আলীম আহমেদ ডা. কবীরের সেই ঘরটায় ফিরে এসেছেন। ডা. কবীর মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে আলীমকে সরাসরি এখানে নিয়ে এসেছেন। ইরা বুকিন এরা একটু আগে গেল। কবীর তার সন্তানদের সঙ্গে আলীম আহমেদকে বেশ কিছুক্ষণ একা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ইরার সঙ্গে কথা হয়েছে কম। ও কেঁদে না ফেলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলেছিল, তুমি বেশ শুকিয়ে গেছ!
আলীম লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন: বড় কষ্ট। বলেই ভুলটা বুঝতে পারলেন।
ইরা ঝরঝর করে বাচ্চার মত কেঁদে ফেলল। বুকিনও মাকে ভয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল, মামাইন্যা, মামাইন্যা...।
আলীম আহমেদের অসহ্য লাগছিল যখন বুকিন চোখ বড় বড় করে বলল, বাবাইন্যা, বাসায় যাবা না।
এদের বিদায় করে ছোট একটা কটে চুপ করে শুয়ে রইলেন। কবীর অবশ্য নিষেধ করে রেখেছে খুব বেশীক্ষণ মন খারাপ করে না থাকতে। বললেই হলো! এই মুহুর্তে কিছু একটা করা খুব জরুরী। আচ্ছা, কবীরের এই ঘরটা নিমিষেই এলোমেলো করে দিলে কেমন হয়? এই যেমন ধরা যাক, বাঁশের চেয়ারগুলো উল্টিয়ে দিলেন। ১৪ ইঞ্চি যে টিভিটা যেটার উপর রাখা আছে- আচ্ছা, গ্রামে এটাকে কি বলে, ছিয়া-ছেকেট, চাল গুড়ি করে যেটা দিয়ে? ওইটাই উল্টিয়ে টিভিটা রাখা আছে। এখন টিভিটা নীচে নামিয়ে টিভির ওপরে এই জিনিসটা রেখে দিলে? কবীর হাঁ হয়ে থাকবে। নাকি ক্ষেপে চিংড়ি মাছের মত লাফাতে থাকবে!
এ ঘরটায় একটা হাসিমুখ শিশুর ছবি আছে, ক্যাপশন দেয়া- কি যেন লেখা ছোট ছোট অক্ষরে পড়া যাচ্ছে না। আচ্ছা, ওটা বদলে একটা কাগজে এটা লিখে লাগিয়ে দিলে কেমন হয়: “বাবা মার আনন্দের ফসল নিরানন্দ অসফল আমি”। উহুঁ, বাক্যটা একটা শিশুর ছবির সঙ্গে ঠিক মিশ খাচ্ছে না! এটা লিখলে কেমন হয়: “বৌন অভ মাই বৌন, ফ্লেস অভ মাই ফ্লেস”।
আলীম শোয়া থেকে উঠে বসলেন। পাশের টেবিলেই কাগজ কলম, একসময় লিখতে না পারলে পাগল-পাগল লাগত। অনেকক্ষণ কাগজে আঁকিবুঁকি আঁকলেন, একটা লাইনও লিখতে পারলেন না। কী কষ্ট- এই কষ্টটা কেউ বুঝবে না, একজন লেখকের লিখতে না পারার কষ্টটা! এক সময় তিনি অপার বিস্ময়ে লক্ষ করলেন, কাগজে তিনি অসংখ্যবার লিখেছেন মুক্তি...মুক্তি...! কাগজটা দলামুচড়া করে বীনে ফেলে দিলেন।
শখের বশে একসময় পেন্সিল স্কেচ করতেন। ভয়ংকর একটা ভূত আঁকলে কেমন হয়, যেটা দেখামাত্র গা ছমছম করবে। তিনি গভীর আনন্দে আঁকা শুরু করলেন। কতক্ষণ কেটে গেছে কে জানে! ভূতটাকে দেখে বিষণ্ন হাসি হাসলেন। ভূতটার সঙ্গে ডা. কবীরের অনেক মিল! আশ্চর্য, তার চিন্তার গন্ডিটা কত ছোট হয়ে এসেছে! ভূত আঁকলেন তাও ডা. কবীর ভূত! ধুর, কাগজ কলম ফেলে উঠে দাঁড়ালেন।
ক্ষিধে লেগেছে। কলবেল চাপতে ইচ্ছা করছে না। কবীর যে ছেলেটিকে রেখেছেন কিছু প্রয়োজন হলে বললেই এনে দেয়, খাবার-টাবার ওই দিয়ে যায়। এ মূহুর্তে ওকে ডাকতে ইচ্ছে করছে না। ফ্রীজটা খুলে অবাক হলেন না। কবীরের ফ্রিজ সম্ভবত এমনই হওয়া উচিত। একদম ঠাসা। এ মূহুর্তে কেউ যদি একটা আলুও রাখতে যায় আঁটবে না।
ফ্রিজের দরজায় লাগানো স্টিকারটা পড়লেন, "Relish Food: It will stay in your mouth for a few minutes, In your stomach for a few hours and in your hip for the rest of your life".
