ত্ববিদ থাকা দরকার। মনে হচ্ছে, দেশে গন্ডায়-গন্ডায় মনস্তত্ত্ববিদ বেকার বসে আছে কেবল ধরে এনে এখানে বসিয়ে দেয়ার অপেক্ষা। এমন যদি কেউ বলেন, আমাদের চাঁদে যাওয়া দরকার এটা বলতেই পারেন। বললে আটকাচ্ছে কে!
সহায়ক লিংক:
১. শিশু হত্যার মারণাস্ত্র: http://www.ali-mahmed.com/2008/09/blog-post_22.html
২. একটি আদর্শ বইয়ের বিজ্ঞাপনের নমুনা: http://www.ali-mahmed.com/2009/03/blog-post_21.html
No comments:
Post a Comment