হা পরম করুণাময়! ভাল লাগার সঙ্গে সঙ্গে একটা ধাক্কাও খেলেন। ফ্রীজের উপরে ছোট্ট একটা কাঁচের বয়াম। বাদাম ভর্তি, চিনা বাদামগুলোর খোসা ছাড়ানো।
আলীম এ জন্য ইরার কম খোঁচা খাননি। মা আলীমের জন্য ঠিক এমনই করে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে বয়াম ভর্তি করে রাখতেন। আলীমের বাদাম খাওয়ার ঠিক-ঠিকানা ছিল না। বই পড়ছেন, ভাত খাচ্ছেন, বাদাম খাচ্ছেন- কখনও ভাতের সঙ্গেও খেতেন।
ইরা রাগে চিড়বিড় করত: তোমার মত 'বাদাম-ভাত' কাউকে খেতে দেখিনি। আর এসব কি, খাওয়ার সময় বই পড়া! প্রায়ই দেখি তুমি বুঝতেই পার না কোন তরকারী দিয়ে ভাত খেলে। তুমি কি বলতে পারবে কাল কি দিয়ে ভাত খেয়েছ?
আলীম আহমেদের মনে পড়ত না, মুখ কাঁচুমাচু করে বলতেন: যাহ, জানব না কেন, সব্জী ছিল ইয়ের...।
ইরা চোখে আগুন নিয়ে বলত: ফাজলামো কর! এক সপ্তাহের ভেতর সব্জী খেয়েছ, তুমি সব্জী খাও?
আলীম আহমেদ বিপন্নবোধ করতেন: কি করব বলো, বদভ্যাস, খাওয়ার সময় না-পড়লে ঠিক স্বস্তি পাই না।
ডা. কবীর ইরার কাছ থেকে জেনে ঠিক-ঠিক মনে রেখেছেন। আলীম আহমেদ মন খারাপ করা নিঃশ্বাস ফেললেন, কবীরের মতো হতে পারলে বেশ হতো। কে জানে, এঁরও হয়তো কিছু অন্ধকার দিক আছে। সবাই তো আমরা এক পেট আবর্জনা নিয়ে ঘুরে বেড়াই। বেশ কিছুটা প্রকৃতি ঢেকে রাখে, খানিকটা মানুষ।
ডা. কবীর আলীম আহমেদকে কিছু মুভি দেখার জন্য জোর অনুরোধ করেছেন। কেন কে জানে! নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। কবীর শুধু শুধু কোন কাজ করবেন না। কিন্তু তাঁর চিকিৎসার সঙ্গে মুভি দেখার কি সম্পর্ক? কবীর মুভিগুলো আলাদা করে দিয়ে গেছে। আলীম নেড়েচেড়ে দেখছেন। মেল গিবসনের ‘ব্রেভ হার্ট’, রাসেল ক্রোর ‘গ্লাডিয়েটর’, স্টিভ ডাসটিনের ‘প্যাপিলন’, ইংরেজীতে ডাব করা বিদেশী ভাষায় একটা মুভি ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’, তামিল একটা মুভি- হিন্দিতে ডাব করা ‘টেররিষ্ট’। আলীম প্রথমেই ব্রেভ হার্ট বেছে নিলেন। হেলাফেলা ভঙ্গিতে দেখা শুরু করলেন। অল্পক্ষণেই জমে গেলেন। নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেছেন। তাঁর ভাবনার জগতে মস্ত একটা উলটপালট হয়ে গেছে।
সহায়ক লিংক:
১. ফ্রিডম, ১: http://www.ali-mahmed.com/2010/08/blog-post_14.html
No comments:
Post a Comment